সুপারহিরো বাদ দিয়ে অ্যান্টিহিরোর পক্ষে দাঁড়াইতে মন চায়

রাজেশ খান্না অভিনীত বিখ্যাত একটা হিন্দি ছবি ‘রোটি’, যা আবার হলিউড সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত। সেই হিন্দি ছবির গানসহ প্রায় হুবহু নির্মাণ জাফর ইকবাল ও ববিতা অভিনীত এবং ইবনে মিজান পরিচালিত ‘এক মুঠো ভাত’। বাংলা মুভি ডেটাবেজে চমৎকার সেই ছবির একটা রিভিউ পড়তেছিলাম। যার শিরোনাম, ‘যে সমাজে ক্ষুধার্ত মানুষ নাই, সেই সমাজে অপরাধ নাই!’

যখন ম্যাট রিভস পরিচালিত ‘দ্য ব্যাটম্যান’ দেখতেছিলাম, যা ডিসির এই সুপারহিরো সিরিজের সর্বশেষ রিবুট, তখন লাইনগুলো মনে পড়তেছিল।

গোথাম সিটির সুপারহিরো ব্যাটম্যান (রবার্ট প্যাটিনসন)। তার শহরটা যাবতীয় দুর্নীতির আখড়া। ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ থেকে প্রশাসন; সব জায়গায় দুই নাম্বারির পসরা। মোটের ওপর কিছু সৎ পুলিশ আর সাংবাদিকের দেখা মেলে। আর গরিবগুলোর কিছু কিছু ছিচঁকে চোর হয়ে খাঁড়ায়া থাকে অলি-গলিতে। সুযোগের সন্ধানে। জায়গাটা কতটা খারাপ তা বুঝাইতে যেন, ম্যাট রিভস তার পুরা তিন ঘণ্টা সিনেমার প্রায় ৯৯ ভাগ দৃশ্যই রাতের বেলায় সাজাইছেন। বা এমনও ভাবা যাইতে পারে, এই শহরটা পাপের ভারে এমন আন্ধার হয়ে আছে।

আরও পড়ুন: জোকারের রাজনীতি

এখানে মনে হইছে প্রতীকী হইতে গিয়ে ম্যাট রিভস একটা ফাঁকি দিছেন। তাবৎ দুনিয়ার কথা বাদ দিলেও আমরা অভিজ্ঞতার ওপর আছর করতে পারি। ধরেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আমরা আছি। খারাপ একটা দুনিয়ার অংশ হিসেবে যারে আমরা প্রায়ই ভাবি। বাট, খারাপরে আন্ধারের মাধ্যমে এ দেখানি যেন আমারে এমন একটা ধারণা দিতে চায়, ফকফকা দিনের বেলায় কোনো আকাম হইতে পারে না। রাতের ভোট দিলেও আসলে তো সেটাই হয়। ওইটা ছাড়া বাকিটা তো দিনেই হয়। এক সময় আবার ‘রাতের ভোট’ তো দূরের কথা ‘ভোটের’ দরকার পড়ে না। একটা খারাপ দুনিয়ায় দিন-রাতের আসলে ফারাক নাই। কিন্তু বিপ্লব তো টেলিভিশনে পয়দা হবে না। এ সিনেমায়ও না। কী বলেন?

এটা এমন একটা সময়; যখন গোথামের মেয়র ইলেকশনের অল্প কদিন বাকি। মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে, কে কত গরিববান্ধব, কে কত তহবিল জোগাড় করতে পারে! এই যে ফিলানথ্রোপ্রির ধারণা, এটা তো ফাঁকিবাজির জিনিস। রাষ্ট্রের জনকল্যাণের জায়গা থেকে সরে করপোরেটদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়, যেহেতু জোগানদাতা মূলত তারা। গোথাম আর উৎকৃষ্ট নিদর্শন ও এই চক্র থেকে যেন তার মুক্তি নাই। করপোরেট যখন দাতা হয়ে ওঠে তখন চাপ দিন দিন বাড়তে থাকে রাষ্ট্রের ওপর। আরও আরও সুবিধা দাও, দুই নাম্বারির। এই যে দেখেন, বাংলাদেশে যখন ক্রমাগত বাড়তে থাকা দ্রব্যমূল্য কথা হয়, তখন সরকারের উপর মহল বলে, কিনতে না পারলে কম খাওয়া, বাদ দিয়ে খাও বা অন্য কিছু খাও।

এতিম হইলেও ব্যাটম্যান সেই লেগেসির মানুষ, তার বাপ ছিল নামকরা দাতা, ব্যাটম্যান এখন ওয়েন ইন্ডাস্ট্রির মালিক। তো, এইরকম দান-খয়রাতের প্রতিযোগিতাময় সময় মেয়র প্রার্থী থেকে পুলিশের বড় বড় কর্তা রহস্যময় রিডলারের (পল ড্যানো) হাতে মরতে থাকে। তাদের কিছু অপরাধও বাইর হতে থাকে। রিডলার জানে না ব্রুস ওয়েন ও ব্যাটম্যান একই মানুষ। জানে না বলে ব্যাটম্যানকে তার জাস্টিস প্রতিষ্ঠার সঙ্গী ভাবতে থাকে, আর (ভালো) বড়লোক ব্রুস ওয়েনরে ভাবে শত্রু, মারার জন্য বোমাও পাঠায়। কারণ ওয়েন বংশের মুখেও কালিমা আছে! এ কালিমা ব্যাটম্যানরে পর্যদস্তু করে ফেলে।

