বাবা আর আমি পাশাপাশি

(ব্যর্থ এক সার্জারি নিয়ে ভোগান্তির কাহিনি এটা। যার মূল পর্ব শুরু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, এখনো চলমান। এখন একটা সিনেমাটিক ক্লাইমেক্সে দাঁড়ায়া আছে, আবার নাও হতে পারে। কল্পনা আমাদের মতো চললেও জগৎ নাও চলতে পারে। সেই গল্পে দুর্ধর্ষ কোনো অ্যাখ্যান নাই, বিরাট কোনো বাঁক-বদল নাই। অনেক বিরক্তিকর দীর্ঘশ্বাস আছে। কিন্তু এ গল্প আমার খুবই কাছের, আমার বর্তমান। আমার স্বজনদের জন্য পরীক্ষার, আমাকে ভালোবাসার। সেই গল্পটা আমার বন্ধুদের জানাতে চাই, অন্তত এক অধ্যায়ের সমাপ্তির আগে আগে। … অবশ্য পুরো গল্পটা এভাবে শেয়ার করা সম্ভব কিনা আমার জানা নাই।)

আগের পর্ব: অসুখের দিন

নোয়াখালী, সেপ্টেম্বর ২০১১/ নামলিপি: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

ছয় বা সাততলায় জেনারেল ওয়ার্ডে নেওয়া হলো। প্রায় বিশটার মতো বেড। রোগী বলতে একমাত্র আমিই। ইনজেকশন দেওয়া হলো। ব্যথা কমছে না। ডাক্তাররা বলল, সহ্য করতে হবে। সম্ভবত সাপোজিটরও দেওয়া হয়েছে ওই সময়। ছটফট করছি হাসপাতালের বেডে। ডাক্তার-নার্স সামলাতে পারছেন না। দুই-তিনটার দিকে একটু ব্যথা কমল। ততক্ষণে ভাগনেও এসেছে।

খেয়াল হলো, তারা দুই ভাই-বোন সেই কখন থেকে আমার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য বেডগুলো খালি হলেও তোষক উল্টানো, বিছানা চাদর নেই। বললাম, তোদের কষ্ট হচ্ছে। ওরা বলল, সমস্যা নাই। একজন নার্সকে ডেকে ওদের জন্য পাশের বিছানাটা ঠিক করতে বললাম। উনি বললেন, ৩০০ টাকা ভাড়া। বললাম, ঠিক করে দেন, ওরা কি সারারাত দাড়িয়ে থাকবে? আমি যদিও অনুভব করছিলাম না, কিন্তু ভালোই শীত পড়ছে। তারা রীতিমতো কাঁপছে। বিছানা ঠিক করে দিল, কিন্তু কম্বল দেওয়ার কোনো নামগন্ধ নাই। আবার ওদের মানা সত্ত্বেও নার্সকে ডাকলাম। কম্বল দিতে বললাম। নার্স ভেবেছিল আমার জন্য কম্বল। যখন বললাম, ওদের দিতে তখন খুবই বিরক্ত প্রকাশ করল।

ব্যাপারটা যখন মাথায় আসে, আমার আর ভালো লাগে না। নিশানের জন্ম আমি প্রাইমারি স্কুলে, আর নিপুণ আরেকটু পরে। ওদের আর আমার বেড়ে উঠা একই সময়ে। ওদেরকে সেই বাচ্চাটা হয়তো মনে করি, কিন্তু একই ধরনের ফিলিংস নিশ্চয় অন্যরা দেখাবে না। কিন্তু শীতের মধ্যে ওর কাঁপছে, তখন একটা কম্বল দিতে বিরক্তিবোধ আমাকে প্রায়শ বিষণ্ন করে তোলে।

রাতের শেষ দিকে ঘুম এলো। সকালবেলায় দেখতে এলেন চিকিৎসকদের চিফ ডা. অসীম। বেশ কিছু চেকআপ দিলেন। আলট্রাসনোগ্রাম বা ইউএসজি’র সঙ্গে এক্সরে ছিল সম্ভবত। বললেন, আপাতত খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। মাঝে মাঝে পানি খাওয়া যাবে। আর স্যালাইন চলবে। এবার এসে বকা দিয়ে গেলেন (এমন বকা সামনেও শুনতে হবে)। সারাক্ষণ শুয়ে থাকা যাবে না, হাঁটাহাঁটি করতে হবে। স্যালাইন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখি স্যালাইনের লাইনে রক্ত উঠছে। আবার শুয়ে পড়লাম।

