আমি, মিশু এবং নীলু

আর তোকে সে আকাশে উড়তে দেবো। হু তোকে দেখতে যেকোন একদিন চলে আসব।

মোটামুটি সব বন্ধুকে কখনো না কখনো চিঠি লিখেছি। বইয়ের ভাঁজে অথবা ডাক মারফত। সেসব চিঠিতে অপ্রকাশ্য ঘ্রাণ লেগে আছে। তাই হয়তো দেখানো যায় না। মিশু আমার প্রিয় মানুষদের একজন। অনলাইনে মিশুকে দুই বছর আগে দুটো চিঠি লিখেছিলাম। জানি এ চিঠি সে এখনো পাই নাই। কখনো পাবে কিনা জানি না। খাওয়া আর ঘুম ছাড়া তৃতীয় কোন কাজে খুব কম সময়ই সে বরাদ্দ দেয়। মিশুর জন্য ভালোবাসা।

এক. সমুদ্দুর অথবা রুপালী জোছনা

পুত্র মিশুকে নিয়ে সমুদ্র দর্শনের ইচ্ছে ছিলো। মাফ করিস বাপ। আগের জম্মে না হয় বন্ধু ছিলি, তার আগের জম্মে ভাই। আগামী জম্মে না হয় আমিই তোর পুত্র হবো। তো এক বৃষ্টির দিনে দুজনে সমুদ্র দেখতে গেলাম। কিন্তু কি আর দেখব! একমাত্র যে বস্তুটা মোটামুটি দেখা যাচ্ছিল সে হলি তুই। এর মধ্যে সন্ধ্যা নেমে এলো। এই হলো তোর আমার সমুদ্র দর্শন।

সমুদ্র দর্শনে অদ্ভুত আবেগে আক্রান্ত হই। ইচ্ছে করে মনের সাধ মিটিয়ে কাঁদি। মনে আছে, রাতের আকাশটা অনেকসময় সমুদ্রের বালুকাবেলার মতো খাঁজকাটা বলে ভ্রম হয়। আমরা সারাটা রাত সে জোছনা মাখা আকাশের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতাম। মনে হতো অন্য কোন পৃথিবীর সমুদ্র তীরে হাঁটছি, যেখানে আমাদের জগতের লজিক খাটে না।

পাগলা, তুই সব কিছুতেই এতো মজা করতি আমি আর নিলু হেসে খুন হতাম। এখনো সে মাঝে মাঝে এসব কথা বলে। যদিও বলা না বলায় তার কিছুই আসে না। নিলুকে মাঝে মাঝে সমুদ্র বলে ভুল হয়। তুই নিশ্চয় হাসছিস। এটাই তোর মুল কাজ, আমার কথায় এমনভাবে হাসতে থাকিস যেনো পাগলের প্রলাপ।

হুঁ আমরা ভালো আছি। আমি আর নিলু প্রায়ই নৌকায় ঘুরে বেড়াই। আমি নৌকার পাঠাতনে শুয়ে চশমাটা খুলে ফেলি। চারদিকটা ঝাপসা হয়ে আসে। নদীর পাড়টা অনন্ত দূরে সরে যায়। মনে হয় সমুদ্রে ভেসে চলেছি। এ অবস্থায় নিলু ধাক্কা দিয়ে নদীতে ডুবালো একদিন। একে তো চশমা ছাড়া কিছু দেখি না, তার উপর ভাটার নোংরা পানি। বকতে গিয়েও বকতে পারি নাই, মোটের ওপর ওর কান্ডটা আমার নিজেই ভালো লাগছিল।

আমার চোখের অবস্থা খারাপ। অনেক বেশী। ভাবছি নিলুকে নিয়ে একবার সমুদ্র দেখতে যাবো। বেচারী কখনো সমুদ্র দেখেনি। এই আমার শেষ সমুদ্র দেখা। কোন ভরা পূর্ণিমায় যাবো। নিলুর হাত ধরে থাকব। তারপর চোখের পর্দা খুলে পড়বে। জোছনার বিভ্রমে ঢাকা পড়বো আমি। হয়ত আমার জগত চির জোছনাময় উঠবে। নিলুই তো আমার সমুদ্র। জোছনা আর সমুদ্র চিরকাল আমার পাশে রবে।

