এক.
আমাদের এলাকায় শীত মওসুম এলেই নানান ধরনের ব্যানার চোখে পড়ত। ‘চলো বন্ধু ঘুরে আসি’, ‘চলো না ঘুরে আসি অজানাতে’ বা ‘আনন্দ ভ্রমণ’ বা সাগরের জল বা পাহাড়ের সৌন্দর্য নিয়ে কিছু লেখা থাকত। তার নিচে স্থানের নাম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কক্সবাজার বা রাঙামাটি, কখনো বা মুহুরী প্রজেক্ট। শুনতাম এসব পিকনিকে রান্নার কাজ করতেন এলাকার ধোপা। হালকা-পাতলা লোকটার নাম মনে নাই। আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। তার ছেলের নামও সুজন।
সে সময় ক্লাব ছিল কমন বিষয়। এমন কয়েকটি নাম- ফুটন্ত গোলাপ, একতা, অগ্রদূত ও বসন্তদূত। প্রায় এলাকায় একটা দুটো ক্লাব থাকত। ক্লাবঘরের সামনে সাইনবোর্ডে নামের নিচে লেখা থাকত- একটি সামাজিক অরাজনৈতিক সংগঠন। সম্ভবত যুব ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দেয়া একটা রেজিস্ট্রেশন নাম্বারও থাকত। উপরে লেখা থাকত শিক্ষা শান্তি প্রগতি টাইপ কিছু। আমি অবশ্য লাজুকপনার জন্য কোনো ক্লাবে ঢুকতে পারি নাই। শিক্ষা শান্তি প্রগতিতে আমার কোনো লোভ ছিল না। লোভ ছিলো ক্লাবে থাকা গল্পের বইয়ে। একবার এক ক্লাবে ইন্দোনেশীয় ভাষায় লেখা বাইবেল পাইছিলাম। আমি অবশ্য এখনো তক ইন্দোনেশীয় ভাষা জানা লোকের দেখা পাই নাই! এখন ক্লাব সংস্কৃতি উঠে গেছে। আমার কাছে এটাকে খারাপ ঘটনাই মনে হয়। সমাজে মানুষের সংঘবদ্ধতা কেন জানি কমে যাচ্ছে। তবে একটা দিক হয়ত আগের মতই বহাল আছে। যেমন- একটি অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন আসলেই রাজনীতি সম্পর্কে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচয়। এখানে রাজনীতি স্রেফ দলাদলি অর্থে প্রযোজ্য। রাজনীতিকে আমরা এখনো ব্যাপক অর্থে ভাবতে শিখি নাই। হেঁয়ালি হলো বেশির ভাগ ক্লাব ভেঙ্গেছেও দলাদলি থেকে। যার লক্ষ্য যত ছোট, তার ভাঙ্গনও হয়ত তত ছোট ব্যাপার দিয়া হয়। তো, কিছু কিছু পিকনিকের আয়োজন ক্লাব থেকেও হতো। কোনো বাড়ির লোকেরা পিকনিক করতে গেছে এমন ব্যাপার তো আছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে পুকুর পাড়ে পিকনিক করতাম। কোনোটাই স্রেফ সীমের বিচির সঙ্গে মাছ রান্না হতো। বাড়ির পিকনিকে সাধারণত আড়াইগ্রাম চাল ও ১০ বা ২০ টাকা চাঁদা ধরা হতো জন প্রতি।
তো, ‘চলো বন্ধু ঘুরে আসি টাইপ’ পিকনিকে আমরা কখনো যাওয়া হয় না। যারা যেতো আমার তাদের খুব হিংসে হতো। তারা ফিরে এসে বেশ রসিয়ে রসিয়ে গল্প করত। সেখানকার দুঃখজনক অনেক ঘটনাকে পরবর্তীতে তারা মজার বলেও প্রচার করত। হৈ হুল্লোড় করে যাওয়া-খাওয়া এটা নিশ্চয় খুব মজার। আমি বেশ কবার স্কুল থেকে শিক্ষাসফরে গিয়েছিলাম। কোনো এক শিক্ষাসফরের শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পতেঙ্গা সৈকতে। বাসেই ঘুমিয়ে পড়ি। যখন ঘুম ভাঙ্গল- তখন সবাই একে একে বাসে উঠতে শুরু করেছে। ঘুমিয়ে আছি দেখে আমাকে ডাকা হয় নাই। পতেঙ্গা আসার জন্য আমাকে ইউনিভার্সিটি পড়াতক অপেক্ষা করতে হয়েছে। সে যাইহোক, পতেঙ্গার কথা মনে হলে তরমুজের ছবি মনে ভেসে উঠে। কেন জানি না। সেবার কি গাড়ি কোনো তরমুজ ক্ষেতের পাশে দাড়িয়েছিল!
