তিন শহীদের একজন আইন আল-কুদাত

মনসুর আল-হাল্লাজ ও শিহাব আল-দীন সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আইন আল-কুদাত সুফিবাদের ‘তিন শহীদ’ হিসেবে পরিচিত।

ইসলামী ঐতিহ্য অনুসারে বড়সড় একটা নাম ছিল তার। তবে অন্য মনীষীদের মতো আইন-আল-কুদাত নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। যা মূল তার উপাধি, ইংরেজিতে ‘দ্য পার্ল অব দ্য জাজেস’, অর্থাৎ কর্মসূত্রে নামের এই হাল। তার জন্ম ১০৯৮ সালে হামদানে। অন্যান্য সূফিদের চেয়ে কিছুটা আলাদা ছিলেন তিনি। সেলজুক শাসকদের বিরোধিতা করে তাদের রোষানলে পড়ে ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগের শিকার হন। সম্ভবত ক্রুশবিদ্ধ করে বা পুড়িয়ে মারা হয় তাকে। তখন বয়স মাত্র ৩৩ বছর, সেই ১১৩১ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

একাধারে আইনজ্ঞ, সুফি, দার্শনিক, কবি ও গণিতজ্ঞ হিসেবে পরিচিত আইন-আল-কুদাতের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বিচারক। বিখ্যাত গাজালি ভাইদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। তিনি ছিলেন আহমাদ গাজালি শিষ্য ও মনসুর হাল্লাজের অনুরাগী।

অল্প বয়সে পণ্ডিতের জন্য খ্যাতি পাওয়া কুদাত বিচারক পেশাকে বেছে নেন। একই সময়ে আবু হামিদ আল গাজালির সঙ্গে সূফি মতবাদ প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন। তখন বয়স ত্রিশের কোটায়।

কিছু সূত্র অনুসারে, সুফি, দার্শনিক, গণিতজ্ঞ ও কবি ওমর খৈয়ামের শিষ্য ছিলেন আইন-আল-কুদাত। তীর্থযাত্রা থেকে ফিরে আসার পর খৈয়াম সম্ভবত কিছু সময়ের জন্য হামাদানে অবস্থান করেছিলেন। খুব সম্ভব যে এই সময় আইন আল-কুদাত তার কাছে দীক্ষা নেন।

আইন-আল-কুদাত রচিত তামহিদাত

আইন-আল-কুদাতের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে ধরা হয় তামহিদাত ও জুবদাত আল হাকিক বই দুটিকে। তিনি আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের অনন্য দিকটির তুলে ধরেছেন। যেখানে মানুষ পূর্ব ধ্যানধারণা পরিত্যাগ করে আল্লাহকে জানতে পারে। এর জন্য ব্যক্তিগত বিবেচনা ও আকলের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

ইসলামকে সত্য ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করতেন। যার শুরু বুদ্ধির পর্যায়ে, কিন্তু শেষটা সাধারণ বুদ্ধির সীমা অতিক্রম করে ব্যক্তিগত অনুভূতিতে আবদ্ধ হয়। কোরআনের ইন্টারপ্রিটেশন বা ব্যাখ্যার মাধ্যমে এটি পরিপূর্ণতা পায়।

আইন-আল-কুদাতের আলোচনায় আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোরআন হলো প্রধান সূত্র। ইসলাম যে সমর্পণের কথা বলে তাকে আমরা দুটি পর্যায়ে দেখি। একটি হলো পূর্ব প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণার ভেতর বা আচার-আনুষ্ঠানিকতার ভেতর সমর্পণ। আরেকটা হলো পূর্ব প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণা বাদ দিয়ে ব্যক্তি তার বুদ্ধি বা আকলের মধ্য দিয়ে কোরআন অনুধাবণ করে। আইন আল কুদাত এই দ্বিতীয় দিকটিকে ঠিক মনে করেন।

এখন কোরানের কাছে যেতে হলে অভ্যাসগত চিন্তা, ঐতিহ্যগত চিন্তা বাদ দিতে হবে। এখানে বুদ্ধিই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ ব্যক্তির বিচার-বিবেচনার নিজস্ব ছাঁচ ধরে এগোতে হয়। আর পেছনে পড়ে ঐতিহ্যগত চিন্তা। ঐতিহ্যগত চিন্তা বলতে নানা প্রকার ফিকহি আলোচনা,মাসয়ালা বা আর যা কিছু।

