যে মুভিকে গার্মেন্টস মালিকদের ছাড়পত্র নিতে হয়েছিলো

মূল ভাবনা ও প্রযোজনা: মো. নাজিম উদ্দিন চেয়ারম্যান
গল্প: জামান আখতার।
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: জি সরকার।
সংগীত: ইমন সাহা।
অভিনয়ে: পপি, ইমন, আহমেদ শরীফ, প্রবীর মিত্র, কাবিলা প্রমুখ।
মুক্তি: ৭ অক্টোবর ২০১১।

সংবাদপত্র মারফত জানা গেলো প্রযোজক মো. নাজিম উদ্দিন চেয়ারম্যান ‘বিদ্রোহী গার্মেন্টেস কন্যা’ নামে মুভি বানাচ্ছেন। বছর পেরিয়ে সেই মুভি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিও পেল। কিন্তু ‘বিদ্রোহী গার্মেন্টেস কন্যা’ থেকে ‘বিদ্রোহী’ শব্দটি বাদ গেল। কি সেই ঘটনা, যার কারণে গার্মেন্টেস কন্যা’র বিদ্রোহ খামোশ হয়ে গেল?।

গার্মেন্টস কন্যা মুভিটি দেখেছিলাম ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে। এ লেখাটি সে সময় রাজনৈতিক.কম-এ ছাপা হওয়া রিভিউয়ের ঈষৎ পরিবর্তিতরূপ।

মুভিটির নির্মাণ ঘোষণা প্রকাশের পরপরই তথ্যমন্ত্রনালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রাণালয়ের নজরে পড়ে। তারা গল্প নিয়ে আপত্তি জানায়। ছয় মাস কাজ বন্ধ রেখে নতুন গল্প নিয়ে কাজ শুরু করতে হয়।এরপর বিজিএমইএ’র (বাংলাদেশে গার্মেন্টেস ম্যানুফেকচারারস এন্ড এক্সপোর্টস এসোসিয়েশন)অনুমতির প্রয়োজন পড়ে। ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিজিএমইএ’র সহসভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ১২ জন প্রতিনিধি নিয়ে ছবিটি দেখেন। গার্মেন্টেস শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টিকারী কিছু না থাকায় তাদের অনুমোদনে সে বছর সাত অক্টোবর মুভিটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়।

এই মুভিতে বলা হচ্ছে ‘সুন্দরী মেয়েরা গার্মেন্টেসের লক্ষী’। এই লক্ষীর কারবার নিছক বিনোদনমূলক কলা নয়। সম্মতি উৎপাদনের কলাও বটে। শুধু তাই নয়, দায় মুক্তিই এর প্রধান লক্ষ্য। সাম্প্রতিক নিশ্চিন্তপুর ঘটনায়ও দায় মুক্তি বিরল নয়।

মো. নাজিম উদ্দিন চেয়ারম্যানের মূল ভাবনা থেকে গল্প লিখেছেন জামান আখতার। চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ছিলেন জি সরকার। বাংলা মুভির প্রথা মতো বি এ পাশ সোনিয়ার (পপি)  বাবা (প্রবীর মিত্র) নীতিবান স্কুল শিক্ষক। ছোট দুই ভাই-বোন আর অসুস্থ্য বাবাকে নিয়ে সোনিয়া’র সংসার। বাবার ঔষুধের টাকা নাই। ভাতের বদলে খেতে হচ্ছে আলু সিদ্ধ। গ্রামের মেম্বারের কাছে চাকুরী চাইলে বলেন, সব হবে। তার আগে সোনিয়াকে তার প্রস্তাবে সায় দিতে হবে। এইসব শুনে তার বাবা মারা যান। বাবার এক সহকর্মীর পরামর্শে ঢাকায় গার্মেন্টেস কর্মী বান্ধবীর (নিশু) বাসায় আশ্রয় নেয় সোনিয়া। ঝকঝকে তকতকে এলাকাটা বাংলা চলচ্চিত্রের আর সব বস্তির মতো অভাব অনটনের আখড়া নয়। এটি গার্মেন্টেস বস্তি, ১৫০০ টাকায় ভাড়ার রুমে ১১ জন সদস্যের পরিবারের একসাথে ঘুমানোর জায়গা নয়।

