জাহানের জন্ম ও রক্তাক্ত আরেকটা সকাল

 (ব্যর্থ এক সার্জারি নিয়ে ভোগান্তির কাহিনি এটা। যার মূল পর্ব শুরু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, এখনো চলমান। এখন একটা সিনেমাটিক ক্লাইমেক্সে দাঁড়ায়া আছে। তবে সেই গল্পে দুর্ধর্ষ কোনো অ্যাখ্যান নাই, বিরাট কোনো বাঁক-বদল নাই। অনেক বিরক্তিকর দীর্ঘশ্বাস আছে। কিন্তু এ গল্প আমার খুবই কাছের, আমার বর্তমান। আমার স্বজনদের জন্য পরীক্ষার, আমাকে ভালোবাসার। সেই গল্পটা আমার বন্ধুদের জানাতে চাই, অন্তত এক অধ্যায়ের সমাপ্তির আগে আগে।  অবশ্য পুরো গল্পটা এভাবে শেয়ার করা সম্ভব কিনা আমার জানা নাই। বিআরবি হাসপাতাল ও ডা. মোহাম্মদ আলী ছাড়া সব হাসপাতাল ও চিকিৎসকের নাম বদলে দেওয়া।)

আগের পর্ব: একঅসুখের দিনদুইবাবা আর আমি পাশাপাশিতিনঅপারেশন টেবিলের ঝাপসা দুনিয়াচারবাসায় ফেরার আনন্দপাঁচ. ঘুম ভেঙে দেখি শরীরজুড়ে রক্তছয়লজ্জা ভুলে কেঁদে উঠলাম হাসপাতালে, সাত. অপারেশন টেবিলে মৃত্যু নিয়ে রসিকতা, আট. হাসপাতালের বিল থেকে অর্ধেকের বেশি টাকা গায়েব, নয়. হোমিওপ্যাথির ডাক্তার বললেন, আপনি কি ক্ষমা করতে পারেন? দশ. সুন্দরবনে ব্যথার সঙ্গে যুগলবন্দি এগারো. কান্না সামলে আম্মাকে বললাম, ভালো আছি, বারো. ক্ষেপে গিয়ে বললাম, ধন্যবাদ আপনার সেবা লাগবে না, তেরো. ‘সুস্থ হয়ে গেছি’ বিশ্বাস হতে চাইল না

যাদুকাটা নদী সুনামগঞ্জ, ২০১৫/ নামলিপি নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

খানিকক্ষণের জন্য আমার গল্প থেকে বিরতি নিই। কয়েক মাস এগিয়ে যাই আপাতত। ২০২২ সালের শেষ দিকে। আমি আর রাশেদ গেলাম শ্যামলীতে। ওইখানকার এক হোটেলে উঠেছে আমাদের স্কুলের বন্ধু আলমগীর। সঙ্গে তার স্ত্রী, দুই বাচ্চা ও ছোট ভাই। উদ্দেশ্যে এসেছে কৃত্রিম পা লাগানো। এই গল্প এই জন্য বলছি, আমাদের জীবনটা আসলে কী, কীভাবে আমরা বেঁচে থাকি, কীভাবে সব মেনে নিতে হয়, তা আগে-ভাগে কখনো বোঝা যায় না। সেটা বোঝানোর জন্য।