সব শিক্ষাসফর হয়েছিল প্রাইমারি স্কুলে। ফয়স লেক বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা খুব একটা মনে নাই। সেটা আগের পোস্টে বলেছিলাম। এবার অন্য দুটি বলি-
দুই.
সম্ভবত ক্লাস ফাইভে গিয়েছিলাম চন্দ্রঘোনা কাগজ আর সিক্সে কুমিল্লার ময়নামতিতে। এরপরে স্কুল থেকে শিক্ষাসফর না হওয়ার কারণ কী- আগে ভাবি নাই। এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশের পাট শিল্পের অধোগতির একটা বিষয় রয়েছে। প্রাইমারি স্কুলে থাকতে জুট মিলে অনেক জাকজমকপূর্ণ বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীদের আসতে দেখা যেতো। আমরা কাগজের পতাকা হাতে রাস্তার দুইপাশে দাড়িয়ে হাত নাড়তাম, ফুল ছুড়তাম। তখন জুট মিলগুলো ফুটবল লিগেও অংশ নিত। আমাদের স্কুলটা ছিলো হাফিজ জুট মিলসের অধীনে।
তখন পিকনিক মানে বাসে মাইকে বাজবে। গান থাকবে- বাপ্পী লাহিড়ীর ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ ও কিশোর কুমারের ‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে’। এ দুটি ছিল পিকনিকের জাতীয় সঙ্গীত। কিশোর কুমারের গানটা শুনলে খুবই বিরক্ত লাগত, এখনও লাগে- তবে হাসি আসে বেশি। অন্য গান তো থাকত। মানে যুগের হওয়া মিলিয়ে। যেমন- একবারের চল ছিলো ‘হাওয়া হাওয়া’। আমরা ফিটফাট হয়ে বাস ছাড়ার ঘণ্টাখানেক আগে চলে যেতাম। তখন থেকেই গানগুলো বাজত। শিক্ষাসফরকে শুধু আনন্দময় বলার কারণ নাই। নাকি নাকি দুঃখও ছিল।
চন্দ্রঘোনার উঁচু-নিচু পথ অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল এমন এক দুর্গম কোথাও চলে এসেছি- যেখানে আগে কেউ আসেনি। এটা সম্ভব! কারণ পুকুরে নামলে নিজেকে টারজান মনে হতো আর কলাগাছকে কুমির! তো এ পিকনিকে আমরা ছিলাম ডিসকোয়ালিফাইডদের দলে। ডিসকোয়ালিফাইড মানে- ক্লাস ফাইভের উপরে যারা পড়ে তারাই কাগজ কল দেখতে যাবে। কর্ণফুলী পেপার মিলের নাম তখন খুব শুনতাম- নিশ্চয় ক্লাস সিক্সে না পড়ার জন্য হতাশা বেড়ে গিয়েছিল। বাড়ার কথাই। কারণ এরপর বড়রা এসে কাগজ তৈরির অনেক বর্ণনা দিয়েছিল। একজন বলল, কাগজ দিয়ে কাপ বানিয়ে তাদের নাকি চাও খেতে দিয়েছিল। এটা ছিল বড় আফসোস। আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম মেশিন থেকে কাগজ বের হচ্ছে। একজন সেখান থেকে কিছুটা ছিড়ে গোল করে কাপ বানালো। আরেকজন ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে দিলো। কল্পনায় আমিও গরম গরম চা খেলাম। দৃশ্যটা কতই না চমৎকার।
