শততম পোষ্ট, ডয়েচে ভেলের মনোনয়ন ও দুর্বল হৃদয়ের ওয়াহিদ সুজন

হাঁটতে হাঁটতে এলাম চলে, এই ঘনবন/ হঠাৎ ভাবি একটু দাঁড়াই- কার দুনয়ন/ আমার দিকে তাকিয়ে আছে অশ্রুসজল/ দুগাল বেয়ে ঝরছে কি তার চোখের কাজল? (আল মাহমুদ/ বৃহদারণ্য)

দুর্বল হৃদয় বলার পিছনে সুবিধা নেবার আকাঙ্খা ষোল আনাই বিদ্যমান। আপনি বলবেন, আহা! লোকটির হৃদয় দুর্বল। আপনার হৃদয় মমতায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠবে। তবে সেটা কতটা পাওয়া যাবে বলা দুষ্কর।

দুর্বল হৃদয়কে দুইভাবে দেখা যেতে পারে। এক. সাহসহীন কিসিমের। দুই. মায়া-মমতা ভরা হৃদয়। সে যাইহোক, আমার হৃদয়টি দুর্বল। কোন কিসিমের তা আপনারাই ঠিক করবেন।

ইচ্ছেশূন্য মানুষ নাম দিয়ে ব্লগ লেখা শুরু করি ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে।প্রথম পোষ্ট ছিলো ঝড়ে বক নাও মরিতে পারে।এটি ছিল প্রতিক্রিয়ামূলক লেখনী। ইচ্ছেশূন্য মানুষ নামটা হঠাৎ পাওয়া। ভেবেচিন্তে নিয়েছি এমন না। কোন এক মৃদৃ সমীরণের দিন এই নামে একটা কবিতা লিখেছিলাম। নির্ঘাত কাছাকাছি সময়ে। ব্লগ বানানোর পর নাম খুঁজতে গিয়ে এটা ছাড়া আশেপাশে কিছু পেলাম না।

এই নামটি আমার সিরিয়াস বন্ধুরা পছন্দ করে নাই।প্রশ্নেরও শেষ নাই। কিন্তু এর ভেতরকার স্ববিরোধিতায় আমি মানুষের মুখ আর তার অবিরাম যাত্রা পথটি খুঁজে যাই। যা আমার নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও দার্শনিক অভিমুখকেও চিহ্নিত করে।এই জায়গায় আমি আল-গাজালীর একটা আপ্তবাক্য ও এডমণ্ড হুসার্লের ফেনোমেনলজির আশ্রয় নিতে পারি বোধহয়। তবে আজ থাক। এটুকু বলি চরম স্ববিরোধী ইচ্ছেশূন্য মানুষ নামে যখন কেউ আমাকে ডাকে ততটা খারাপ লাগে না।

সামাজিক হতে পারি নাই দেখে আম্মা-বাবা, আপার বকা প্রায় শুনি। ব্লগ কিছুটা সামাজিক করেছে বটে। কোন আড্ডায় বসলে কথাই বলতে পারি না। স্বাক্ষী রাখলাম ব্লগার উদরাজী ভাইকে। মজার বিষয় হলো ইচ্ছেশূন্য মানুষ নামে একটা ব্লগ আছে- সেটা বলতে কিযে লজ্জা লাগে। কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করতে চাওয়ার দুর্দমনীয় ইচ্ছেয় তা বলে ফেলি। হা হা হা।

কেবল ইচ্ছে, কাউকে গোপনে বলি-/ আমি তোমাকে ভালবাসি/ এই একটি শব্দে মনে হয় হঠাৎ বুছি পায়ের তলায় মাটি/ ঘন ঘন কেঁপে উঠেছে।/ কে কাকে ভালোবাসে এটা বড় কথা নয়/ বড় কথা হল সবাই এখন এই মুহুর্তে হাসছে।/ ইচ্ছে হয় ঘাসে ঘাসে গড়াগড়ি যাই। (আল মাহমুদ/ খুশির প্রেমিকের নাম- আনন্দ)

