অপারেশন টেবিলে মৃত্যু নিয়ে রসিকতা

ব্যর্থ এক সার্জারি নিয়ে ভোগান্তির কাহিনি এটা। যার মূল পর্ব শুরু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, এখনো চলমান। এখন একটা সিনেমাটিক ক্লাইমেক্সে দাঁড়ায়া আছে। তবে সেই গল্পে দুর্ধর্ষ কোনো অ্যাখ্যান নাই, বিরাট কোনো বাঁক-বদল নাই। অনেক বিরক্তিকর দীর্ঘশ্বাস আছে। কিন্তু এ গল্প আমার খুবই কাছের, আমার বর্তমান। আমার স্বজনদের জন্য পরীক্ষার, আমাকে ভালোবাসার। সেই গল্পটা আমার বন্ধুদের জানাতে চাই, অন্তত এক অধ্যায়ের সমাপ্তির আগে আগে। … অবশ্য পুরো গল্পটা এভাবে শেয়ার করা সম্ভব কিনা আমার জানা নাই। এখন পর্যন্ত সব হাসপাতাল ও চিকিৎসকের নাম বদলে দেওয়া।)

উড়ির চর থেকে যেদিকে সন্দীপ, ডিসেম্বর ২০২১; নামলিপি: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

আগের পর্ব: একঅসুখের দিনদুইবাবা আর আমি পাশাপাশিতিনঅপারেশন টেবিলের ঝাপসা দুনিয়াচারবাসায় ফেরার আনন্দ, পাঁচ. ঘুম ভেঙে দেখি শরীরজুড়ে রক্ত, ছয়. লজ্জা ভুলে কেঁদে উঠলাম হাসপাতালে

সকালটাও একা একা কাটল। আগের বিকেলের পাউরুটির কয়েকটা স্লাইস আর কলা ছিল। সেটা দিয়ে নাশতা সারলাম। সকালে নার্স এসে গ্যাস্টিকের ওষুধের কথা বলে গেল। ইআরসিপি কখন করাবে জিজ্ঞাসা করলাম, উত্তর দিতে পারলেন না। দুপুরের দিকে ক্ষিদে লেগে গেল। বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসার কথা নিপুণ ও মিনহাজের। কিন্তু ওদেরও ডাক্তারে এপয়ন্টমেন্ট ছিল, তাই আসতে খানিকটা দেরি হবে। দুই পিস পাউরুটি তখনো রয়ে গেল। সেটাই খাইলাম।

দুইটার দিকে ডা. রাফি আসলেন। বললেন, ইয়ংম্যান কেমন আছেন? বললাম, ভালো। এরপর বললেন, আজকে রিপোর্ট পাইলে সন্ধ্যায় অপারেশন হবে। কিছু খাবেন না। নইলে দুইদিন পিছিয়ে যেতে হবে। শুক্রবার আমি অপারেশনে যায় না। মেবি শনিবারও উনার অন্য শিডিউল ছিল।

এ কথা শুনে কিছু বলতে পারলাম না। একটু পরই ভাগনি হাজির হলো খাবার নিয়ে। তখন নার্স এসে বললেন, সকাল থেকে কিছু খেয়েছেন? খাবেন না। আপনার করোনা নেগেটিভ। রাত আটটার দিকে ইআরপিসি করা হবে। বললাম, এটা এমন কথা। সারাদিন যাওয়ার পর বলছেন খাবেন না। এটা তো সকালেই আপনাদের বলা উচিত ছিল। এখন আমার মনে হয়, কখন দুই পিস পাউরুটি খেয়েছি। আর খাবার দেরিতে এসেছে বলে এতক্ষণ খাইনি। আপনার দায়িত্ব পালন করলেন না। গ্যাস্টিকের ট্যাবলেটের কথা বলতে আসছিলেন শুধু। তারা কোনো উত্তর দেই না।

