হাশর-কেয়ামতের পালা: দুনিয়াবি সম্পর্কে আখিরাতকে জীবন্ত করার জিহাদ

Bangla_Pala_HosorKeamot_wahedsujan.comগ্রামের দুই কুকুর শহরে বেড়াতে গেছে। শহুরে ভাই বেরাদরের সাথে খানা-পিনা, ঘুরা-ফিরাতে বেশ মজা পাইছে। এক হপ্তা পর গ্রামে ফেরার সময় শহুরে ভাইদের কাছে তারা একখান কৌতুহল প্রকাশ করল। গ্রামের কুকুররা লেজ নাড়ায় ডানে-বামে আর শহুরে কুকুর লেজ নাড়ায় ওপর-নিচে। তাহলে এর কাহিনীখানা কি? শহুরে কুকুর বলে, শহরে মানুষ বেশি। জায়গা কম। ডানে-বামে লেজ নাড়লে, কখন কার গায়ে লাগে, কে কি মনে করে- তাই তারা ওপর-নিচ করে লেজ নাড়ে। এতে কারোর কোন মুসিবত হয় না। এ গল্পে গান গেথেই শুরু হল হাশর-কেয়ামতের পালা। 

আয়োজকরা ঠিক করে দিয়েছেন কে কোন বিষয়ে পালাগান গাঁথবেন, গাইবেন। কাজল দেওয়ানের ভাগ্যে পড়েছে হাশর, আর শাহ আলম সরকারের জন্য কেয়ামত। যেদিন ইসরাফিল ফেরেশতা শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে হইলোকের খতম ঘোষণা করবেন, সেদিন হল কেয়ামত। সেদিন দুনিয়ার সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। কেয়ামতের পর হাশরও একই ফেরেশতার শিঙ্গার ফুঁয়ে তৈরি হবে। হাশরের দিন সকল মানুষ হাশরের ময়দানে হাজির হবে। আল্লাহ আমলনামা ধরে বিচার করবেন। এটা হল পরলোক। এখানেই বেহেশত-দোজখ।

শাহ আলম সরকার এই কুকুরের লেজের গল্প দিয়ে হাশর আর কেয়ামতের বিষয়ে বলেন, কেয়ামত হবে এই দুনিয়ায় আর হাশর কবে হবে কেউ জানে না। দুইটা হবে এমন দুই জায়গায় যেখানে কারও সাথে কারও সম্পর্ক নাই। দুইটাই আলাদা জিনিস। তাই যার যার লেজ তার তার লগে হইলে ভাল। পালা শুরু হয় কুকুর কাহিনী দিয়ে।

ওরে ঈমান আমান দিয়ে বলি, আমরা যে যার মত চলি গো

দাদা পীর আমজাত শাহ এর মাজার শরীফ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার পেয়ারা কান্দি গ্রামে। তার ওরস উপলক্ষে এই পালার আয়োজন হয়েছিল। পালাকার দুইজন হচ্ছেন শাহ আলম সরকার ও কাজল দেওয়ান। দুইজনই যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং খ্যাতিমান।

কাজল দেওয়ান

কাজল দেওয়ান

পালাগানের রীতি, ঐতিহ্য ও চর্চা বহুকাল আগ থেকে চলে আসছে বৃহৎবঙ্গে। এর ভেতর বিনোদনের খোরাক আছে, আছে ধর্ম, ধর্মতত্ত্ব ও জীবনের সহজ প্রকাশ। মানুষের নিত্যদিনের কথাবার্তা, কায়-কারবার লেনদেন এতে পরিস্কার। এই মানুষ সামাজিক মানুষ হওয়ার পরও তার জীবন একমাত্রিক না। একই সরল রেখায় চলে না। বহুমাত্রিক এবং বিচিত্র। একইসাথে ভাব আর বস্তুতে বিচরণ করে এই মানুষ। পালায় সাধারণত দুইজন গায়ক থাকে, তারা সওয়াল-জবাবের মধ্য দিয়ে পালা পরিবেশন করেন। দুইজনের জন্য সম্পর্কযুক্ত আলাদা আলাদা বিষয় নির্দিষ্ট থাকে। এক গায়ক অপর গায়ককে বিষয় ধরে প্রশ্ন করে। এই প্রশ্নগুলো একটু অদ্ভূত ঠেকে কিন্তু তার মধ্যে থাকে গুরুত্বপূর্ণ ও মজাদার বয়ান। কিছু বয়ান বা গল্প করার পর গায়ক একটা গান গেয়ে থাকেন। তারপর প্রতিপক্ষকে একটি প্রশ্নের মাধ্যমে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করেন। এর সাথে আবার নানা রকম খুনসুটিও আছে-

