উকিল মুন্সীর গানের ভেতর বাড়ি

(এটি মূলত চিন্তা.কম-এ প্রকাশিত উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে; লেখাটির একটি অংশ যুগান্তরের সাহিত্য পাতায় ছাপা হযেছিল। সে কারণে আলাদা করে এতদিন ব্লগে দিই নাই। কিন্তু আজ ওয়েব ঘাটতে গিয়ে দেখি দুটো সাইটে এই লেখা প্রকাশ করা হয়েছে। তারা অনুমতি নিয়ে ছাপেন নাই। ফলে মনে হলো যার লেখা তার ব্লগে থাকলেই ভালো।)

আমি আগে না জানিয়া সখিরে কইরে পিরীতি আমার দুঃখে দুঃখে জীবন গেলো, সুখ হইলো না এক রতি…।

ধুলোর রাজ্যে আমরা হারিয়ে যাই নাই- পেছনে রেখে যাচ্ছিলাম ধুলোর ঝড়। পথের দুইপাশে চোখের শান্তির জন্য অনেক কিছূ ছিলো। যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। ফসলের মাঠ। এর ভেতর দিয়ে নিঃসঙ্গ রাস্তাটা ঘুমিয়ে থাকা ক্ষত-বিক্ষত পরাজিত এক অজগর যেন। পরাজয়ের ক্ষোভে এই দুনিয়াকে দুইভাগ করে মিলিয়ে গেছে কোন অসীমে। আমরা সাওয়ার হয়েছি সেই অজগরের পিঠে। /উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে/ ফটো: দাউদুল ইসলাম।

 গীতিকবি ও গায়ক সাধক উকিল মুন্সীর জম্ম ১৮৮৫ সালের ১১ জুন, পিতার বাড়ি নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামে। মৃত্যু ১৯৭৮ সালে। বাংলা হিসেবে পৌষ মাসের দুই তারিখে, মোহনগঞ্জ উপজেলার জৈনপুর গ্রামে। এই অঞ্চলে তিনি বিরহী উকিল নামে পরিচিত। তার গানের বিরহী আর্তি শ্রোতাদের মনোযোগ বিশেষভাবে আকর্ষন করে। সেই আর্তিতে আছে বাংলার চিরকালীন ভাব, হাওর অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও দুর্বিপাক। সেই ভাবে একই সুতোয় বেঁধেছেন ইসলামের শরীয়ত ও মারেফাতি ব্যাখ্যা। এই দুইয়ের মেলবন্ধন তার জীবনাচরণেও দৃষ্ট।

প্রায় হাজারখানিক গান রচনা করলেও সারা দেশে উকিল মুন্সী তিনটি গান দিয়ে পরিচিত- আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, আষাঢ় মাইসা ভাসা পানিরে এবং শুয়াচান পাখি। এই তিনটি গান ব্যবহৃত হয়েছিল হুমায়ুন আহমেদের চলচ্চিত্র শ্রাবণ মেঘের দিন-এ। গায়ক ছিলেন বারী সিদ্দীকী, তার বাড়ীও নেত্রকোনা। তিনটি গানই রোমান্টিকতা ও বিরহী ভারে শ্রোতাদের আপ্লুত করে। উকিলের সহজাত বিরহ ভাব শ্রোতার হৃদয় আদ্রতাকে উস্কে দেয়। উকিলের মৃত্যূর ৩৪তম বছরে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে হাজির হয়েছিলাম তার বসত ভিটায়। তখনো আমরা তার সময়কাল নিয়ে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না। নেত্রকোনা থেকে সংগ্রহ করা দুটি লেখক পরিচিতি থেকে তার জম্ম, বিবাহ ও মৃত্যুর সন উল্লেখ করা হলো।