সমস্যা হলো, আমি কখন পাউরুটি খেয়েছি মনে নাই। ওই যে সংশয় পিছু ছাড়ে না। শয়তানটা আশপাশে কোথাও বসে থাকে। যখনই কোন কিছু নিশ্চিত হতে চাই, টুপ করে আমার মাথায় মধ্যে ঢুকে পড়বে। তারপরও একটা সময় ধরে ঠিক করা হলো রাতে ইআরসিপি হবে। কয়েকদিন পিছিয়ে যাওয়ার চেয়ে এই ভালো। এই জঘন্য হাসপাতালে আর থাকতে হবে না।

রাত আটটার খানিকটা আগে সার্জারি রুমের পাশে একটা বিছয়ানায় শুইয়ে দেওয় হলো। হাতে লাগানো হলো স্যালাই। এর আধঘণ্টা পর ডা. রাফি আসলেন। সঙ্গে দুজন ছিলেন। খুব একটা কথা বললেন না। দ্রুত অপারেশন টেবিলে শুয়ে পড়লাম। এক হাত স্যালাইনের কারণে লম্বা করে রাখছি, অন্য হাত মাথার নিচে। একজন মুখের মধ্যে একটা চোঙের মতো জিনিস দিলেন। তারপর সেখানে টেপ লাগিয়ে দিলেন।

তিনজনে কথা বলতে বলতে এটা সেটা করছেন। পায়ের দিকে কিছু তারের মতো জিনিস জড়ানো হলো। ভয় পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, পা ছোড়াছুড়ি করবো নাকি। জিজ্ঞাসাও করা যাচ্ছিল না, মুখ বন্ধ। এই ফাঁকে তাদের কিছু কথা শুনে গা হিম হয়ে আসলো। আগেই হয়তো বলেছি অ্যানেন্থেশিয়ার মাধ্যমে অজ্ঞান হওয়া ভয়ংকর একটা ব্যাপার। যেন ফাঁদে পড়ে যাওয়া, মৃত্যু নয়, আর যদি জ্ঞান না পেরে। আর তখন তারা মৃত্যু নিয়ে রসিকতা করছে।

ডা. রাফি সম্ভবত অপারেশন টেবিলে মারা যাওয়া কোনো এক রোগীকে নিয়ে কিছু বলছিলেন, তারপর তিনজনই হাসছিলেন। আমি বলতে লাগলাম, ভাই আপনারা দেখছেন না, আমি এখানে শুয়ে আছি। একটু পর অজ্ঞান করবেন। এইসব কথা বন্ধ করুন। কিন্তু কথাগুলো আমার ভেতরেই রয়ে গেল। মুখ খোলা গেল না। পা নাড়ানোর চেষ্টা করলাম, সেটাও হলো না। তাদের হাসাহাসির মাঝে একজন আমার দিকে এগিয়ে এলেন। চোঙে লাগানো টেপ খুলে একটা নল আমার মুখে মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। অ্যানেন্থেশিয়া!

লোকজনের অস্পষ্ট কথাবার্তা ও আলোর মাঝে জ্ঞান ফিরলো। ততক্ষণে কেবিনে নিয়ে আসা হয়েছে। অ্যানেস্থেশিয়ার ঘোর সহজে কাটছিল না। ঘণ্টাখানেক বা এর আগে-পরে টলতে টলতে ওয়াশ রুমে গেলাম। দরজা লক করি নাই। কমোডের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো।

খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, গলায় খুব তৃষ্ণা; এভাবে শুয়ে পড়লাম। পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। এক হাতে স্যালাইন লাগানো। ভয় হচ্ছিল মাঝরাতে হয়তো শেষ হয়ে যাবে, কেউ টের পাবে না। যদি রক্ত ওঠে। সারারাত ঘুম আসে নাই। পেট ফুলে থাকায় গ্যাসের যন্ত্রণা। মিনহাজকে কিছুক্ষণ পরপর বলছিলাম, মামা দেখেন তো স্যালাইন বোধহয় শেষ। এই করে করে সেই স্যালাইন শেষ হলো সকাল ৮টার দিকে। সকাল হতেই বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেছি। হাসপাতালে লোকেরা বলছিল, খারাপ লাগলে থাকতে। কিন্তু থাকার কোনো দরকার ছিল না। যা হয়, কাগজপত্র রেডি করতে করতে অনেক সময় চলে গেল। ডা. রাফির সঙ্গে আর দেখা হলো না। একজন নার্স ওষুধ বুঝিয়ে দিয়ে বললেন এক সপ্তাহ যেন ডা. রাফির সঙ্গে আল হামরায় গিয়ে দেখা করি। দুলাভাই এসে বিল পরিশোধ করতে গেলেন। এ রক্তপাতহীন কাজের জন্য গলব্লাডারের অপারেশনের সমান টাকাই গেল। এর মধ্যে করোনা টেস্টের সাড়ে চার হাজার টাকা আছে। করোনা নেগেটিভ হওয়া সত্ত্বেও করোনা প্রটেকশন ফি নামে আরও চার হাজার বাড়তি নিল। কী যেন একটা নলের জন্য আলাদা করে টাকা নিল। অথচ আল হামরার মতো সুপরিসর হাসপাতালে এর চেয়ে দুটো দিন বেশি ছিলাম। এটা হলো ঠেকে যাওয়া অবস্থা। পৃথিবীর অন্য কোথাও কেমন জানি না, আমি দেখেছি যে দিন শরীর খারাপ থাকে, এটা বুঝে গেলে পাড়ার রিকশাওলারাও ১০ টাকা বেশি নিতে চায়। ‘রিকশাওলা’ বললাম এ কারণে যে এটা খুবই সহজ উদাহরণ!এখন তো উপায় নাই আমার। এরা ভর্তির সময় বলেছিল, রিপোর্ট আসতে তিন-চারদিনও লাগতে পারে।

ডা. রাফি যদিও বিষয়টা না বুঝিয়ে অনলাইনে দেখে নিতে বলেছিলেন, কিন্তু ইআরসিপি কী আমার দেখা হয় নাই। তবে বাসায় আসার পর দেখলাম লম্বালম্বি হয়ে শুতে গেলে পেটের মধ্যে কেমন যেন লাগে। তাই কোনাকুনি একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হলো। আমার ধারণা ছিল, অপারেশনের লিকের জায়গায় জোড়া দেওয়া হয়েছে। একদিন তাসমিয়া আফরিন মৌ ফোন করে পুরো বিষয়টা জানতে চাইলেন। সব শুনে উনি বললেন, তাইলে কী পেটের মধ্যে সেলাই করছে। বললাম, না। ঝালাইও করে নাই। তাহলে? ভীষণ বেকায়দায় পড়ে গেলাম। আসলে আমার পেটের মধ্যে কী করেছে।

এক সপ্তাহ পর আল হামরায় গেলাম। প্রথমে ডা. আকবর আহমেদের সঙ্গে দেখা করলাম। উনি ড্রেসিং চেঞ্জ করার জন্য সহকারীকে ডাকলেন। কিন্তু মাত্র তিনদিনে আমার ক্ষতে বুজে গেছিল। এটা দেখে উনি সন্তুষ্ট হলেন। তারপর বললাম, আমার পেটের মধ্যে কি সেলাই করা হয়েছে? উনি একটা শরীরের একটা ছবি টেনে নিয়ে জানালেন, আমার সমস্যা কোথায় এবং কী? বললেন, শরীরের ভেতর একটা স্ট্রেইন বসানো হয়েছে। অনেকটা ক্লিপের মতো। তাহলে? বললেন, ওটা একমাস পর বের করে আনা হবে। এবার তো ভয় পাওয়ার পালা। পেটে কেটে বের করবে? না, যেভাবে স্ট্রেইন বসানো হয়েছে, ঠিক সেভাবে খুলে আনা হবে। হায় হায়! কী মুশিবত!

