এক.
‘সে রূপ দেখবি যদি নিরবধি সরল হয়ে থাক, আয় না চলে ঘোমটা ফেলে নয়ন ভরে দেখ’।
লালনের এই গানখানা শুনতে শুনতে চাঁদের আলোয় বাড়ি ফিরছিলাম। এক অর্থে আমরা কোথাও যাই নাই। গেলে তো সেখানটাই চাঁদ থাকত না। কি থাকত? কোথাও যাই নাই বলতে আমরা আর চাঁদ কখনো আড়াল হই নাই বলছি। যেন চাঁদের বাড়ির আঙ্গিনায় হাটতে ছিলাম। একে তো আর যাওয়া আসা বলে না।
ছোটবেলায় বটগাছে বসে থাকা বুড়ি নিয়ে চাঁদ আমাদের ঘরে হাজির হতো। আমি এখনো বিস্মিত হয়ে ভাবি এই বুড়ির গল্প আমরা কারো কাছে হাসিল করে থাকি, না জম্মগতভাবে সে আমাদের হৃদয় খুদিত থাকে। চট্টগ্রামে আমার এক দাদী ছিলেন, যাকে নোয়াখালীর উচ্চারণে বুইজা বলতাম- আমার শৈশবে তিনি আর চাঁদের বুড়ি ছিলেন একাকার। দারুন সব কিচ্ছা বলতেন। পুকুর পাড়ের বাধানো ঘাটলায় কখনো উল্টো দিক থেকে লেখা শুরু করা পুঁথি পড়তেন। এরমধ্যে আবু হানিফার নামটাই মনে পড়ছে। যিনি কিনা হযরত আলী (রঃ)-র দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান।
যে বুড়ির গল্প শেষ হতে না হতেই যখন ফাইভ বা সিক্সে পড়ি তখন চাঁদ অন্য রহস্য নিয়ে হাজির। মাঝে মাঝে রাতে আম্মা-বাবা বা অন্য কারো সাথে যখন যখন কোথাও থেকে ফিরতাম- আকাশে চাঁদ থাকলে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটত। চাঁদও আমাদের পিছু পিছু আসত। চাঁদের এই কারিশমায় বিরক্ত হতাম। চলন্ত গাড়ি থেকে ঠাই চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম- কখন চাঁদটা পিছে পড়বে। না, এমনটা হতো না।
আর যখন কলেজে পড়তাম- আমি আর সাথে দুই ভাগ্ন ভাগ্নি চাঁদের আলো কখন বিছানায় এসে আমাদের গায়ে পড়বে তার অপেক্ষা করতাম। আমরা মজা করে আলো খেতাম- গোসল গোসল খেলতাম। আর কখনো কখনা দারুন কান্না পেতো- কখনো চাঁদে যাওয়া হবে না। শুধু বলতাম- আল্লাহ একটা অপশন দাও ইচ্ছে পূরণের- তাহলে জীবনভর মহাশূণ্য ভ্রমনই চাইব। ঐ চাঁদটাই হবে আমার ঠিকানা। আচ্ছা! আমি এত পলায়নপর কেন!
চাঁদের আলোয় ভাবতেছিলাম বন্ধুদের কথা। জোছনা নিয়ে চমৎকার অনেক স্মৃতি আছে। বিশেষ করে বাগেরহাট ও শরীয়তপুরে চাঁদের আলোয় ভ্যান চড়ে অনেকদূর যাওয়া। একবার ছিল দারুন হাওয়ার দোলানো জোছনা আরেকবার ছিল হালকা হিম ভেজানো জোছনা।
দুই.
শবে বরাতের সময় আমরা বেশ রাতে মসজিদ থেকে ফিরতাম। অবাক হইতাম এই ভেবে- প্রতি শবে বরাতে একইভাবে চাঁদ পথ দেখায়। এই বছর যখন চাঁদ নিয়া সবাই স্ট্যাস্টাস দিচ্ছিল আমি চাঁদ দেখারই ফুসরত পাই নাই। কিন্তু ঈদের আগের দিন ছাদে উঠে তো অবাক। আরে, এইতো বরাবরের মতো কোরবানের সময়কার সেই চাঁদ। শৈশবের বিস্ময় না থাকলেও আমাকে মুগ্ধ করল। এমন আলোতে ছাদে পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকা ছাড়া আর কিইবা করার আছে। যদিও মশা ছিল ঢের। মন কেমন যেন উদাস হয়ে গেল।
তিন.