জৈনপুরে উকিলের বাড়িটি বেতাই নদীর কূল ঘেঁষে। সে ভিটায় কাঁচা পাকা বড়ইয়ের ভারে অবনত গাছের তলে উকিল তার গায়ক পুত্র আবদুস সাত্তাররের পাশে শুয়ে আছেন। বর্ষায় নদী ফুসে উঠলে কখনো কখনো তার জল উকিলের কবরকে ছুঁয়ে যায়। তার স্বজন ও ভক্তরা নিজেদের সাধ্যমত এই কবরের পরিচর্যা করছেন। সেই বাড়িতে থাকেন উকিল মুন্সীর ছাত্রী ও আবদুস সাত্তারের দ্বিতীয় স্ত্রী রহিমা খাতুন। রহিমা খাতুন জানান মাত্র আট মাসের ভেতর স্ত্রী লাবুশের মা, পুত্র আবদুস সাত্তার ও উকিল মুন্সী মারা যান। স্ত্রীর মৃত্যুর পর পুত্রের মৃত্যু শোক সহ্য করতে পারেন নাই। উকিলের এই বিরহভাব তার জীবনের সাথেও জড়িয়েছে- যা শুধুমাত্র গানের অনুষঙ্গ নয়। জীবনের অনুসঙ্গ। কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র শোকের কথা মনে করিয়ে দেয়। উকিলের ভিটায় কথপোকথনে উপস্থিত ছিলেন নাতনী জামাই মতিউর রহমান (কলম মেম্বার) এবং  ভক্ত দুলাল কমান্ডার। পরবর্তীতে কথা হয়েছে উকিলের ছোট মেয়ে কন্যা রাজিয়া খাতুনের সাথে । সেই দীর্ঘ আলাপ থেকে এখানে শুধুমাত্র উকিলের গানের প্রসঙ্গটুকুই তোলা হলো।

উকিল মুন্সীকে নিয়ে সবচেয়ে রোমান্টিক কাহিনী হলো লাবুশের মায়ের সাথে তার বিবাহ নিয়ে। এতিম উকিল জালালপুর গ্রামে তার চাচা কাজী আলিম উদ্দিনের বাড়িতে বেড়াতে এসে সাধারণ কৃষক লবু হোসেনের সুন্দরী কন্যা ষোড়শী‌ লাবুশের মা এর প্রেমে পড়েন। এরপর উকিল নানা উছিলায় লবু হোসের বাড়ির আশে পাশে যাতায়াত করেন। সেই সময় তিনি একটি গান রচনা করেন-

ধনু নদীর পশ্চিম পাড়ে, সোনার জালালপুর। সেখানেতে বসত করে, উকিলের মনচোর।

১৯১৫ বা ১৯১৪ সালের প্রেক্ষাপটে সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে তা আমাদের জন্য অনুমান করা কঠিন। কিন্তু এই গানটি উকিলের কন্ঠে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। গানের মাধ্যমে প্রেমের কথা জানাজানি হলে আভিজাত চাচার বাড়ির লোকেরা বাধা দেয়। কারণ, অসম বিয়ে ছিল কাজী বাড়ির জন্য অপমানজনক। প্রেমে বাধা পেয়ে বিরহী উকিল কিছুদিন জালালপুরের আশেপাশে শ্যামপুর, পাগলাজোড়, জৈনপুর গ্রামে পাগলের মত ঘুরাঘুরি করেন। অবশেষে তিনি জালালপুর থেকে কয়েক মাইল দূরে বরান্তর গ্রামের মসজিদে ইমামতি শুরু করেন। এ সময় তিনি ইমামতির পাশাপাশি সারারাত স্বরচিত গজল গেয়ে সময় কাটান। ১৯১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে লাবুশের মা-এর ইচ্ছায় গোপনে কাজী বাড়ির মানুষের অগোচরে উকিল মুন্সীর বিয়ে সম্পন্ন হয়। লাবুশের মাকে নিয়ে উকিল মুন্সীর এই কাহিনী বেশ জনপ্রিয়। এর অনেক পরে তিনি জালালপুর ছেড়ে জৈনপুরে ভিটা গাড়েন। এখানকার দুটো মসজিদে তিনি ইমামতি করেন। তিনি মক্তবেও পড়াতেন।

