পরম

এক.

‘খাজাগো অসীম ক্ষমতা তোমার, দান করেছেন পাকওয়ার, গুছাইয়া দাও মনের আঁধার তোমায় যেন দেখতে পাই। খাজা তোমার বাজার প্রেম বাজারে আমি কাঙ্গাল যেতে চাই…’– আবদুল করিমের গান ।

খাজার (মঈনুদ্দীন চিশতি) ক্ষমতা অসীম। মানুষ খাজার কাছে কতই না আর্জি জানায়। খাজা কি সেই আর্জি পূরণের ক্ষমতা রাখেন! রাখেন। তবে সে ক্ষমতা তার নিজের নয়। এই ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়েছে। খাজাকে অন্য কারো বরাতে সেই ক্ষমতা প্রকাশ করতে হয়। খাজাও কারো দয়ার কাঙ্গাল। কার? যাকে কারো বরাত দিতে হয় না। যিনি সব ক্ষমতার উৎস। যিনি পরম। তিনি আল্লাহ।

দুই.

দার্শনিক পরমের ধারণাকে চিন্তার অনুসিদ্ধান্ত থেকে সহজাত বলা যায়। চিন্তার পরম যা সহসা মানদণ্ড আকারে হাজির তার সাথে ধর্মের পরমের পার্থক্য আছে। এটি মানুষের চিন্তার একটি পূর্ণতার ধারণা। এরিস্টটলের ধ্রুপদী দিক থেকে ‘যা হচ্ছে’।

দার্শনিকতা মানব চিন্তার স্বাধীন ক্রিয়াপরতা। সে চিন্তার পরম অস্তিবাচক নয়। কিন্তু জগতকে অনুধাবণের ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ। আপেক্ষিতা ও বিশেষের মধ্য থেকে উদ্ধারের একটি অস্ত্র। তার গুনাগুন বিচার করে বস্তু বা কোন আচরণের খাঁটিত্ব মাপা যায়। অথবা ধারণা আকারে তাকে বিচার করা যায়। অথবা অসীমতার চক্রকদোষ কাটাতে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নির্ধারণে তার গুরুত্ব আছে। এই পরমের চিন্তার কেন্দ্রে মানুষই দাড়িয়ে থাকে। সেখানে পরমের কর্তারূপে কখনো মানুষ একাকার। কিন্তু জগতের সবকিছু মানুষ ঠিক করে না। ফলে সে পরম বাস্তব কোন অস্তিত্বকে এই অর্থে সম্ভব করে- যা আপাত এবং বিচ্ছিন্ন। এরমধ্যে কোন সমগ্র (কল্পিত নয়) সাড়া দেয়ার বিষয় নাই। অর্থ্যাৎ, এ পরম চিন্তার আগে অস্তিত্ববান নয়। বরং চিন্তা তার সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে তাকে কল্পনা করে নেয়। এই চিন্তার সামনে মানুষ খাড়া হয়ে থাকে।

যে পরম বাস্তব অস্তিত্বকে এককে সম্ভব করে তোলে তা শুধুমাত্র চিন্তা নয়- জগতের নানা ঘটনাবলী, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যমুখী (আপাত বিচ্ছিন্ন) কর্মের মধ্য দিয়ে হাজির। যে নিরংকুশ, কারো মুখাপেক্ষী নয়। কিন্তু সকল কিছুর বরাত সে। সে পরম নিজের নাম নিজে দিয়েছেন। তাকে কেউ নাম দেয় না। তিনি আল্লাহ। তাকে ধারণা বা অনুমান করে নেয়া মূল বিষয় নয়, মূল বিষয় হলো সে আপনার মধ্যেই নিজেরেই হাজির করে। এ হাজিরানায় স্বাক্ষ্য দিতে হয়। এমনকি আমার নিজের অস্তিবাচক স্বাক্ষ্য পরোক্ষভাবে তার সামনে নিজেকে হাজির করা।

তিন.