এর মাঝে আরেক বাজে ঘটনা ঘটল। সেটা জুলাই মাস সম্ভবত। আম্মা কিছুদিন আগে পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছিলেন। এবার হঠাৎ করে স্মৃতি বিভ্রমের মতো ঘটনা ঘটল। কিছুক্ষণ কাউকে চিনতে পারছিলেন না। আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে বলছিলেন, গরুর দুধ ধুইয়ে আশপাশের ঘরে দিয়ে আসতে। অথচ আমার বুদ্ধি হওয়ার পর বাড়িতে গরু পালতে দেখি নাই। এ রকম এলোমেলা ঘটনা। উনি এমনিতে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাত কাঁপার রোগী। বাড়িতে একটা ভয়ংকর অবস্থা। রাতের বারোটা দিকে ছোটবোন ভিডিও কল দিলো। আম্মা আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। কী নীরব তার চাহনি। কথায় কোনো তাড়াহুড়ো নেই। খুব ধীরস্থিরে বলছিলেন, উনার কিছুই ভালো লাগছে না। আমি কেমন আছি। ভিডিওতে আম্মাকে দেখতে কী যে সুন্দর লাগছিল। যেন একটা পরী! আমি তো কাঁদতে কাঁদতে অস্থির। তখন এমনিতে আমার জন্য ঘুমানো কষ্টকর ছিল। রাতের পর রাত জেগে থাকছি। একটু চোখ লেগে এলো বোধহয়। কিন্তু কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙ্গল। প্রথমে মনে হলো আপার কাঁদছে। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। একটু সুস্থির হতে বুঝতে পারলাম। বারান্দার খোলা দরোজায় দিয়ে হু হু বাতাসের সঙ্গে অনেক দূর থেকে কোনো নারীর কান্না ভেসে আসছে। আল্লাহ আমাদের ডাক শুনেছিলেন। পরদিন আম্মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রক্ত ও প্রশ্রাবে কিছু ইনফেকশন ধরা পড়ে। দুই-তিনদিনের মাথায় তিনি বাড়ি ফেরেন। অনেকটা রিলিফ পেলাম।

সম্ভবত জুলাইয়ের কোনো একদিন টিভি দেখতে বসেছি। তখন শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিদিন একটা অনুষ্ঠান দেখায় সব চ্যানেলে। যেখানে বলা হয়, ওই দিন বঙ্গবন্ধুর জীবনে কী ঘটেছে। তখন জানলাম, ১৯৭৩ সালের দিকে সম্ভবত উনার গলব্লাডার অপারেশন হয়েছে। ঘটনা শুনে মনে হলো, সদ্য স্বাধীনতা দেশের ডাক্তাররা হয়তো নিজেদের হাতের ওপর ভরসা করতে পারছিলেন না, তাই উনাকে লন্ডন গিয়ে এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। ওই সময় নাকি বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীরা। সদ্য স্বাধীন দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ছিলেন শেখ মুজিব, সেই সংবর্ধনার একটা ছবি অনলাইনে পাওয়া যায়। পরে জেনেভায় যান অবসর কাটাতে।

অনেক পরে যখন আম্মার সঙ্গে দেখা। তিনি বলছিলেন, আগের দিনের অনেক মানুষ নিশ্চয় গলব্লাডারে ব্যথায় ভুগছেন। কিন্তু তারা বলতে পারতেন না, আসলে কী হচ্ছে! ব্যাপারটা কেমন বিভীষিকাময় নয়? তো, টিভিতে শেখ মুজিবের গলব্লাডারের ঝামেলার কথা শুনে মজাই পাইলাম। আর জিনিসটা আমারই চোখে পড়া বাকি ছিল বুঝি।