পালাগান আসলে গানে-গানে, কথায়-কথায়, সুরে-সুরে বাহাস-তর্ক-বিতর্কে। ফলে যার যার লেজ তার তার লগে হইলে তা তো হইল না। মোটাদাগে পালা গায়েনরা শহুরে হইলে চলে না। মনে প্রশ্ন জাগে, তাইলে কি শাহ আলম সরকার শহুরে লেবাস ধরতে চান। যদি গ্রাম হয় তবে লেজ নড়বে ডাইনে-বাঁয়ে আর শহর হইলে লেজ নড়বে ওপর-নিচে। কিন্তু যার যার লেজ তার তার লগে- শাহ আলম সরকারের এই বক্তব্য মানলে তো বলতে হয় যে, তিনি আর গ্রামের হতে পারছেন না। নাগরিকতার ইটসুরকির তলায় চাপা পড়তে হবে তাকে।

শাহ আলম সরকার

শাহ আলম সরকার

কিন্তু এর আসল কথা হল শহুরে মানুষ এবং গ্রামীণ জীবনের ফারাক পরিস্কার করা। যাতে শেষ পর্যন্ত এই পালা শহুরে এবং গ্রামীণ মধ্যবিত্তের বাইরের জিনিস- গানের ভাষা, মর্ম এবং আনুষ্ঠানিকতার রীতি সবই মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। পাশাপাশি এর ধর্মভাব এবং ধর্মতত্ত্বের বয়ান শহর-গ্রাম এবং ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বের তফাতটাও পরিস্কার করে তোলে। শাহ আলম সরকারের আরেকখান কেচ্ছা- এক ব্যক্তি সদর ঘাটে লঞ্চ থেকে নেমে এক কেজি আপেল কিনছে। দোকানদার বলল, পঞ্চান্ন  টাকায় কিনেছি, ষাট টাকায় বেচলে পাঁচ টাকা লাভ হবে। দোকানদারের মাথায় টুপি দেখে লোকটা। এতে ওই ব্যক্তি দোকানদারকে বিশ্বাস করে ষাট টাকা দরে আপেল কিনে নিল। লোকটা দূর থেকে দেখল দোকানদারটি আরেক ক্রেতাকে বলছে, পঁয়তাল্লিশ টাকায় কেনা, পঞ্চাশ টাকায় বেচলে পাঁচ টাকা লাভ। সাথে সাথে প্রথম আপেল কেনা লোকটি এসে বলল, কি মিয়া মাথায় টুপি দিয়া মিথ্যা কথা বলছ। দোকানদার বলল, এইটা ব্যবসার টুপি। নামাজের টুপি আরেকটা।

নবীজির ব্যবসার কথা তুলেন শাহ আলম সরকার, তিনি খারাপ মালগুলা ওপরে রাখতেন আলাদা করে। যাতে লোকে খারাপ মালগুলো দেখতে পায়। আড়াল করে রাখতেন না। আর আমরা দুনিয়ার কাছে আখেরাত বিক্রি করে দেই। ধর্ম আর আখেরাত নিয়ে ব্যবসা করছি। তোমরা দেখছনি গো চাইয়া, মিছা কথা বলছে মানুষ আল্লাহর কসম খাইয়া… হাশরের গান গাইবেন কাজল দেওয়ান, একটু নাড়া দিয়া দেখব ভাইয়ের আছে কি চালান, নিচের দিকে চাইয়া দেখি মুখখানা বেজার, তাই দেখিয়া কেমন করে মনটা যে আমার

হাশরের দিন মিজানে মানুষের নেক আর গুনাহ মাপা হবে। মানুষ এই দেখে পেরেশানিতে পড়বে যে, তারা দুনিয়ায় নেকের চেয়ে গুনাহ বেশি করেছে। সেই মানুষের একদলের নেকের পালায় কিছু গু-গোবর দিয়ে দয়াল নবী বলবেন- আল্লাহ দেখেন, তাদের পালার নেকের দিক ভারী হয়ে গেছে। অতঃপর আল্লাহ তা কবুল করবেন। কাজল দেওয়ানের কাছে প্রশ্ন রাখেন শাহ আলম সরকার, এই গু- গোবরগুলা কিসের এবং কেন?