এখন কোরানের সঙ্গে বোঝাপড়াটা একদম সরাসরি। সেখানে দুটো বিষয় থাকে কোরান ও আকল। সাধারণত আপনি যখন অনুসন্ধানে ব্রতী হন, তাহলে আকল দিয়েই বিবেচ্য হবে কার মতবাদ গ্রহণ করা যাবে, কোনটা যাবে না। কিন্তু আইন-আল-কুদাত মনে করেন, কোরানের পাঠ ব্যক্তি নিজেকেই করতে হবে। কোন ঐতিহ্যবাহী পুরুষ বা ট্রাডিশনকে অনুসরণ নয়। কারণ যত বড় পণ্ডিতই হোন, দুজনের মধ্যে বোঝাপড়া ও পরিপ্রেক্ষিতগত পার্থক্য রয়েছে।

অন্যভাবে বললে, একজন মুসলমানের সফর দুই রকম। আল্লাহর দিকে ও আল্লাহ থেকে দূরে সরে থাকার। সরাসরি ইন্টারেশনের চর্চাটাই হলো আল্লাহর দিকে সফর। এখানেই কোরআনের সঙ্গে সরাসরি ব্যক্তির বুদ্ধির সংযোগ ঘটে। তিনি বিচার-বিশ্লেষণ করে গ্রহণ করেন।

কিন্তু কোরআন কেন? আইন-আল-কুদাতের ভাষ্যে কোরআন হলো আল্লাহর বাণী। আর এজন্য কোরআনই সর্বোচ্চ সত্য। শব্দ ও ভাষার বাইরেও এর ব্যাপ্তি। এ কারণে কোরআন ধরেই আল্লাহর কাছে যেতে হয়। তখন টেক্সট আর ব্যক্তির মধ্যে আর কিছু থাকবে না।

তবে আইন-আল-কুদাত সম্পর্কে পড়লে মনে হয়, বুদ্ধি বা আকলের ওপর ভরসা একপক্ষীয় বিষয়। এখানে একটা বিষয় আছে, যেন শুধু বুদ্ধি দিয়ে এগিয়ে গেলেই হচ্ছে না। মানে পুরোনো ধ্যান-ধারণা অতিক্রম করছি বললেই হচ্ছে না। বরং কোরআনের নিজস্ব একটা মহিমা আছে, যার কারণে ওই ব্যক্তি ধ্যান-ধারণা মুক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ, কোরআনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিপরীত দিক থেকে একটা সাড়া আসে। তখনই ব্যক্তি পুরোনো ধ্যানধারণা থেকে মুক্তি পেতে পারে। যেটা স্রেফ বুদ্ধির ব্যাপার না। এভাবে মনে হয়, শুরুটা বুদ্ধি দিয়ে কিন্তু শেষটা বুদ্ধির স্তর পার হওয়ার মধ্য দিয়ে।

*আহমেদ দীন রুমির কিছু নোকতা থেকে বোঝার চেষ্টা। সেক্ষেত্রে যাবতীয় ভুল যিনি অল্পতেই বেশি কিছু বোঝার চেষ্টা করছেন তার। আর আইন-আল-কুদাতের জীবনী সম্পর্কে তথ্যের উৎস উইকিপিডিয়া। ছবি- ইন্টারনেটের একাধিক উৎস।

Comments

comments

2 thoughts on “তিন শহীদের একজন আইন আল-কুদাত

  1. নতুন বিষয় জানলাম স্যার। এই ধরণের চিন্তাভাবনার সাথে পরিচয় ছিল না। কিন্তু লেখাটা হঠাৎ শুরু হয়ে হঠাৎই শেষ হয়ে গেলো বলে মনে হচ্ছে। আরও কিছু আসবে?

    • আপাতত এতটুকুই। আরেকটু পড়াশোনা ও ভাবাভাবির পর হয়তো লিখতে পারি। দোয়া কইরেন। ধন্যবাদ।

Comments are closed.