এই মুভির ঝকঝকে বস্তি, মালিক এবং গার্মেন্টস দর্শকদের মনও কেড়েছে।  মুক্তির পয়েলা সপ্তাহের শেষদিন টিকেটের গায়ের মূল্যের চেয়ে পনের টাকা (কমপক্ষে) বেশি দিয়ে দুপুর তিনটার শো’তে দর্শকের অভাব হলো না। দর্শকের বড় অংশই গার্মেন্টেস কর্মী। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শক নারী দর্শক। হলের মালিকদের দাবি মতে, তখন পর্যন্ত বছরের সবচেয়ে ব্যবসা সফল মুভি ‘গার্মেন্টস কন্যা’। প্রথম দিনেই আয় ১০ লাখ টাকার দাপটে দ্বিতীয় সপ্তাহে বাড়ে প্রিন্ট সংখ্যা।

সোনিয়া শহরে নানান জায়গায় কাজের খোঁজ করে। ‘কর্ম খালি নাই’ নোটিশে ত্যক্ত হয়ে গার্মেন্টেসে বোতাম লাগানোর কাজে নেয়। বেতন দুই হাজার টাকা। সেখানকার ম্যানেজার (অমল বোস) তার উপর চড়াও হলে কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়। সাথে তার আশ্রয়দাতা বান্ধবীও। এবার তারা কাজ নেয় চৌধুরী গ্রুপের গার্মেন্টেসে। ভালো বেতন ও কাজের পরিবেশের জন্য এই গার্মেন্টেসের সুনাম আছে।এখানেও ম্যানেজার (কাবিলা) খারাপ মানুষ। তার সাথে যোগসাজস আছে চাঁদাবাজ মিশা সওদাগরের। গার্মেন্টেসের জুট ব্যবসা থেকে নানা কিছু তার নিয়ন্ত্রণে থাকে। সোনিয়া ম্যানজারের হাতে আক্রান্ত হলে অন্যরা এসে তাকে উদ্ধার করে। এবার আর চাকুরী ছাড়া নয়, ম্যানেজারের বিচারের দাবিতে গার্মেন্টেসের শ্রমিক’রা সবাই আন্দোলনে নামে। এই গার্মেন্টেসের তদারকিতে আছেন ইমন। ইতিমধ্যে দর্শক দেখেছে সোনিয়ার জন্য যার নাওয়া-খাওয়া হারাম হয়ে গেছে। ইমন শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়। ম্যানেজারকে দারোয়ান বানিয়ে সোনিয়াকে ম্যানেজার বানানো হয়। তারপর তার মনের কথা সোনিয়া জানায়।

বি এ পাশ গার্মেন্টেস কন্যা এটা কতটা বাস্তব সম্মত অথবা গার্মেন্টেসে কাজ করা কতভাগ নারী কর্মী প্রাথমিক শিক্ষাটুকুর সুযোগ পান! আবার যে গার্মেন্টেস কন্যাকে যদি মালিকের পছন্দ হয়, তাকে যেনতেন হলে চলবে না। জাতে তুলতে হলে তাকে শিক্ষিত হতে হবে। স্মার্ট ও বুদ্ধিমতী হতে হবে। পুরুষতান্ত্রিকতা ও শ্রেণী সচেতনতা ছাড়া প্রেমও অসম্ভব। বুঝা যাচ্ছে প্রেম দিয়ে সবকিছু জয় করা যায় না। আগের কালের বেদেনী ও রাজপুত্রের প্রেম কাহিনীগুলোতেও দেখা যেত, যে বেদেনী সেও কিনা এককালে রাজকন্যা ছিলো। সেই শ্রেণী সচেতনতা থেকে এই মুভিও মুক্ত নয়। বুঝা যাচ্ছে যে মানদন্ড বজায় রেখে কাহিনী লেখা হয়, সেখানে এর উপযোগিতা আছে।

