কান্না সামলে আম্মাকে বললাম, ভালো আছি

 (ব্যর্থ এক সার্জারি নিয়ে ভোগান্তির কাহিনি এটা। যার মূল পর্ব শুরু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, এখনো চলমান। এখন একটা সিনেমাটিক ক্লাইমেক্সে দাঁড়ায়া আছে। তবে সেই গল্পে দুর্ধর্ষ কোনো অ্যাখ্যান নাই, বিরাট কোনো বাঁক-বদল নাই। অনেক বিরক্তিকর দীর্ঘশ্বাস আছে। কিন্তু এ গল্প আমার খুবই কাছের, আমার বর্তমান। আমার স্বজনদের জন্য পরীক্ষার, আমাকে ভালোবাসার। সেই গল্পটা আমার বন্ধুদের জানাতে চাই, অন্তত এক অধ্যায়ের সমাপ্তির আগে আগে।  অবশ্য পুরো গল্পটা এভাবে শেয়ার করা সম্ভব কিনা আমার জানা নাই। এখন পর্যন্ত প্রায় সব হাসপাতাল ও চিকিৎসকের নাম বদলে দেওয়া।)

আগের পর্ব: একঅসুখের দিনদুইবাবা আর আমি পাশাপাশিতিনঅপারেশন টেবিলের ঝাপসা দুনিয়াচারবাসায় ফেরার আনন্দপাঁচ. ঘুম ভেঙে দেখি শরীরজুড়ে রক্তছয়লজ্জা ভুলে কেঁদে উঠলাম হাসপাতালে, সাত. অপারেশন টেবিলে মৃত্যু নিয়ে রসিকতা, আট. হাসপাতালের বিল থেকে অর্ধেকের বেশি টাকা গায়েব, নয়. হোমিওপ্যাথির ডাক্তার বললেন, আপনি কি ক্ষমা করতে পারেন? দশ. সুন্দরবনে ব্যথার সঙ্গে যুগলবন্দি

নামলিপি নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

একদিন হোম অফিস শেষে বের হলাম। সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ইউনিভার্সিটির ছোট বিল্লাহর বাসায় গেলাম আমি আর মিশু। মূলত মিশুকেই দাওয়াত করছিল তারা। খাবার-দাবারের অনেক আয়োজন। আমি পোলাও-মাংস বাদ দিয়ে সামান্য মাছ দিয়ে সাদা ভাত খাইলাম। মাছের টেস্টটা একটু অন্যরকম। সম্ভবত বিশেষ কোনো মশলা ইউজ করছে, যা আমি আগে খাই নাই বা খেয়াল করি নাই। ওই বাসায় ঘণ্টা দেড়েকের মতো ছিলাম।

তখন সাতটা নাগাদ বাজে। গাড়িতে উঠার পর গল্প করতে করতে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, ব্যথাটা আস্তে আস্তে ফিরছে। সেদিন খুব কষ্ট পাইছিলাম। মিশু বকা দিচ্ছিলো ডাক্তার না দেখানোর জন্য। আমি অবশ্য এর আগে থেকে ট্রাই করছিলাম, সেদিন জানলাম আমার সার্জন আকবর আহমেদ এখনো ছুটিতে। রাতভর যন্ত্রণায় কাতরালাম। নিশো ভাইয়ের দেওয়া একটা ঔষুধ খাওয়ার পাশাপাশি পিঠে মালিশও করলাম। কী একটা অবস্থা!

ও আচ্ছা দারাশিকোর কথা ভুলে গেলে চলবে না। একদিন মেসেজে জানালেন, পরদিন সন্ধ্যার দিকে ওনার গলব্লাডার সার্জারি। ল্যাপারস্কপি হবে। আসরের নামাজের পর হাজির হলাম মধ্যমমানের একটা হাসপাতালে। তবে উনার সার্জনের নিয়মিত চেম্বার পাশের গ্যালাক্সি স্পেশালাইজড হাসপাতালে।