যাই হোক, এই অধ্যায়টা ছোট করা যাক। এর আগের মাসে মানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে প্রথমবার কভিড-১৯ ধরা পড়ে। এ নিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে নানা ধরনের খবর পরিবেশিত হচ্ছে। তবে সতর্কতা নিয়ে ততটা আলোচনা তখনো শুরু হয় নাই।

দুই দিনের মাথায় জানানো হলো হাসপাতাল থেকে আমার ছুটি হচ্ছে। এখন শক্ত খাবারও খেতে পারছি। ডা. অসীম জানালেন, খাবারের সমস্যাজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। টেস্টে খারাপ কোনো ইঙ্গিত পাননি। প্রথমে তারা অ্যাপেন্ডিসাইট ভাবলেও এ ধরনের কিছু নেই। কিছু ওষুধ দিলেন, বললেন ছয়-সাত দিনের মাথায় আরেকবার ফলোআপের জন্য আসতে।

এর দু-তিনদিন পর আপা-দুলাভাই বাসায় ফিরলেন। সঙ্গে আসলেন বাবা, উনিও ডাক্তার দেখাবেন। বুকে ব্যথার মতো একটা ব্যাপার। হাসপাতাল থেকে ফেরার পরও আমার শরীরের কোনো উন্নতি হয় না। খেতে পারছি না ঠিকমতো, হাঁটাচলাও কষ্টকর। বুকের মাঝামাঝি একটা ব্যথা সারাক্ষণ থাকে। খুব তীক্ষ্ন না, কিন্তু সারাক্ষণ এ অস্বস্তি। বোঝা যাচ্ছে, কোথাও একটা ঝামেলা হয়েছে।

সাধারণত আমাদের কোনো অসুখ-বিসুখের কথা আম্মা-বাবাকে শোনাতে চাই না। তারা সারাক্ষণ শুধু এ নিয়ে চিন্তা করবেন। কিন্তু বাবাকে দেখে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। তখন শুয়ে ছিলাম। দেখি বাবা এদিক-ওদিক হাঁটছে, নানা বিষয়ে কথা বলছে। কিন্তু আমার পাশে বসছে না। বেশি কিছু জিজ্ঞাসাও করেন না। আমাদের একটু ছুঁয়েও দেখে নাই। কী যে মন খারাপ হলো। বলেই ফেললাম, আপনি এতক্ষণ হয় আসলে আমার পাশে বসলেন না, আমাকে একটু মাথা হাতও বুলিয়ে দিলেন না।

ছোটবেলায় বাবা কোলে নিয়ে না হাঁটলে বা পিঠে আস্তে আস্তে থাপ্পড় না দিলে ঘুম আসতো না। এখনো বাবার সঙ্গে ঘুমালে একই কাণ্ড করতে হয়।

আমাদের আচরনে বাবা বিব্রতবোধ হলেন। একটু লজ্জা নিয়ে বললেন, আমি কতদূর থেকে আসছি। তুই অসুস্থ তাই তোরে ধরি না। হাত-মুখ না ধুয়ে তোর পাশে কী করে বসি। তবুও আমি ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলাম। বাবা আমার পাশে বসলেন। মাথায় বুলাতে লাগলেন। আমার মনটা এতই গলে গেল যে, বাবা-আম্মাকে অসুখ নিয়ে কিছু বলে যাবে না এমন বিষয় ভুলে গড়গড় করে নিজের সব দুঃখের কথা খুলে বললাম। বাবার খুব মন খারাপ হয়ে গেল।