সত্যি কি এই সময় আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। একে তো অ্যানস্থেশিয়া নিয়ে দারুণ অস্বস্তি, তার ওপর আবারও মুখের ভেতর নল করিয়ে কিছু একটা বের করে আনা। যদি কোনো অনর্থ ঘটে। এর মধ্যে বাসায় থাকতে থাকতে হাপিয়ে উঠছিলাম। হাসপাতালে দিনগুলো বা খুব একটা বাধ্য না হলে কাজ করা বাদ দিই নাই। অফিসের কাজ না থাকলেও নিজেদের কিছু কাজ দেখাশোনা করতে হতো। নইলে নানান দুশ্চিন্তা তো ছিল। এ সময় মানে কোরবানের কয়েক দিন পর আমার বউ আসলেন। আমরা মাস খানেক একসঙ্গে ছিলাম। একেবারে সুস্থ হওয়ার আগে আম্মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। যাতে তারা কোনো দুশ্চিন্তার সুযোগই না পান। বিশেষ করে বাবা সব সময় নানান বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন, তার মধ্যে আর নতুন করে কিছু যোগ করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু এবার জোরাজুরির কারণে যাইতে হলোই।

সেদিন ছিল ২৯ আগস্ট, পরদিন আমার জন্মদিন। এই দিন ও আম্মা-বাবার সঙ্গে প্রায় ১০ মাস পর দেখা হওয়া নিয়ে অনেকটা আপ্লুত ছিলাম। এখানে শুধু নিজের অসুস্থতা নয়, করোনার বিষয়টা এজন্য গুরুত্ব দিয়ে দেখছিলাম, আম্মা-বাবা বয়স্ক ও ওনাদের নানা ধরনের অসুস্থতা রয়েছে। তা সত্ত্বেও না গিয়ে পারলাম না।   

ওই দিনের কথা কেন যেন খুব একটা মনে নাই। গভীর দিনগুলো এমনই হয়। স্মৃতি বা অভিজ্ঞতায় জানান দেওয়ার বাইরে আয়ু খোরাক হয়ে থাকে তারা। ২৯ আগস্ট সকালে যখন রওয়ানা দিলাম, ততক্ষণে জানতে পারলাম ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ অভিনেতা চাডউইক বোসম্যান মারা গেছেন। প্রায় চার বছর ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছিলেন তিনি। কিন্তু এর মাঝে বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করলেও ব্যাপারটা তিনি কাউকে জানতে দেন নাই, পরিবার জানতো শুধু। কী অবাক বিষয়। হয়তো বাস্তবের সুপারহিরো এমন হয়। বা আমাদের মধ্যে এমন কিছু ফ্যান্টাসি আছে, গোপনে সব সয়ে যাবো কাউকে বলবো না। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের এমন সংযম নাই আসলে। বরং এ চিন্তার চোরা একটা সুখ আছে। যেটা স্বস্তির কিছু না। এমনটা ভাবতে আমার ভালোও লাগে না।

যাই হোক, সন্ধ্যার পর আমরা বাড়ি পৌঁছি। আম্মা-বাবা কী যে খুশি হইছেন। এখানে একটা ব্যাপার আছে, আমি যেন নিজের অনুভূতিগুলো ঠিকঠাক বুঝাইতে সংকোচ বোধ করি, তেমনি আম্মা-বাবার মধ্যেও একটা লজ্জার ব্যাপার আছে যেন। ব্যাপারটা যে কোন পক্ষ থেকে শুরু হইছে আল্লাহ ভালো জানেন। বাড়ি পৌছার ঘণ্টা দু-এক পর তাদের পুরো ঘটনাটা জানালাম,শুধু ইআরসিপি রিমুভের ব্যাপারটা গোপন করে গেলাম। আরেকবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা শুনলে ভীষণ টেনশনে পড়ে যাবেন। আম্মা অনেকটা হতভম্ব হয়ে গেলেন। বারবার বলছিলেন, তাকে জানাই নাই কেন! কিন্তু এটা তো স্পষ্ট যে, উনি অনেক কিছু বুঝতে পারেন। যখন বাজে বাজে ঘটনাগুলো ঘটছিল, তিনি নানা সময়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। একটাই কথা, আমার জন্য মন কেমন যেন করছে।