দারাশিকো ভাইয়ের সার্জারি যথাসময়ে শুরু হলো। একটা বিষয়ে খুবই বিরক্ত হয়েছিলাম সেদিন। ছোট একটা ওয়েটিং রুম ছিল রোগী ভর্তি। বাচ্চা আছে, নারীরাও আছে। একটু পর হয়তো প্রশাবের রাস্তা থেকে পাথর ও টিউব খোলার জন্য তাদের কারো কারো ডাক পড়বে। যেমন; একজন জিজ্ঞাসা করছেন, টিউব খুলতে যন্ত্রণা হবে কিনা। দারাশিকো ভাইয়ের কাছ থেকে যা শুনছিলাম, সেখান থেকে আশ্বস্ত করলাম। যদিও অল্প সময়ের জন্য একটা তীক্ষ্ণ ব্যথার কথা বলছিলেন। তখন লোকটা হাসতে হাসতে বললেন, কম বা বেশি ব্যথা একটা আপনাকে পাইতেই হবে। এই হাসি একই সঙ্গে দুঃখ ও ঠাট্টার। কার সঙ্গে ঠাট্টা? সেখানে একজন এসে বললেন, দারাশিকোর সঙ্গে কে আছেন? বললাম, আমি। ওই লোক জানালেন, একটু পর অপারেশন হবে। সেখানে থাকা টিভিতে দেখাবে।

লোকজন এক আগে বলছিল, ওপরে থাকা ছোট টিভিতে অপারেশন দেখাবে। কিন্তু বিষয়টা আমার বিশ্বাস হয় নাই। অপারেশন ছোট বা বড় যাই হোক, প্রাইভেসি বলে একটা বিষয় আছে। এ ছাড়া অপারেশনের জন্য অপেক্ষারত বা ছোট ছোট বাচ্চারা এখানে বসে আসে। অবশ্য কারো মাঝে অস্বস্তি দেখা গেল না। সবাই মনোযোগ দিয়ে পিত্তথলি কাটার দৃশ্যটা দেখছিল। আমার সহ্য হচ্ছিল না, উঠে গিয়ে দরোজার কাছে দাঁড়ালাম। চোখে পানি চলে আসলো। বেশিরক্ষণ লাগলোও না।

একটু পর ডাক্তার এসে বললেন বাংলাদেশ ব্যাংকের রোগীর সঙ্গে কে আছেন? মানে রোগী নামটাও দেখে নেয়ার টাইম নাই। তার হাতে একটা ছোট একটা বাটিতে পিত্তথলির পুরোটাই। হায়! আমারটা একদম গলে গেছিলো। ডাক্তার ছুরি দিয়ে কেটে ফেললেন। ভেতর থেকে ছোট একটা পাথর বের হলো। এর কিছুক্ষণ পর পিত্তথলিটা একটা বৈয়ামে করে একজন নিয়ে এলো। ভাবির বড় ভাই সেটা নিয়ে গেল অন্য এক হাসপাতালে, বায়োপসি করাতে। বয়োপসি বিষয়টার সঙ্গে পরিচিত ছিল না। পরে, জেনেছিলাম সংক্রমণের ধরন বা অন্য কোনো ঝুঁকি আছে কিনা জানতে এ পরীক্ষা। এ পরীক্ষা না করায়নি বলে পরে এক চিকিৎসক আমাকে দুই কথা শুনিয়েছিলেন।

মোটামুটি এক ঘণ্টার মাঝে দারাশিকো ভাইয়ের জ্ঞান ফেরলো ও উনাকে কেবিনে নেয়া হলো। এরপর কিছুক্ষণ বসে বাসার পথ ধরলাম। স্বস্তি পেলাম. যাক অপারেশনটা হয়ে গেল আর ঝামেলা নাই। যদিও হাসপাতাল আমার একদম পছন্দ হয় নাই। আর কে-ই বা জানতো পিকচার আভি বাকি হ্যায়!