খেতে পারি না ঠিকঠাক, চলাচলও ঠিক নাই। সারা দিন শুয়ে থাকি। রাতে আমি আর বাবা একসঙ্গে ঘুমায়। দুজনই অসুস্থ, প্রায় সারারাত জেগে থাকি। যখনই ডাকি ‘বাবা’, দেখি বেশির ভাগ সময় উত্তর দেন ‘কী আবু’। কখনো উনার পিঠে আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, কখনো বা তিনি। আমার তো ঘুমই আসে না। যখন চোখ লেগে আসে অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি, এভয়েড করতে চাই, পারি না। স্বপ্ন যেন আরও জেঁকে বসে। সবচেয়ে বাজে বিষয় হলো নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলা। যেন আমি আমার সামনে বসে আছি। যতই বলি ‘চুপ থাক’। মাথার মধ্যে অন্য আমি অবিরাম কথা বলতেই থাকে। মাঝে মাঝে বলি, প্লিজ চুপ করো করো। কিছুতে কিছু হয় না, যখন কেউ কথা বলে না, একের পর এক দৃশ্য এসে চোখের সামনে ঘুরতে থাকে। সকাল হলে বাবা উত্তরার একটা হাসপাতালে যান। আমি সারাদিন শুয়ে থাকি, ওষুধ চলছে।

বাবার আসার পর যে ব্যাপারটা হলো— ছোটবেলার কোনো একটা স্মৃতি মাথায় আটকে গেছিলো। অসুস্থ হওয়ার পর বাবা আমাকে বড় কোনো ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি শক্ত করে তার হাত ধরে আছি। এ স্মৃতি এতই পোক্ত যে, এসএসসির পর থেকে বাবা-আম্মার সঙ্গে না থাকলেও যেকোনো অসুখে একজন ফাদার ফিগার খুঁজতাম। কেউ যদি আমাকে হাত ধরে নিয়ে না যেতো তবে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হতো না। বিশেষ করে ইউনিভার্সিটিতে থাকতে খুবই ঝামেলা হতো। অনেক সময় দেখা গেল জ্বরে পড়ে আছি, ডাক্তারের কাছে যাওয়া হচ্ছে না। অথচ একটা কল দিলে মেডিকেল থেকে অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। বাবা আসায় মনে হলো, আমার আর কোনো ঝামেলা থাকবে না। যদিও জানি না আসলে ঝামেলাটা কী। আমি পরিবার ও বন্ধুদের কাছে কৃতজ্ঞ যে অসুস্থতার প্রতিটা পর্যায়ে তারা আমাকে হাত ধরে ছোটাছুটি করেছেন।

এক সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগে বাবাকে নিয়ে ডা. অসীমের কাছে গেলাম। উনি বললেন, কোনো সমস্যা নাই। এমন তো হওয়ার কথা না। জ্বর থাকবে কেন? আর ব্যথাও হওয়ার কথা না। আমরা পরীক্ষা করে তো কিছু পেলাম না। আবার ইউএসজি করেন। সঙ্গে এনডোসকপিও করেন। উত্তরার পপুলার ল্যাবে করতে বললেন। ইউএসজিতে একজন ম্যাডামের নাম লিখে দিলেন। আরও এক সপ্তাহের ওষুধ দিয়ে বললেন, এরপর যেন করি।

এর মাঝে অফিসে যাওয়া শুরু করলাম। একদিন খবর হলো মেজো খালু খুবই অসুস্থ। হলি ফ্যামিলিতে হাসপাতালের আইসিইউতে আছেন তিনি। ডাক্তার একপ্রকার আশা ছেড়েই দিয়েছেন। সেদিন অফিসে গেছিলাম। বাসার সবাই গেছিলো খালুকে দেখতে। বাংলামোটর মোড়ে যেহেতু অফিস, ভাবলাম হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিটই তো লাগে। হায় আল্লাহ! এতটুকু পথ হাঁটতে আমার কত যে কষ্ট হলো। হলি ফ্যামিলির বিশাল করিডোর ধরে হাঁটছিলাম, মনে হচ্ছিল এখনই হয়তো মাথা ঘুরে পড়ে যাবো, এর মধ্যে খিদাও লেগেছে। যেহেতু এক মুহূর্ত আগের দৃশ্যও অনেক সময় অবিশ্বাস্য মনে হয়। বুঝতে পারলাম আমি অনেকটাই অসুস্থ।