এই ঘটনা ছাড়াও স্ত্রীর সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে আরেকটি কাহিনী প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে সেই প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে তার শুয়াচান পাখি শিরোনামের অতি জনপ্রিয় গানটি। গায়ক বারী সিদ্দীকীর বরাতে জানা যায় মৃত বউয়ের শিয়রে বসে উকিল মুন্সী এই গানটি রচনা করেন। উকিলের গানের সাথে সাথে শিষ্য রশিদ উদ্দিন তাৎক্ষনিক একই সুরে গান গেয়ে উকিলকে সান্ত্বনা দেন। বারী সিদ্দীকী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই গানের দুটো অংশই গেয়ে থাকেন। আবার কিছু বইয়ে লেখা আছে এই গানটি উকিলের নয়, রশিদ উদ্দিনের। এই তথ্যই সঠিক। শুয়াচান পাখির গীতিকবি রশিদ উদ্দিন। আর এই ভুল বোঝাবুঝি স্বযং উকিল মুন্সীর পরিবারেও রয়েছে।

কিন্তু রহিমা খাতুন এই গানের রোমান্টিক তত্ত্বটি নাকচ করে দিয়ে আধ্যাত্মিকতার দিকে গেলেন। যা ছিল আমাদের কাছে একেবারে নতুন। তিনি বললেন, এইসব বানানো কথা। উকিল মুন্সী এই গান বেঁধেছিলেন তার পীর মুর্শীদকে। পীরের বাড়ি থেকে ফিরে এসে উকিল এই কথাটা তাকে জানান। উকিলের অনেক গানের সাথে আছে তার পীর মুর্শীদের গভীরতর সম্পর্ক।

রহিমা খাতুনের জবানে, উকিলের পীর ছিলেন হবিগঞ্জের রিচির মোজাফফর মিয়া। যিনি সাহেব বাড়ীর মোজাফফর আহম্মদ (রঃ) নামে পরিচিত। এই দরবার শরীফ হবিগঞ্জ শহরের কাছাকাছি, জাহাগীর দরবার শরীফ নামে পরিচিত। কিশোরগঞ্জ অথবা সুনামগঞ্জ জেলা পার হয়ে নেত্রকোনা থেকে হবিগঞ্জ যেতে হয়। মোজাফফর আহমেদ হযরত শাহজালাল (রঃ) এর তিনশ ষাট জন শিষ্যের একজন সৈয়দ নাসির উদ্দিনের সিলসিলার উত্তরসূরী। মোজাফফর আহমেদের ছেলে কুতুব শাহও একজন পীর। তরিকা হলো চিশতিয়া। উকিল মুন্সী মোজাফফর আহম্মেদের পাঁচ খলিফার একজন। উকিলেরও কয়েকজন মুরিদ ছিলো। এখন রহিমা খাতুনের চাচী শাশুড়ী ছাড়া উকিলের কোন মুরিদ  জীবিত নাই। পীরের ছেলের কুতুব শাহের কাছে তিনি আর তার স্বামী মুরিদ হন। তিনি আরো জানান- পীরের নাতি বলেছেন, উকিল মুন্সীকে আমার দাদা খেলাফত দিয়েছেন। তাকে শুধু উকিল মুন্সী বলবেন না- বলবেন হযরত উকিল মুন্সী।

পীরের নির্দেশেই উকিল তার গানে একতারা ছাড়া অন্য কোন বাদ্য যন্ত্র ব্যবহার করেননি। শুধু তাই নয়, পীর নির্দেশ অনুসারে তার বংশে মেয়েদের মজলিশে গান গাইতে নিষেধ করে যান। তার এক নাতনী বেশ জনপ্রিয় গায়িকা ছিলেন। উকিলের নির্দেশনার কারণে তিনি গানে ইস্তফা দেন। পীর মোজাফফর আহম্মদ (রঃ) এর জলসায় নিয়মিত অংশগ্রহণ ছাড়াও বারহাট্টার চন্দ্রপুরের পীর মোফাজল হক চিশতী, ঝিমটির চান মিয়া শাহ ফকির, পূর্বধলার লেটিরকান্দা পাগলা বাড়িসহ বিভিন্ন পীর-ফকিরগণ ছিলেন তাঁর গানের মুগ্ধ শ্রোতা। উকিল মুন্সীও তাঁদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেন।