চট্টগ্রামে আলমগীর ও আমি শিশু শ্রেণী থেকে এসএসসি পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছি। এখন ও আমাদের স্কুলেরই শিক্ষক। কয়েক বছর আগে স্কুলের ৩৯ বছর পূর্তিতে গেছিলাম। দেখলাম শিক্ষক হিসেবে সে বেশ তৎপর, প্রচুর দৌড়ের মধ্যে ছিল। হঠাৎ করে একটা পা হারিয়ে ফেলল সে। এমন না ধীরে ধীরে আমার মতো কোনো রোগ বাসা বেধেছে বা ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছে। রাস্তার পাশের দোকান থেকে মেয়ের জন্য চিপস বা কিছু একটা কিনছিল। এরপর রাস্তা পার হবে। আচানক করে রাস্তা থেকে ছিটকে একটা ক্রেন এসে ওর গায়ের ওপর উঠে গেল। তারপর লম্বা সময় ধরে অপারেশন, পা কেটে ফেলা। কয়েক মাসের ট্রমা। হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি। এ সবের মাঝে একদিন ফোন করেছিলাম। কথায় কথায় জানালো, ওর বাবার পিত্তথলির অপারেশন হয়েছিল চট্টগ্রামে। কিন্তু যেটা ওপেন হওয়ার দরকার ছিল, ডাক্তাররা ভুলে করল লেপরোস্কপি। আধা সমাপ্ত অপারেশন নিয়ে ঢাকায় এলেন। যেখানে অনেক কাণ্ড। শেষ পর্যন্ত তিনি মারাই গেলেন।

কৃত্রিম পায়ের জন্য আলমগীর বেশ কয়েক জায়গায় যোগাযোগ করেছিল। ব্র্যাকেও কথা বলেছিল। ওর মতে, এই প্রতিষ্ঠানে দেয়া পায়ের অনেকটাই আসে ডোনেশনে থেকে, তা সত্ত্বেও দাম তুলনামূলক বেশি। এখন যে ভদ্রলোকের কাছ থেকে কিনছে, উনি নাকি অন্য কারো কাছ থেকে খবর পেয়ে আলমগীরকে ফোন দিয়েছেন। এমনকি চট্টগ্রামে ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করে এসেছে। যাচাই-বাছাই করতে করতে কৃত্রিম পা নিয়ে রীতিমতো এক্সপার্ট হয়ে উঠেছে মনে হলো। ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার ভীষণ কান্না পেল। সম্ভবত, লম্বা ধকল সামলে ইমোশনাল হয়ে পড়েছি। আহা! জীবনটা কেমন। যেন কৃত্রিম পা নয়, নতুন এক জোড়া জুতার ক্ষেত্রে আমরা যেমন খুঁতখুঁত করি ঠিক তেমন। আমরা মানিয়ে নিই, সব মানিয়ে নিই। নইলে কীভাবে বেঁচে থাকব।

আমার গল্পে ফিরে আসি। দুলাভাই হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, দ্রুত সার্জারি করায়া নেবো। তখন মার্চের শেষ দিক। পরের মাসের শেষ দিকে আমাদের প্রথম বাচ্চা আসার ডেট। তাই যতটা সম্ভব আগে আগেই হাসপাতালে ভর্তি হতে চাইছিলাম। সবাইকে জানায়া দিলাম। দেশ রূপান্তরের সম্পাদক অমিত দা বললেন, যতটা সময় লাগে যেন নিই।

আর বাকি থাকে টাকা-পয়সা। আগেরবার অনেকটাই খরচ দিয়েছিলেন আপা আর দুলাভাই। সঙ্গে বউ কিছু দিয়েছিলেন। এরপর তো টানা দুই বছর অসুস্থতার মাঝে গেছি। ফলে মোটামুটি আমার হাতে কোনো টাকা নেই। দেখতেছিলাম, অনেক পরিচিতজন স্যালারি অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছে। আমিও ভাবলাম সেই পথে হাঁটব। কিন্তু কয়েকজন বন্ধু যখন শুনল সঙ্গে সঙ্গে মানা করল। তাসমিয়া আফরিন মৌ সার্জারির অর্ধেক টাকা ধার দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন; নেজাম ভাই বাংলা মুভি ডেটাবেজের (বিএমডিবি) তহবিলের পুরো টাকাটা খরচের প্রস্তাব দিলেন। পরে অবশ্য আমার বউ প্রস্তাব দিলেন, পুরো খরচ উনি বহন করবেন। আর রাশেদ যখন শুনল, টাকার ঝামেলার কথা উঠার আগেই নির্দিষ্ট অ্যামাউন্ট দিতে পারবে বলে জানালো। মেজবাহ যখন সার্জারির কথা শুনল, তার একটাই কথা কত টাকা লাগবে।