তবে সেদিন একটা বিষয় চোখে লেগেছিল। এমন যে, আমরা নিজেরা অনেক সময় ঠিকঠাক দেখতে পাই না। তখন একই পরিস্থিতিতে অন্য মানুষরা আমাদেরই আয়না। দারাশিকো ভাইয়ের বাসায় অনেক গেছি। উনার বড় বাচ্চাটা আমাকে খুব পছন্দ করে। কখনো উনাদের মধ্যে উঁচু গলায় কথা দেখি নাই, সেটা আমাকে দেখানোর মতো বিষয়ও না। যখন উনাদের কেবিনে গিয়ে বসলাম, ভাবি নানা বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন। পরবর্তী সমস্যা, খাওয়া-দাওয়াসহ নানান কিছু। খেয়াল করলাম, দারাশিকো ভাই খুব বিরক্ত, প্রশ্নের জন্য পরে যখন নিজের দিকে তাকিয় বুঝতে পারি অসুখ মানুষকে কতটা এফেক্ট করে। কীভাবে ধীরে ধীরে আমরা ক্ষয়ে যাই। বাসায়, ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল, অসুখে ভুগে ভুগে আমার মেজাজের অবস্থা কী হয়েছিল! এ সময় অবহেলার বোধটা খুব টনটনে হয়। নিজের অক্ষমতার জায়গাগুলো বারবার চোখে পড়ে। এমনই হয়।

অবশেষে ডা. আকবর আহমেদ এক সপ্তাহের ছুটি কাটিয়ে ফিরেছেন। মিশু এসে বাসা থেকে ওনার কাছে নিয়ে গেলেন। ওই দিন উনার সঙ্গে এক জুনিয়র ডাক্তার ছিলেন, নারী। দুজনে আলোচনা করে প্রেসক্রিপশন লিখছিলেন। ঠিক আগের মতো, আমাকে দেখিয়ে আকবর আহমেদ বললেন, উত্তরা থেকে আসছেন! উনি কিন্তু অনেক ধৈর্য্যশীল। উনাকে পুরো ঘটনা জানালাম। উনি বললেন, পিত্তথলির সার্জারির কারণে কিছু হওয়ার তো কথা না। তারপরও কিছু টেস্ট দিলেন। কিডনির কথা জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম, আগের ইউএসজির কথা। উনি বললেন, এটা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় না। এক্স-রে করাতে হবে। পরে অবশ্য এক্স-রে দিলেন না। রক্তের টেস্ট দিলেন।

বেশ সময় লাগলো। বাসায় না গিয়ে মিশুর সঙ্গে রয়ে গেলাম। এই রকম বেশ কয়েকবার থাকতে হইছে। ডাক্তার দেখিয়ে বেশ রাত হয়ে গেছে, শরীর আর চলতো না। হাসপাতালগুলো বাসা থেকে বেশ দূরে দূরে। সকালে আবার অফিস। এই রকম একদিন মেজবাহর অফিস থেকে খাবার খেয়ে ফিরছিলাম আমি ও মিশু। এরপরই পেটে হালকা ব্যথা শুরু হয়। আল্লাহ আল্লাহ করছিলাম, যেন কোনো বিপত্তিতে না পড়ি। গরম পানি খাচ্ছিলাম ঘনঘন। ব্যাপারটা কত যে অস্বস্তিকর। এখন তো নোয়াখালী ছাড়া ঢাকার বাইরে যাই না। বাড়িতে গেলেও ভয়ে ভয়ে থাকি, কখন আবার ব্যথা ওঠে। জরুরি মুহূর্তে কোথায় যাবো?

যাই হোক, পরদিন রিপোর্ট দেখাতে গেলাম। আকবর আহমেদের আত্মবিশ্বাস বেশ দেখা গেল। আগের দিন তিনি রক্তের একটা টেস্ট দিয়েছিলেন। এখন সেই সূত্রে বললেন পেটের মধ্যে এইচ ফাইরোলি নামের একটা জীবাণু পেয়েছেন। যেটা খাবার ও পানীয়ের মাধ্যমে পেটে ঢোকে। বেশ খারাপ ধরনের জীবাণু। পাকস্থলিতে সাধারণত খুব কড়া ধরনের এসিড থাকে। সে এসিডও এ জীবাণুকে গলাতে পারে না। বরং এটি নিজের চারপাশে শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এ কারণে ব্যথা-জ্বালা পোড়া হয়ে থাকে। অনেক সময় পিত্তথলির অপারেশনের রোগী একে অপারেশন পরবর্তী জটিলতা বলে মনে করে।