পরমকে আস্তিক বা নাস্তিক সিদ্ধান্ত নির্ভর বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের সাথে যুক্ত করব না। কারণ যুক্তির গুরুত্ব অস্বীকার না করেই বলা যায় যুক্তি নির্ভর আলোচনা মানুষের সীমাবদ্ধতাকেই চিহ্নিত করে। আস্তিক্য বা নাস্তিক্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। যা মানুষের সম্ভাবনাকেই সীমায়িত করে। পরমের ধারণা কোন সীমায়িত বিষয় নয়। পরমের মধ্যে নিজেকে নিশ্চিত করতে চাইলে তার সীমাহীনতার ভেতর দিয়ে নিজেকে উপলব্দি করতে হবে। এ উপলব্দি স্থির কোন বিষয় নয়, বরং নিজেকে নানান শর্ত ভেঙ্গে প্রকাশ করা। চুড়ান্ত মুহুর্তে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করতে তার সামনে হাজির থাকা- এটাই পরমের উপলব্দি। মানুষের গোষ্টীগত বা সমাজে নির্মিত পরিচয়ের বাইরে আরেকটি পরিচয় হলো তার আত্মা হলো আল্লাহর নির্দেশ। সে আত্মা অমর, ধারক দেহ নশ্বর। এই নির্দেশই পরমের নির্দশন। মানুষ যখন এই নির্দেশকে বুঝতে পারে- সে তখন নিজেকে চিনতে পারে। নিজেতে নিজে পরিচ্ছন্ন নয়। সে মুহুর্তের স্বাক্ষ্য পরিপূর্ণ স্বাক্ষ্য। পরমকে মানুষ বানায় না, মানুষ তার সামনে স্বাক্ষ্য দেয়।

চার.

দর্শনের পরম আগে থেকে হাজির কিছু নয়, এটি চিন্তা বা মতবাদ সংশ্লিষ্ট। যুক্তি পরম্পরায় সে হাজির হয়। ধর্ম এই দিক থেকে আলাদা। ধর্ম মতবাদ নয়। কারণ এটা কোন মতের উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে পরমের দাবির উপর।

পাঁচ.

ধর্ম মানুষকে পরমের সাথে সম্পর্কিত করে। ধর্মের পরম মানুষের চিন্তা সাথে যুক্ত কিন্তু চিন্তা আকারে নয়- বরং জগত সম্পর্কের ভেতর দিয়ে তার আরজ পরিষ্কার করতে হয়। ফলে পরম যুক্তির অনুকূলে নয়। এর সাথে পরমের ঘোষণা জড়িত আছে। যে ঘোষণা কারো মাধ্যমে আল্লাহর বাণীরূপে আবির্ভূত হয়। যুক্তি বুদ্ধি বা অনুধ্যান দ্বারা আল্লাহর ধারণায় উপনীত হলেই চলে না- বরং গুরুরূপে সে শিক্ষা কারো কাছ থেকে পেতে হয়। নবী বা পয়গম্বর পরমের বাণী বহন করেন। জ্ঞানীরা পরমের বাণী ব্যাখ্যা করেন। আবার সেই ব্যাখ্যার অনুপ্রেরণা পরমের বাণীর অন্তর্নিহিত দ্যোতনা থেকে আসে। যুক্তি-বুদ্ধি দ্বারা প্রাপ্ত পরম যুক্তির মধ্যেই বন্দী থাকে। সে যুক্তির ভারে ক্লান্ত হওয়া পরম মানব ইতিহাসে বিরল নয়। সে পরম অহরহ তর্কের বিষয়। সে পরম হাটে মাঠে ঘাটে অহরহ দোল খায়। কিন্তু তার অনুধাবণ হাসিল হয় না।

ছয়.

