লজ্জা ভুলে কেঁদে উঠলাম হাসপাতালে

(ব্যর্থ এক সার্জারি নিয়ে ভোগান্তির কাহিনি এটা। যার মূল পর্ব শুরু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, এখনো চলমান। এখন একটা সিনেমাটিক ক্লাইমেক্সে দাঁড়ায়া আছে। তবে সেই গল্পে দুর্ধর্ষ কোনো অ্যাখ্যান নাই, বিরাট কোনো বাঁক-বদল নাই। অনেক বিরক্তিকর দীর্ঘশ্বাস আছে। কিন্তু এ গল্প আমার খুবই কাছের, আমার বর্তমান। আমার স্বজনদের জন্য পরীক্ষার, আমাকে ভালোবাসার। সেই গল্পটা আমার বন্ধুদের জানাতে চাই, অন্তত এক অধ্যায়ের সমাপ্তির আগে আগে। … অবশ্য পুরো গল্পটা এভাবে শেয়ার করা সম্ভব কিনা আমার জানা নাই। এখন পর্যন্ত সব হাসপাতাল ও চিকিৎসকের নাম বদলে দেওয়া।)

আগের পর্ব: একঅসুখের দিনদুইবাবা আর আমি পাশাপাশিতিনঅপারেশন টেবিলের ঝাপসা দুনিয়াচারবাসায় ফেরার আনন্দ, পাঁচ. ঘুম ভেঙে দেখি শরীরজুড়ে রক্ত

চেয়ারম্যান ঘাট. নোয়াখালী ২০১৩; টাইপোগ্রাফি: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

সম্প্রতি মানে, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে আমি যখন হাসপাতালে ভর্তি, একই হাসপাতালে আমার ছোট ভাইয়ের হাত থেকে একটা টিউমার অপসারণ করা হয়। সিরিঞ্জ দিয়ে ছোটখাট শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে। বিষয়টা যন্ত্রণার বটে। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, চিৎকার করছ নাই। ও একদম বাচ্চাদের মতো করে বলল, চিৎকার কেন কেন করবো, শরম না! এই শিরোনামটা তার কথা থেকেও নেওয়া।

এ পর্যায়ে আমার গল্প থেকে সামান্য বিরতি নেবো। ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে একটা বড়সড় বিড়ম্বনার দিকে যাচ্ছিলেন দারাশিকো ভাই। আমার পরিচিতজনদের মধ্যে অফিসের একজন ছাড়া সম্ভবত প্রথম শুনেছিলাম, কোনো একটা পরিবারের সবাই করোনায় আক্রান্ত, সেটা হলো দারাশিকো ভাইয়ের শ্বশুর ফ্যামিলি। স্ত্রী ও ছোট দুই মেয়ে তুবা ও রুবাকে নিয়ে দারাশিকোর সংসার। করোনার প্রাথমিক ধাক্কায় এর ভয়াবহতা মানসিকভাবে কতটা অশান্তির ছিল পরবর্তী বছরে উপলব্ধি করা কষ্টকরই বটে। সম্ভবত ঈদের পরপরই দারাশিকোর শ্বশুর মারা যান, দিনে দিনে গ্রামের বাড়ি নিয়ে গিয়ে কবর দেওয়া হয়। কিন্তু ভাবি বাচ্চাদের কথা ভেবে যান নাই বাবাকে দেখতে।

এমন খারাপ ঘটনার ভেতর দিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। একদিন উনার একটা মেসেজ পাইলাম হোয়াটস অ্যাপে। উনার প্রশ্রাবের রাস্তায় কিডনি থেকে নেমে আসা পাথর আটকে গেছে, সন্ধ্যায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, রাতের মাঝে সার্জারি। কী ভয়ানক ব্যাপার! এ ধরনের ঘটনায় যখন কাউকে হেল্প করার কোনো উপায় নাই, অহেতুক ফোন করে বিরক্ত করতেও চাই না। তারপরও থাকতে না পেরে সন্ধ্যার দিকে কল দিলাম। উনি ধরলেন না। পরে টেক্সট করে জানালেন, রাতে অপারেশন হইছে। সকালে বাসায় ফিরছেন।