সব শুনে আমার ভয়ই লাগছিল। তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ জীবাণু কীভাবে পেটে ঢুকল? আসলে উত্তরের জন্য উনি বলেন নাই। আমি বলছিলাম, অনেকদিন তো বাইরের কিছু খাই না সাধারণত। করোনার পর থেকে অফিস করলে বাসা থেকে খাবার নিয়ে যায়। … ও হ্যাঁ, কিছুদিন আগে সুন্দরবন গিয়েছিলাম…। উনি বললেন, এত কিছু নাও ঘটতে পারে। আগে কখনো ঢুকে বসে থাকতে পারে। এর জন্য খুব বেশিকিছু দরকার হয় নাই। দোকানে অনেকের চা খাওয়ার অভ্যাস থাকে। কাপ তো ঠিকমতো ধোয় না। সেখান থেকেও ঢুকতে পারে।

সব শুনে তো আমার হতাশ হওয়ার পালা। নতুন কী বিপদ বাড়ালাম আবার। তাইলে? ডা. আকবর এবার হতাশার সুতা গুটিয়ে আনলেন। বললাম, এটা কী রেয়ার কিছু। না। তাহলে? উনি বললেন, কয়েক মাসের ওষুধের একটা কোর্স করতে হয়। নরমালি কয়েক মাস ওষুধ খেলেই সেরে যায়। সব ওষুধ মিলিয়ে একটা প্যাকেজের মতো কিছু আছে। তবে তিনি ওষুধ আলাদা আলাদাভাবে দিলেন। গ্যাস্টিকের ওষুধ টানা দুই মাস। বাকি দুটো কীসের মনে নাই। এগুলো সম্ভবত ১৫ দিন করে ছিল। পুরো বিষয়টা শুনে ডা. ফাহিম বললেন, ঠিক আছে। এ ধরনের সমস্যা আছে। চিন্তার কিছু নাই। ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যায়।

চিন্তার বিষয় পাইলাম অনলাইনে খুঁজতে খুঁজতে। এইচ ফাইলোরি নিয়ে রীতিমতো নোবেল পাওয়ার মতো গবেষণা হইছে। থার্ড ওয়ার্ল্ডে এটা কমন রোগ। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষের মাঝে আছে, তবে বিশ ভাগের মধ্যে এর প্রকাশ পায়। একটা বিশাল গবেষণাপত্র পাইলাম। যেখানে যেদিকে চোখ যায় ‘ক্যানসার আর ক্যানসার’। ওষুধ খাইতেছি আর হতাশ হচ্ছি টাইপ অবস্থা। এর মধ্যে কয়েকবার ডা. আকবরের কাছে গেলাম পেটে ব্যথা, বুকে ব্যথা নিয়ে। এক্স-রে, ইউএসজি করা হলো। কোনো সমস্যা পাওয়া গেল না। জ্বরের কারণে দু-এক দফা অ্যান্টিবায়োটিকও খাইলাম। সব মিলিয়ে অস্বস্তি যাচ্ছে না। কবে যে সুস্থ হবো?

একবার আকবর আহমেদ কিছু টেস্ট তাৎক্ষণিক করিয়ে আনতে বললেন। কাউন্টারে বলা হলো, এ বিষয়ে কাস্টমার কেয়ারের অনুমোদন লাগবে। সেখানে গেলাম, দেখলাম কাস্টমার কেয়ারের ম্যানেজার কম বয়সী এক ভদ্রলোক। উনি আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, কী সমস্যা? বললাম, আমার এই টেস্টটা জরুরি লাগবে। কাগজটা দিতেই উনি তাকালেন, আপনি ওয়াহিদ সুজন? বললাম, হ্যাঁ। উনি বললেন, আপনাকে চিনি তো। আমরা ফেসবুক ফ্রেন্ড। আমরা খানিকক্ষণ গল্প করলাম। দেখলাম আমার ভালোই পরিচিত কয়েকজন উনার বন্ধু। চিকিৎসার পুরো ঘটনা জানাতে বললেন, আপনি যদি মনে করেন পুরো বিষয়টা রিভিউ করা দরকার, তবে আমাকে জানাবেন। আমরা অন্য ডাক্তারের সাহায্য নেবো। তবে আমি যে আপনার পরিচিত তা আকবর আহমেদকে জানানোর দরকার নেই। বলতে অস্বস্তি নেই যে, উনার বলার ধরন দেখে আকবর আহমেদের প্রতি খানিকটা বিরক্তি আসে নাই এমন নয়।

