স্কুল বললে একটা স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব ফুটে উঠে। ইনফ্যাক্ট আমাদের স্কুলের নামটাও তেমন। সবুজ শিক্ষায়তন উচ্চ বিদ্যালয়। সাদা শার্ট, নীল প্যান্ট, নীল হকি সু। এল আকৃতির সাদা হাফ বিল্ডিং, মাঠের বাইরে ঢেউ খেলানো ওয়াল। মাঝে লোহার একটা গেইট। ফুলের বাগান। অবশ্যই সে শ্রী এখন নাই। অনেক আগেই বদলে গেছে। আমরা যখন প্রাইমারিতে পড়ি।
এখানে আমি ১১ বছর পড়েছি। শিশু শ্রেণী টু এসএসসি। অবশ্যই ভর্তির দুই-দেড় বছর আগে থেকেই স্কুলে যেতাম। লাকি আপুর হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে। আমরা যে মেইন গেইট বা কলোনি গেইট দিয়ে যেতাম এমন না— যাওয়ার আরো দুটি রাস্তা ছিল। স্কুলের পেছনে একটা ছোট গেইট ছিল। এটা পরে বন্ধ হয়ে যায়। আরেকটা আদতে গেইট না। ওয়াপদা অফিসের পেছনে একটা লিচুগাছ ছিল— দেওয়ালে হেলান দেওয়া। আমরা গাছটার উপর থেকে লাফ দিতাম। তারপর স্কুল। এ মজা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
স্কুল মানে আমার কাছে এমন ছোটখাট কিছু ব্যাপার। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন রাস্তায় কোথাও যাওয়ার এ তারিকা আসলেই বৃহত্তর অর্থ নিয়ে আসে। আমরা ভিন্ন ভিন্ন রাস্তায় চিরকালই যাকে আপন গন্তব্য বলে জেনেছি, তাও হয়ত সেই একই গন্তব্য, যা অনেকে চান। এটাই আমাদের প্রকৃত স্কুল হয়ত। যেখানটাই আমরা শিখতে চাই, তা আসলে আমাদের জীবন। তার চেয়ে বড় স্কুল কোনটা!
তারপর স্কুল একটা অনন্য ব্যাপার। স্কুলে যাওয়ার আগে আমরা তো অনেক ছোট থাকি। তাই অবশ্য মনে নাই, স্কুলে যাওয়ার আগে স্কুল ব্যাপারটা কেমন ছিল। মনে আছে, যখন খেলার ছলে আসতাম তখন বাঁধাধরা কোনো বিষয় ছিল না। দুই-একজন টিচারের কোলেও চড়েছি। একজন আমাকে ডাকতেন ‘বউয়ের বাপ’। তাকে সবাই বড়ুয়া স্যার বলতেন বোধহয়। আমি ভর্তি হওয়ার পর উনার ক্লাস করেছি কি-না মনে পড়ে নাই। কিন্তু এ স্মৃতিটা ঝলমলে। যে দিন স্কুলে ভর্তি হলাম, বেঞ্চের নিচ দিয়ে লাকী আপার কাছে চলে আসি। আমার ব্যাগে উনার জ্যামিতি বক্স ছিল। যে ম্যাম ক্লাস নিতেন তিনি বলে দিলেন এভাবে যেতে হয় না। এটা একটা দারুণ লেসন। তরিকা। আর কখনো তো এভাবে যাই নাই। এখনো! এরপর আসলে আর কিছু কী শিখছি!