পুরো ঘটনা এমন যে, কাটা-ছেড়া ছাড়াই ব্যাপারটা ঘটছে। উনার প্রশ্রাবের নালি দিয়ে একটা চিকন নল ঢোকানো হইছে, সেখানে ক্যামেরাও ছিল, ওই নালি দিয়ে পাথরটা বের করে আনা হইছে। ভেতরে নালির মতো একটা জিনিস রয়ে গেছে। যা একমাস পর বের করে আনা হবে। উনি যখন পরবর্তী ফোন ধরলেন তখন অনেক পানি খেয়ে প্রশ্রাব করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বিপদ এখানে শেষ না!

কিডনির ইউএসজি করতে গিয়ে উনার পিত্তথলিতে পাথর ধরা পড়ছে। এখনো ইনফেকশনটাইপ কিছু ঘটে নাই। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ, মাস দুয়েক অপেক্ষা করতে। এ সময়ের মধ্যে করোনায় তিনি অপারেশনে না যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। তবে ভাবি আর ডা. ইমরান চাইছিলেন এ মুসিবত যাতে শরীরে না থাকে। দারাশিকো ভাই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নিলেন, তার দেয়া ঔষধ খেতে থাকেন। এত এত বিপদে উনার পাশে আমি একদমই নাই। একে তো নিজের বাজে অবস্থা, তার ওপর করোনা।

এর মধ্যে পেলাম আরেকটা পিত্ত পাথরের কাহিনী। আমার একমাত্র মামার অবস্থা খুবই খারাপ। পিত্তথলির সঙ্গে সঙ্গে লিভারও নাকি আক্রান্ত। উনার অপারেশন হয় উত্তরার খুবই পরিচিত হাসপাতালে। এর পরের দুই বছরেও উনি স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারেন নাই।

যাই হোক, আমার নিজের গল্পও খানিকটা ফেলি এসেছি। একদিন খবর পেলাম, আম্মা দেখতে পেলেন বারান্দায় কিছু মুরগির বাচ্চা হাঁটছে। উনি প্রায় সারাটা সময় শুয়ে খাটান। বিছানা থেকে উঠে মুরগির বাচ্চাকে খাবার দিতে গেলেন। আর উল্টে পড়ে গেলাম। বেশ ব্যথাও পেলেন। এক জায়গায় ছড়ে গেছিলো। সেই ক্ষত মেলাতে বেশ সময় লেগেছে। এটা রোজার মধ্যকার কথা। আমার পিত্তথলিতে আবার পাথর আবিষ্কারের ঘটনা ঈদের পরে। সেই পুরোনো গল্পে ফিরে আসি। ডা. আকবর আহমেদ ‘ফেটে যাওয়া পিত্তথলি’র গল্প পুনরাবৃত্তি করে জানালেন, পিত্তরস জমে কিছু ফাঁপা তৈরি হওয়ার কথা বললেন, যা দেখতে পাথরের মতো দেখাচ্ছে। ইউএসজির ডাক্তার বললেন, তাহলে আমরা এখন কী করবে? ডা. আকবর বললেন, আপনার ফাইন্ডিংস যা বলছে লিখে দেন। বাকিটা আমি দেখছি।

সব মিলিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা। এর মাঝে একটা প্রশ্ন মাথায় জাগলো। ডা. আকবরের চেম্বারে যেতেই পুরোনো কাসুন্দি টানলেন। যেটা এতদিন বলে আসছিলেন, পিত্তথলি পচিয়ে ফেলেছিলাম। এমনিতেই এর আগে ও পরে দেখা হলেই অন্য কারো সামনে আমার ধৈর্য্যের কথা বলতেন। আমি প্রশ্ন ছাড়াই উনি বললেন, যেহেতু ওপেন সার্জারির মাধ্যমে পেট খুলে দেখা হয়েছে সেক্ষেত্রে পাথর থাকার প্রশ্নই ওঠে না (যদিও এ প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে)। আর যদি থাকে, জ্বর-জন্ডিস-বমি এ সব লক্ষণ দেখা যাবে। আমি আসলে আশ্বস্ত হতে পারছিলাম না। এ অস্বস্তি নিয়ে বাসায় ফিরলাম। শারীরিক যন্ত্রণাও কাটেনি। আরও বিষয় হলো, সত্যি সত্যি পিত্তথলির অংশ রয়ে গেছিলো, কিন্তু আমার আর কখনো জন্ডিস বা বমি হয় নাই।