হাসপাতালের আইসিইউতে একজন একজন করে খালুকে দেখার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আমাকেও যেতে বলল। কিন্তু যাইতে ইচ্ছা হলো না। অন্যদিকে দুলাভাই ও এক খালাতো বোনের জামাইয়ের ফিসফাসে যা শুনলাম— খালুর ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নাই। অন্তত ডাক্তার তাদের বলছেন। হু হু করে হাসপাতালের বিল বাড়লেও ইমোশনের কারণে এ কথা কেউ খালা বা খালাতো বোনদের বলছে না।

আবার অফিস যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। এখন আতঙ্কের নাম যেন এনডোসকপি। কলেজে পড়াকালের ঘটনা। তখন রাসেলদের বাসায় খুব আসা-যাওয়া ছিল। একদিন ওদের বাসায় গিয়ে দেখি থমথমে অবস্থা। কী হলো? আন্টি খুবই অসুস্থ। উনাকে ফার্মগেটের একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। দেখতে গেলাম। দেখি আন্টি খুবই আতঙ্কিত। তার ভাষ্যে, একটা ডাক্তার আসছে। আজরাইল যেন। উনার মুখ দিয়ে একটা পাইপ ঢুকিয়ে দিলেন। উনার তো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার মতো অবস্থা। পরে জানতে পারলাম, এ পরীক্ষার নাম এনডোসকপি। গলা দিয়ে সরু পাইপের মাধ্যমে ক্যামেরা ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয়। এ বিষয়টা মনে পড়তে খুবই ভয় পেলাম। একদিন বিকেলে সবাই খালুকে দেখতে গিয়েছিলেন, আমি বাসায় একা। জ্বরে কাঁপতেছিলাম, কী যে কান্না পেল। আম্মার কথা মনে পড়ছিল। কন্নড় ‘কেজিএফ’ সিনেমার একটা গান আছে মাকে নিয়ে। এ গানটা কয়েকবার শুনলাম।

অবশ্য ততদিন রাতের বেলায় দুঃস্বপ্নগুলোকে সামাল দেওয়ার চেষ্টায় খানিকটা সফলই হলাম বোধহয়। যেহেতু নিজের ভুলগুলো চোখের সামনে ভাসতো। ভাবতাম এবার ভালো হলে জীবন নতুন সাজাবো। এর মাঝে এমন এটা খবর শোনা গেল, খাবারের মাধ্যমে বিষাক্ত কিছু শরীরে ঢুকেছে। যেটা ইচ্ছা করে কেউ খাইয়েছে। এ খবর শুনে রাতারাতি নতুন করে জীবন সাজানোর স্বপ্ন মিলিয়ে গেল। তবে একটা ব্যাপার যে, এটা পরে উপলব্দি করলাম— স্বল্পমেয়াদি অসুস্থতার মধ্যে জীবনকে রিভিশন দেওয়া সম্ভব। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার ক্ষেত্রে আমাদের স্বপ্নগুলো ভেঙে যায় দ্রুত। জীবন চারদিক থেকে দুর্বিষহ হয়ে উঠে। সে ক্ষেত্রে অসুস্থতা ছোট বা বড় কোনো ব্যাপার না। অপেক্ষার মুহূর্তগুলো দিন দিন কঠোর হয়ে উঠে। চারদিকের প্রতিক্রিয়াও সমান থাকে না।

সম্ভবত ৩১ জানুয়ারি ছিল। সারাদিন না খেয়ে ছিলাম। ভাগনিকে নিয়ে বিকেল বেলায় পপুলারে গেলাম। এনডোসকপির সিরিয়াল দিয়ে ইউএসজি করাতে গেলাম। সেখানকার ম্যাডাম তো অবাক। উনি বললেন, আপনার গলব্লাডারে পাথর, বাম কিডনিতেও পাথর আছে। আগের পরীক্ষায় ধরা পড়লো না কেন? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর তো নাই।

এরপর এনডোসকপি করতে গেলাম। দরোজা খুলে ঢুকতেই আমাকে চমশা খুলে রাখতে বলা হলো। সম্ভবত এ পরীক্ষার নিয়ম এমনই আমাকে দ্রুত বেডে শুয়ে পড়তে বলা হলো। দেখলাম মাথার কাছে একজন নারী, বিয়ের পোশাক পরা। চশমা না থাকায় সব ঘোলা। এমন দৃশ্য ভয় জাগানোর মতোই। অল্প সময় লাগলেও এনডোসকপি ভীতিকর একটা বিষয়। ওই মহিলা আমার মাথা ধরেছিলেন। তবে বেশি যন্ত্রণাকর কিছুর অপেক্ষায় থাকায় ততটা ভয়ংকর কিছু হলো না। ডাক্তার বললেন, ওয়াহিদ সুজন আপনার কোনো সমস্যা নাই। সব পরিষ্কার। অথচ আমার ধারণা ছিল, আমার খাদ্যনালি হয়তোবা একটা এবড়ো-তোবড়ো রাস্তার মতো হবে!

