ভদ্রা পাড়ের দৃশ্যাবলী: অনুবাদ ও বিবাদ

অতপর তাহারা সুখে বসবাস করিতে লাগিল। তাতে কি এই অর্থ মিলে, তারা অনন্তকাল এমনভাবে থাকিবে। গল্পের শেষটা এমন হলে আমরা খুশি হই। অথবা এই ছবিটা মনের মধ্যে জারি রেখে আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচতে চাই। এর পেছনে কি অনুমান থাকে জীবনের জটিলতা আমরা কাটাতে চাই। কেউ বলতে পারেন, সুখের মধ্যে অন্য কোনো বিষয়-আশয় আছে আমরা তা ধরতে পারি না বলে, সে দৃশ্যটার মধ্যে আটকে থাকতে চাই। বিদ্যমানতার মধ্যে এমনই তো দেখি, সুখ বা অ-সুখ মানুষের বিবিধ কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে নিরন্তর বয়ে চলা কিছুর নাম। সে বয়ে চলার প্রতিধ্বনি যেন শুনতে পাই কামার আহমাদ সাইমন ও সারা আফরীনের চলচ্চিত্র ‘শুনতে কি পাও’-তে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

shunte ki pao

শুনতে পাই বলছি। তা মানি। শুনতে পাওয়া নিয়ে নানান ধরনের আলোচনা হতে পারে। যেমন মস্তিষ্ক বাইরের পরিবেশ থেকে সংকেত গ্রহণ করে আমাদের বোধগম্য করে অনুবাদ করে। তার ফলে আমরা কিছু একটা বুঝতে পারি। আবার এই অনুবাদের মধ্যে পূর্বানুমান, অভিজ্ঞতা বা তত্ত্ব যোগ হয়। সেদিক থেকে ‘শুনতে কি পাও’ কী নিয়ে হাজির হয়? অথবা একজন দর্শকের কাছে ছবিটি কীভাবে অনুদিত হয়?

চলচ্চিত্রের ভাগাভাগির দিক থেকে ‘শুনতে কি পাও’ ডকুমেন্টারি বা প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। ভাগাভাগি যাই হোক এ ছবি মানুষের অনিঃশেষ সংগ্রাম আর তার ভেতরকার আনন্দ-বেদনার উপাখ্যান। অনিঃশেষ এই অর্থে, মানুষের সংগ্রাম প্রজম্মের পর প্রজম্ম বাহিত। তার বিস্তৃতি এ ছবির প্রতিটি মুহুর্তে বর্তমান। ডকুমেন্টারির প্রথাগত ন্যারাশান ও নির্মাণের বাইরে এসে ফিকশনের রূপ ধারণ করেছে। এটা বিভ্রম বটে। পর্দার বিভ্রম না হোক ভাবনার বিভ্রম তো বটে। তবে বানানো কাহিনীর চেয়ে মানুষের দৈনন্দিনতা কত সুন্দর করে সিনেমাটিক ভিউতে আসতে পারে- তার ভালো উদাহরণ। আরও গুরুত্বপূ্র্ণ বিষয় হলো- একজনকে এই ছবিটি দেখার কথা বলেছিলাম। সে ডকুমেন্টারি ট্যাগিং না জেনেই ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়। মুগ্ধ হয়ে বলে দৃশ্যায়ন ও কাহিনী ভালো। কেমন কাট কাট- কোনো ইল্যুশন নাই। ইল্যুশন নিশ্চয় অপরিহার্য নয়- তবে মনের ভেতর ইল্যুশন থাকা বা না-থাকা নিশ্চয় দরকারি ব্যাপার। কিন্তু ফিকশন আকারে তার আবিষ্কারটা ইন্টারেস্টিং। তাই বলি ইল্যুশন কি নাই? অন্তত এই দ্বিধা রেখে গেছে এ ছবি।