এবার দেখা যাক এই মুভির চরিত্রগুলোকে কিভাবে দেখানো হয়েছে। শ্রমিকদের বড় অংশ ভালো। তারা কোন রা করে না। তাদের এক অংশ কাপড়, সুতা, বোতাম ইত্যাদি চুরি করে। এদেরজন্যই কারখানায় তালা দিতে হয়। যদিও এ মুভিতে তালার ব্যবহার নাই। কিন্তু বাস্তবে শ্রমিক পুড়ে ছাই হবে- তালা খোলা হবে না নীতিই বহাল। শ্রমিকদের একটা অংশ অন্যের ষড়যন্ত্রে কান দেয়। তারা না জেনে না বুঝে সৎ হৃদয়ের মালিকের বিরুদ্ধাচরণ করে।

গার্মেন্টসের সমস্যা মানে কামলায় কামলায় কামড়াকামড়ি। যেমন- ম্যানেজার মানে দুশ্চরিত্র। তারা শ্রমিকের হক্ব (বেতন, বোনাস পর্যন্ত) মেরে দেয়। গার্মেন্টেস শিল্পের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে হাত মেলায়। অন্যদিকে, মালিক সবসময় শ্রমিকদের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে চান। তারা চাঁদাবাজিদের হাতে অসহায়। এমনকি মালিক হয়েও কারখানায় কি ঘটছে তা নিয়ে বেখবর। সহজ-সরল মানুষ। শ্রমিকদের প্রতি ক্ষোভ নাই, আছে বিশেষ কারো প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ। যেমন মালিকের সাথে শ্রমিকের প্রেম নাজায়েজ।

গার্মেন্টেস নিয়ে আরো দুটি উল্লেখযোগ্য মুভি হলো শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘পালাবি কোথায়’ (১৯৯৪), এবং কাজী হায়াতের ‘শ্রমিক নেতা’(২০০৯)। প্রথম মুভিটি প্রেক্ষাগৃহে তেমন একটা না চললেও টেলিভিশন মারফত দর্শকদের বেশ বিনোদিত করেছিল। পরের মুভিটি হিট হয়েছিল। বলাবাহুল্য প্রথমটির অর্থে দ্বিতীয়টিতে বিনোদনের মাসালা সরবারহ করে নাই। তবে এই দুটি মুভির ফর্মুলা একই। সেই পথেই হেটেছে হালের গামেন্টেস কন্যা। এই মুভিয় বাড়তি হলো ম্যানেজারের সাথে  চাঁদাবাজদের যোগসাজশ।

ইমনের বাবা (আহমেদ শরীফ) যদি মালিক হিসেবে সৎ ও আপোষহীন, তিনি প্রেমের কারণে (বামন হয়ে চাদঁ ছোয়ার স্বপ্ন) সোনিয়াকে চাকুরীচ্যুত করে, চুরির দায়ে জেলে দেয়। তিনি একই সাথে চাঁদা না দিয়ে খেপিয়ে তুলেন মিশা সওদাগরকে। সোনিয়া জেলে থাকা অবস্থায় বস্তিতে আগুন দিলে তার ছোট দুই ভাই-বোন মারা যায়। গার্মেন্টেস কন্যা প্রতিশোধ নিতে একটা বাহিনী গড়ে তোলে।অদ্ভুত পোশাক, অস্ত্র আর হোন্ডা নিয়ে হান্টারওয়ালী টাইপ অভিযান। তারা চাঁদাবাজদের টাকা নিয়ে গরীবদের বিলি করে। গার্মেন্টেস শিল্পের বিরুদ্ধে যেখানে ষড়যন্ত্র সেখানে ছুটে যায় সোনিয়ার সশস্ত্র বাহিনী। গার্মেন্টসের ভেতর সব ফিটফাট, ষড়যন্ত্র বাইরে।