বাড়ির উঠানে বড়ই গাছের নিচে দুটি কবর। কাচা-পাকা বড়ইয়ের ভারে গাছটি নত। উকিল মুন্সীর পাশে তার ছেলে সাত্তার মিয়ার কবর। তিনিও বিখ্যাত কবি ও গায়ক ছিলেন।

jugantor_wsপীর মোজাফফর আহম্মদ (রঃ) উকিলের গান খুবই পছন্দ করতেন। এমনকি তার মৃত্যুর কিছু আগেও উকিলের গান গেয়ে যান। উকিলের সাথে পীরের সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে রাজিয়া খাতুন একটা কাহিনী বলেন। একবার পীরের দরগায় ওরছ ছিলো। শরীর খারাপ থাকায় উকিল যেতে পারেন নাই। পীর সাহেব বেজায় রেগে গেলেন। ভক্তদের বললেন- উকিল মুন্সী আসলে তাকে ভিতরে ঢুকতে দিবা না। তার জন্য ওরছটাই নষ্ট হলো। কয়েকদিন পর উকিল মুন্সী পীরের সাথে দেখা করতে গেলেন।তিনি পীরের ঘরে ঢোকার আগেই গানে টান দেন- নিঃদুনিয়ার ধনরেৃ। এই গান শুনে পীর ঘর থেকে বের হয়ে উকিলকে  হাতে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভক্তরা অনুযোগ করে বলল, আমাদের বললেন তারে যেন ঘরে উঠতে না দিই। আর এখন আপনি নিজেই তপস্যা ভেঙ্গে তারে নিয়ে যেতে আসলেন। পীর সাহেব কিছুই বললেন না।

সেই মাশুক পীর যখন মারা যান, আশেক উকিল মুন্সী তার শিয়রে বসা। পীর নিজ কন্ঠে উকিলের- আতর গোলাপ ছিটাইয়া শুইয়া রইলাম বিছানায়, বন্ধু তোমারি আশায়… গানটি গাইলেন। তারপর সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজেকে চাদর দিয়ে ঢেকে দেন। চাদর ঢাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। এই ঘটনা উকিলের মনে বড় প্রভাব ফেলে।  সেখানে উকিল শুয়াচান গানটি রচনা করেন। এভাবে একটি গানের মানে যখন পরিবর্তন হয়ে যায়- তখন অন্য গানগুলো নিয়েও কথা চলে আসে। এভাবে উকিলের গানের রোমান্টিকতা ও বিরহের আরেকটা প্যার্টান আমাদের গোচর হয়। এর সাথে বাহ্য কৃত্যের যোগ আছে। সত্যকে জানা ও নিজেকে মাসুম করে তোলার বিষয়টি এই গুরু-শিষ্য পরম্পরার সাথে যুক্ত। এছাড়া এটা নিছক দুজন ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক নয়, পরমের সাথে সম্পর্কের যোগসুত্র হলো এই দুনিয়াবী সম্পর্ক। উকিলের একটি বিখ্যাত গান হচ্ছে-

পিরীত ও মধুর পিরীত, পিরীত করা কি সহজ ব্যাপর। তুমি ধর গুরুর সঙ্গ, তোমার পাপে ভরা অঙ্গ, ভিতর বাহির কর পরিষ্কার।

উকিল মুন্সীর নাতনী জামাই কলম মেম্বার পীরের শানে রচিত একটি গান শুনান। এই গানটির রচিয়েতা উকিলের ছেলে আবদুস সাত্তার। আমরা মোবাইল রেকর্ড থেকে যেটুকু গান উদ্ধার করেছি গানটি হলো এই রকম- সরওয়ারে মদিনা তুমি আল্লাহর ওলি কুতুবুল আকতার শাহ পীর বদলে নুরে আলামীন জাহাগীর দরবার শরীফ রিচি করিলা তরাফ… ওহে নিরাশার আশা আসিয়া.. ভক্তের আশা।