ছবিতে উঠে এসেছে সাতক্ষীরার আইলা দুর্গত মানুষদের জীবন কাহিনী। তারা ঘর-বাড়ি হারিয়ে ঠাই নিয়েছেন ভেড়িবাঁধে। সেখান থেকে বাছাই কয়েকজনের জীবনের চালচিত্র উঠে এসেছে ৯০ মিনিটের দৈর্ঘ্যে। সেই সূত্রে এসেছে বাঁধে আশ্রয় নেওয়া অপরাপর মানুষ, তাদের ভাব-ভাষা, প্রকৃতি, জীবন সংগ্রাম, দেশীয় ও বিশ্ব রাজনীতি এবং বিনোদন, সর্বোপরি জীবনের নানান অনুসঙ্গ। জানা গেল, তারা ছিটকে পড়তে পারেন কিন্তু জীবনের আয়োজন কোনো অংশে হ্রস্ব নয়।

সাইমন এবং সারা আমাদের জানান, `ভদ্রা নদীর পাড়ে, সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে ছোট্ট একটা গ্রাম। নাম তার সুতারখালি। বিশাল আকাশের নিচে ছোট ছোট মানুষের রোজনামচা দেখে মনে পড়ে যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি আর এস এম সুলতানের ক্যানভাস… লোভে, ঔৎসুক্যে, ভালোবাসায় ক্যামেরা হাতে কাটিয়ে দিলাম সপ্তাহ, মাস, বছর, দুই, তিন… নাম কি শুনতে কি পাও।’ এই কাটিয়ে দেওয়াটা আমাদের জন্য লাভজনক। ছবি তো তাই বলে! একইসঙ্গে পাশাপাশি এসে দাড়ায় শহরবাসীর দেখার চোখ, কল্পনা ও রাজনৈতিক ধারণা। অবশ্য আত্মা, মন বা ধারণাবিহীন মানুষ কি মেলে! অথবা মানিক ও সুলতান মিলে কিসে! শহুরে মানুষের গ্রামীণ আত্মায় তারা বসবাস করেন। পুরোটায় কি করেন না কিছু উপচে পড়ে!

এই যে শুনতে কি পাও- সেই ডাকের ভেতর থেকে উঠে আসা মানুষ কারা? সৌমেন, রাখী ও রাহুল। রাখী পুরানা বাড়ির ছবি নিয়ে গল্প করে। যে ছবিতে প্যান্ট-শার্ট পরা মানুষেরা আছে। কেউ বাপ, কেউ বা ভাই। রাখী স্কুলে পড়ায়, কলেজে ভর্তি হবে, তার রুচি আছে, মানে শিক্ষার রুচি-দীক্ষার রুচি। ফলে বাধ ভেঙ্গে যাওয়ায় রাখীদের কী হয়- সেটা গুরুতর কৌতুহলের বিষয় হতে পারে। যার আছে, তার হারানোরও আছে। অপরদিকে যারা আগে থেকেই দিন আনে দিন খাই অবস্থায় ছিলো তাদের গতিক কী। তাদের জীবনও কী এমনভাবে জীবনের আয়োজনের কাঠামোকে হ্রস্ব না করেই চলে। তার টুকরো দৃশ্য হিসেবে বাঁধে কাজ করছে এমন কিছু নারীকে দেখা যায়। ‘হতদরিদ্র’ শব্দ নিয়ে দারুন কিছু সংলাপ আছে এ ছবিতে। শুনতে মজাদার হলেও এর মধ্যে মানবিক সম্পর্কের করুণ দিকটিই ফুটে উঠে। কিন্তু হতদরিদ্রের রুচি সঙ্গে আমরা খাপ খাওয়াতে পারি না। সে তুলনায় সৌমেন-রাখীর পরিবারটা দারুন। রুচিশীল গোছগাছ একটা ব্যাপার আছে। আমাদের স্বস্থি দেয়। অনুভূতিতে খুব একটা পীড়া দেয় না। বরং, তাদের মুহুর্তগুলোকে উপভোগ্য করে তোলে। এই অনুবাদ হয়তো ভালো লাগে। আবার হয়তো কাঁটার মতো খোঁচা দেয়। সেখানে যেটুকু আমার সাথে মিলে তার কতটুকু আমার দেখার ভেতরের জিনিস, আর কতটা দেখানোর। হয়তো দুইটায় এক।