যাই হোক, তাদের কারো কাছ থেকে টাকা নিলাম না। বউয়ের হাসপাতাল খরচের জন্য সে টাকাটা রেখেছিলাম, উনি নিলেন না। সঙ্গে একই পরিমাণ টাকা নগদে পাঠিয়ে দিলেন। মূলত আগের বছর একাধিক হাসপাতালে কথা বলার সুবাদে এই বাজেটটা করেছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, ডা. মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে একবার যোগাযোগ করা যাক। উনি যদিও বলে দিয়েছিলেন, যখনই সিদ্ধান্ত যেন সার্জারি করাবেন, আগেরদিন হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়ে গেলে হবে। তারপরও ভাবলাম দেখা করে আসি। শেষ মুহূর্তে টাকার কথা জিগাসা করতে উনি যে অ্যামাউন্ট বললেন, তাতে চিন্তায় পড়ে যায়। কারণ, যা ভেবেছিলাম তার দ্বিগুণ।

দ্রুত মিশুকে ফোন দিলাম। ও ৫০ হাজার টাকা পরদিনই পাঠিয়ে দেবে বলল। এখন সেই ডরমেন্ট হওয়া অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা ছাড়া কোনো উপায় নাই। টাকাটা তুলতে শ্যামলীতে গেলাম। বাসায় যখন ফিরলাম, আপা বললেন, দুলাভাই এক লাখ টাকা দিতে চান। মাত্র হাসপাতাল থেকে ফিরলেন, তাই বললাম না। উনাকে টিবির জন্য ছয় মাস টানা ওষুধ খেতে হবে। ঠিকমতো চলাফেরা করতেও পারেন না। তো, ব্যাংক থেকে আসার পর উনি, আমাকে একটা চেক দিয়ে বললেন, টাকাটা যেন খরচ করি। যখন দিতে পারি, তখন যেন দিই। এটা নিয়ে চিন্তা করতে মানা করলেন। বললাম, মোটামুটি যোগাড় হয়ে গেছে। আপা বললেন, আপাতত রাখ। কখন কী খরচ আগে থেকে তো বোঝা যায় না। না লাগলে ফেরত দিস। আসলেই আমি কি জানতাম, আমাকে একবার নয় পরপর দুইবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। এমনকি পরের বছরেও আরেকবার সার্জারির টেবিলে যেতে হবে।

টাকার বিষয়টা শেয়ার করতাম না। কিন্তু একটা ভুল চিকিৎসার কারণে আমাকে কতটা ভুগতে হচ্ছে, সেটা জানালাম। সঙ্গে মানসিক যে ক্ষতি কখনো হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারবো না। পারিবারিক স্বাভাবিক জীবনের যে অসম্পূর্ণতা বা যা কিছুকে অবহেলা বলে ভেবেছি তাও কাটিয়ে উঠা অসম্ভব। আমি মানুষকে পরীক্ষা করাতে বিশ্বাসী নয়, ফলে অনাহুত এই ঘটনায় যাকে যেভাবে দেখেছি, তা কখনো জানতে পারতাম না। এমনকি আমাদের কাছের মানুষেরা এমন হয়ে থাকলেও সমস্যা না, একেক জনের দেখার ভঙ্গি একেক রকম, আবেগ-অনুভূতি একেক রকম। এখন চিকিৎসকের ভুলের কারণে বা ভুল স্বীকার না করার কারণে তাদের প্রতি জাজমেন্টাল হইতে হচ্ছে।

তৃতীয় রমজানে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। প্রথম সার্জারির বছরের ক্ষতের মুখ খোলা থাকলেও পুরো রোজা রেখেছিলাম। পরের বছর মানে ২০২১ সালে ব্যথার কারণে ১৩টা রোজা রাখতে পেরেছিলাম। এবার সাকুল্যে এই তিন।