আমরা অবস্থান করছিলাম কাগজকলের অফিসার্স ক্লাব টাইপ একটা কিছুতে। সামনে বাচ্চাদের খেলার সরঞ্জাম ছিলো। সামনের জলরাশি হয়ত কোনো নদী বা লেক। অবিরত ঢেউয়ের খেলার। হঠাৎ দেখা গেল কি যেন লাফ দিয়ে উঠল। আমাদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। এটা একটা ভোদর ছিল। কিছুক্ষণ পরপর মাথা তুলছিল। সবাই ফিরে আসার পর ওই ক্লাবে নাটক, নাচ-গান হয়েছিল। মঞ্চ জিনিসটা কেমন হয় সেবার প্রথম দেখেছিলাম। অবাক হয়ে ছিলাম- কেন দুইপাশে খোপ খোপ থাকে। নিজে নিজে মেলানোর চেষ্টা করি। আরেকটা বিষয় হলো সেবারই প্রথম গোল টেবিল দেখেছিলাম। মানে আমরা যেসব টেবিলে বসে খেয়েছিলাম। না ভুল, গোল একটা টেবিল আমাদের বাড়িতে ছিলাম। কিন্তু খাবার জন্য এটা ব্যবহার হতো না। হা হা হা, হুট করে কত কিছুর কথাই না মনে পড়ছে।
সেসময় পিকনিকে যাবার কালে সাথে ছোট ছোট কিছু কাগজের টুকরো নিয়ে যেতাম। লেখা থাকত শিক্ষা সফর, সবুজ শিক্ষায়তন উচ্চ বিদ্যালয়, আ ন ম আবদুল ওয়াহেদ সুজন। ক্লাস, তারিখ ও গন্তব্য লেখা থাকত। পুরো বিষয়টা স্পষ্ট মনে নাই। রাস্তায় লোকজন দেখলে বাস থেকে তার দিকে ছুঁড়ে দিতাম। এই আইডিয়া বোধহয় আমার না। জসিম ভাইয়া বা এমন কারো। যাই হোক নিজেকে জানান দেয়ার ইচ্ছে মনে হয়- মানুষের মধ্যে ছোটবেলায়ই বাসা বাধে। নইলে এমন করতাম না কেন? এমনও হতে পারে- এটাকে মুক্তির সোপান হিসেবে দেখতাম।
তিন.
ময়নামতি যাওয়াটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সম্ভবত সিক্সে পড়তাম। নোয়াখালী তো নিয়মিত যেতাম। আর বছরে একবার ঢাকা। আপার কাছে। এটা বাদ দিলে এটা ছিল ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারের আগে সবচেয়ে দূরে কোথাও যাওয়া।
ফলে কুমিল্লার এ ভ্রমণটা আমার কাছে অনেক অজানা জানা টাইপ বিষয় ছিল। সে লালমাটির পাহাড়, খোলা প্রান্তর, উচুনিচু রাস্তা, মিউজিয়াম। বাঁশ দিয়ে বানানো এক ধরনের শোপিস বিক্রি হতো সে সময়। ক্যালেন্ডারের মতো দেওয়ালে টাঙ্গানো হতো। আমিও কিনেছিলাম- দশ টাকা দাম বোধহয়। মাঝখানে ধানের শিষের মাঝে হলুদ জমিনের উপর লেখা ‘মা’। নিচে লেখা ছিল ‘আমাকে দোয়া করো’। ফেরার পথে সামনের দিকের সিট থেকে কে যেন চিৎকার দিলো। রাস্তায় গাড়ি থেমে যায়। পরে জানা গেল এক আপুর গায়ে তেলাপোকা উঠছিল। যাওয়ার পথে আমরা মিরসরাইরের একটা স্কুলে বসে টিফিন খেয়েছিলাম। পেছনে রেল লাইন। জায়গার নাম মনে হয় নিজকুনঝরা। এ পথে গেলে আজও স্কুলটা দেখার জন্য উম্মুখ করে থাকি। নিজের পদরেখা কত প্রিয় মানুষের!