এরপরে ঘটনা দু-তিনদিন পরের। তাও সকালে ঘুম থেকে উঠে। দেখি পুরো গেঞ্জি হলদেটে-সবুজ এক ধরনের রসে ভেসে গেছে। মানে ক্ষতের মুখ আবারও খুলে গেছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। দ্রুত সিএনজি ডেকে দুলাভাইয়ের সঙ্গে আল হামরায় গেলাম। ডা. আকবর ক্ষত পরিষ্কার করে ড্রেসিং করে দিলেন। বললেন, ভেতরে কোনো একটা ঝামেলা আছে। ক্ষত কতদূর গভীরে তা জানার জন্য সাইনোগ্রাম করার কথা বললেন। এটা এক ধরনের এক্সরে। উনার ধারণা, সাতদিন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড দিয়ে ক্ষত পরিষ্কার করলে ক্ষত সেরে যাবে। এ জন্য প্রতিদিন আসা-যাওয়া না করে সাতদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পরামর্শ দিলেন। তবে তার আগে সাইনোগ্রামের রেজাল্ট হাতে পেতে হবে।

ডা. আকবর বললেন, সাইনোগ্রামের একটু প্রস্তুতি আছে। পরে বললেন, দেখেন আজ করা যায় কিনা। একটু ব্যথা করবে, ক্ষতও তাজা। আচ্ছা ওষুধ দিয়ে দেবো। ‘ব্যথা’র কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। এক্সরে বিভাগে গিয়ে জানলাম, সে দিন সম্ভব না। পরদিন টেকনিশিয়ান থাকবেন না। পরশু যেন সকাল সকাল আসি, একটু বেশি সময় থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হবে। কয়েক হাজার টাকার ব্যাপার বলে জানালেন।

দুইদিন পর সকাল সাতটা বা আটটার দিকে গেলাম। পুরো ব্যাপারটা এমন স্যালাইনের নল দিয়ে একটা ইনজেকশনের অ্যাম্পুল থেকে একটা তরল ক্ষতের ভেতরে নেওয়া হবে। সেখানে পারদ থাকে। সম্ভবত এ কারণেই ভেতরে কতটুকু পর্যন্ত খোলা আছে তা এক্সরেরে দেখা যায়। এক্সরে টেবিলে শোয়ার পর একজন টেকনিশিয়ান নানাভাবে দেখলেন কোন পজিশনে থাকলে ঠিকঠাক ফল পাওয়া যাবে। উনি আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। জানলাম, এক্সরের জন্য অন্য হাসপাতালে রেডিয়েশনজনিত বিশেষ ঝুঁকি ভাতা থাকলেও ওনাদের দেওয়া হয় নাই। অথচ কত বড় হাসপাতাল, কত নামডাক!

একটু পরপরই আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম, কতটা ব্যথা পাওয়া যাবে। উনি আশ্বস্ত করছিলেন। কিছুক্ষণ চলার পর বললেন এবার বাইরে যান। আমি বললাম, শেষ। খুশি হয়েই। কিন্তু উনি খুশির বাত্তি নিভিয়ে দিলেন। বললেন, আসলে কাজ তো শুরুই হয়নি! একজন নারী প্রেশেন্ট আছেন, তার টেস্টটা করাবেন এ সময়ে।