আষাড় মাইসা ভাসা পানিরে পূবালি বাতাসে, বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি,আমার নি কেউ আসে ... এই অঞ্চলের বাইরে উকিলের জনপ্রিয় তিন বা চারটি গানের একটা। এই গানটি শুনলে খুব সহজেই বুঝা যায় নাইওর যেতে দেরি হওয়া কোন এক নারীর আর্তি। কিন্তু এই গানে উকিল কেন নিজের নামে ভানিতা যোগ করলেন। যোগ করলেও কি শুধুমাত্র নাইওর যেতে না পারা নারীর আর্তিই বিবেচনা করব! পুরুষের কন্ঠে নারীর ভাব নিয়ে গান গাওয়ার প্রচলন অনেক পুরানা। সেই ভাব বাংলার সর্বত্র আছে। বিরহী নারী ভাব সংগীতে তীব্র দ্যোতনা তৈয়ার করে, যা পুরুষ দিয়ে বুঝা যায় না। আত্মা-পরমাত্মা ও গুরু-শিষ্যের সম্পর্কে এই ভাব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। উকিল মুন্সী ঘাঁটু গানের (বিকৃত অর্থে ঘেঁটুগান) দেশের মানুষ। ঘাঁটু গানে পুরুষ রাধা বেশ নিয়ে কৃষ্ণের জন্য বিরহের গান গায়। যেহেতু আমরা পীর-শিষ্যের সম্পর্ক জেনেছি সেই দিক থেকে এই গানের স্বতন্ত্র্য তাৎপর্য আছে। আষাঢ় মাসে সবাই নাইওর যায় কিন্তু উকিল যেতে চান কার্তিক মাসে। কেন? তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় পীরের মৃত্যু তারিখ থেকে। উকিলের পীর মারা গেছেন কার্তিক মাসের শেষ দিকে। পীর-মুর্শেদের সম্পর্কের মধ্যে এটা খুব সাধারণ বিষয়- ভক্ত তার পীরের মৃত্যু দিনে মৃত্যু বরণ করতে চান। সেই আকুতি এই গানে প্রকাশ পেয়েছে। সব নাইওরী আষাঢ় মাসে বাপের বাড়ী গেলেও উকিলের নাইওর হবে কার্তিক মাসে। নাইওর মানে হলো সেই উৎসে ফিরে যাওয়া যেখান থেকে আমরা এসেছি। কিন্তু সেই ইচ্ছা পূরণ হয় নাই। উকিল মুন্সী মারা যান পৌষ মাসের দুই তারিখে।

পরে উকিল মুন্সীর ভক্ত মুক্তিযোদ্ধা দুলাল কমান্ডার আমাদের আরো কয়েকটি গানের লাইন শুনান। যেগুলো পীরের তরফে লেখা এই তথ্য না জানলে সঠিক মর্ম উদ্ধার করা কঠিন। প্রথম গানটি হলো- দক্ষিন হাওয়ারে লাগিস না মোর গায়, গায়ে লাগলে আগুন জ্বলে । দক্ষিনে হাওয়ারে চোখে নাহি দেখা যায়, দ্বিগুন জ্বালা লাগিলে আমার গায়…। এই গানের দক্ষিন দেশ মানে পীরের দেশ। হবিগঞ্জ এই অঞ্চল থেকে দক্ষিণ দিকে। যে দেশে যেতে হয় হাওরের পর হাওর নৌকা বেয়ে। দক্ষিন দিকের হাওয়া তো পীরের গায়ে লেগে তারপর উকিলের অঞ্চলে আসবে। অথচ উকিল পীরের কাছ থেকে দূরে। এই হাওয়া তার কাছে পীরের পবিত্র স্পর্শ নিয়ে আসে। এই স্পর্শ এই আশেক বুঝতে পারে, কিন্তু এটা তাকে শান্তি দেয় না। বরং, দেখার আকুলতা আর বিরহ আরো বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয় গানের কথায় সেটা আরো স্পষ্ট হয়। এই হাওয়ার মতোই পীরের খবর উকিলের বিরহ ব্যথা বাড়িয়ে দেয়। সে ব্যথা উকিল কেমনে সহ্য করেন! এই বিরহ কিছুতেই মিটে না। শুধু সংবাদে কি তার খবর জানা যায়।তাকে দেখলেই তার জ্বালা মিটবে-

সংবাদে কি অঙ্গ জুড়ায় সখি বিনা দরশনে, শিশিরে না ভিজে মাটি বিনা বরিষনে। যে যাহারে ভালোবাসে নয়নে নয়নেরই কোণে, তারে কি যাইরে ভোলা থাকিতে জীবনে। না দেখিয়া সংবাদ পাইলে দ্বিগুন দুঃখ বায়, যেমন কাটা গায়ে লেবুর রসে ধরে তার গায়…