পালা গানের এইসব বাণী এবং বক্তব্য সবই প্রতীকী। সরল ও সহজ কথার মত করে বলা। কিন্তু বলার ভঙ্গি এবং তরিকা হল রূপক-উপমা ও কেচ্ছা-কাহিনী। সহজে মানুষের মনের গভীরে দুনিয়া এবং পরকালের মত বিষয়গুলার তাৎপর্য ধরিয়ে দিতে চান পালাকারেরা।

হাশর মানে কি, মিজান মানে কি নিছকই বস্তুগত একটা ব্যাপার- এর আসল অর্থ কি ইত্যাদি বিষয়ের মর্ম ও তাৎপর্য প্রতীক, উপমা ও গল্পের ভাষায় তুলে ধরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাশরের দিনে মিজানের কথা বলতে গেলে শুরু করতে হয় বাজার, ব্যবসায়, মানুষের সততা, হক্ব-ইনসাফের ধারণা দিয়ে। দুনিয়া থেকে এই ভাষাগত চিহ্নগুলা ধার করা। এইভাবে ইহলোক থেকে পরলোকের দিকে যাত্রা। দুই কুকুরের কেচ্ছা সাফ সাফ শহুরে ও গ্রামীণ সমাজের বিরোধ। শহরের আধুনিকতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা মানুষকে অপর করে দিয়েছে। তাই সবাই নিজ নিজ চিন্তা করে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। অপরদিকে গ্রামের সমাজ কাঠামোয় মানুষের ভাগাভাগি আর মাখামাখি করে থাকার রেশ এখনও স্পষ্ট। এই পালাগানও গ্রামীণ ভাগাভাগি আর মাখামাখিরই অংশ।

এতক্ষণ শাহ আলম সরকারের কথা বললাম। এবার দেখা যাক, কাজল দেওয়ান কোন নোক্তা ধরে তার পালা গাইছেন। আল্লাহর দরবারে লাখ-কোটি শুকরিয়া জানিয়ে, দয়াল বাবা পাগলা রাজ্জাক দেওয়ান ও দাদা পীর আমজাত শাহকে ভক্তি জানিয়ে কাজল পালা গানের এইসব বাণী এবং বক্তব্য সবই প্রতীকী। সরল ও সহজ কথার মত করে বলা। কিন্তু বলার ভঙ্গি এবং তরিকা হল রূপক-উপমা ও কেচ্ছা-কাহিনী। সহজে মানুষের মনের গভীরে দুনিয়া এবং পরকালের মত বিষয়গুলার তাৎপর্য ধরিয়ে দিতে চান পালাকারেরা।

দেওয়ান তার প্রথম পর্ব শুরু করেন। তিনি শাহ আলম সরকার সম্পর্কে বলেন, শাহ আলম সরকার বিজ্ঞ গায়ক কিন্তু তিনি তার গানে মা-বাবা বা ওস্তাদ আবুল সরকার কিংবা কোন ওস্তাদকেই স্মরণ করেন নাই। এটা তো আদবের খেলাফ। শাহ আলম সরকার জবাব দেন বটে, কিন্তু অভিযোগের নায্যতা খণ্ডাতে পারেন না। এই প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সামাজিক সম্পর্ক ও গুরু-শিষ্যের যে সিলসিলা তার ইশারা স্পষ্ট। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আমাদের ঐতিহ্যবাহী যেকোনও পরিবেশনা শিল্পে গুরুকে স্মরণ না করা শরমিন্দার বিষয়।