ধর্ম সৃষ্টিতত্ত্বে গুরুত্ব দেয়। যে ধর্ম মানুষের উৎপত্তি, কর্ম ও অভিমুখী দিতে পারে না- ধর্ম হিসেবে তার কোন মূল্য নাই। তা নামে বেনামে দার্শনিক তৎপরতার বেশি নয়। মানুষকে কেন্দ্রে বসাতে গিয়ে তা সমগ্র সৃষ্টিকে অবহেলা করে। এক পরম থেকে মাখলুকাতের সৃষ্টি এবং তার কাছে ফিরে যাওয়ার উপলব্দি তাৎপর্যপূর্ণ। একইসাথে দুনিয়ার মানুষের একসাথ হওয়া একই পরমের নির্দেশ বহনের নিশানা। এখানে কোন বিমূর্ত মানুষের ধারণা নাই- যে বিমূর্ত খাড়া হলে মানুষ এককাতারে শামিল হবে। ফলে পরমকে উপলব্দিই হলো মানুষকে এককাতারে শামিল করার উপলক্ষ্য। এটা যদি সম্ভব হয়, তবে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের যে ধারণা সেটা দূর হবে। কিন্তু ইতিহাসে এটি কিভাবে ঘটবে?

সাত.

পরমকে তার গুণ দ্বারা আমরা বুঝি। গুনবাচক নামে তাকে ডাকি। তার গুনাগুন ঐতিহাসিক সকল শৃংখলকে ভেঙ্গে দেয়। শর্তহীন। তাকে সত্য নামে ডাকা যায়। এ পরম কোন কিছুর সাথে তুলনায় নয়- বরং পরমের গুনার্জনের  যে পরমের কাছ থেকে সে এসেছে আবার সে পরমে ফিরে যাবে। মানুষের দুনিয়ায় দ্বীন অর্থে তা লেনা-দেনার সম্পর্ক। আল্লাহ আমাদের মাঝে তার রুহ ফুঁকে দিয়ে ঋণী করে রেখেছেন। এই ঋণী মহব্বতের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক আসলে পরমের প্রতি তার আনুগত্যকে উপলব্দি করা। এই উপলব্দি শুধুমাত্র অন্তরের জয়োগান জাতীয় কিছু নয়। তার আছে কথা ও কাজের দায়। এরমধ্য দিয়ে তা পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠে। একই সাথে এই উপলব্দি পরিপূর্ণ হবে না যদি তা সামষ্টিক না হয়।

আট.

যদি সামষ্টিক প্রেক্ষিতে হয়, তবে আমরা দেখি মানুষে মানুষে নানা ধর্ম, বর্ণ বা চিহ্নের ভেদ। তাহলে পরমের উপলব্দির স্থানটি কোন নির্দিষ্ট সময় বা গোষ্ঠীর সীমার মধ্যে কি করে সম্ভব সেটা অবোধ্য। যদি এই হয় তবে মানুষ তার লক্ষ্যের সন্তুষ্টির জন্য সবসময় পরমের সাথে সম্পর্ক করে। যেমন- আল্লাহ শুধু দয়ালু নয় পরম দয়ালু, শুধু ক্ষমাশীল নন পরম ক্ষমাশীল। একইভাবে সকল প্রশংসা শুধুমাত্র তার। এটা পরিপূর্ণ আনুগত্যের সাথে সম্পর্কিত। ফলে একজন ঈমানদার কোন মানুষ এমনকি ধারণার আনুগত্য করতে পারে না।

কিন্তু সামষ্টিক উপলব্দির আগে এটি সাময়িক প্রচেষ্টা মাত্র। সেক্ষেত্রে সামষ্টিক চিন্তার ক্ষেত্রে মানুষের অনুসন্ধানের সাথে সেটা সম্পর্কিত। কোন নিদিষ্ট বর্ণ, গ্রোত্রে এমনকি নির্দিষ্ট ধর্মের সবাই পরমকে উপলব্দি করতে পারে না। তাহলে সেটা কিভাবে সম্ভব। এ প্রশ্ন তোলা থাকল।

নয়.