এই বিচ্ছেদ শুধুমাত্র গুরু-শিষ্যের নয়- পরমের সাথে মানুষের যোগসুত্রের রজ্জুরও বিচ্ছেদ। সেই রজ্জু ধরতে না পারলে কিছুর মূল্য নাই। তার আরেকটি গান হলো- এসো হে কাঙ্গালের বন্ধু তুমি দেখা দাও আসিয়া।আমার পুরা অঙ্গ জুরাইতাম তোমার চান্দ মুখ দেখিয়া। আরেকটি গানে বলেন, চিতার অনল জ্বলে চিত্তে

উকিলের বিরহ হলো শরীয়তি ও মারেফাতী ধারার এই যুগল প্রকাশ। এই কারণে তিনি জীবদ্দশায় নিজ অঞ্চলে পেয়েছেন ব্যাপক সম্মান ও খ্যাতি। তার মোনাজাত ছিলো বিখ্যাত। তিনি বিভিন্ন জন সমাবেশ মোনাজাত করতেন। উকিল তার মোনাজাতে ও গানে উপস্থিত মুসল্লি ও দর্শক-শ্রোতদের যেমন নয়ন জলে ভাসিয়েছেন- তেমনি এক অন্তর্লীন প্রার্থনায় নিজেও কেঁদেছেন অঝোর ধারায়। তার সম্পর্কে আরো বলা হয়, উকিল মুন্সী কুলিয়াটি, পালগাঁও, বরান্তর গ্রামের মসজিদে ইমামতি করেও যখনই নিজ গ্রাম জালালপুর আসতেন তখন গ্রামের মুসল্লিদের অনুরোধে এখানেও তিনি ইমামতি করতেন। কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজনরা জানাজার নামাযে ইমামতি করার জন্য উকিল মুন্সীকে মনে প্রাণে চাইতেন। এমনও হয়েছে যে, বাউল গানের আসরে বিরতি দিয়ে তাঁকে জানাজার নামাজে ইমামতি করতে হয়েছে। উকিল মুন্সী তার বিনয়গুণ, চরিত্র মাধুর্য, মানবপ্রেমী হৃদয়, দরাজ গলা, ভরাট ও মিষ্টি কন্ঠস্বর, সবোর্পরি তাঁর সৌম্যকান্তি অবয়ব, সঙ্গীত ও ধর্ম প্রতিভার অপূর্ব সমন্বয়ের কারণেই তাঁর জীবনে জীবনে বিস্ময়কর সাফল্য এসেছিল। নামাজ বা মিলাদ মাহফিল বা অন্য কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাঁর মোনাজাত শুনে ধর্মপ্রাণ মানুষ যেমন কেঁদেছেন- ঠিক তেমনি ভাটিয়ালি সুরে একতারাতে তাঁর বিরহ বিচ্ছেদের আর্তনাদে মুখর মরমি গান শুনেও কেঁদেছন সঙ্গীত পিয়াসী সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। (নেত্রকোণা মুখশ্রী, প্রকাশক- নেত্রকোণা জেলা সমস্বয় পরিষদ ঢাকা, ঢাকা, ২০০৫, পৃষ্টা ৯৪-৯৫)