আর তোকে সে আকাশে উড়তে দেবো। হু তোকে দেখতে যেকোন একদিন চলে আসব।

দুই. ফিরে না আসা নীলুর জন্য

সমুদ্র কি তোমারি মতো!! আরেকবার ফিরে তাকালাম, দেখলাম দৃশ্য সীমানারয় ভেসে আছে আকাশের ছায়া। আকাশ ছায়া মেলে তাকিয়ে আছে। নিরবতায়। অনেক কথাই বলে গেলে। সে যেন অনন্ত গল্প গাঁথা, যা বলতে হয় সুনসান নিরবতায়। মিশু তোকে সে গল্পটা শুনিয়েছিলাম কোন এক চৈত্রের রাত্রিরে। বিশাল মাঠটা পেরুলে যেখান স্থির জলের লেক। মাথার উপর পূর্ণ চাঁদ। জলের সুহ্ম ঢেউয়ে চাঁদ আরো বড় দেখায়। হয়তো আমি বসে ছিলাম ভারাক্রান্ত মনে।

নিলু এসেছিলো চৈত্রের বাতাস হয়ে। লেকের টলটলে শীতল জল ছুঁয়ে। আমাদের ছেলে মানুষী কথা শুনে কাঁচ ভাঙ্গা ঝনঝন শব্দ…। হাসির কি বললাম!! সেতো তোমারি গল্প। মিশুকে জিজ্ঞেস করতে পারো, সে আমার মতো মিথ্যেবাদী নয়। মিথ্যেবাদী এই নামটি তোমারি দেয়া। তোমার সবকথায় আমার কাছে জলের মতো স্বচ্ছ। তুমি যাই বলো তা আমার মাঝে জলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে সমুদ্দুরে মেশে। হয়তো তোমাকে আমি সমুদ্দুর বলে ডাকি তাই।

তুমি আনমনে সারাটা দুপুর জানালার সামনে দাড়িয়ে কাটিয়ে দাও। মেঘের দল তোমাকে জড়িয়ে ধরে। তারপরও তোমার বিষস্নতা পরাজিত হয়না, তোমায় যেন আরো শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে। যদি আমি মেঘ হতাম তোমার অজ্ঞাতে মেঘ হয়ে সারাটা বেলা..। আহা! নিলু আমাদের সমুদ্দুর দিনগুলো। স্মৃতি তোমায় পরাজিত কেন করে? তুমি আর আকাশের দিকে তাকিয়ে কোন কিছু খুঁজো না। আকাশ শুধু শূন্যতার হদিশ দেয়। ওখানে তোমার জন্যে কেউ অপেক্ষা করে নেই।

আমি একা একা লেকের পাড়ে। ছায়াময় টলটলে কালো জল। আমি ছুঁতে গেলে দূরে সরে যায়। হয়তো সবকিছু আগের মতো, আমিই দূরে সরে পড়ি। জৈষ্ঠ্যের কড়া রোদে একা একা হাঁটি। আমার ছায়া পড়ে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় কাঁদি। কিন্তু কোথায় সে চোখের জল, আমার তো কোন ইচ্ছে নেই, হতাশা নেই, আনন্দ নেই। শুধু মাঝে মাঝে দূরতম মরীচিকার মতো কি যেন আমায় তাড়া করে। আমরা ক’জনা..

শেষ বিকেলে মিশুর ঘুম ভাঙ্গে। মরা মরা আলোয় সবকিছু কেমন যেন ফ্যাকাশে লাগে। কিছুক্ষন চুপচাপ শুয়ে থাকে। কি যেন মনে পড়ে পড়ে করে আর পড়ছে না। কিছুটা অস্বস্থি লাগে। হঠাৎ উঠে বসে, দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। না, আর খেয়ে কাজ নেই। সে একা একা কিছুক্ষন হাঁটে।

তারপর মাঠের এক কোনে গিয়ে বসে। দূরের পাহাড় সারির দিকে তাকায়। ধীর পায়ে পাহাড় সারির দিকে এগুতে থাকে। বেশী দূর এগুতে পারে না। সামনে দৃশ্যটা বদলে গিয়ে জল ভরা সরোবর হয়ে য্য়। মিশু এগিয়ে যায়, পা ভেজায়… তারপর আমি আর নিলু আসি হাত ধরাধরি করে। আমরাও পা ভেজাই।

জোসনার আলোয় চারদিক প্লাবিত…

আমরা জলে পা ডুবিয়ে চুপচাপ। কতকটা কাল কেটে গেলে এমন দিন আসে আমরা কেউ জানি না। এতটুকুই জানি কোন অপেক্ষাই চিরন্তন নয়।

Comments

comments

9 thoughts on “আমি, মিশু এবং নীলু

  1. মিশুকে আমার মনে নেই। যেটুকু মনে আছে তাও নেই। শুধু মনে পড়ে একটা ছেলে মাথা কাত করে ঝুপড়িতে আপনার মুখোমুখি বসে আছে। আমি আসাতে সে আর কথা বলছে না। অনেক বার তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই কেন যেন ঐ ছায়াটাই মনে ভাসে।

Comments are closed.