এক.
ইউসুফ-জুলেখা মাত্র দুই-তিন পর্ব দেখছি। তাও পুরো না। তারপরও যা দেখছি চিন্তায় পইড়া গেছি। এর একটা কারণ হতে পারে ঐতিহাসিক বা ধর্মীয় বা মিথের যে কোনো ফর্মে উপস্থাপনে এমন কিছু উপলব্ধির বর্ণনা, প্রশ্ন ও সাওয়াল থাকে, যা সবসময়ই নাড়া দেই। সে কারণে বোধহয় ওই ধরনের গল্পে আমরা সাড়া দিয়ে থাকি।
সাধারণত, আমরা যারা প্রাকটিসিং মুসলিম— তাদের মধ্যে (বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে) ধর্ম নিয়া নানান শঙ্কা কাজ করে। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাধা-বিপত্তির পাশাপাশি বিষয়ী আকারে নিজের ধর্ম ও তার অনুষঙ্গকে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রেও। বিজ্ঞানবাদীতা, বুদ্ধিবাদীতার রমরমা বাজার তো একটা প্রেক্ষিতই বটে! যেহেতু আমারে এসবের মধ্যেই আগাইতে হচ্ছে।
ব্যাপারটাকে আরেকটু আগায়া দেখলে— এমন শঙ্কা সব ধর্মের, সব যুগেরও। ‘ইউসুফ-জুলেখা’র একটা পর্বে দেখলাম রাজা নিজেকে খোদা দাবি করায় দেবতার পূজারীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। দেবতার সম্মান রক্ষায় তারা রাজাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কারণ, রাজাকেও তাদের খোদা মানতে হচ্ছে। অর্থাৎ, খোদা সংক্রান্ত ঈমানে বাধাগ্রস্ত হইলে তাদেরও জ্বলে। তাইলে তারা কেন নিজেদের খোদারে বাদ দিয়া ইউসুফ যার কথা বলছেন তাকে গ্রহণ করবেন। এ প্রশ্নটা আমার মধ্যে খাড়া হলো। আর তাদের একটা অংশ হয়তো ইউসুফকে শেষ পর্যন্ত মানবেনই না। ইউসুফ রাজদণ্ড পাইলে তাদের কি করবেন?
দুই.
ইউসুফ তো বানু জুলেখার অভিযোগ মাথায় নিয়া জেলে গেলেন। দুনিয়ার বন্দিত্বের বিপরীতে জেলখানায় মুক্তির তালাশ করলেন তিনি। ব্যাপারটা জুলেখাকে আরো রাগিয়ে দিল। সিদ্ধান্ত নিলেন ইউসুফের উপ্রে নির্যাতনের ব্যবস্থা করবেন। তো, এইটাও ইউসুফ মাইনা নিলেন। শরমিন্দা হইলেন জেলার। জুলেখা এরপর কী করে সেটাই দেখার বিষয়। জুলেখাকে মনে হইতেছে আগ্নেয়গিরি— নিজের আগুনেই ছারখার। অন্যদিকে ইউসুফ যেন মহাসমুদ্র। শান্ত, শীতল ও মুগ্ধকর। পাশাপাশি একই জেলে বন্দি আছে রাজাকে যারা অর্ধ-ঈশ্বর মানেন না তাদের কেউ কেউ, তারা হলেন আমন দেবতার পুজারী। আর কিছু দুর্বল মানুষ। তারা দুনিয়ার সব জায়গায় নির্যাতিত। জেলে ঢুকেই নির্যাতিতদের পক্ষ নিলেন ইউসুফ।
তিন.
ইউসুফকে যখন জেলখানার ভয় দেখানো হলো— তিনি জানালেন, বানু জুলেখা ও অন্যান্য নারীর ষড়যন্ত্রের চেয়ে বড় জেলখানা আর নাই। বরং জেলখানায় গিয়াই তিনি মুক্তি পাবেন। এছাড়া অভিযোগ ভূয়া হলেও ইউসুফের শাস্তি না হইলে জুলেখার তো সম্মান থাকে না। তারে জুলেখার সম্মানও বাঁচাইতে হবে। আহা! ইউসুফের তো সম্মান নামের এমন মেকি জিনিসের দরকার পড়ে নাই। তাকে সম্মানিত করেছেন খোদা।
চার.