এভাবে আরো কয়েকটি গান শুনেছিলাম যেগুলোর দ্বৈত অর্থ প্রকাশ পায়। কিন্তু আশেক-মাশুকের ভাব ছাড়া এই গানগুলো শিক্ষিত মানুষের কাছে যতই আদরণীয় হয়ে উঠুক- এর মর্ম না বুঝতে পারলে উকিল মুন্সীর গান, উপমা আর সেই হাওর অঞ্চলের উদাসী প্রকৃতিকে বুঝা সম্ভব না। বিশেষ ধরণের যাপনের সাথে সম্পর্ক না বুঝলে- সাধারণ প্রেমের গান থেকে এগুলোকে আলাদাও করা যাবে না। সেই কারণে গানের সাথে সাথে পেছনের মানুষটার হদিস জানা বড়ো প্রয়োজন। গানের ভাব নিয়ে যা বলছিলাম, সেই বিষয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো সুনামগঞ্জের শাহ আবদুল করিমের গান। যিনি নানা আসরে উকিল ও উকিলপুত্রের সাথে গান গেয়েছেন। করিমের গান নিয়ে ব্যবসা হয়েছে বেশ। বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের বাহারী আয়োজন, বাদ্যযন্ত্রের ঝংকার ও গায়কীতে কূলহারা কলঙ্কীনি  বা কৃষ্ণ আইলো রাধার কুঞ্জে  মানব-মানবীর সাধারণ প্রেমের আইল টপকাতে পারে নাই। ক্ষেত্র বিশেষে সেই প্রেম শরীরের ভেতরের হৃদয়েরও খবর রাখে না। এর সাথে পরম সত্য খোঁজার বা সাধনার কোন যোগ পাওয়া যায় না। এতে অনেকের লাভ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভাবচর্চার দিক থেকে লোকসান হয়েছে ঢের। তাই প্রয়োজন উকিলের গানের প্রকাশ, সুরের সংরক্ষণ । উকিল মুন্সী ও তার গান নিয়ে গবেষণা হলে নেত্রকোনার ঐতিহ্যবাহিত নানা সুর ধারার মধ্যে আরেকটি ধারা যুগ যুগ ধরে হৃদয়ের ক্ষুধা মিটিয়ে যাবে।

Comments

comments

18 thoughts on “উকিল মুন্সীর গানের ভেতর বাড়ি

  1. অসাধারণ লিখেছেন। শুয়াচান গানটি আমার একটি প্রিয় গান। অথচ আমি উকিল মুন্সী সম্পর্কে কিছুই জানতাম না!
    একটি ব্যাপার ঠিক বলেছেন- প্রতিটি গান রচনার পিছনের কাহিনী না জানলে এর রস ঠিকমতো আস্বাদন করা যায় না।

    • আসলে এ ধরণের ব্যাখ্যার জন্য আমরাও প্রস্তুত ছিলাম না। সে দিক থেকে প্রশ্ন তোলা যায়- প্রাচীন গীতিকবিদের আমরা যেভাবে রোমান্টিকতা (মানব প্রেম) দিয়ে চর্চা করি- তার কতটা তার গানের মধ্যে আছে?

      সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।

  2. I love to read and know the lives of such nature gifted sages. Thanks for this write-up. I wonder where do they get such wisdom from that can’t be taught in any university? How they look differently to the meaning of life will remain a big question mark for me.

  3. ধন্যবাদ Hasan Imam ভাই। প্রকৃতির নিবিড়তা এবং মানুষ নিজেই প্রকৃতির অংশ এই দুটো দিক মানুষের জিজ্ঞাসার জন্য জরুরী। এ জায়গায় কোন শিক্ষায়তনিক সভ্যতার দরকার পড়ে না। দরকার নিজেকে পাঠ করার একাগ্রতা। এটা হলে- জগতের ইতিহাস নির্দিষ্ট সভ্যতা/চিন্তার বিবর্তনের একরৈখিকতা নয়। এর বহুমাত্রিক তাৎপর্য আছে। যা চৌহদ্দির মাপজোকে অনেক সময় ধরা পড়ে না বা মার খেয়ে যায়। কিন্তু হারিয়ে যায় না। কিছু চিহ্ন জাদুর কাঠির মতো এখানে ওখানে উকি মারে। তারে ধরতে চাই।

  4. খুব ভালো লাগলো পড়ে, আপনার লেখনির হাত অসাধারণ। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য ওনাদের মত মাটির মানুষ নিয়ে কাজ করা হয়েছে খুব অল্প তাই তাদের সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। এখনই কাজ শুরু না করলে হয়ত তাদের উত্তরসূরী কাউকে খুজে পাওয়া যাবে না।
    আপনি শুরু করেছেন দেখে আপনাকে ধন্যবাদ 🙂

    • আমি একা না। সাথে আছেন আমার বন্ধূ দাউদুল ইসলাম। এই লেখা তৈরিতে অনেকে সাহায্য করেছেন। অনেকে সামনে সাহায্য করবেন বলে কথা দিয়েছেন। এই ধন্যবাদ তাদের সকলেরই প্রাপ্য।

      জি তখ্য সংগ্রহ এখনকার জন্য দরকারী কাজ। ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।

Comments are closed.