শাহ আলম সরকার বলেন, কেন কাজল দেওয়ান তার অংশে হাশরের কথা না বলে কবরের গান গাইলেন। কবর তো হাশরের অংশ না, আলমে বরজখ (কবরের জগত) এর অংশ। তাহলে, হাশর আর কেয়ামতের বিষয়ে কাজল দেওয়ানের জ্ঞান পরিস্কার না। কাজল দেওয়ানের মতে যিনি কবরবাসী হলেন, তিনি কেয়ামতের অংশ শেষ করে ধাপে ধাপে হাশরের দিকে অগ্রসর হলেন। হাশর সবার জন্য এক। হাশরের বেলায় আগে পরের ব্যাপার নাই, দুনিয়ায় মানব বংশের শুরু থেকে শেষ মানে কেয়ামত পর্যন্ত সব মৃত মানুষই জীবিত হয়ে উঠবে। কিন্তু কেয়ামতে আগে অর্থাৎ মৃত আর পরের মানে জীবিত মানুষের জন্য আলাদা আলাদা ব্যাপার আছে কি। যারা আগে থেকেই দুনিয়ায় মৃত তাদের কাছে কেয়ামত কেমনে হাজির হবে? এখানে দুইরকম কথার চল আছে। প্রথমত, ধর্মতত্ত্বের ভাষ্য মতে মানুষের এন্তেকাল হওয়ার সাথে সাথে তার পরকাল শুরু হয়ে যায়। পরকালের পয়লা ধাপ হল মৃত্যু। মৃত্যু আবার একইসাথে দুনিয়া এবং পরজীবনের সন্ধিক্ষণ। দ্বিতীয় ধাপ হল কবর। তৃতীয় ধাপ হল কেয়ামত। ফলে একঅর্থে কেয়ামত মৃত্যুর সাথে সাথে হাজির হয়ে যায়। যেখানে আদতে আগের আর পরের ব্যাপার নাই। কিন্তু ইসলামের ধর্মতত্ত্বে পরজীবনই আসল কথা, কেয়ামত তার একটা বিশেষ মুহূর্ত মাত্র। দ্বিতীয়ত, কেয়ামতের মুহূর্তে জীবিতরাই কেয়ামত উপলব্ধি করতে পারবে, ব্যাপারটা তা না। যারা আগে মরে গেছে আর যারা কেয়ামতের অবস্থায় মরবে কেয়ামত উভয়ের বেলায়ই সমান কথা। কারণ কেয়ামত মানে ধ্বংস। মানে এক অবস্থা পুরা শেষ করে নতুন আরেক অবস্থা তৈরি হওয়া। এই আপাত অর্থে ধ্বংস এবং তাৎপর্যগত ভাবে পুরা জগতের নতুন অবস্থার ঘটনা আগের মৃত আর পরের মৃত উভয়ের বেলায় ঘটছে।

গান ও কথোপকথনের মধ্য দিয়ে পালা চলতে থাকে। দুই গায়ক অসাধারণভাবে উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে একে অপরকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করেন। মজার বিষয় হল, যে আকস্মিক প্রশ্নগুলো তারা একে অপরকে করেন তার অপ্রস্তুত জবাবগুলা তাৎক্ষণিকভাবে ঠিক ঠিক দিচ্ছেন। কিন্তু কথা কাটাকাটির মধ্য দিয়ে অন্য তর্কও চলতে থাকে। যে তর্ক তারা পালার শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়া যান। একজন একটা কেচ্ছা বললে অপরজন অন্য একটা বলেন। আর চলতে থাকে পাল্টাপাল্টি প্রশ্ন। প্রশ্নের ভেতর রয়েছে চমৎকার রহস্য আর গুরুত্বপূর্ণ অর্থ ও ইংগিতময়তা। যেমন- আল্লাহ সর্বজ্ঞাত। তিনি সব জানেন। মানুষের আমলনামা লেখার দুই ফেরেশতা মুনকার-নাকির। তারা মানুষের দুই কান্ধে বসে আমলনামা লেখেন। যদি আল্লাহ সবই জানেন তবে আমলনামার ফেরেশতার দরকার কেন?