আমার হালকা-পাতলা চিন্তায় দুইটা ব্যাপার মাথায় আইলো। প্রথমত. মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা ও অনিশ্চয়তা নিয়া বরাবরই সচেতন থাকতে চায়। আত্মসচেতনতার মধ্যে বৃহত্তরের অংশ হওয়া বা বৃহত্তরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা হাজির হয়। এ হাজিরানায় ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ধরেন রাষ্ট্রের মতো একটা বৃহত্তর সামাজিক সংগঠনে সে নিজেকে হাজির করে। সে ধরতে পারে এ সংগঠনের জন্য তার সম্মতি-অসম্মতির ব্যাপার আছে, যদিও সে গণতন্ত্র বানায়া, আইন বানায়া তারে শ্রদ্ধা করে, অন্যদের শ্রদ্ধাও দাবি করে। যদিও জিনিসটা সে নিজে বানাইছে। আবার এ জিনিসটা সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে। কিন্তু এটা তার আকাঙ্ক্ষার বাইরের দিক মাত্র। আবার সে নৈতিকতা আরোপ করে, তা মূলত ধর্মগত চেতনা। যদিও ধর্মকে স্রেফ নৈতিকতা পর্যবসিত করা ধর্মকে খণ্ডিত করা। ধর্মের জায়গায় সে এমন বৃহত্তর কিছুকে আবিষ্কার করে, যা তার অস্তিত্ব-অনস্তিত্ত্বকে অর্থ দান করে।
ধর্মের এ অর্থে উপলব্ধিগত ব্যাপার থাকে— বাট তার সম্মতির জন্য অপেক্ষা করে না। কেউ সম্মতি দেয় মানে এমন না ধর্ম সে বানায়। ‘ইউসুফ-জুলেখা’য় দেখা যায় যারা হযরত ইউসুফের অনুসারী হচ্ছেন— তারা আত্মসচেতনতার চূড়ান্ত পর্যায়ে দাড়িয়ে আছেন। তারা যুক্তিগত বা অন্য কোনো পন্থায় খোদার ধারণা পেয়েছেন। আত্মসচেতনতার পরিপূর্ণতার ক্ষেত্রে তাদের বিশ্বাস করা ইচ্ছাই উদ্দিষ্টের দিকে চালিত করেছে। ধর্মের দিক থেকে ইউসুফ উপলক্ষ। তিনি পথ প্রদর্শক আকারে হাজির। হাজির তাদের কাছে পথ চায়! বা বাছ-বিচারে আগ্রহী। দেখার বিষয় চূড়ান্তের ধারণার মধ্যে তারা প্রথমে তুলনা করছে। এরপর প্রায়োগিক ক্ষেত্রে হাজির হচ্ছে। আধ্যাত্মিক লেন-দেন বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
দ্বিতীয়ত, ধর্ম নিপীড়িতকে ভাষা দেয়। নিপীড়িত সত্যকে আকড়ে ভবিষ্যত নির্মাণ করতে চায়। এটা কি সব যুগে সত্য নয়! মানুষের আধ্যাত্মিক সত্য এমন কিছু যা অদেখার প্রতি সমর্পণ ও তার সঙ্গে সম্পর্কের ভাষাকে প্রস্ফুটিত করে। তেমনি নিপীড়িত মানুষ মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও দেখে ধর্মে। একত্ববাদী ধর্মের এ ভাষাটা গুরুত্বপূর্ণ যে একের নামের সকল আকাঙ্ক্ষার সমর্পণ ও মুক্তির প্রতি ভাষা তৈরি করা। যে ভাষায় ভ্রাতৃত্বের ধ্বনি থাকে। ইউসুফ তাই রাজপ্রাসাদের চেয়ে কারাগারকে বেছে নেন। দৃশ্যত যারা নানা দোষে অপরাধী, আবার অপরাধের সাজা দেওয়ার নামে তাদের উপর জুলুম করা হচ্ছে। অপরাধ ও সাজার মধ্যে ভারসাম্য থাকা না থাকার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু অনুমান করা যায়।
তবে হ্যাঁ, একের নামে সবাইকে ডাকা সত্ত্বেও সবাই সাড়া দেবে ব্যাপারটা তো এমন না। তখন যারা দাবি করে— সত্য পেয়েছেন। তাদের ওপর এ হক্ব (সবাই ভাবে কিনা জানি না/যৌক্তিকভাবে বোঝার চেষ্টা করলাম, এটারে ধর্মীয় সত্য বলে আপাতত চাপায়া দিতে রাজি না) বর্তায় যারা সত্য গ্রহণে প্রত্যাখান করেছেন তাদেরও একের বান্দা হিসেবে গ্রহণ করা। ইউসুফ-জুলেখা এতদূর পর্যন্ত যাই কিনা জানি না!
ধর্মের আরো ব্যাপার আছে বটে! যেটা আমি নানা সময় নানা কারণে ভাবতে পারি। তবে ‘ইউসুফ জুলেখা’ এ পর্যন্ত নিছে।
পাঁচ.
‘আলিফ লায়লা’ বা ‘হাতিম তাঈ’কে যেভাবে বাঙালি সেক্যুরালদের নেওয়া সম্ভব— ‘সুলতান সুলেমান’ বা ‘ইউসুফ জুলেখা’কে নেওয়া সম্ভব না। বিশেষ করে ইসলামের প্রতি তাদের তাচ্ছিল্য ও ইসলাম (দূরবর্তী হলেও) সম্পর্কিত বিষয়াদিকে ‘সাম্প্রদায়িক’ নাম দেওয়ার বাতিক। ব্যাপারটা সংখ্যাগরিষ্টের মাঝে নিপীড়িতের বোধ আনে কিনা তারা কি ভাবেন? এখানে উল্লেখিত প্রথম সিরিয়ালটি ধর্মীয় বয়ান না, কিন্তু আমাদের দেখা-চেনা একটা দুনিয়ার বাইরেও অন্য একটা জগতে ‘আল্লাহ’, ‘রাসুল’, ‘ঈমান’, ‘আদল’, ‘ইসলামের ইতিহাস’ ফ্যাংশন করে যতই তারে হেরেম বা ক্ষমতার কাড়াকাড়ি দেখা হোক কিন্তু ওই ব্যাপারগুলা গুরুত্বপূর্ণ। আর খেয়াল করার বিষয় যতই রঙিলাভাবে হেরেম কালচার আসুক, তা কিন্তু রাজনীতিই! সে কথা বোঝা কঠিন নয়।
অন্যদিকে ইউসুফ (আ.) তিন সেমেটিক ধর্মেরই অন্যতম প্রধান নবী। মুসলমানদের নবী-রাসুলদের কাহিনী নিয়া শুদ্ধতার বাতিক কে না জানে! আর এ শুদ্ধতা কত কত নিন্দার ভাগিদার! তাও জানি!