কোরবানের ঈদে কোথাও বেড়াতে যাই নাই। যাইতে ইচ্ছে করছিল না। যদিও পরিকল্পনা ছিলো ধুমসে ঘুরব। কিসের কি? সন্ধ্যা হতেই ইচ্ছে হলো ভ্যান চড়ে ঘুরি। কিন্তু আমাদের অঞ্চলে তো ভ্যান চড়ার রেওয়াজ নাই। ফলে আমরা একটা রিকশা নিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে থাকি। চাদেঁর আলোয় ঘুরতে বেরুলাম অথচ মন বলছে চাঁদের আলো ভালো লাগে না! লাগে আর লাগে না, আছে আর নাইয়ের মধ্যে চিরদোদুল্যমান মন আমার। ভালোবেসে নাও পারি না নিজের মনকে।
যেখানটায় রিকশা তরতর করে চলছে- এটাকে আমরা বলি চর। চরের লোকদের অনেকটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করাও হয়। মজার বিষয় হলো আমি এখনো এমন কোন চরের লোক দেখি নাই- যারা নিজেদের চরের লোক বলে স্বীকার করে। তারা বলে চর তো আরো পশ্চিমে। চর আমার ভালো লাগে। যদিও এখন বেশ বাড়িঘর হয়ে গেছে। তবুও অনেকদূর বিস্তৃন প্রান্তরের মধ্য দিয়ে চোখ জুড়িয়ে যায়। দারুন হাওয়া। শরতে তো মনে হয় যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আর মেঘের খেলা দেখতে চান- চরের জুড়ি নাই। আমরা তেমন চরের পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। এইটাই সম্ভবত বছর চল্লিশেক আগে নদী ছিল। বুড়োবুড়িরা বলেন দরিয়া। মাঝে মাঝে সেই দরিয়ার জন্য আমার মন কাঁদে। মন কার জন্য কাঁদে নারে পাগলা!
চাঁদের আলো ভালো লাগে না। কেন লাগে না? চাঁদ ভালো লাগে কি? নাকি শুধু আলো। এর উত্তর আমি জানি না। এইটুকু বুঝি চাঁদের আলোর সৌন্দর্য তুলনারহিত। আমার মনও জানে। কিন্তু কেন জানি মন খারাপ করিয়ে দেয়। সৌন্দর্য নিয়ে আমার মনে এত দ্বিধা কেন? ভেবে কূল পাই নাই।
চার.
চাঁদ আর চাঁদের আলো নিয়ে আমাদের মধ্যে এক ধরণের ভাবালুতা আছে। তার প্রকাশ দেখা যায় বাংলা ও আরবী সাল গণনাতে। আমবস্যা পূর্ণিমার হিসাব তো আছে। আধুনিকতার মধ্যে তো তা ভালোভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছেন রবি ঠাকুর। জোয়ার-ভাটার মতো চাঁদ আমাদের রক্তে কেমন তোলপাড় তুলে সেটা হয়ত খেয়াল রাখি না। বরং আমাদের ভাবালুতা জোছনা রাতে সবাই গেছে বনেৃ। মজার বিষয় হলো এই জোছনার সাথে আনন্দের চেয়ে দুঃখের যোগ বেশি। গানের কথাগুলো খেয়াল করুন।
পথ চলতে চলতে মনে পড়ে আরণ্যকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের কথা। আমিও যেন তার মতো বনের ভেতর হাটছি। দশবছর আগে যখন উপন্যাসটি পড়ছিলাম- কেমন যেন ঝিম ধরে যায় চোখে। কিন্তু তারপর বন জোছনা ইত্যকার সম্পর্ক শহুরে উপরি ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়। নস্টালজিয়া ছাড়া কিছুই থাকে না। তখন মনে হয় ক্ষণিকের মৌজ ফুর্তির জন্য এই বন, চাঁদ টিকে থাক। এই বলে দায় নেয়ার শোধ হয়।
হুমায়ূন আহমেদ আমাদের জোছনা কাতরায় ভিজিয়েছেন। আবার একই সাথে জানিয়ে দেন- উতল জোছনায় গৃহত্যাগী আমরা হতে চাই। এই চাওয়া এক ধরণের বিলাস মাত্র। তার সত্যতা নাই।
আহা! শহীদুল জহিরের পূর্ণিমার রাতটা কতই না ভয়ানক ছিলো।
পুরানো জোড় তালগাছ যেখানটায় ছিলো- সেখানে এখন যেন কার ভিটে। ঘর-বাড়ি কিছু হবে হয়ত। তার পাশে ছোট ব্রীজটাই বসি। ভাবি- কেন বৃথা গৃহত্যাগী বা উতলা হওয়ার কথা ভাবি।এরচেয়ে এই আমি বেশ আছি। যেমন আছি তেমনটাই ভাবি। তারপরও হুমায়ূনের সেই গানটা শুনি ‘চাদনী পসর কে আমারে স্মরণ করে…’।
পাঁচ.