Captureপীড়া না দেওয়া ও ফিকশানাইজ হয়ে উঠার ধারণা মিলবে আলোকিত বাংলাদেশ নামের সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকার থেকে। সেখানে প্রথমদিকের একটি দৃশ্য নিয়ে সাইমন বলেন, ‘তৃতীয় দিন যখন এই সিকোয়েন্সের শুটিং করি ও তখন আলতুফালতু গান গাচ্ছিল। আমি বললাম, এসব তুমি কি গাচ্ছো? একটু ভালো গান গাও। রোলিং-এর মধ্যেই বললাম। ফট করে সে ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ গাওয়া শুরু করলো। এরে আপনি কীভাবে ডকুমেন্টারির ছাঁচে ফেলবেন?’ যুতসই কথা। বানানোর তরিকা জানা গেল খানিক।

আপনি বলতে পারেন, আমরা হয়ত বঞ্চিত হলাম ভদ্রা নদীর পাড়ের মায়েরা বাচ্চাদের রাতের বেলায় কী গান শুনান সেটা জানা থেকে। ফিকশনের টাইপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন জাগে ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ গাইলে দৃশ্য ওকে হয় কেন? এটা কি কোনো সংস্কৃতি এবং তার সঙ্গে তৈরি হওয়া অপরাপর বিষয়ের রুচিগত দাবি নয়। এভাবে কি বাইরে সংকেত পূর্বানুমান নিয়ে ব্যাখ্যা হয়। নাকি পূর্বানুমানও সংকেত আরোপ করে। হতে পারে তার তলে হারিয়ে যায় ভদ্রা তীরের গান ও গানের সুর। দেখা মেলে নিজেদের পরিচিত কথা ও সুর। স্বস্থি তো মিলে। এই তো আমাদেরই ঘরের কথা। তাদের সঙ্গে প্রেমে মজতে বাধা কোথায় আর! এই ছবিতে নদী নিয়ে একটা গান আছে। গানটা কোন অঞ্চলের আমার অবশ্য জানা নাই। তবে গানটা চমৎকার। দৃশ্যায়নও চমৎকার।

প্রথাগত ছবির মতো আছে নানান বাঁক। তবে মূল বিষয় হলো নদীতে বাঁধ দেওয়া হবে কিনা- তা নিয়ে দোলাচলে চলা জীবন ও বাড়ি ফেরার তাড়না। সংসারের জন্য সবচেয়ে বেশি খেটে যাওয়া নারীর আকাঙ্খা একরকম আবার পুরুষের মাঝে অন্যরকম। যেমর নারীরা যখন এক হয় তখন রঙ্গ-তামাশা করে। স্মৃতিকাতর হয়। বেহিসেবী কেনাকাটা করে। ভালোবাসে। অভিমান করে। অন্যদিকে পুরুষের উচ্চকন্ঠে থাকে দাবি-দাওয়া। তারা তামাশা করছে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না। ও হাঁ, তারা ফুটবল খেলে। বউ পোলাপান নিয়ে পুজায় যায়। এই ছোট ছোট বিষয়গুলোতে মানুষের সুক্ষ পার্থক্য ফুটে উঠে।

কারিগরি দিক থেকে এই ছবি অনেক সাউন্ড। সে দিকে আর না যাই- ছবির কোনো কোনো দৃশ্যের মাঝে বাচ্চারা হুটহাট দৌড়াইয়া যায়। আমরা হয়ত এমনিতে দৌড়াই তবে তা চোখে পড়ে না। কিন্তু এই দৌড়ের গুরুত্ব আছে। এ যেন মানুষের নিরন্তন জার্নি। হয়তো প্রশ্ন জাগবে দৌড়তর বাচ্চারা কোথায় যায় অথবা কেন যায়? এর মধ্যে একটি দৃশ্যে নেপথ্যে থেকেই কথার মাধ্যমে হাজির হন নির্মাতা। তাকে রাহুল জিগেশ করে কাকার বাড়ি কই? তাকে একটা দিক দেখিয়ে দেওয়ার পর রাহুল সেদিকেই দৌড় দেয়। ক্যামেরার পেছন থেকে দুই একটা শব্দ দিয়ে সাইমনের আবির্ভাব- আর রাহুলের বিশ্বজয়ের চিত্র দারুণভাবে প্রতীকি। রাহুলরা কী তবে ভদ্রার পাড় ছেড়ে কাকুর বাড়িতে আসতে চান। লোকে তো বলে তারা শহরের দিকে দৌড়াইতে চায়। হয়তো আরেকপক্ষ বলবে বন্যরা বনে সুন্দর।