এতদিনের যত ব্যথা-বেদনা তার মধ্যে ভয়ংকর ছিল ওইদিনটা। ঠিকঠাক বর্ণনা করে বলা কঠিন। এর পর এক্সরে টেবিলে শুয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে তরলটা পুশ করা হচ্ছিল। আসলেই তো তত ব্যথা নাই। যাক, বেঁচে গেলাম। এ ধরনের ভাবতে ভাবতে একটা অস্বস্তি জেগে উঠল। বললাম, ব্যথা শুরু হয়েছে। টেকনিশিয়ান বললেন, আরেকটু। বেশিক্ষণ লাগবে না। কতটা সময় মনে নেই। ব্যথা বাড়তেই থাকলো। আমি চিৎকার করছি। একসময় এক্সরে শেষ হলো। বললাম, দ্রুত জিনিসগুলো বের করেন। আশ্চর্য! তাদের কাছে গজ জীবাণুনাশক কিছুই নাই। একজনকে গজের জন্য পাঠানো হলো আর উনি দুইপাশ থেকে টিপে টিপে ওই তরলটা বের করছেন। এরপর একসারি টিস্যু দিয়ে চেপে থেকে ডা. আকবরের চেম্বারের সামনে গেলাম। ভেতরে রোগী আর বাইরে আমি কাতরাচ্ছি। রিসেপশনিস্ট বললেন, ওখানে শুইয়ে দিন। দুলাভাইয়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে কাঁদতে থাকলাম। সম্ভবত স্মরণকালের ভেতর, প্রকাশ্যে এভাবে প্রথমবার কাঁদলাম। রোগী বের হলে ডা. আকবরের কাছে গেলাম।

সেদিনই প্রথম প্রকাশ্যে কেঁদেছিলাম। ভাবলে এখনো শিউরে উঠি। ডা. আকবর অনেকটা সময় নিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করলেন, খালি সিরিঞ্জ দিয়ে অনেকটা তরল বের করে আনলেন। ড্রেসিং করে দিয়ে কিছু ওষুধ দিলেন, রিপোর্টের খোঁজ নিতে বললেন। এক্সরে বিভাগ থেকে আমার বাকি কাগজপত্র নেওয়া হলো।

পরদিন এক্সরে রিপোর্ট নিয়ে আমি আর দুলাভাই গেলাম ডা. আকবরের চেম্বারে। তিনি রিপোর্ট দেখে বললেন, যা ভাবছিলেন তার চেয়ে খারাপ অবস্থা। অপারেশনের জায়গায় একটা লিকেজ আছে। মানে পিত্তরস সরাসরি লিকেজ দিয়ে শরীরের বাইরে বের হয়ে আসছে। কী ভয়ংকর ব্যাপার! তখন ‘ভয়ংকর’ হিসেবে মাথায় আসে নাই। কিন্তু অনেকদিন পর শরীরের ভেতর আর বাইরে এই বেসামাল বিষয়টা কল্পনা করতে গিয়ে গা হিম হয়ে আসছিল আমার।

লিকেজ বন্ধ করতে ইআরসিপি নামের একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু এটার উনার বিভাগের কাজ না, গ্যাস্টোলিভারের কাজ। চিন্তা করতে মানা করলেন। বললেন, এমন ঘটনা খুব একটা ঘটে না। কিন্তু কিউর সম্ভব। ডা. আবদুল্লাহ রাফিকে ফোন দিলেন। কিন্তু তিনি হাসপাতালে নাই, আমাদের গ্রিন রোড যেতে হবে। আমরা বাইরে বসে থাকলাম। রিসেপশন থেকে দুলাভাইকে ডাকা হলো একটু পর। তিনি একটা স্লিপ নিয়ে আসলেন, যেখানে ডা. রাফীর ঠিকানা লেখা। গ্রিনরোডের মুনলাইট গ্যাস্টোলিভার হাসপাতাল। খুবই বিরক্ত লাগছিল। এই হাসপাতালের ডাক্তার, অথচ আমাদের যেতে হচ্ছে অন্য এক হাসপাতালে।

আধাঘণ্টার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম। ছোটখাট একটা হাসপাতাল, আল হামরার মতো প্রশস্ত না। খানিকটা নোংরাও। ডা. রাফী রোগী দেখতে গেছেন। আমার অপেক্ষা করতে হবে। দশ-বিশ মিনিট বসতে হলো। এসে নাম বয়স, জিজ্ঞাসা করলেন। লিখতে লিখতে বললেন, ও! আমি ভাবছিলাম আপনার বয়স আরও কম।