হাসপাতালে যাওয়ার দিন সকালে দুলাভাইয়ের চেকটা নিয়ে বাসার কাছে ব্যাংকে গেলাম। সেখানে হলো ঝামেলা। অসুস্থতার কারণে উনার হাত কাঁপে। ফলে চেকে স্বাক্ষরের খানিকটা গোলমাল হলো। কাটাকাটিও ছিল। ব্যাংক সেটা মানবে না। আমি পরিস্থিতিটা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। তাদের কথা, আরেকটা ঠিকঠাক স্বাক্ষর লাগবে। বাসায় ফিরে আসলাম। খানিকটা ট্রায়ালের পর দুলাভাই আরেকটা স্বাক্ষর দিলেন। না হলে, অন্য ব্যাংকের একটা চেক দিলেন। এবার অবশ্য ব্যাংক কবুল করলো, দুলাভাইকে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নিল। এরপর উবার ধরে হাসপাতালে গেলাম, সেখানে অপেক্ষা করছিল রাশেদ। কাউন্টারে বলে দিল, আমরা যেন ঘণ্টা দু-এক অপেক্ষা করি। করোনার একটা টেস্ট করে এই সময়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে পজিটিভ বা নেগেটিভ। নইলে ডা. মোহাম্মদ আলী সার্জারি করাবেন না। তথাস্ত। টেস্ট করিয়ে রিসেপশনে বসে আছি। তখন একটা ডিসপ্লেতে চিকিৎসকের তালিকা দেখাচ্ছিল। হয়তো চোখের ভুল হতে পারে, একজন যে দেখে বিরক্ত হলাম। উনার সঙ্গে চিকিৎসার অভিজ্ঞতা ছিল ভীষণ রকম জঘন্য। আবার আরেকজনকে দেখে ভালো লাগল। আশরাফ জুয়েল। লেখক হিসেবে উনারে জানি এখন। করোনার বাড়বাড়ন্ত সময়ে উনার অনেক পোস্ট শেয়ার হইতো এই বিষয়ে, তাই ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়াছিলাম। সম্ভবত খেয়া মেজবার মা যখন অসুস্থ, উনিই হাসপাতালে বেড পাইতে হেল্প করছিলেন। এই সব গল্প ফেসবুকে পড়ছিলাম।

করোনার রিপোর্ট নেগেটিভ আসলো। কেবিনে ইন করার খানিক পর ডা. আশরাফ জুয়েলকে ফেসবুকে নক দিলাম। এরপর উনি মেসেঞ্জারে কল দিয়ে একবার দেখে গেলেন। খুবই ভালো লাগল। সার্জারির ব্যাপারে আশ্বস্ত করলেন তিনি। বিকেল নাগাদ রাশেদ চলে গেল, আজ রাতটা আমাকে একা থাকতে হবে। ওই দিকে সকাল সকাল নোয়াখালী থেকে রওনা দিয়েছে ছোট ভাই সোহেল, দুপুরের মাঝে বাসায় পৌঁছে গেছে। বিকেলে দেখতে এলেন ডা. মোহাম্মদ আলী। বাকি সব রিপোর্ট দেখে বললেন, ঠিক আছে। এমআরসিপি রিপোর্ট কই? যেটা আগের বছর করেছিলাম। সেই রিপোর্ট না পেলে আবার করাতে হবে। সাত-আট হাজার টাকার ধাক্কা। বাসায় ফোন করে রিপোর্টটার হদিস পাওয়া গেল। সোহেল পরদিন সকালে আসার কথা থাকলেও ইফতারের পর হাসপাতালে রিপোর্ট নিয়ে চলে এলো।