ব্লগের সাথে পরিচয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালে। আর্টস ফ্যাকাল্টির কম্পুটার ল্যাবে নিয়মিত বসতাম। সে সময় কবি নির্ঝর নৈ:শব্দ্য একটা লিংক মেইলে পাঠায়। সামহয়ারইন ব্লগের। পরিচয় হলেও কয়েক বছরের অনাভ্যস্ততায় বাংলা টাইপিং ভুলে যাওয়ায় আরো বছর দুয়েক অপেক্ষা করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন পাকাপাকি বাসায় ফিরে আসি তখন থেকে ব্লগ নিত্যসঙ্গী। একই সময় চতুর্মাত্রিক লিখেছি বছর দুয়েক। সরব, শব্দনীড় ও মুভিলাভার্সে আছে গুটিকয়েক লেখা আছে। ইদানিং কমিউনিটি ব্লগে না লিখলেও ফেসবুক লাইক বাটন অনেক কিছু সহজ করে দিয়েছে। পড়াশুনা ও লেখালেখি একটা কারণ। আবার নানা কারণে পুরানোরা- যাদের ফলো করতাম তারা আর ব্লগে লিখেন না। এমনকি বন্ধুরাও। এছাড়া অসহিষ্ণুতা বেড়েছে বেশ। ফলে অন্যের ব্লগ পড়লেও মন্তব্য হয় না খুব একটা। নানান ব্লগের দলাদলি ও তালগাছ মার্কা বাক স্বাধীনতার থিওরি দিয়ে অপরকে দমন করার বিষয় তো আছে। বাংলা ব্লগে একসময় যারা অন্যের বাক-স্বাধীনতা হরণের কাজ করেছে, এখন তারা নিজেরাই সে সমস্যা পড়েছে। দুটোই দু:খজনক।

সেই যাই হোক, প্রায় আড়াই বছর পার হবার পর খেয়াল হলো মোটামুটি একশতম পোষ্টে চলে এসেছি। যখন লেখা আসত না, পুরাতন লেখা দিতাম। কিন্তু একশতম পোষ্টটি পুরানো হলে কেমন দেখায়? কিন্তু একটা ভীতিকর সময়ে ভবিষ্যত বুঝতে না পারায় মন আচ্ছন্ন। তাই কোনভাবে লেখা যাচ্ছিল না। একই সাথে তীব্র শংকার কারণে নিজেকে প্রকাশ করা হয়ে উঠল কষ্টকর। আগে-পিছে কে কি ভাবে। কারণ স্পষ্ট দেখতে পেলাম কাছে পিঠের মানুষেরা দুই ভাগ হয়ে গেছে। সেই সময় জানলাম ডয়েচে ভেলের সেরা বাংলা ব্লগ ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছে ইচ্ছেশূন্য মানুষ। সেটাও আবার সম্ভব হয়েছে কিছু মানুষের ভালোবাসায়। কিন্তু আমি বন্ধুদের অনুরোধ করলাম- তার যেন ভোট বা ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহন না করে।দুর্বল হৃদয়ের মানুষেরা ভালোবাসা অগ্রাহ্য করতে পারে না, তার নমুনাও সেখানে পাওয়া যাবে। ঠিক এই সময়ে শততম পোষ্ট লেখা হয়ে গেল- হিংস্র অহিংস সহিংস

দেখো, এখানে ফেরার কোনো হাঁকডাক নেই।/ সূর্যাস্তের নিচের মাঝিহীন কার যেন/ একটা নাও মাত্র দুলছে। (আল মাহমুদ/ করতোয়া)

এই মাসের চার তারিখে চলচ্চিত্রের পোষ্টার প্রদর্শনী দেখতে যাচ্ছিলাম। মোবাইলে দেখলাম হাসান আলী রুমান আমার ওয়ালে লিখেছে ডয়েচে ভেলে মনোনয়ন পেয়েছি। খুশিতে সামনে থাকা দারাশিকো ভাইয়ের কাছে অভিনন্দন দাবি করলাম। তিনি কৃপণতা করেন নাই। বাসায় ফিরতে ফিরতে কজন বন্ধুর শুভেচ্ছা পেলাম। আমিও কজনের কাছে ভোটও চাইলাম।

কিন্তু এক বন্ধুর একটা কমেন্টের পর ডয়েচে ভেলের পুরষ্কারপ্রাপ্তদের তালিকা দেখলাম। বিভিন্ন সময়ে পুরষ্কার পাওয়া আবু সুফিয়ান, আলী মাহমেদ ও নিয়াজ মওলা ভাইয়ের সাথে সাথে এমন কিছু লোককে দেখলাম যারা বাংলা ব্লগস্ফিয়ারকে দুষিত করার জন্য অনেকটা দায়ি। আগেও দেখেছি আমাদের সমাজের জন্য অনেক ক্ষতিকারক ব্যক্তিরাই আন্তির্জাতিকভাবে সম্মানিত। বাক স্বাধীনতার এমন থিওরি আমি মানতে পারি না। এমন না যে, সবোর্চ্চ সংখ্যক ভোট পেয়ে আমি জিততাম- তাও মনে রেখে ফেসবুকে স্ট্যাস্টাস দিলাম-