তার কথার সারমর্ম হলো, ইআরপিসি হলো মুখ দিয়ে একটা নল প্রবেশ করানো হয়। ঘণ্টা দুয়েকের ব্যাপার। দিনে দিনে করে হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়া যায়। তবে আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে হাসপাতালে একদিন ভর্তি থাকতে হয়। মুখ দিয়ে নল… বললাম, এন্ডোস্কপির মতো কিছু নাকি! সম্ভবত বুঝিয়ে বলার পরিশ্রম কম হলো দেখে খুশি হলেন। বললেন, হ্যাঁ, এমনই! আপনি শিক্ষিত মানুষ, নেট ঘাটলে সহজে বুঝতে পারবেন। পরে বুঝেছি, আসলে রোগীকে দেওয়ার মতো উনার সময় নাই। বোঝাবেন কখন। বললাম, তাইলে তো ব্যথা করবে। উনি আশ্বস্ত করলেন অজ্ঞান করা হবে। পুরো বিষয়টি নিরাপদ। তবে সতর্কতা হিসেবে বললেন, অনেকেরই ইআরসিপির পর যক্ষা হয় বুকে, তবে চিন্তার কিছু নাই, ছয় মাস ওষুধ খেলেই চলবে।

আরও জানালেন, করোনার কারণে একটা দিন হাসপাতালে বাড়তি থাকতে হবে। করোনা টেস্ট করাতে হবে। একদিন স্যাম্পল নিয়ে যেতে পরদিন রেজাল্ট চলে আসবে, তাই একটা দিন বাড়তি থাকা লাগবে। একটা প্যাডে লিখে দিলেন ইআরসিপি, পরদিন ভর্তি হতে বলে ৫০০ টাকা চাইলেন।

বাসায় ফেরার পর পুরো বিষয়টা কেমন যেন লাগছিল। এক হাসপাতালের ডাক্তার অন্য হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছে। হঠাৎ, পুরো বিষয়টা ভাবতে ভাবতে ইউনিভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের কথা মনে পড়লো, অনেক বছর যোগাযোগ ছিল না, কিছুদিন আগে একবার কথা হইছিল ফেসবুকে। উনি এক সময় ছাত্র শিবিরের বড় নেতা ছিলেন, মুনলাইটের আবহাওয়া দেখে তাই মনে হলো। যাই হোক, উনাকে মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মুনলাইট গ্যাস্টোলিভার চেনেন কিনা। উনি জানালেন, চেনেন। মূলত আল হামরার কিছু ডাক্তার সাইড বিজনেস হিসেবে এটা দাঁড় করিয়েছে। আমার সমস্যার কথা বলতে মুনলাইটের ম্যানেজারের নাম্বার পাঠালেন, উনার পরিচিত লোক। ডাক্তার নাম বলতেও চিনলেন। উনার একই সময়ে চট্টগ্রামে রাজনীতি করেছেন, ভালো পরিচিত। বললাম, ডা. রাফীকে যেন আমার কথা বলে। উনি বললেন, জানাবেন। পরে জিজ্ঞাসা করে নিলেন, টাকা-পয়সা কমাতে বলবেন কিনা। বললাম, দরকার নাই। হয়তো পাঁচ হাজার কমাবে বড় জোর। এখন টাকার চেয়ে সঠিক চিকিৎসা দরকার বেশি। উনিও বলে দিলেন, আমার ছোটভাই, একটু কেয়ার কইরেন। যাই হোক, সেই কেয়ারের চাপ দেখি নাই ডাক্তারের কাজকর্মে।

দুলাভাইয়ের অফিসে কাজের খুব চাপ, আর ভাগনে চাইছিল না করোনার ভয়ংকর সময়ে তিনি হাসপাতালে যান। নিশান করোনার ভয়ে একদম দিশেহারা। বাসায় থাকলে একদম রুম থেকে বের হয় না। যদি বের হতেই হয়, তবে ফিরে এসে ছাদের কমপক্ষে আধাঘণ্টা হাত-মুখ-পা ধোয়, তারপর গোসলখানায় এক ঘণ্টা। এ কদিনে তার মুখ শিরিষে ঘষা হয়ে গেছে। ভাগনি নিপুণের ধারণা, নিশান প্রতিদিন ব্লিচিং পাউডার দিয়ে গোসল করে। যদিও ব্লিচিং পাউডার শব্দটা ওর মুখ দিয়ে আসছিল না, বলছিল, কোরবানের ঈদে গরুর রক্ত পরিষ্কারের পাউডার দিয়ে গোসল করে ভাইয়া।