এই প্রশ্ন শুনতে যতই সহজ মনে হোক, কিন্তু মোটেই সরল আর সাদামাটা না। শুধু সাধারণ মানুষই না একজন ভাবুকও এই প্রশ্নে থমকে দাঁড়াবেন। যেখানে এই প্রশ্নের জবাবে-মোকাবেলায় দর্শন, ধর্মতত্ত্ব তাদের আলাদা আলাদা পথ ঠিক করে নেয়। যা পরবর্তীতে ভাল-মন্দ সমস্যা বা ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে কি না, এই ধরনের দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক গুরুত্ব সম্পন্ন আলোচনার পথ ধরে। কিন্তু পালা গানের বয়ান এত জটিলতার দিকে না গিয়ে সামনে থাকা মানুষকে দেখেই ব্যাখ্যা দেয়। গ্রাম-গঞ্জের অতিসাধারণ মানুষের সহজ জীবনাচার আর তাদের ভাবজ্ঞানের ভাষা এমনই স্বতঃস্ফূর্ত এবং সরাসরি। এতে মুখোমুখি (মোরাকাবা) শ্রুতিময় (ওরাল) চর্চায় এইসব ভাব ও জ্ঞানময় বক্তব্য হৃদয়ঙ্গম করা আরও সহজ হয়ে ওঠে। কারণ পালার এসব বিষয়ের ব্যাখ্যা বুঝার জন্য আলাদা শাস্ত্রজ্ঞানেরও প্রয়োজন পড়ে না। ফলে পালাগানে সামনা-সামনি বয়ানের এই তরিকা নিছকই একটা মজা করারও জিনিস না। মানুষের ভাল মানুষীর সাথে সাথে আছে হিংসা, লোভ, ঠকবাজী আর সত্যকে অস্বীকার করার প্রবণতা। দুনিয়ার সকল জীবের মধ্যে একমাত্র মানুষই আছে যে কোন কিছু অস্বীকার করে থাকে। সোজা বাংলায়, মানুষের রগ ত্যাড়া। অপকর্ম করে আবার তা সবসময় অস্বীকার করে সে। হাশরের দিন আল্লাহ যখন তাকে তার পাপের কথা বলবে। সে বলবে, এই কথা মানি না। তখন আল্লাহ প্রমাণ দাখিল করবেন। সেই প্রমাণে বান্দা লা-জওয়াব হবে এবং বিচার মেনে নেবে। এতে মানুষের নিজেকে নিজে ফাঁকি দেয়ার স্বভাব রুখে দেয়ার মন তৈরি করা যায়। নিজেই নিজের নফসের মধ্যে পুলিশ বসিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এটাই হল আমলনামা লিখে রাখার পেছনের কথা।

আরেকটা প্রশ্ন হল, আজরাইলের চারটা মুখ। একেক জন বান্দার রুহ কবজ করতে গিয়ে আজরাইল একেক রূপ ধরেন। কাজল দেওয়ানের প্রশ্ন হল কোন ধরনের মানুষের কাছে আজরাইল কোন ধরনের চেহারা নিয়া যান। নিশ্চয়ই এর জবাব আছে। কিন্তু আসলে এই প্রশ্নের ভেতর দিয়ে মানুষের স্বভাব ফারাক করা হয়। মানুষের আচার পরিস্কার হয়ে ওঠে। যাতে ভাল-মন্দ বিচার করে মানুষকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। এটা শুধু আজরাইলের জান কবজেরই বিষয় না। এটি একটি প্রতীকী বক্তব্য। এখানে নবী-রসুলের বিষয় আলাদা।

কিন্তু প্রশ্ন আছে। নবীরা অপরাধ করলে সেটা স্বয়ং আল্লাহকেও বিব্রত করে। তবে প্রশ্ন হল আল্লাহ বিব্রত হবেন কেন? নবীর সাথে তার উম্মতের সম্পর্ক বুঝলে একইসাথে আল্লাহর দিক থেকে নবীর সাথে সম্পর্কের তৎপর্য কত গভীর সেটাও পরিস্কার হবে। এইসব কথাবার্তা নিছকই পরকালীন না, প্রতীকী অর্থে এটি দুনিয়াদারিরও বিষয় হয়ে ওঠে শেষ পর্যন্ত। অর্থাৎ এই আখেরাত বা পরকালীনতা দুনিয়া আর বৈষয়িকতার মধ্যে জীবন্ত করে তোলা। যেমন কাজল দেওয়ানের প্রশ্নের রেশ ধরে, হাশরের মাঠে আল্লাহ এক ব্যক্তির বিচার না করে তারে নানান রকম খাবার-দাবার দিয়ে ভুলাইয়া রাখে। যখন সে আল্লাহকে বলবে আমার হিশাবটা করেন। তখন আল্লাহ ফেরেশতাদের বলবেন, তাকে যেন আরও খাবার দেয়া হয়। তাহলে এটা কোন মানুষ আল্লাহ যার বিচার করতে চাইবেন না? এরও উত্তর আছে। সেই প্রশ্নের সাথে জড়িয়ে আছে নবীগণের মর্যাদা। যেখানে তারা পাপ-পুণ্য করে কিনা বা আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক কি এই প্রশ্ন এইভাবে এখানে তোলা হয় না।