উনি কার্ড ধরিয়ে বললেন, যেকোনো সমস্যায় আমাকে ফোন করবেন। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। পরে অবশ্য উনার সঙ্গে যোগাযোগ হয় নাই আর। একদিন কোনো একটা বিষয়ে ফোন করছিলাম, ধরেন না। আর হাসপাতালে গেলেও দেখা করি নাই।

এখন অফিসে যাওয়া-আসাও অনিয়মিত। ব্যথার দিনগুলো বাসায় থাকি। একদিন অফিস থেকে ফিরছি। বাসে। বনানী ক্রস করছি, তখন মেজবাহর ফোন। ওর ভায়রা ভাই সিএমএসের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক, ডা. বাদশা। আমার কথা ওনাকে জানাতে নাকি সব কাগজপত্র চাইছিলেন। আমি একটা মেইলে সংক্ষিপ্ত হিস্ট্রি লিখে সঙ্গে একবছরের উল্লেখযোগ্য রিপোর্টগুলো পাঠালাম। বাদশা ভাই আমাকে নিজেই ফোন করলেন। উনার ধারণা, আমার অপারেশনে কোনো গলদ আছে, তাই ভেতরে একটা ইনফেকশন রয়ে গেছে। তাই এ অবস্থা। আবার অপারেশন লাগবে? উনি বললেন, সম্ভবত ইনজেকশনে সেরে যাবে। হাজার টাকা করে ১৪টা ইনজেকশনে কাজ হতে পারে। উনার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বললেন, করোনার সময় বাইরে রোগী দেখা নিষেধ। একে তো ব্যস্ততার জন্য সময় বের করতে পারেন না, তারপরও তিনি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না। আমাকে বললেন, অভিজ্ঞ কোনো হেপাটোবিলিয়ারি সার্জন দেখাতে। অবশ্যই এফসিপিএস হতে হবে। এই প্রথম ‘হেপাটোবিলিয়ারি’ শব্দটা শুনলাম। উনিও সাজেস্ট করতে পারলেন না। বললেন, এ বিষয়ে উনার জানাশোনা কম। কাজের ব্যস্ততার কারণে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যোগাযোগ নেই এক প্রকার।

মেজবাহ বলল, সমস্যা নাই, আমরা খুঁজে বের করে ফেলবো। আমি ডা. ফাহিমকে মেসেজ দিয়ে বললাম, একজন সিনিয়র হেপাটোবিলিয়ারি সার্জন খুঁজছি। খানিকটা সময় নিয়ে উনি বললেন, আমার তো চেনা কেউ নাই এ মুহূর্তে। তবে একজন তরুণ হেপাটোবিলিয়ারি সার্জনের নাম্বার দিচ্ছি। উনাকে আমার নাম বললে হেল্প করবেন। কার কাছে যেতে হবে তা সাজেস্ট করবেন। ওই নাম্বারে ফোন করার পর ভদ্রলোক কাগজপত্র ও বিস্তারিত লিখে জানাতে বললেন। ডা. বাদশাকে পাঠানো ডকুমেন্টগুলো ওনাকেও দিলাম। এর খানিকক্ষণ পর ফোন করে ডা. আফজাল হোসেনের কাছে যেতে বললেন, উনি আল হামরায় বসেন। দুটো কারণে ব্যাপারটা পছন্দ হলো না। একে তো উনি নবীন ডাক্তার, দ্বিতীয়ত আল হামরায় আমার আগের সার্জন আকবর আহমেদ বসেন। এখন ওই হাসপাতালে অন্য কোনো চিকিৎসকের কাছে যাওয়া মানে সেখানে একটা ভুল বোঝাবুঝি ঘটনা ঘটতে পারে। ডা. ফাহিমকে ঘটনাটা জানালাম। উনি আবার খবর নিয়ে বললেন, আমি বলে দিছি। আপনি যান। ডা. আফজাল হোসেন এ বিষয়ে যে তথ্য দরকার তা তা জানাবেন।