পরদিন সন্ধ্যার দিকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হলো। ওই সময় রাশেদ, সোহেল ও নিশানের সঙ্গে ছিল আমাদের বন্ধু মোস্তফা ভাই। ঘণ্টা চার-এক পর মনে জ্ঞান ফিরল। ঠাণ্ডা একটা ঘর। সোহেল এসে একবার দেখা করে গেল। চশমা দিয়ে গেল। সকালে কেবিনে এলাম। এবার পেটে দুটো ড্রেনেজ ব্যাগ লাগানো। রাশেদ পরে বলতেছিল, ডা. মোহাম্মদ আলী অপারেশন শেষে বাইর হয়ে তাদের পিত্তথলির সেই শয়তানি অংশটা দেখাইছে। সেটা দৃশ্যমান হিসেবেই যথেষ্ট বড়ই। যথারীতি খাইতে পারতেছিলাম না। ডাক্তার প্রতিবার এলেই ধমক দিতেন। প্রচুর মানে হাসপাতালের দেয়া খাবার ফেলে রাখা যাবে না। তাই লুকায়া রাখতাম। প্রচুর হাঁটতে হবে। মাঝে মাঝে কেবিন থেকে বাইর হইতাম। দুই হাতে দুটো ড্রেনেজ ব্যাগ ধরে হাঁটতাম। মূলত রিসেপশনের পাশের বড় জানালাটা দিয়ে নিচে তাকিয়ে থাকতাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দশ তলা থেকে নিচের জীবনটা অন্য রকম লাগত। ভীষণ স্থবির, ঢাকার ভীষণ জ্যামের কারণে, আবার ভোরে যখন দাঁড়াইতাম, তখন হঠাৎ হঠাৎ গাড়ি দেখা যাইতো। এর মাঝে আমি ভাবতাম, একটা অনিশ্চিত সময় নিয়ে। যেহেতু আমি জানি না, এই যন্ত্রণার কোনো শেষ আছে কিনা। এবারের সার্জারি নিয়ে কয়েকজন বন্ধু ছাড়া কেউ জানত না। এটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার, অসুস্থ সময়ের জন্য। মনে হচ্ছিল, আস্তে আস্তে যাচ্ছি।

আমার কেবিনে প্রচুর আলোর ব্যবস্থা ছিল। যদিও জানালাটা ঝাপসা পেপারে মোড়া। আরেকটা কেবিন নিতে চাইছিলাম। রাস্তার পাশে, এক পাশজুড়ে কাঁচ। তবে সেখানে গরমের সঙ্গে ছিল, রোগীর অ্যাটেন্ডেন্টের থাকার জায়গার স্বল্পতা। আসলে খুবই বিষন্ন একটা সময়। তাই ওই সময় কেবিনজুড়ে যতই আলোই থাকুক আমার মনে হতো- আলো নাই একদম।

সার্জারির দুইদিন পর আমার বউয়ের পেইন উঠল। উনাকে হাসপাতাল পর্যন্ত নেয়া হলো। কিন্তু এটা ছিল ফলস পেইন। এই সময়টা নিয়ে আমার আলাদা কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু পাশে থাকব এটুকু জানতাম। যা ভাবি তার চেয়ে ভিন্ন হয় সবকিছু। পরদিন আবার ব্যথা উঠল। আমাকে ফোন করা হলো। প্রার্থনা ছাড়া আর কী করতে পারি। হাসপাতালে যাওয়ার আগেই আলোর মুখ দেখলো আমাদের মেয়ে জাহান! খবরটা শুনে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালাম। চোখে পানি চলে এলো। সত্যি বলতে কী আমার অনুভূতি কাজ করছিল না। মনে হচ্ছিল, কোনো অনুভূতিই বাবাসুলভ হচ্ছে না। একটা অপরোধবোধ কাজ করছিল। এমন সময়ে আমার পরিবার আম্মা-বাবা, ছোট বোন আমার বউকে নিয়মিত সঙ্গ দিয়েছে। পাশে থেকেছে। আমি জানতাম না, কখন যাওয়ার মতো ছুটি পাবো। শুয়ে-বসে থাকা আর নিয়ম করে দুটো ড্রেনেজ ব্যাগ হাতে ধরে হাসপাতালে করিডোরে হাঁটা। প্রথম সার্জারিতে মোট তিনদিন হাসপাতালে ছিলাম। এবার কতদিন থাকতে হবে, তার কোনো নিশানা নাই। মাঝে মাঝে মনে হতো, আর যেন বাসায় ফিরব না। ডা. মোহাম্মদ আলী নিশ্চিত না হয়ে রোগীদের ছাড়েন না। আমার কেসটা তো ক্রিটিকালই ছিল। তাই উনার বলার ভেতর একটা অনিশ্চিতভাব থাকত। মাঝে মাঝে সব খাবার শেষ না করার কারণে বকা দিতেন। ভালো লাগত। এই করে ছাড়া পেলাম পয়লা বৈশাখের একদিন আগে। মানে ১৩ এপ্রিল। সাতদিন হলেও মনে হচ্ছিল সাত বছর। বাসায় ফেরার তর সইছিল না। ডা. মোহাম্মদ আলী ড্রেনেজ ব্যাগ খুলে দিয়ে বললেন, দুইদিন পর এসে যেন জরুরি বিভাগ থেকে সেলাই কাটিয়ে নিয়ে যায়। উনাকে দরকার হবে না। যে কেউ করে দিতে পারবে। এর সাতদিন পর আরেকবার দেখা করতে বললেন।