স্কুলের প্রথমদিন যার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তার নাম নয়ন। নয়নকে নিয়ে আমি একটা গল্পও লিখেছিলাম। পত্রিকায় ছাপাও হইছে। প্রথমদিন একা একা ফিরতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলি। তার বাসা ছিল ওয়াপদা অফিসের ভেতর। ওর কারণে পথ চিনে বাড়ি ফিরি। এরপর কখনো পথ ভুল করি নাই। বেশিদিন নয়, তারপর আর নয়নকে দেখি নাই। মাঝে মাঝে এমন তো হয়, যারা পথ দেখাইয়া দেয় তারা আমাদের পাশে থাকে না বেশিদিন। তাদের কাজ করেই চলে যায়। হয়ত এটাও স্কুল।
স্কুল মানে আর কী! হাফিজ জুট মিলসের পেছনে আদিগন্ত ছড়ানো সবুজ পাহাড়। যার কথা ভাবলে চোখে স্বপ্ন ভর করে। আমি বলি পাহাড়ে শেষ বিকেল। সত্যি সত্যি এক শেষ বিকেলে— যখন আমরা এসএসসিতে এক শেষ বিকেল পাহাড়ে কাটিয়েছিলাম। যার অনেকখানি যেন বার্ডস আই ভিউ থেকে কল্পনায় দেখতে পাই। সে দিনে কী এমন সত্য ছিল— বিশালত্ব, নির্জনতা, করুণাধারা, অশেষ মায়া-ভালোবাসা দ্বারা তৈরি একটা জগতের উপলদ্ধি। খুবই কান্না পেয়েছিল। আর কী হতে পারে! এরপর যাদের ছেড়ে চলে গেছিলাম— সেই বন্ধুদের আর তত আপন মনে হয় নাই। সত্য কী এটাই— একেকটা পথে আমরা একবারই হাঁটি। কিন্তু দারুণ হেঁয়ালি হলো একই রকম অনেক রাস্তায় আমরা হাঁটি— অথবা জীবনকে সহজ করে নিতে চাই বলে এমনটা মনে হয়। যাবে অভ্যস্ততা বলা যায়। নিরাপদ আশ্রয়। আসলে একই রকম বলে কিছু নাই। এ অন্তর্নিহিত সত্য বুঝতে না পারা আমাদের ব্যর্থতা। তখন আমাদের কোনো স্কুল থাকে না।
আরও পড়ুন : ইচ্ছেশূন্য মানুষ । জার্নাল
অনেক বছর পর। অনেক বছর পর স্কুলে যাবো। হয়ত অনেকের সঙ্গে দেখা হবে। এমন কারো কারো সঙ্গে দেখা হবে না, যাদের অবচেতনে দেখতে চাই। কিন্তু চেতনে কখনো মনে পড়ে না। তারা কারা! তারা কী আমাদের ছায়া। নাকি আমরা তাদের ভগ্ন বা মিলতে থাকা দিগন্তে— এমন ছায়া যা চিরকাল হারিয়ে যায়।
এখানেই থাক আমার স্কুল। তাকে নিয়ে যত অপূর্ণতা, দীর্ঘশ্বাস— তাই তো সত্যি। হয়ত একদিন আবারো সে স্বপ্ন দেখবো। বাবার হাত ধরে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়া। অ্যাবাকাসে এক, দুই, তিন গুণে দেখানো। অ, আ, ক, খ লিখে দেখানো। সেই ইংরেজি বই। অদ্ভুত একটা রঙে অলংকরণ। যে রঙটা স্মৃতিতে হারিয়ে গেছে। অথবা শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে দীর্ঘ ইউক্যালিপ্টাস গাছের ছায়ায় হাঁটতে থাকা। কখনো স্কুল মানে জিএমের বাংলোর পাশ থেকে ফুলের চারা কুড়িয়ে এনে লাগানো। তেমন একটা গাছে একশ কুড়িটা গাঁদা ফুল ফুটেছিল। আমি এখনো সে গাছটা স্বপ্ন দেখি। বড় সাইজের কাগজে গোলাপ এঁকে বন্ধুদের মাঝে বিলানো। পিকনিকে যাওয়ার পথে কাগজ উড়ানো। লাকি আপুর ক্লাসমেটের বাসা থেকে রান্না করে আনা শুঁটকির তরকারি, যার স্বাদ আমি এখনো টের পাই। আমাদের কৃষি বিজ্ঞানের ক্ষেত, ক্লাসের সামনে লাগানো বাদাম গাছ, দোলনা, ঢেঁকি অথবা সে লিচু গাছ— কখনো যার ফল পাকতে দেখি নাই। আর খাতার ভাঁজে ভাঁজে আঁকা জলকন্যা।
এই তো আমার স্কুল। আমার সবুজ শিক্ষায়তন উচ্চ বিদ্যালয়। আর কী চাই।