ছবিতে অনেক সিম্বলিক বিষয় আছে। যেমন- একদম শেষদিকে দুইটা শিশু নিজের পাতের পাঙ্গাস মাছ নিয়ে কথা বলছে- কাদেরটা বড়, দারুণ একটা দ্বন্ধ। অথবা রাখীর মোবাইলে কেনা, বাড়ি-ঘর নাই তবুও প্রযুক্তি-পুঁজি তোমায় ছাড়বে না। ফুটবলে জয়ী দল পুরস্কার হিসেবে টেলিভিশন পায়। অথবা হঠাৎ লং শর্টে চোখ ধাঁধানো দৃশ্য অথবা জলের স্রোতের নানান ধরন অথবা ফুটবল মাঠে বিজয় উদযাপন হয় শাকিরার ‘ওয়াকা ওয়াকা’ গান। পরিচালক অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে সামলিয়েছেন চায়ের দোকানের তর্ক-বিতর্কসহ যাবতীয় ভিড়ভাট্টা। এতো প্রাণবন্ত কীভাবে করে তুলেছেন তা বিস্ময়ের বটে।

সব মিলিয়ে সৌমেন ও রাখীর জীবন নদীর মতো প্রবাহমান। এই নদীর প্রবাহধারা মানুষের জীবনের বিবিধ রহস্য নিয়ে হাজির। এই ছবি দেখিয়ে দিচ্ছে সে জীবনকে নাটকীয় করে তোলার জন্য আলাদা রটনা লাগে না। এই রটনাহীন ঘটনার মাঝে আছে গান ও কবিতার মতো দৃশ্যাবলী। এইসব দৃশ্য তৈরিতে সাইমন ও সারার খাটুনী বৃথা যায় নাই। মুভিটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অসংখ্য পুরস্কার জুটিয়ে নিয়েছে। আবার দেশের ভেতর যে ক’জন দর্শকের মুখে এর কথা শুনেছি- সবাই তৃপ্তির হাসিই হেসেছেন। দেশীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এই দৃশ্যটা বিরল।

একদম শেষদৃশ্যের কথায় ফিরে আসি। রাখী ও সৌমেন ফিরে আসে পুরানো ভিটেয়। কিন্তু আবার ঝড় আসে। তারা এই নিয়ে তর্ক করে। আবার টিকে থাকার বাসনাও করে। এর মাঝেই তো মানুষের নিরন্তর ছুটে চলা। মানুষের টিকে থাকা। আমরা শুনতে চাই মানব জীবনের বিবিধ অনুবাদ। থাক কিছু বিবাদ, তবুও শুনতে ভালো লাগে।

Capture1

> ব্যবহৃত ফটো: আলোকিত বাংলাদেশ

> লেখাটির আটপৌরে.কম সংস্করণ।

Comments

comments

4 thoughts on “ভদ্রা পাড়ের দৃশ্যাবলী: অনুবাদ ও বিবাদ

  1. ভালো লাগলো। ভালো লাগলো শব্দের চেয়ে অধিক শক্তিশালী শব্দ আমার ভান্ডারে নাই। লেখা নিয়া আলোচনা পর্যালোচনা হইতে পারে কিন্তু ভালো লাগে এর চেয়ে অধিক প্রিয় এবং আর্কষণীয় অন্য কিছু আছে বলে আমার আপাতত মনে হয় না। কারণ যদি কোনো নারীকে যখন পছন্দ হয় তখন কই তোমারে ভালো লাগে তারপর ভালোবাসাবাসি মধ্যে গিয়া ভাইসা যাই। অতএব ভালো লাগছে এই লেখাটির এটাই যুতসই কথাবার্তা।

Comments are closed.