নিচ তলায় এসে ওষুধপত্র কিনলাম। তারপর উবার ডেকে গাড়িতে উঠলাম। যেতে যেতে ড. মহসিনকে মেসেজ দিলাম। বাড়ি ফিরছি। বিস্তারিত জানার পর বিলের বিষয়টা জানতে চাইলেন। অঙ্কটা বলতে জানালেন, সবাই ভাবে বেশির ভাগ টাকা ডাক্তাররা নেন, কিন্তু তার বেশির ভাগই হাসপাতালের ইউটিলিটি বিল। সেটাই দেখা যাচ্ছে।

পরদিন পয়লা বৈশাখ। সারাদিন টিভি দেখছিলাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেবার হট টপিক ছিল টিএসসির কিছু মূর্তি। যেখানে মূলত ধর্ম নিয়ে উসকানি। ব্যাপক গরমের মধ্যে লোকজনের ঘোরাঘুরি দেখলাম। পরপর কয়েক বছর করোনার কারণে জনসমাগম বন্ধ থাকায় মানুষ খানিকটা ঘোরাঘুরি সুযোগ পেল। আসলে টিভি দেখাদেখি বা মোবাইলে সোশ্যাল মিডিয়া সার্ফিং ছাড়া কিছুই করার থাকে না। ওই দিকে আমার বউ নানান জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। বাচ্চা খাচ্ছে না। মা-মেয়ে দুজনেই কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।

১৬ এপ্রিল হাসপাতালে গেলাম। জরুরি বিভাগে জুনিয়র একজন ডাক্তার ব্যান্ডেজ খুলে পিনগুলো তুলে দিলেন। সব দেখে বললেন, ঠিক আছে। একটা ক্রিম দিলেন শুধু। দিনে কয়েকবার ব্যবহার করতে বললেন। আমি যেদিন হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলাম, সেদিন রাতে আরেক কাণ্ড। দুলাভাই খেয়াল করলেন, আমার ছোটভাইয়ের হাতে টিউমার জাতীয় কিছু একটা। কিন্তু ও চাইছিল বিষয়টা আড়াল করে রাখতে। বেশ খানিকটা বকাবকি শুনলো সে। তো, সেলাই কাটার দিন আমরা বিষয়টা নিয়ে জরুরি বিভাগে যখন কথা বললাম, তখন জানানো হলো একজন রেসিডেন্ট সার্জেন আছেন, ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমি, নিশান ও সোহেল সেই ডাক্তারের রুমের সামনে সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষা করছি। আমার কেমন যেন লাগছিল। হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছিল, শরীরটা দুইভাগ হয়ে গেছে। সেলাইয়ের জায়গাটা খুলে গেছে। সেখান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। রক্ত গড়ানোর কিছু দাগ যেন দেখা যাচ্ছে। হাত দিয়ে দেখি এটা সার্জারির সময়কার দাগ। ডাক্তারের চেম্বারের সামনে অনেকক্ষণ একা বসে, নিশান ও সোহেল ভেতরে। ডাক্তার পরে একদিন আসতে বললেন। নিশানকে বললাম, সার্জারির জায়গায় কেমন যেন লাগছে। ও বলল, সন্দেহ হলে জরুরি বিভাগে চলো যায়।