আরও পড়ুন: সুপারহিরোর নৈতিক ধাঁধা

রিডলারের লড়াই হলো ‘আনমাস্ক দ্য ট্রু’। সত্য আসলে কী, এর একটা সুরাহা তো দরকার। নিপীড়িতরা কেন নিপীড়িত, আর কারা এর পেছনে। কিন্তু ‘আনমাস্ক’ বলতে মুখোশধারী রিডলার বা ব্যাটম্যানের মুখোশে পেছনে আসলে কে আছে সেটা জানা না! বরং নিপীড়িত হিসেবে যে হাজির তার পরিচয় তো সেটাই। সে নিপীড়িত। কিন্তু কেন সে কেমন? বা কারা এর পেছনে আছে? অথবা খারাপ একটা সমাজ না থাকলে ব্যাটম্যান বা রিডলারেরও দরকার পড়ে না। সেখানে রিডলারের যে সত্য উন্মোচনের দাবি তার সঙ্গে তার চেহারা দেখার সম্পর্ক কতটুকু। এতটুকু যে আইন-অপরাধের ধারণা ও শহরের পরিস্থিতি একটা পক্ষের অনুকূলের ভেতর রাখাই। তাই অনিষ্ট উচ্ছেদের জন্য রিডলারের পরিচয় দরকার পড়ে। কিন্তু যখন সব মানুষই রিডলারের মাস্কের ভেতর একাকার হয়ে যায়, একজনের চেহারা উন্মোচন হইলেও হাজার হাজার মানুষ মাস্ক পরে রাজনীতি, করপোরেট, প্রশাসনের সুন্দর চেহারা ‘আনমাস্ক’ করার লড়াইয়ে নামে। সেখানে আর ব্যক্তিবিশেষ থাকে না। ন্যায়-নায্যতার ধারণা ব্যক্তিবিশেষ নয়, সেটা না দেখে রং, বর্ণ বা টাকা। আসলেই। সেখানেই এক সত্য ‘আনমাস্ক’ হলেও মানুষ পরিচয়টা ‘মাস্কের’ মধ্যে ঢুকে পড়ে, যেখানে সবাই এক।

তাইলে ব্যাটম্যান বা রিডলার দুজনেই তো সত্যের ‘আনমাস্ক’ চাইতেছে; এই গল্পে নায়ক কে? রিডলার নাকি ব্যাটম্যান। তাদের একই মুদ্রার দুই পিঠ আকারেই দেখানো হয়। দুজনের লড়াই গোথাম সিটির দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। যেটা রিডলারও মনে করে। একজন খুবই সহিংস, একের পর এক হত্যাকাণ্ডের পর জনগণরে নিয়ে অভ্যুত্থানে নামে। রিডলার বুঝতে পারে, এই পচে যাওয়া শহরটারে একদম ভেতর থেকে বদলাইতে হবে। এর জন্য পুরোনো কাঠামো ও নেতৃত্ব ধ্বংস করে দিতে হবে। এ কারণে শুরু থেকে একের পর এক হত্যা ও তাদের পাপ উন্মোচনের মাধ্যমে দেখানো হয়, এই শহরটা নিয়ন্ত্রণ করছে আসলে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা। মেয়র প্রার্থীরাও তার বিপরীত না। তাইলে গরিব লোকগুলারে নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে।

কিন্তু আমাদের নায়ক ব্যাটম্যান গোথামের সংস্কার কীভাবে চায়? যতদূর মনে হয়, অদ্ভুতভাবেই সে কাঠামোগত দুঃশাসনের ব্যাপারটা বোঝে না। বরং একে ব্যক্তির অপরাধ হিসেবেই দেখে। যেহেতু সে করপোরেটের দাতা হওয়ার পক্ষে। ফলে ব্যক্তির বিচার বা পরিশোধনের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তন সম্ভব। এখন প্রশ্ন হলো, করপোরেটদের ওপর সমাজের কল্যাণের দায়িত্ব দেওয়া এই শহরের ন্যায়ের প্রশ্নটি আসলে ব্যক্তির নাকি কাঠামোর। অদ্ভুত মনে হলেও ব্যাটম্যাট সেটা বুঝতে যেন ব্যর্থ। ইভেন, ডিসি কমিক সিরিজের সবচেয়ে দুর্বল সিনেমাগুলোর একটা ‘ডন অব জাস্টিস’ও ব্যাটম্যানের এমন বিভ্রান্তির ওপর দাঁড়ায়া আছে।