এই মুভির বিক্ষোভগুলো অসংগঠিত। মুহুর্তে নেতা গজিয়ে উঠছে। তাদের সুদূরপ্রসারী কোন লক্ষ্যও নাই। তাহলে সেই বিক্ষোভ নিভানোও সহজ। গার্মেন্টেস কন্যার প্রতিশোধ মালিকের বিরুদ্ধে নয়। ম্যানেজার ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে। মুভির শেষে সোনিয়া চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়। ‘মালিক-শ্রমিক ভাই ভাই’র জয় হয়। গার্মেন্টেস কন্যারা স্বীকার করে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য হলেও অস্ত্র হাতে নেয়া ভালো নয়। প্রমানের অভাবে ছাড়াও পায়। ইমনের বাবা সোনিয়াকে মেনে নেন। এই হলো গার্মেন্টেস কন্যা’র কাহিনী। ‘মালিক-শ্রমিক ভাই ভাই’ এই সম্মতি উৎপাদনে মুভিটির জুরি নাই। দর্শকের হাততালি ও ব্যবসা তা-ই নির্দেশ করছে।

বাস্তবে শ্রমিক অসন্তোষের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- মজুরি না বাড়া, সময়মতো বেতন এবং ওভারটাইম ভাতা না পাওয়া, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্রাচুইটি না থাকা, শ্রমিকদের সাথে দুর্ব্যবহার, যে কোনো অজুহাতে ছাঁটাই ও শোকজ ইত্যাদির মাধ্যমে হয়রানী,শ্রম আইন ও ট্রেড ইউনিয়ন না থাকা ইত্যাদি। বাংলাদেশে নায্য মজুরীর দাবেতই নানা সময়ে শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা গেছে। যেখানে হত্যা-হামলা-মামলা-গুমও ঘটেছে। এইসব কিছুই গার্মেন্টস কন্যাকে স্পর্শ করে না।

হক্ব কথা। এই সুন্দরী গার্মেন্টস কন্যা যদি লক্ষী না হয়, তবে কে হবে!

 > ব্যবহৃত ফটো: ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহকৃত।

Comments

comments

8 thoughts on “যে মুভিকে গার্মেন্টস মালিকদের ছাড়পত্র নিতে হয়েছিলো

  1. লেখা ভালো লেগেছে।
    সিনেমার ছাড়পত্র নিতে বিজিএমইএ’র অনুমোদন কেন দরকার পড়ল, বিষয়টা বুঝলাম না।

    বাংলা সিনেমার প্রথাগত অসম প্রেমের গল্প এই সিনেমাতেও আছে। বিএ পাস মেয়ে সাধারণ শ্রমিকের কাজ করবে- এটা হাস্যকর। পরবর্তীতে যেন তাকে ম্যানেজার বানালে খারাপ দেখা না যায়, সেজন্যেই কি এরকম করা হয়েছে?

      • সেটা সিনেমা মুক্তি পাবার পর প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারত তারা। কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতির গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ে যে বিজিএমইএ’র এরকম প্রকাশ্য আধিপত্য আছে, তা জানতাম না।

        • ক্ষমতা শিল্প সংস্কৃতিকে সবসময় নিজের পক্ষেই রাখতে চায়।

          আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টেসের মালিক এখন শ্রমিক পোড়ানোর দায় চাপাচ্ছেন কর্মচারীদের উপর। এ সিনেমা তো তাই বলে। মালিক কোন অন্যায়ের সাথে যুক্ত না।

  2. আমি গার্মেন্টেসে প্রায় ৮ বছর কাজ করেছি। বলার কিছু দেখি না। রাষ্ট্রের আর সব কিছুর মতই গার্মেন্টেসেও অনিয়মের আখড়া।

Comments are closed.