পরদিনই মিশুকে সঙ্গে নিয়ে ডা. আফজালের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। দুজন রোগীর পর দেখা করার সুযোগ মিলল। উনি কাগজপত্রগুলো দেখে বললেন, আপনার অপারেশন দরকার। ডা. আকবর আহমেদের প্রতি এক ধরনের অশ্রদ্ধা প্রকাশ পেল। তবে আমি যে ডা. আফজালের কাছে সিনিয়র কারো সাজেশন চাইছিলাম, এ দিয়ে কোনো আগ্রহই দেখালেন না। একটা বেডে শুয়ে পড়তে বললেন। সব দেখে-টেখে বললেন, দ্রুত যেন ভর্তি হয়ে যায়। আবারও এমআরসিপি করাতে বললেন। নিজেদের হাসপাতাল বাদ দিয়ে অন্য একটার নাম বলে দিলেন, যেন সেখানেই টেস্টটা করাই। ইচ্ছা করেই আমি বললাম, হাসপাতালের নামটা প্রেসক্রিপশনে লিখে দিন, মনে থাকবে না। লিখতে গিয়েও লিখলেন না। বললেন, বোঝেন তো এগুলো লেখা যায় না।

একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে আর ফি দিয়ে বেরোলাম। আমার যতই জটিলতা হোক। এটা শহরের নামি হাসপাতালগুলোর একটা। অথচ উনি অন্য হাসপাতালে নিয়ে এমআরসিপি করতে বলছেন। এরপর পারলে তখনই ভর্তি করিয়ে দেয়। মিশুকে বললাম, হবে না। নতুন ডাক্তার খুঁজতে হবে। ডা. ফাহিম পুরো ঘটনা শুনে বেশ বিরক্ত ও লজ্জিত হলেন। বললেন, এমনটা হবে উনি ভাবেন নাই। আরেকটু খোঁজ-খবর করে আমাকে জানাবেন।

এর মধ্যে একদিন ফেসবুকে মেসেজ পাঠালো মেজবাহ। হেপাটোবিলিয়ারির একজন ডাক্তারের প্রোফাইল। ও গুগল করে পেয়েছে। আমিও গুগল করে শুরুর দিকে উনাকে পেলাম। ডা. সালাউদ্দিন। উনি বসেন আল-শেফা হাসপাতালে। এরই মাঝে দুজন ডাক্তারের অ্যাড্রেস পাঠালেন ডা. ফাহিম। একজনের নাম মোহাম্মদ আলী (প্রকৃত নাম)। উনি বেশ নামকরা ডাক্তার। বাংলাদেশে হেপাটোবিলিয়ারিতে উনাকে অগ্রগণ্য ধরা হয়। নিজে লিভারের ওপর ইনস্টিটিউট গড়েছেন। সেখানে ফোন করলাম। জানালেন, মোহাম্মদ আলী সরাসরি রোগী দেখেন না, অনলাইনে দেখেন। আমি তেমন ভরসা পেলাম না।

অন্য ডাক্তারের নাম দেখে পরিচিত লাগলো। দারাশিকো ভাইকে ফোন করে তার সার্জেনের নাম জিগাসা করতে বুঝে গেলাম একই ব্যক্তি। দারাশিকো ভাই বললেন, ওই সার্জেনের বয়স কম হলেও বেশ নামডাক হয়ে গেছে। আগেই বলেছি তার মূল চেম্বার গ্যালাক্সি স্পেশালাইজড। করোনার সময়ে যেখানে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত লোক মারা গেছেন। অ্যাপয়মেন্ট নেওয়ার জন্য তাদের হাসপাতালে ওয়েবসাইটে ঢু মারি। সেখানে একটা ফর্ম পূরণের ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পরপর দুটো ফোন। এর মধ্যে প্রথমটাতে সময় বুক করি, মোটামুটি এক সপ্তাহ পর সময় পেলাম। এ কথা শুনে ডা. ইমরান খুবই ইমোশনাল হয়ে গেলেন। বললেন, ওনার হাতে অপারেশন করে আমার বন্ধুর (দারাশিকা) কী হাল হয়েছে দেখেছেন? তার কাছে আমি যেতে মানাই করবো। তার অবহেলার কারণেই টিবি হয়েছে। নরমালি পিত্তথলির অপারেশনের সঙ্গে টিবির সম্পর্ক নাই। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি যথাযথ জীবাণুমুক্ত না হলে এমন হয়।