সেই বিভ্রান্তির সঙ্গে পুরো সিনেমা আন্ধার হওয়ার একটা অনুকূল পরিবেশ আছে। এটা মূলত ব্যাটম্যানের বিভ্রান্ত হওয়ার আন্ধার, এবং তার অনুসারী দর্শকদেরও। ছবির শেষে রিডলারের লাগানো বোমাগুলো গোথামের চারপাশের সামুদ্রিক সুরক্ষা দেওয়া ধ্বংস করে এবং শহরকে প্লাবিত করে। এই ধ্বংস সবকিছু বদলায়া দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু এই আন্ধার গোথাম সিটিতে ব্যাটম্যান মশাল হাতে উদ্ধার করতে নামে। ব্যাটম্যান এটারে আশাবাদ হিসেবেই দেখে, গোথাম যেন এই আলো দিয়ে আলোকিত হবে। তিন ঘণ্টা আন্ধারে থাকার পর দর্শক এবার আশ্বস্ত হয়। ফোন কোম্পানির ভাষায় ‘আলো আসবে’।

সুপারহিরো সিনেমা পশ্চিমা সভ্যতার বাস্তবতার মধ্যে সৃষ্ট। বিশেষ করে বিশ্বযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক হতাশার মাঝে স্বস্তি এবং বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের নায্যতা এখানে আছে। আলোকিত করার যুক্তি আছে। সেখানে ডিসির ব্যাটম্যান একটু আলাদা এ কারণে যে এর ভিলেনগুলো সমাজের অনায্যরূপগুলো ধরতে পারে নায়ক-ভিলেনের মাঝের ধূসররেখা ঘুচিয়ে দিতে যায় যেন। এ কারণে নিষ্ঠুর জোকার বা রিডলারসহ অপর অপর ভিলেন, অ্যান্টিহিরো মনোবিকারকে সার্বিক একটা রূপ দেয়। এই মনোবিকার সামষ্টিক। এখানে ব্যাটম্যানের গল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে মানসিক হাসপাতাল। তো, সেখানে দাঁড়ায়া রিভসের এই রিবুট সমসাময়িক বাস্তবতায় প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক অবিশ্বাস সমাজের মধ্যে কী কী বিকার জন্ম দেয় তারে চিহ্নিত করে। আবার একই সঙ্গে উচ্চাভিলাষী সুপারহিরো রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিপরীতে গিয়ে ‘সুপারহিরো ইন্ডাস্ট্রি’কে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের জায়গা নিয়ে যায়। অর্থাৎ, সুপারহিরো দিয়ে বিপ্লব হবে না, রক্ত-মাংসের মানুষই দরকার।

আরও পড়ুন: বুড়ো লোগানের মৃত্যুর আগে

যাই হোক, এই লেখার প্রেক্ষিতে মনে হইতে পারে ছবি নায়ক ব্যাটম্যানের চেয়ে ভিলেন রিডলারের প্রতি আমাদের পক্ষপাত হইতেছে। জনতার বিচার বা মব জাস্টিসের প্রেমেও আমরা পড়তেছি। যেমন; এখন বাংলাদেশের অনেক মানুষ আর বিচার চায় না, আবার অনেক মানুষ গণপিটুনি, ক্রয়ফায়ার বা নিপীড়নে সম্মতি দিয়ে দেশ উদ্ধার করতে চায়। এর আগে ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ব্যাটম্যান’ ট্রিলজিতে আমরা মব জাস্টিসের ব্যাপারটা খেয়াল করছি।

এখানে জাস্ট খেপে যাওয়া মানুষরে বিভ্রান্ত বলে পার পাওয়ার উপায় নাই। এটা ঘা ঘা খাইতে খাইতে সৃষ্ট একটা মনোবিকার। বিদ্যমান অনাচারকে রুখতে সমাজকে পাল্টাতেই তাদের রাস্তায় নামা, কিন্তু অভিমুখটা ব্যর্থ আরকি, তাদের নেতৃত্বকেও মনোবিকার সরায়া পজিটিভলি আঁকতে ব্যর্থ। আমরা যেহেতু একটা পরিবর্তন চাই, তার সঙ্গে এই মবের ঘটনার পার্থক্য তো আছে। রাজনৈতিক বা যেকোনো নৈতিক জায়গা থেকে; এমনকি ‘ভালোত্ব’-এর দাবি নিয়েও মবকে তো সমর্থন করা যায় না। সম্ভবত এই ফারাকের সুযোগ নিয়ে মন্দের ভালো হিসেবে ব্যাটম্যানকে আমরা সমর্থন করতে পারি। এমন একটা আশা নিয়ে, মন্দের ভালো নিয়ে ব্যাটম্যানকে দেখতে পারা মানে তাকে হারায়ে দেওয়া। এমন হইলে তো আমরা নায়কদের কাছে রাজনৈতিকভাবে পরিবর্তনের আশা দেখছি না। যেটা গোথাম সিটিতে যেমন দেখি না, বাংলাদেশেও না। সে ক্ষেত্রে সুপারহিরো না থাকায় তো একটা সুবিধার।

তো, হায় হায় ব্যাটম্যান উড়ে যাচ্ছে। যে কিনা উড়তে পারে না। কিন্তু সমাজ যারা পাল্টাবে তারা উড়াইয়া দিতেছে আরকি। কী অদ্ভুত!

Comments

comments