এক.
হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের কথা মনে হইলেই একটা দৃশ্য চোখে ভাসে। কলেজে পড়া একটা ছেলে ফার্মগেটে গেছে ঈদ কার্ড কিনতে। আসার পথে তেজগাঁও কলেজের সামনের ছোট দোকানটা থেকে কিনে নিয়ে আসছে একটা বই। সেবার অনুবাদে ‘রিটার্ন অব শি’, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের বই। এটা তার বিখ্যাত চরিত্র আয়শার ফিরে আসার গল্প। কলেজে পড়া ছেলেটা আমি। বলতেছিলাম নিজের চোখে নিজে ভাসতেছি। ব্যাপারটা কেমন না! কিন্তু এমনই হয়।
‘শি’ (১৮৮৭) পড়েছিলাম সম্ভবত অনিন্দ্যের কাছ থেকে নিয়ে। ছেড়াফাড়া একটা বই। রাত জেগে শেষ করেছিলাম। কি যে অদ্ভুত সে কাহিনী। শেষে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়, যেভাবে সবার হয় আরকি! আয়শার অন্তর্ধানের পর লিও সব চুল সাদা হয়ে যায়। পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নের মতো। এতে মানব জীবনের পাওয়া-না পাওয়ার একটা চিরায়ত দীর্ঘশ্বাস তো ছিল। যার কারণে ‘রিটার্ন অব শি’ (১৯০৫) খুঁজতেছিলাম। কিন্তু মানুষের দীর্ঘশ্বাসের তো শেষ নাই। না পাওয়াই ছিল লিওয়ের প্রেমের একমাত্র সান্ত্বনা।
‘শি’র মূল চরিত্র আয়শা নামের এক প্রজ্ঞাবান নারী। আরও আছে তার প্রেমিক লিও ও লিওয়ের পালক বাপ হলি। নানা জম্মে নানাভাবে আয়শা ও লিও পরস্পরের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে। কিন্তু নিয়তি তাদের মাঝে দেয়াল হয়ে থাকে। তবে আয়শার সঙ্গে অমরত্বের একটা বিষয় থাকে। কিন্তু লিও ও হলিকে বারবার জম্মাতে হয়। আয়শাকে কখনো ফারাও মন্দির, কখনও গ্রিসে, কখনও তিব্বত অথবা উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখা যায়। প্রায় একযুগ আগে পড়া। এত কি মনে থাকে! এভাবে অমরত্বের সঙ্গে আয়শা প্রজ্ঞাবতী এক নারীতে পরিণত হন।
ও হাঁ, তাদের এক শত্রু আছে। একজন নারী। যে একেক জম্মে একেক রূপে দুজনের মাঝে দাড়ায়। পুরো বিষয়টার মধ্যে অন্যরকম কোনো মেটাফরিক কোনো বিষয় থাকতে পারে। ওই যে চিরায়ত বিরহ এবং একইসঙ্গে জ্ঞান মানুষকে কিভাবে ক্ষমতা দেয় ও অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলে। উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা গেলো আয়শা চরিত্রটিকে সিগমন্ড ফ্রয়েড ও কার্ল ইয়ঙের মনোসমীক্ষণে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।
ফেসবুকের কয়েকটি গ্রুপে হ্যাগার্ডের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সংক্ষিপ্ত জীবনীর লিংক শেয়ার করেছিলাম। দেখা গেছে এক গ্রুপে একশয়ের মতো লাইক ও বেশ কটা মন্তব্য পড়েছে। বেশ তো! এ থেকে বুঝা যায় তার জনপ্রিয়তা এখনও কমে নাই- সাত সমুদ্দুর তের নদী দূরের বাংলাদেশেও। ‘শি’ নাকি ১৯৬৫ সালের মধ্যে ৮৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। অনুদিত হয়েছে ৪০ এর বেশি ভাষায়। যাকে বলা হচ্ছে কখনও নাকি আউট অব প্রিন্ট হয় না- এমন বই।
চাকরিসূত্রে আফ্রিকা মহাদেশ সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞানলাভ করেন হ্যাগার্ড, সে সব অভিজ্ঞতাই ছিল তার বইগুলোর মূল উপজীব্য। তবে এমন সব অঞ্চল নিয়ে লিখেছেন, যেগুলো ইংরেজদের কাছে ছিল অনেকটাই অপরিচিত ও অদ্ভুত। এ বইগুলোতে আফ্রিকা ও প্রাচ্য সম্পর্কে প্রচলিত শ্বেতাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ রয়েছে। বিশেষ করে অ-ইউরোপীয় দেশগুলো এসেছে জাদু, কুসংস্কার ও প্রেম-প্রতারণার কাহিনীর প্রেক্ষাপটে। তা সত্ত্বেও আফ্রিকানদের অনেকটা সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখেছেন ও তারা হয়ে উঠেছে অনেক কাহিনীর প্রধান চরিত্র। তার কাহিনীর বড় একটি অংশজুড়ে আছে আফ্রিকার জুলু ও ইগনসি উপজাতি। এ ছাড়া ভাইকিং, প্রাচীন মিসর ও ইসরাইলকে তিনি কাহিনীর প্রেক্ষাপট করেছেন।