আমার ইচ্ছেশূন্য মানুষ ব্লগ ডয়েচে ভেলের আন্তর্জাতিক ব্লগ এওয়ার্ডে সেরা বাংলা ব্লগ ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পাওয়া নিয়া গড়যধসসধফ অৎলঁ বলতেছেন, মনোনয়ন প্রকৃয়া জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, স্রেফ এথিকাল জায়গা থেকে ঝঁলধহ ভাই এই মনোনয়ন প্রত্যাখান করবেন বলে আমার অনুমান

মনোনয়ন পাওয়া নিয়া বেশ খুশি হইছি বলতে অসুবিধা নাই। সকালে আগে কারা জিতছে তার ইতিহাস ঘাটলাম।

নিয়াজ মওলা ভাই আমার বেশ পছন্দের মানুষ। উনারে বাদ দিয়া বুঝলাম পলিটিক্যাল হোক আর এথিক্যাল হোক, ভোটাভুটির জন্য এটা আমার জায়গা না। স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য এটা আমি ভুলতে চাই।

বিবেক হিসেবে হাজির থাকার জন্য আরজু ভাইরে ধন্যবাদ। তাদেরও ধন্যবাদ যারা ইতিমধ্যে ভোট এবং ক্যাম্পেইন করার ঘোষণা দিছেন। আমি বন্ধুদের ভোট না দেয়ার অনুরোধ করছি।

কৃতজ্ঞতা যে বন্ধুরা বিষয়টাকে ভালোভাবে নিয়েছে। আজ বাংলা ব্লগের দারুণ দু:সময়। এই সময়ে এমনিতেই এই মনোনয়ন আনন্দ বয়ে আনার না। তবুও প্রাথমিক আনন্দ পিছু ছাড়ে নাই। কিন্তু এটা এমন দু:সময় যে আমার নাস্তিকতা ও ধর্মবিদ্বেষের ফারাকটা রাখি নাই। এর দুটো কারণ হতে পারে। আমাদের অজ্ঞতা অথবা ভেতরকার তীব্র ঘৃণা। এর কোনটাই সুস্থ্য জাতি গঠন বা জ্ঞানচর্চার অনুকুলে নয়। ফলে আমাদের অন্ধত্বকেই মেনে নিতে হচ্ছে। সেই একই কারণে মানুষে মানুষে এতো ফারাক। সমাজের সবক্ষেত্রে ঘৃণার চর্চা।

দুহাত বাড়িয়ে আমি ডাকি ওরে/ পাখি আয় ফিরে-কবির বুকে/ কিন্তু ফেরে না পাখিটি আমার।/ আমি চেয়ে থাকি আকাশের দিকে চোখে জল নিয়ে। (আল মাহমুদ/ তোমার নামের ছোবল)

তারপরও কি আশা ছাড়ি? না! আশাবাদী হবার মতো চমৎকার ঘটনা আমাদের মাঝে আর কি আছে। জিনিসটা ছোঁয়া যায় না, অথচ কতো কাছের। অপরকে বুঝার জ্ঞানগত চর্চাই ব্লগের একটা অনুসন্ধান হতে পারে আমার বিশ্বাস। এতে অপরের সাথে সাথে নিজের পর্যালোচনা হবে অবশ্য। এভাবে সামাজিক সম্পর্কের নতুন ধরনের নির্মাণ হবে।

ব্লগের মাধ্যমে চমৎকার সব মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। সামনে আরো অনেকেই হবেন আশা করি। হুটহাট দুই একজনের সাথে দেখা হয়ে যায়। কি যে ভালো লাগে। তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতা যারা নানান উপদেশ দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা যারা ফেসবুক ও মেইলে ফলো করছেন। সেই দুই বন্ধুর কাছে কৃতজ্ঞ, যারা গত দুইবছর আমার বিল পরিশোধ করেছে। তাদের কাছে কৃতজ্ঞ, আর যারা একই কাজটি করতে চেয়েছেন।

এত ভাষা- ভালোবাসা/ আশা ও ভরসা আমাকে ঘিরে/ আমি শুধু আছি নিজের মধ্যে নিজের নিয়মে বাঁচি/ তবু কিছু কথা ব্যথা আকুলতা ঝরে যায় চারিদিকে/ আমি সীমাহীন যেন-বা প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো- (আল মাহমুদ/ আমি সীমাহীন যেন-বা প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো)

………………………………………………………………………………………………….