সেদিন ছিল ২০২০ সালের ২৪ জুন। বিশেষ করে দুলাভাই যাবে না শুনে কান্না জুড়ে দিলাম। সাধারণত নিজের বিড়ম্বনার জন্য অন্যের দোষ দিই না, সব নিজের ওপর চাপিয়ে দিই। কাঁদতে কাঁদতে সে সবই বলছিলাম। পরে দুলাভাই বললেন, আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করেই তবে অফিসে যাবেন। এবার শান্ত হলাম।

আমাদের বাসা থেকে ব্যাটারি চালিত রিকশা বা অটোয় করে মেইন রোড ১৫-২০ মিনিটের রাস্তা। এরপর বাস, সিএনজি যা ইচ্ছা নেওয়া যায়। বাসা থেকে বের হয়ে আবিষ্কার করা গেল রিকশা-অটো সব বন্ধ! করোনার কারণে হুটহাট বন্ধ হতে আগেও দেখেছি। কিন্তু এমন দিনে? অটো স্ট্যান্ডে অদূরে কয়েকটা মটরসাইকেল দেখা গেল। তারা যাত্রী নিচ্ছে। এবার অটোর ড্রাইভাররা তেড়ে এলো, তারা যাত্রী নিতে দেবে না। অসুস্থ, অপারেশনের রোগী বলেও পার পাওয়া গেল না। একটু হেঁটে সামনে গেলাম, সুযোগ বুঝে এক মটরসাইকেল আমি ও দুলাভাই উঠে পড়লাম। ক্ষেপে গিয়ে তেড়ে আসলো ড্রাইভারেরা। অন্যদিকে পেছনে রয়ে গেলেন ভাগনি জামাই মিনহাজ। উনি পরে প্যাডেলের রিকশায় করে এলেন। এরপর একটা প্রাইভেট কারে হাসপাতালের দিকে যাত্রা। একে তো রোদের ভেতর দিয়ে হেঁটে এসেছি, তার ওপর মোটরসাইকেল চড়া— এ নিয়ে খানিকটা ভয় পেয়ে গেছিলাম। দেখলাম পেটের ব্যান্ডেজে কিছু ঘটে নাই। মোটামুটি ভালোভাবে মুনলাইট গ্যাস্টোলিভার হাসপাতালে পৌঁছলাম।

ভর্তি হতে গিয়ে ঘটল বিপত্তি। রিসেপশন থেকে বলা হলো, করোনার টেস্ট রিপোর্ট কতদিনে আসে ঠিক নাই। তিন-চারদিনও লাগতে পারে, এ কটা দিন হাসপাতালে থাকতে হবে। বললাম, ডা. রাফি বলেছিলেন একদিনে রেজাল্ট পাওয়া যায়, আর এখন তিন-চারদিন! উনি বললেন, আমাদের করার কিছু নাই। রেজাল্ট পাওয়া না যাওয়া পর্যন্ত আপনাকে ভর্তি থাকতে হবে। আমার মেজাজ চড়ে গেল। দুলাভাই ধমক দিয়ে বললেন, চুপ করো। যতদিন থাকা লাগবে থাকো, তোমার ভালো হওয়া নিয়ে কথা। আমি বলছিলাম, উনারা ধাপ্পা দিচ্ছেন। প্রতিদিন কতগুলো বিল দিতে হবে জানেন? দুলাভাই বললেন, টাকা নিয়ে তোমার ভাবার দরকার নাই। ডা. আকবর আহমেদকে ফোন দিলাম। পুরো ঘটনা বললাম। উনি বললেন, তাহলে তো ঝামেলা। আমাকে বললে তো আল হামরায় সকালে নমুনা নিয়ে বিকেলে রেজাল্ট দিতে পারতাম। বললাম, তাহলে কি কাল সকালে আল হামরায় চলে আসবো। উনি বললেন, আপনার এ অবস্থায় দৌড়াদৌড়ি ঠিক হবে না। ভর্তি হয়ে যান। আমি দেখছি। এরপর ফোন করে জানালেন, ডা. রাফির সঙ্গে কথা হয়েছে। একদিনে রেজাল্ট দেওয়ার সবোর্চ্চ চেষ্টা করবেন। আমি ভর্তি হয়ে গেলাম।