বাড়িতে প্রথম কাউকে না জানালেও এক ফেসবুক পোস্টের সূত্র ধরে ছোটবোন জেনে যায়। তারও ভীষণ টেনশন নিয়ে ব্যাপারটা গোপন রাখতে হচ্ছিল। প্রায় ফোন করে জিগাসা করতো কেমন লাগছে, কষ্ট হচ্ছে কিনা। ও জানত না যে, এক সময় এ প্রশ্ন শুনতে শুনতে আমি বিরক্ত হয়ে উঠেছি।

সেই সফরে দুদিন বাড়ি ছিলাম। তারপর ঢাকায় ফিরে আসলাম। তখন আমার মধ্যে কিছু ফ্যান্টাসি চলে আসছে। মনে হলো, খুব পছন্দ করি এমন কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা না হলে চলবে না। যেমন; মিশু। যদি মরে-টরে যায়, তার আগে ওর সঙ্গে দেখা করে যাওয়া উচিত। ও যদিও আমার এত জটিলতার কথা স্পষ্টভাবে জানতো না। নওগাঁয় এসি ল্যান্ডের দায়িত্ব পালন করছিল। করোনার লকডাউনে কাজ করতে করতে ওর জান জেরবার অবস্থা। মাঝে মাঝে তাদের করোনা ঠেকানোর বিষয়গুলো জানার জন্য ফোন দিতাম।

একদিন ফোন করে বললাম, আমি আসতে চাই। ও রাজি হয়ে গেল। সেপ্টেম্বরের এক শুক্রবার অফিস করে কল্যানপুর থেকে বিকেলের গাড়ি ধরে রাত ১২টার দিকে পৌঁছে গেলাম নওগাঁ। মিশু শুধু আমার বন্ধু বা ছোট ভাই-ই নয়, মাঝে মাঝে মনে হয় ও আমার ছেলে। দুইদিন আগে দেখা হলেও মনে হয় অনেকদিন দেখা হয় নাই। সেইবার প্রায় ১০ মাস পর ওর সঙ্গে দেখা। নওগাঁর আত্রাইয়ে গেস্ট হাউসে ওর পাশের রুমে উঠলাম। গোসল দিয়ে মিশুর ধরা বিশাল একটা মাছের মাথা দিয়ে ভাত খাইলাম। এরপর টুথপেস্ট নিতে এসে গল্প করতে করতে ভোর ৪টা বেজে গেল।