*ব্যবহৃত কবিতা আল মাহমুদের আমি সীমাহীন যেন-বা প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো বই থেকে নেয়া। প্রকাশ কাল: ফেব্রুয়ারী ২০১৩, প্রকাশক: চন্দ্রাবতী একাডেমি, ঢাকা।

*ব্যবহৃত চিত্র: ভ্যান গগেঁর আঁকা এ পিয়ার অব সুজ (১৮৮৬)।

Comments

comments

14 thoughts on “শততম পোষ্ট, ডয়েচে ভেলের মনোনয়ন ও দুর্বল হৃদয়ের ওয়াহিদ সুজন

  1. সুজন ভাই,
    আপনার লেখাটা পড়লাম। প্রথমেই আগের শততম পোষ্টের জন্য অভিনন্দন। আসলে সকলেরই খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে।
    ডয়েচে ভেলের মনোনয়নের ব্যাপারে আমার প্রতিক্রিয়া আমি ফেবুতেই আপনাকে জানিয়েছি। আপনার মেসেজটাও পড়েছি, কিন্তু রিপ্লাই আর দেওয়া হয় নি।
    কিছু মানুষ/ব্লগার ব্লগ সমাজকে কলুষিত করেছে। তাদের জন্যই একটা বিশাল আন্দোলন আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। এই এদেরকেই কি আবার আমরা মাঠ ছেড়ে দিবো? তা হয় না, সুজন ভাই। সেজন্যই আমি মনে করেছিলাম, আপনার ভোট যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া উচিত।
    যাহোক, আবারো বলি, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আপনার।
    ভালো থাকুন খুব।

    • শুকরিয়া। পাশে আছেন জেনে ভালো লাগছে। এ সময় খুব কম মানুষকে পাশে পাওয়া যায়।

      বুঝতে পারছি বেশ ব্যস্ত আছেন। এরমধ্যে চমৎকার পোষ্ট দিচ্ছেন। ভালো খবর।ভালো থাকুন।

  2. নামেই যার পরিচয় পাওয়া যায়। তাকে নিয়ে কিছু বলতে চাই না। সুজন মানেই ভালো মানুষ, আরও ভালো হোক তার এই কামনা করি।

  3. বলতে দ্বিধা নেই, দৃঢ় চিত্তে প্রকাশের ক্ষমতা আপনার আছে।নিরহংকারী বলে শততম পোষ্টে কেমন বিনয়ী!

  4. আমি অবাক হলাম না আপনার এই সিদ্ধান্তে । আমি ফেবুর ভোট যুদ্ধে আপনাকে নামার অনুরুধ করতে চাই না। তবে বলতে চাই যারা বিগত সময় পুরুষ্কার পেয়েছে তাদের সাথে আপনার মতের বা আর্দশের অমিল থাকতেই পারে। আপনি যদি মনে করে তারা বাংলা ব্লগিং দূষণ করেছে, তবে আপনি কেন সরে দাড়াবেন? কিছু পদচিহৃ তো রেখে যেতে হবে। যা দেখে আগামীতে ব্লগারা শিখবে, অনুসরন করবে।

    যাই হোক ইদানিং দিনে একবার আপনার ব্লগ ঘরে ঘুরে দেখে যাই ইচ্ছে শূণ্য মানুষের ইচ্ছে দেখতে। আজ দেখি ইচ্ছে শূণ্য মানুষের ঘরে প্রতিবাদের সুর চাঁদ ওঠেছে। আপনার প্রতিবাদের প্রক্রিয়া প্রতি শ্রদ্ধা রইল। শুভ ব্লগিং

  5. কথাগুলো এত মোলায়েম মনে হলো কোমল মানুষটা সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বলে গেল আনমনে একটি বারের জন্যও চোখের দিকে চোখ না রেখে।

  6. ইচ্ছেশূন্য মানুষটি যেনো শতায়ু পান এই কামনা
    আয়নায় যেনো নিজেকে দেখার একটি অনন্য দলিল

Comments are closed.