শোনা যায়, হ্যাগার্ড নাকি ভাইয়ের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ (১৮৮৩) এর চেয়ে জনপ্রিয় বই লিখবেন। সেবা প্রকাশনীর সূত্রে সেটাও পড়েছিলাম। ‘কিং সলোমনস মাইনস’ (১৮৮৫) লেখার পর সেটি ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ এর চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়। আমার অবশ্য ট্রেজার আইল্যান্ডই ভালো লেগেছে। কেননা, ছোটবেলায় ইচ্ছে ছিলো জলদস্যু হবো।
সলোমনের গুপ্তধনের মাধ্যমে লস্ট ওয়ার্ল্ড নামের সাহিত্যের একটা ঘরানা তৈরি হয়। এ হারানো দুনিয়াটা কী? এটা হলো সে দুনিয়া যেখানে পশ্চিমের শিক্ষা-সভ্যতা-মানবতার রোশনি ঝিলিক তখনো দেখা দেয়া শুরু হয় নাই। কিন্তু একটা জাতি আলো ছাড়া কেমন থাকে গো। যাইহোক সে প্রশ্নের কোনো মুসিবিদা আছে কিনা ইয়াদ নাই। যেহেতু সময় অনেক কিছু ভুলাইয়া দেয়। এ যে পশ্চিমার নিজের ঘরের কাহিনী তা তো ফকফকা, হয়তো তাই ট্রেজার আইল্যান্ডের চেয়ে সলোমন জনপ্রিয় ছিল। কুসংস্কার আমাদের আলোকিত চিত্তে অনেক মজা উৎপাদন করে। শেষমেষ দেখা যায় অ্যালান কোয়াটারম্যানের ফাই ফরমায়েশ কাটা লোকটা কিনা উপজাতিতে ভবিষ্যত নেতা।
আরেকটা কাহিনী পড়ছিলাম কোয়াটারম্যানের প্রেম নিয়া। যেখানে নেশার ঘোরে আরেকজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে বরফযুগে চলে যান। যার সঙ্গে কখনও মিল হবে না। বাস্তবে হ্যাগার্ড যাকে ভালোবেসেছিলেন তাকে বিয়ে করতে পারেননি। ওই ভদ্রমহিলা একজন ব্যাংকারকে বিয়ে করেন। পরে ওই লোক দেউলিয়া টাইপ কিছু হয়ে সম্ভবত বউকে ত্যাগ করে। পরে হ্যাগার্ড সারা জীবন প্রাক্তন প্রেমিকা ও তার সন্তানের ভরপোষণ করেন। তবে তিনি নিজে বিবাহিত ছিলেন। সে অর্থে লিও বা কোয়াটারম্যানের জনম জনম অপেক্ষা হয়ত আর কিছু নয় হ্যাগার্ডের নিজেরই অপেক্ষা ও অতৃপ্তি।
এ কাহিনীর নারী নেতৃত্ব ও শ্বেতাঙ্গ প্রধান্য নতুন কিছু নয়। নতুন কিছুই বা কেন হবে। এর মধ্যে এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার না থাকলে কি চলে। আর সময়টা তো ভিক্টোরিয়ান আমল। অন্যদিকে আয়শাও এক সাদা রমণী। যাকে সম্মান করে বলা হয়- যাকে সম্মান করতে হবে। ফলে সাদা মানুষ ও নারীর শাসন দুইটায় গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। ফলে শি-র জনপ্রিয়তা আমাদের মাঝে হ্যাগার্ডের চিরন্তন বিরহের সঙ্গে সাদা নারী এবং যে নারীকে সম্মান করতে বাধ্য তার প্রতি শাসকসূলভ শ্রদ্ধা জারি রাখে। যার প্রধান দাবি হলো বিচারহীন আনুগত্য। তাই লিও যখন ‘অমরত্ব’কে সংশয় করে, হারাতে হয় আয়শাকে। শিক্ষা লাভ হয় তারে আমরা চাই- কিন্তু সে আমার নয়। তার মধ্য দিয়ে সাদা মানুষদের জ্ঞান ও ক্ষমতা অক্ষয় হয়ে জারি থাকে। তবে এ অর্থে এসব কষ্ট-বেদনা আসলে জ্ঞানের বেদনা। যা প্রাপ্তির তুলনায় কম নহে।
দুই.
হ্যাগার্ডের উপন্যাসের একটা জিনিস আমার ভালো লাগত। উপন্যাসের শেষটায় কী আছে মানে প্রধান চরিত্রগুলোর কপালে কী আছে- তা প্রথমেই বলে দেয়া হইত অথবা অনুমান করা যাইত। এবারের সংগ্রাম হলো নিয়তির সে বিধানকে মোকাবেলা করা। কিন্তু তারা তা পারে না। এটা পাঠকরে হয়ত অলস করে দিতে পারে। কিন্তু শিক্ষা হলো বীর নিয়তি জানা সত্ত্বেও তারা মোকাবিলা করতে যায়। পারে না কিন্তু অমর হয়ে থাকে। আর প্রেমিকার অমরত্ব? সে ক্ষেত্রে আয়শা’র মতো অমর না হলে মানুষের চলে কিন্তু প্রেমিকা অমর না হলে প্রেম চলে না।
“শিক্ষা হলো বীর নিয়তি জানা সত্ত্বেও তারা মোকাবিলা করতে যায়। পারে না কিন্তু অমর হয়ে থাকে। আর প্রেমিকার অমরত্ব? সে ক্ষেত্রে আয়শা’র মতো অমর না হলে মানুষের চলে কিন্তু প্রেমিকা অমর না হলে প্রেম চলে না।”— অসাধারণ কথা বলে ফেলেছেন। বাস্তব একটা কথা।
ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকুন।
🙂