এখানে দুটো অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলাম। অদ্ভুত ঠিক না, কেমন যেন অস্বস্থিকর। প্রথমটা এমন- একটা বিশাল মাঠের একপ্রান্তে চট বিছিয়ে আমরা খেতে বসি। মাথার উপরে গাছের ছায়া। পোলাও, মুরগী, গরুর সাথে অন্য কিছু থাকতে পারে। খেতে খেতে মাঝপথে খেয়াল হলো- আমাদের পেছনে অনেক বাচ্চা। হাতে পলিথিন। তারা অন্যদের না খাওয়া খাবারগুলো কুড়িয়ে পলিথিনে রাখছে। মানুষের এতো অভাব যে- অন্যের খাবার কুড়িয়ে খেতে হয়- এটা আমি আগে কখনো দেখি নাই। নিজেদের কতো অভিযোগ এর কাছে ম্লান হয়ে যায়। এ দৃশ্য আমার কাছে খুবই গুরুতর ছিল। অনেক খারাপ লেগেছিল। সেটা বর্ণনা করা সম্ভব না। অন্তত এর দশবছর পরও এর সাথে তুলনার করার দৃশ্য আমি পাই নাই।
বিকেলের দিকে টিচারদের নজরদারির রশি হালকা হলো। বোধহয় ঘোরার জন্য কিছু সময় দেয়। অনেক কোলাহল মানুষজনের মধ্যে থাকলে আমার কেমন যেন লাগে। খুব একা একা লাগে। কখনো কখনো অদ্ভুত নৈঃশব্দে ভরে উঠে চারদিকে। সেদিনটি এমন ছিল। আমি একা একা ময়নামতির প্রাচীন দেয়ালগুলো ধরে হাটছিলাম। এখানে যেন কারা কথা বলছিল। আমার কাছে এইসব প্রাচীনত্ব অদ্ভুত লাগে। কেমন যেন বিষস্নতার ভার চেপে ধরে। খালি কান্না আসে। সেদিনের কথা ততটা মনে নাই। তারপর দেয়াল বেয়ে উপরে উঠি। পরে আবিষ্কার করি আমার এতো কষ্ট করার দরকার ছিল না। ধ্বংসস্তুপে যাওয়ার সুন্দর রাস্তা আছে!
২০০৭ সালে ইউনিভার্সিটি থেকে শিক্ষাসফরে গেছিলাম। দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ ঘুরা হইছিল। ভ্রমণের প্রথমদিন গেছিলাম বাগেরহাট ষাট গম্ভুজ মসজিদ দেখতে। মসজিদের বোধহয় আসর নামাজ পড়েছিলাম। দুই রাকার নফল নামাজও হয়ত পড়েছিলাম। নামাজ শেষে মসজিদের দেয়াল ছুঁয়ে হাটছিলাম। হঠাৎ কিযে হলো। আমি যেন অনেক স্থান-কালে বিরাজ করছি। নানা সময়ে এ মসজিদের আসা লোকদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। তারা হাটছে, কথা বলছে। পুরো শরীর যেন ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ভয়ে কেঁপে উঠি। দ্রুত বের হয়ে আসি। তখন আমার বন্ধুরা হৈচৈ করছে, ফটো তুলছে। কিন্তু আমার অসম্ভব খারাপ লাগে, কান্না আসে। সে কারণে ষাট গম্ভুজ মসজিদের সামনে আমার কোনো ছবি নাই। এমন কিছুর কাছাকাছি ছিল রাজশাহীর বাঘার মসজিদের অভিজ্ঞতা।
মাঝে মাঝে এ ঘটনাটি চোখের সামনে ভাসতে থাকে। প্রায় সময় কোলাহলে এমন নৈঃশব্দ্য ফিরে ফিরে আসে। আমি কোনো উত্তর মেলাতে পারি না। তখন মনে হয় আমি এমন কিছু যা আসলে আমি নই। অথবা এমন কিছু যা আমি ধরতে পারি না। ভাবি, মানুষই তো অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যোগসূত্র। তাই বুঝি এমন হয়। জানি না- তারপরও এমন কিছুর জন্য অপেক্ষা করি!
*ছবি: অন্তজাল থেকে।