ইসলামে আনুগত্যের দিক গুরুত্বপূর্ণ। আনুগত্যের দিক থেকে ইসলাম বা কুরানের কোন কিছুকে আলাদা আলাদাভাবে না বুঝে তাওহীদের কনসেপ্ট থেকে পরিপূর্ণ আকারে অনুধাবণের জরুরত আছে। যেমন- আনুগত্য বলতে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য। জগতের কোন কিছুর প্রতি মানুষের আনুগত্য হতে পারে না। সে দিক থেকে শিরক বা পৌত্তলিকতার ধারণা ব্যাপক। পরমের দিকে যাত্রা মানে প্রতি মুহুর্তে শর্তহীন আনুগত্যের দিকে যাত্রা। অন্যদিকে জাগতিক যেকোন আনুগত্য লাভ-ক্ষতি এবং প্রশ্নের সাথে যুক্ত।

আমরা যখন বিস্মিত বা আনন্দিত হই আলহামদুলিল্লাহ, মাশাল্লাহ বা সুবানাল্লাহ ব্যবহার করি। কোন ব্যক্তির কর্মকে সামনে রেখে প্রশংসা করলেও সকল প্রশংসার মালিকের প্রশংসাই করছি।

দশ.

শিরক কোন চিহ্নের মামলা নয়। জীবনব্যাপী অভিযাত্রায় শিরকমুক্ত হতে হয়।

এগারো.

মানুষকে শ্রেষ্ট বানিয়ে তোলা মানবকেন্দ্রিক চিন্তার মধ্যে কিছু ভ্রান্তি বিদ্যমান। এই কারণে মনে করা হয়- মানুষই শ্রেষ্ট। এটা প্রজাতিগত নির্বাচন হতে পারে যেখানে মানুষ আলাদা। কিন্তু আনুগত্যের শর্তে মানুষ জবাবদিহি করতে বাধ্য। তার রাসুল অন্যান্য মানুষের মতো। আল্লাহর দয়া ও ওহী তাকে মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ট করেছে। তার মতো করে কেউ আল্লাহকে উপলব্দি করতে পারেন নাই। তার স্বাক্ষ্যই মোমিনের স্বাক্ষ্যের নমুনা। তিনি নির্দেশদাতা নন, নির্দেশ বহনকারী।

বারো.

হাছন রাজায় কয়, আমি কিছু নয়রে, আমি কিছু নয়। অন্তরে বাহিরে দেখি, কেবল দয়াময়।

কৃতজ্ঞতা: নিয়াজ মাওলা ও শাহাদাৎ তৈয়ব।

Comments

comments

16 thoughts on “পরম

  1. ইচ্ছেশূন্য মানুষ ব্লগ আমি নিয়মিত দেখিনা। কোন লেখা ফেসবুকে শেয়ার করা হলে পড়ে ফেলি। আমার ভালোই লাগে। দার্শনিক চিন্তা ভাবনা আমার মধ্যে আসেনা। আমার ধারণা অনেকের মধ্যেই আসেনা। তাই সহজ ভাষায়, সহজ বিষয়ে লেখা গুলো পড়তে ভালো লাগে।
    এই লেখাটি সহজ ভাষাতে হলেও বিষয়টা মোটেই সহজ নয়। আমরা যদিও ‘পরম’ এর কথা বলি, আমাদের চারপাশে যা ঘটে তার সবই কিন্তু আপেক্ষিক। আমরাও আপেক্ষিকতাকেই বিশ্বাস করি। পরম আমাদের কাছে নিছক কাল্পনিক ভাবনা মা্ত্র।

    • হুমম। প্রথমেই ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য। মানুষ যদি নিজে নিজে পরম বানায়- তাতে কল্পনাকে জুড়ে দিতে পারি। আমার এইখানকার আলাপ হলো- ‘পরম তা-ই, যা নিজেকে পরম বলে দাবি করে’। সে দিকটাই আমার জন্য আপাতত গুরুত্বপূর্ণ। আরো কিছু কথা তো আছে…….. সেগুলো অন্য কোন সময়ের।

Comments are closed.