কেবিনে ওঠার পর দুলাভাই অফিসে চলে গেলেন। আমার সঙ্গে থাকলেন ভাগনি জামাই মিনহাজ। বিকেলের দিকে তিনিও চলে গেলেন। এ হাসপাতালটা পছন্দ হওয়ার কোনো কারণ নাই। আল হামরার ডাক্তার হয়েও ডা. রাফি এখানে ভর্তি করালেন, ব্যাপারটা পছন্দ হলো না। কেবিন বেশ জরাজীর্ণ ও সংকীর্ণ। পায়ের দিকে এক জানালা আছে। মশা তাড়ানোর জন্য জালি দেওয়া। একটু দূরে আরেকটা বিল্ডিং। একদম একা, টিভিও নেই যে দেখে সময় কাটাবো। আর করোনার এ সময়ে কাউকে আসতে বলতে ইচ্ছাও করছে না।

হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি এটা রাশেদ জানে, সম্ভবত করোনার কারণে তার আগ্রহ জাগে নাই আসতে। দীর্ঘ একটা দিন ও রাত গেল। এখানে যে কেউ একটু ফাই ফরমায়েশ কেটে কিছু এনে দিবে তারও উপায় নেই। এর মধ্যে রাতের খাবার নিয়ে ঝামেলা। ফোন করলাম অফিসের কলিগ রাফসান গালিবকে। তার বাসা কাছাকাছি কোথাও। সে প্রায় রান্না-বান্নার পোস্ট দেয় ফেসবুকে। তাকে বললাম, রাতের খাবারটা দিয়ে যেতে। প্রথমে ব্যস্ততার কথা বলল, পরে খাবার দিতে রাজি হলো। বললাম, হাসপাতালে উঠার দরকার নেই। মিনহাজ নিচ থেকে নিয়ে আসবে। মিনহাজ খাবার দিয়ে বাসায় চলে গেলো।

এ দিকে হাসপাতালে যেহেতু আছি, হাসপাতালের কিছু দায়িত্ব তো আছে। অনেক দিন ধরে আমি প্রেশারের ওষুধ খাই, আর গ্যাস্টিকের ট্যাবলেট তো আছে। সেটা আমার প্রেসক্রিপশনে আছে। নার্স এসে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানিয়ে গেলেন, কী কী ওষুধ খেতে হবে। একবার ডাক্তার এসেও ঘুরে গেলাম। আমার খুব হাসি পাইলো। যদিও পরদিন ড্রেসিং চেঞ্জ করতে বলায় বেশ আমতা আমতা করলো। পরে টেপ খুঁজে পাচ্ছিল না। আমি ব্যাগ থেকে বের দেওয়ার পর তারা কাজ সারল।

সেদিন রাতটা কেমন কাটছিল? এমন না খুব খারাপ লাগছিল। তবে সময়ের হিসাব চলে গেছিলো। শুয়ে থাকা আর এক-আধটু পায়চারি ছাড়া আসলে করার কিছু ছিল না। সন্ধ্যার দিকে দারাশিকো ভাই ফোন করে অনেকক্ষণ কথা বললেন। হাসপাতালে জানালার একটা ছবি পোস্ট করে ‘লাইট থ্রু দ্য হসপিটাল উইনডো’ এ রকম একটা ক্যাপশন দেওয়ার পর ফেসবুকে অনেকেই প্রশ্ন শুরু করলো। তাই দ্রুত ছবিটি অনলি মি করে দিলাম। সোশ্যাল মিডিয়ার দিনে এই এক জটিলতা, আমরা নিজেদের প্রকাশ করতে চাই, আবার চাইও না যেন!

চলবে …

Comments

comments