পশ্চিমের সাথে আমাদের আমবস্যা পূর্ণিমা ভাবনার দারুণ বৈপরীত্য। জীবজগতে প্রাণীরা চাঁদ দ্বারা কতটা আপ্লুত হয় আমার জানা নাই। পশ্চিমা মুভি ও সাহিত্যের কল্যাণে আমরা জানি নেকড়েজাতীয় প্রাণী চাঁদের আলোয় উম্মাদ হয়ে পড়ে। ভ্যাম্পায়ার, ভুত-প্রেতের সাথে চাঁদের আলোর যোগ আছে। সৌন্দর্যকে এত ভয়ংকরভাবে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত নয়। সৌন্দর্যের সাথে কি ভয়ংকর শব্দটা যায়! পাশ্চ্যের কৃত্য, রোমান্টিকতায়, সৌন্দর্যচেতনায় সাথে চাঁদের যোগ বহু পুরানো। আমাদের শরীরেও যে আমবস্যা-পূর্ণিমা থাকে। সে ভেদ ক’জনে পারে বুঝিতে। পাশ্চ্যের লোকেরা এই আলোতে মরতে চান। সুন্দর-অসুন্দরের এই বৈপরীত্যের সাথে নিশ্চয় তাদের ভাব-ভাষা এমনকি জীবন সম্পর্কে ধ্যান-ধারণাও নিশ্চয় আলাদা। টুয়ালাইট, ড্রাকুলার জগতে ঢুকে আমার কি হাসিল হবে। এরচেয়ে ছোটবেলা থেকেই তো জানি চাঁদ আমাদের সার্বজনীন মামা। থাকুক সেই মামা-ভাগ্নের দেনা পাওনা।
ছয়.
দুইপাশে ধানের ক্ষেত। মাথার উপর কম বয়েসী কিছু গাছ। চাঁদের আলোয় চারদিকে ফকফকা আর ছায়ায়ও ঢাকায়। অল্প বিস্তর বাতাস আছে আবার যেন নাইও। এইভাবে হাটতে থাকি। হাটতে থাকি। ভাবছি না গন্তব্যহীন হাটছি। আমরা জানি কোথায় যাচ্ছি। আর যা জানি না তা তো অন্তর্যামী জানেন। কেমন যেন সুর করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে হয় গন্তব্য অসীম হোক। কিন্তু বুঝতে পারি এই চাওয়ায় হয়তে মন আছে দেহ নাই। অথবা কেউ নাই তবুও এমন করে ভাবি। কোথায় হারিয়ে ফেলি যাবতীয় সরলতা।
চাঁদের আলোর দোহাই প্রভু আমায় এমন ভাবনা দাও- যেখানে সেই সরল রূপটাই ফুটে উঠে সরল ভাবনা থেকে। অরূপে আমার কি দায়- শুধু ঠাঁই দিও দাসেরে।
পরিশিষ্ট:
সে রূপ দেখবি যদি নিরবধি সরল হয়ে থাক
আয় না চলে ঘোমটা ফেলে নয়ন ভরে দেখ।।
সরল ভাবে যে তাকাবে অমনি সে রূপ দেখতে পাবে।
রূপেতে রূপ মিশে যাবে ঢাকনি দিয়ে ঢাক।।
চাতক পাখির এমনি ধারা অন্য বারি খায় না তারা
প্রান থাকিতে জ্যান্তে মরা
ঐ রূপ ডালে বসে ডাক।।
ডাকতে ডাকতে রাগ ধরিবে
হৃৎকমল বিকশিত হবে
লালন বলে সেই কমলে হবে মধুর চাক।।
-লালন সাঁইজী
> ব্যবহৃত চিত্র: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।
লেখাটি এতো ভালো লাগছে যে আমি লেখাটি পাঠ করে দীর্ঘক্ষণ বসে ছিলাম।
কেনো জানি না
হয়তো আবার জানি
শৈশব আমাকে জাপটে ধরেছিলো
আমি আর নড়তে পাড়িনি।
ধন্যবাদ নিজাম ভাই।