জরুরি বিভাগে গেলাম। ভেতরে দেখি প্রচুর মানুষ। কোনোভাবে ডাক্তারকে রিচ করতে পারছি না। ঘটনা হলো, একজন স্ট্রোকের রোগী নিয়ে আসা হয়েছে। ডা. আশরাফ জুয়েল এখানকার আইসিইউয়ের দায়িত্বে আছেন। উনি ওই রোগীর বুকে পাম্প করতে করতে পরিশ্রান্ত হয়ে গেলেন। আশপাশে তার খেয়াল নেই, মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিজের কাজ করেই যাচ্ছেন। জরুরি বিভাগে এত মানুষ না থাকার কথা থাকলেও কে শোনে কার কথা। বারবার তাগাদা দিয়ে সরানো যাচ্ছে না। এক সময় ডা. জুয়েল সফল হলেন। ভদ্রলোকের হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে। ওই দৃশ্যটা আমি অনেকদিন ভুলি নাই। বেশ কসরত করে একজন ডাক্তারকে পেলাম, যিনি সকালে আমার সেলাই খুলেছিলেন। তাকে পুরো ঘটনাটা বললাম। উনি চেক করে বললেন, কোনো সমস্যা নাই। ডাক্তারের কথায় খানিকটা আশ্বস্ত হলাম।

বাসায় ফিরে সন্ধ্যায় যখন টিভি দেখছিলাম, পাশের সোফায় ছিলেন দুলাভাই। ওনাকে জিগাসা করলাম, আইসিইউর কথা মনে পড়ে? তখন কেমন লাগত? উনি বললেন, প্লিজ মনে করাইয়া দিও না। আইসিইউতে থাকা মৃত্যুর সমান। আর সে কথা মনে করতে চাই না। এই সব কথা বলতে বলতে খুব কাশি পাইলো। অসহ্য রকম এই কাশি। যেটা শুরু হয়েছিল হাসপাতালে থাকতে। কিন্তু এতটা জঘন্য ছিল না। আর কাশির সঙ্গে তলপেটে নাভির কাছে প্রচণ্ড ব্যথা। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। শুয়ে থাকলাম। এর আগে ব্যান্ডেজ নিয়ে বাসায় ফেরার পর গরম পানি দিয়ে কয়েকবার কুলিও করছিলাম। কিন্তু আজ অসহ্য ব্যথা। ডাক্তার মহসিনকে ফোন করার পর সাপোজিটর ব্যবহারের কথা বললেন। করে একটু রিলিফ পাইলাম। কিন্তু খানিকক্ষণ পর আবার একই অবস্থা। উনি সমতলভাবে শুইতে মানা করছিলেন। তাই বালিশকে উচু-নিচু এমন করে ঢালু করে রাতে শুইলাম। কিন্তু কাশির দমকে একটু পরপর ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল।

ভোর ছয়টার দিকে ঘুম ভেঙে গেল। সেহেরি খেয়ে সবাই তখন গভীর ঘুমে। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। পেটের দিকে হাত যেতে বুঝতে পারলাম, পুরো জায়গাটা ভিজে গেছে। অনেক কষ্টে উঠলাম। দেখলাম পুরো টি-শার্ট ও কাঁথা রক্তে ভেজা। দুই বছর আগে প্রথম সার্জারির পর যেমন হয়েছিল। কী করব এখন? মাত্র গতকাল সেলাই খোলা হয়েছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল, রক্ত হারাতে হারাতে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ব। সাহস করে পেট চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালাম। দুলাভাইকে ডাকব কিনা ভাবছি। ডাইনিং রুমে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর তখনই নিশান বাথরুম থেকে বের হলো। বললাম, নিশান দেখ এবার এখান থেকে রক্ত পড়ছে। ঘুম ঘুম চোখে সে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারল না। পরে বলছিল, ওর মনে হচ্ছিল, বিশাল একটা ফাঁক দিয়ে আমার নাড়িভুড়ি সব দেখা যাচ্ছিল।

আগামী পর্বে সমাপ্য

Comments

comments