ও আচ্ছা! আমার প্ল্যান ছিল বগুড়া ঘুরে দেখার। মিশুকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম বগুড়া চলে আসুক। ওই দিন রাতে থেকে পরদিন ঘুরেফিরে সন্ধ্যার গাড়িতে ঢাকায় ফিরবো। কিন্তু মিশুর রাতে থাকা মানে ড্রাইভারেরও থাকার ব্যাপার আছে। তাই ঠিক হয়েছিল, নওগাঁ থেকেই বগুড়া ঘুরব। কিন্তু সকালে খবরাখবর নিয়ে জানা গেল, বগুড়ার প্রধান পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ। আর মিশু কোনো বিশেষ সুবিধা নিতে আগ্রহী না। এটা নিয়ে আমারও আগ্রহ নাই। নওগাঁ আমার আগে খানিকটা ঘোরা ছিল। আমরা কুসুম্বা মসজিদে গিয়ে যোহরের নামাজ পড়লাম। করোনার মাঝে মসজিদে যাওয়া বন্ধ ছিল। অনেকদিন জুমা তো দূরের কথা ঈদের নামাজও পড়া নাই। এর আগে একদিন হাসপাতালে এমআরসিপি রেজাল্ট আনতে গিয়ে মাগরিব নামাজ পড়া হয়েছিল। রাশেদ থাকার কারণে। আর এ দিন যোহরের নামাজ। তারপর আদমদীঘি গেলাম অনেক পথ পাড়ি দিয়ে। এখানে আমি আগেও গেছিলাম। অদ্ভুত বিষয় হলো, বছর সাতেক আগের সেই ভ্রমণে আমি আর শাহনেওয়াজ খান জঙ্গলের মাঝে ঘুরেছিলাম। গা ছমছম অবস্থায় ছবিও তুলেছিলাম। এখন সেই সব জঙ্গলের কিছু নাই। তবে মানুষ সমাজ উঁচু উই ঢিবিগুলো রয়ে গেছে। দুনিয়াতে এই সব থাকা বা না থাকা একেকটা উদাহরণ বটে। যখন আমরা থাকবো না, যেন কখনো ছিলাম না। যেমন; মিশুকে জঙ্গলের বিষয়টা আমি বোঝাইতে পারছিলাম না।

সন্ধ্যার দিকে গেলাম ধীবর দীঘিতে। পাশের একটা মসজিদে আসর নামাজ পড়া হলো। অনেক দিন পর একটা মসজিদ দেখলাম যেখানে ফ্যান নাই। রাত বারোটার দিকে ঢাকার ট্রেন ধরলাম। মিশুর সঙ্গে কোলাকুলি করে ট্রেনে উঠলাম। মন খারাপ হয়ে গেল খুব। আর কী দেখা হবে। এটাও মনে হলো, একটা মিশন শেষ হলো। আমি চলে গেলেও একটা অপূর্ণতা অন্তত থাকবে না।

এ ঘটনাগুলো কেন বলছি? জাস্ট আমার মনের অবস্থা বোঝানোর জন্য। কতটা ভঙ্গুর হয়ে গেছিলাম আমি। কারণ কখনোই নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, এরপর আমি বলতে পারবো কিনা— হ্যাঁ, আমি সুস্থ হয়ে গেছি! আমার এ অস্থির সময়ে আপা সব সময় একটা কথায় বলতেন, কখনো আল্লাহর ওপর নারাজ হতে নাই। অসুখ-বিসুখ উনি দেন। উনি আমাদের সুস্থ্য করবেন। এমনকি ঝড়-বৃষ্টিতে বিরক্ত হতেও মানা করেন তিনি। কারণ, দুনিয়াতে সবকিছুর দরকার আছে। দারাশিকো ভাইও সান্ত্বনা দিতেন। বিশেষ করে আমাদের দুজনের জীবন বিষয়ক কিছু ধারণার মিল ছিল। আমরা ভাবতাম, প্রত্যেক মানুষের এই পৃথিবীতে আলাদা কাজ আছে। লক্ষ্য আছে। সেটা আমরা বুঝি বা না-ই বুঝি, আমরা সেই উদ্দেশ্য পূরণের দিকে এগিয়ে যাই। আসলে কি আমরা কখনো জানতে পারি কী সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য? এমনও হতে পারে, অন্য কারো জীবনে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ি, যেটা কখনো জানতে পারি না। রাশেদ অবশ্য এতটা কল্পনা বিলাসী ছিল না। তাসনিম আলমের ব্যাপারটা এমন যে, উনি যখন জানতে পারেন, নতুন কোনো অসুস্থতায় জড়িয়ে পড়েছি, বলতেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। আল্লাহ নাকি প্রিয় বান্দাদের অসুখ-বিসুখ দিয়ে থাকেন। মাসুম হয়ে যায় কি আমরা? আর আমি কি এতই প্রিয়! সব আল্লাহই জানেন।

চলবে …

Comments

comments