আচ্ছা। যেটা বলা হয় নাই। দারাশিকো ভাই আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার অপারেশনের জায়গায় টিবি হয়ে গেছে। এটা ছোঁয়াচে না হলেও বেশকিছু নিয়ম মানতে হবে। সঙ্গে ছয় মাসের ওষুধ খেতে হবে।

সব মিলিয়ে আল-শেফার ডা. সালাউদ্দিনের কাছে যাবো ঠিক করলাম। ফেব্রুয়ারির কোনো একদিন মিশু আসলো অফিসে। আমাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলো। রাশেদও আসলো। মেজবাহও এসেছিল। আল-শেফায় এর আগে একবার পায়ের সমস্যা নিয়ে আসছিলাম। সেবার ডাক্তারের আচার-ব্যবহার ভালোই লেগেছিল। উনি সব শুনে বলে দিয়েছিলেন, সম্ভবত আপনার চিকিৎসা আমার এখতিয়ারের না। এ টেস্টগুলো করে আনুন। একটু খরচ হলেও আমরা নিশ্চিত হবো। তার কথা ঠিকই হয়েছিল। ভিটামিন ডি-জনিত সমস্যা। ওনার রেফার করা চিকিৎসকের কাছে প্রায় দেড় বছর চিকিৎসা করাই। যদিও ডা. আকবর আহমেদের মতে, ভিটামিন ডি-র আবার চিকিৎসা কী! রোদে বসে থাকবেন, ব্যায়াম করবেন তাতেই চলবে!

যাই হোক, ডা. সালাউদ্দিন বেশ সময় দিয়ে আমার কথা শুনলেন। তারও একই কথা অপারেশন করতে হবে। ডা. আকবর আহমেদ নাকি (প্রায়) পুরো পিত্তথলি রেখেই দিয়েছে। সম্ভবত অবস্থা খারাপ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু এখন অস্বীকার করছেন। আবার এমনও বললেন, এমন খারাপ অবস্থা ডা. আকবর প্রায়ই করেন। রোগীরা ঝামেলায় পড়েন। তবে সালাউদ্দিনের অ্যাপ্রোচ ভালোই ছিল। আরো বললেন, এই ধরনের ঝামেলা কারো কারো হয়। কোনো এক সিনিয়র সাংবাদিকের উদাহরণ দিয়ে তার মেয়ের বারবার সার্জারি বিপত্তির গল্প বললেন। কিছু টেস্ট করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেতে বললেন। খরচ দেখলাম, প্রথমবারের দেড়গুণ। ডা. সালাউদ্দিন বললেন, দ্বিতীয় অপারেশন একটু জটিল, অনেকটা সময় নিয়ে ধরে ধরে করতে হবে।

ওহ! পিত্তথলির অপারেশনের পর বায়োপসি করিয়েছিলাম কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। জানালাম, না। কেন করিনি? বললাম, সার্জন বলেনি। এ ছাড়া বায়োপসি বলে কোনো বিষয় আছে সেটা দারাশিকো ভাইয়ের সার্জারির সময় জানতে পেরেছি। এ নিয়ে খানিকটা গজগজ করলেন তিনি। বুঝতে পারলাম না, বড়সড় কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা।

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে অপেক্ষা করছি। আমাদের গাড়িতে কী যেন ঝামেলা, ঠিক করা হচ্ছে। এই সময় প্রচণ্ড কান্না পেয়ে গেল। মিশুকে জড়িয়ে ধরলাম। ও বারবার বলতেছিল, আরে জন ভাই। কী হইছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। এর মাঝে বাবার ফোন। ধরতেই বললেন, আমার জন্য আম্মার কেমন যেন লাগছে। নিজেকে সামলে নিয়ে আম্মাকে বললাম, ভালো আছি।

চলবে …

Comments

comments