গলব্লাডারের পাথর আমাদের পরিবারে নতুন কোনো বিষয় নয়। আম্মা-বাবারও এ অপারেশন হয়েছিল। কিন্তু তাদের এতটা ভুগতে হয় নাই। যখন অনার্স ফাইনাল দিচ্ছিলাম আম্মার অপারেশন হয়। পরীক্ষা বলে আমাকে জানানো হয় নাই। আর পাশ করে ঢাকায় চলে আসি বাবার অপারেশন হয়। বাবা তো দেড়দিনের মাথায় রীতিমতো হেঁটে বাসায় চলে গেছিলেন। এমনকি আমাকে না দেখে হাসপাতাল ছেড়ে রাস্তা পার হয়ে বহুতদূরও গেছিলেন রিলিজের আগে। আমার এ গড়বড় অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম বাবাকে কিছু জানাবো না। বাসায় এসে বাবা ছাড়া সবাইকে এ ঘটনা বললাম।

পরদিন সন্ধ্যায় একা একা ডা. অসীমের কাছে গেলাম। রিপোর্ট দেখে তো রেগে লাল। হাসপাতালের ল্যাবের লোকজন, আরও কাকে কাকে যেন তলব করলেন। আমাকে বাইরে বসতে বললেন। নিজের হাসপাতালে ভুল রিপোর্ট আসায় রেগে গেছেন তিনি। আমাকে পরামর্শ দিলেন ভালো একজন সার্জেনের খোঁজ করতে। সপ্তাহখানেক প্রতিদিন একটা ইনজেকশন নিতে বললেন। কিন্তু যেহেতু অফিস আছে, তাই ক্যানোলা লাগানো আমার পক্ষে সম্ভব না। পরামর্শ করলাম ডা. শাহ মোহাম্মদ ফাহিমের সঙ্গে। তিনিও বললেন, ইনজেকশনে যাওয়ার দরকার নাই। দ্রুত ডাক্তার খুঁজে অপারেশনটা করাতে। আমরা চাইছিলাম না বাবা থাকা অবস্থায় ছুরি-কাচির নিচে যেতে। বাবা হয়তো এটা সহ্য করতে পারবেন না।

যদিও গলব্লাডার অপারেশন খুবই মামুলি একটা ব্যাপারের মতো। কিন্তু কাটাকাটি বা রক্তের বিষয় কখনো কারো ভালো লাগার কথা না। এছাড়া একটা শঙ্কার বিষয় তো থাকে। আম্মা বা বাবার ক্ষেত্রে বিষয়টা জটিল ছিল না। ক্রমাগত জ্বর, ওজন কমতে, খেতে না পারা, দুঃস্বপ্ন মিলিয়ে রয়ে গেলাম দ্বিধায়।

দুজনের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি এ অংশে। হাসপাতালে ভর্তিকালীন দেখতে এসেছিলেন নাজমুল হাসান দারাশিকো। আমরা অনেকদিন ধরে বাংলা মুভি ডেটাবেজ নামে একটা সাইট চালিয়ে নিচ্ছি। উনি একদিন ফোন করে জানতে চাইলেন, টাকা লাগবে কিনা। আরেকদিন অনেকটা সময় নিয়ে আমার কথা শুনলেন ও দরকারি পরামর্শ দিলেন শাহাদাৎ তৈয়ব ভাই। শেষে টাকা দিতে চাইলেন। যেখানে অনেক বন্ধু জানা সত্ত্বেও খবর নেন নাই, সেখানে তাদের এ সাহায্যের আবেদন আমি সারা জীবন স্মরণ করবো।

চলবে…

Comments

comments