কাহিনীখান মজার। দাউদ নবী কোন এক নারীকে খুব মহব্বত করতেন। সেই আবার বিবাহিতা। দাউদ নবী সেই নারীর স্বামীকে সেনাপতি বানিয়ে যুদ্ধে পাঠান। তার নাম আওলিয়া। সেই লোক মারা গেলে দাউদ নবীর মনোবাসনা পূর্ণ হয়। তার মহব্বতের পেয়ালা পুরা হয়। নবীরা যেহেতু মাসুম বা গুনাহমুক্ত তাই আল্লাহ দাউদ নবীরে ক্ষমা করে দিছেন। নবীর সম্মান রক্ষার্থে আল্লাহ আওয়লিয়ারও বিচার করবেন না। বিনা বিচারে তাকে বেহেশত দান করবেন।

দেখা যাচ্ছে, এধরনের কাহিনীর মধ্যে প্রধানত একটি বিষয় পরিস্কার হয়ে ওঠে- সেটা হল, দুনিয়ার সব সম্পর্কের মধ্যে আখিরাতকে জীবন্ত করার জিহাদ জারি আছে এই বাংলায়। এই অঞ্চলের নিজস্ব ভাষার মধ্যে এই জিহাদ জারি হয়ে আছে বহুকাল ধরে। একইসাথে আইন অর্থে শরিয়ারও একধরনের নিরাকরণ ঘটে। কিন্তু বিষয়গুলা এত সরল আর সাদামাটা না। বঙ্গভূমিতে এধরনের পালাগানের মত আরও বহু নিজস্ব প্রচেষ্ঠা আছে যেগুলার মধ্য দিয়ে বাংলার নিজের বিজ্ঞান-দর্শন, ধর্ম ও জীবন সম্পর্কিত ভাষা ও বয়ান গড়ে তোলা যায় নিজের মত করে।

এভাবে প্রশ্ন আর পাল্টা সওয়াল-জওয়াব ও কেচ্ছা-গানে সময় যে কখন উড়াল দিল টেরও পাই নাই। কিন্তু শেষ করতে গিয়েও লোভ সামলাতে পারছি না আরেকটা পঙক্তি তুলে ধরার- মনে কি পড়ে না পথিক, আসিয়াছ কতই দূরে। যখন মাতৃগর্ভে ছিলে, কি বলিয়া এসেছ। আর কারে ভালবাসবে বলে কারে ভালবেসেছ। দিন আর দিনে গেল রে দিন, সোনার দেহ হইল হীন। আবার কবে আসবে সুদিন ডাকিতে দীন বন্ধুরে। গানটি শাহ আলম দেওয়ানের।

শাহ আলম সরকার কি জানতেন না শেষ পর্যন্ত যার যার লেজ তার তার ওপর থাকে না। ডাইনে বাঁয়ে নাড়াইতে হয় সেটাও তিনি বিলকুল জানতেন। তাইলে কেন বললেন এই কথা। আসলে মানুষের মুখে এক আর কাজে আরেক। শাহ আলম সরকার আর কাজল দেওয়ানও সেই সিস্টেমে পড়ে গেছেন। খুশি হবার কিছু নাই। আমরাও সেইটার বাইরে না। কিন্তু এখানেও আরেক কথা আছে, মানুষ যখন তার নতুন সময় তৈরির চেষ্টা করে তখন সে নানা রকমভাবে, নানা কাব্য ভাষায় সেই ভবিষ্যতের বয়ান খাড়া করে। যেটার সাথে বর্তমানের কাজের সাথে মিল থাকে না। ফলে যা বলে তা করে না– এরকম নীতিকথা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না।

*প্রথম প্রকাশের শিরোনাম: দুনিয়ার সব সম্পর্কের মধ্যে আখিরাতকে জীবন্ত করার জিহাদ।

*পাক্ষিক চিন্তায় পূর্ব প্রকাশিত।

Comments

comments