গত এক দশকের মধ্যে হলিউডের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত সিনেমা ছিল এপ্রিলে মুক্তি পাওয়া ‘অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম’। এই উত্তেজনা উসকে দেয় মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের আগের কিস্তি ‘অ্যাভেঞ্জার্স: ইনফিনিটি ওয়ার’। যেখানে ভিলেন থ্যানোস (জোশ ব্রোলিন) ছয়টি ইনফিনিটি স্টোন (সৌল, টাইম, স্পেস, মাইন্ড, রিয়্যালিটি ও পাওয়ার) নিজের করায়াত্তে এনে মহাবিশ্বের অর্ধেক প্রাণীকে আক্ষরিক অর্থেই গায়েব করে দেন। যার মাঝে ছিল অর্ধেক সুপারহিরোও।
ফলে ‘এন্ডগেম’-এর সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল যুক্তিগ্রাহ্যভাবে অর্ধেক প্রাণী, বিশেষ করে মার্ভেল সুপারহিরোদের ফিরিয়ে আনা। সেই প্রক্রিয়া অনেককে হতাশ, আর কাউকে খুশিও করেছে। এর জন্য ব্যবহার করা হয় অতি পুরোনো আইডিয়া- সময় ভ্রমণ বা টাইম ট্রাভেল। বলা যায়, সায়েন্স ফিকশনের প্রাথমিক যুগ থেকেই ‘সময় ভ্রমণ সম্পর্কীয় আলোচনা শুরু। এমনকি ক্ল্যাসিক সায়েন্স মাস্টাররাও এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফলে অতীতে ফিরে গিয়ে বর্তমান বদলে দেওয়া নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। এই সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ওল্ড মাস্টারদের বিজ্ঞানের বদলে কোয়ান্টাম লেভেলে গিয়ে ধাঁধার উত্তর মেলানো।
যাই হোক, সময় ভ্রমণ সম্পর্কিত ধাঁধা আমাদের এই লেখার আলোচ্য নয়। বরং সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই সিনেমায় তোলা নৈতিক ধাঁধা নিয়ে আলোচনা হবে। যার জন্য সাহায্য নেওয়া হয়েছে দুই-একটি বিদেশি আর্টিকেলের।
আরও পড়ুন: সুপারহিরোর ধর্মভাব
এক.
থ্যানোস অন্য সুপার ভিলেন থেকে একদম আলাদা। গড়পড়তা ধারণায় ক্ষমতা জাহির ও ‘দুনিয়াকে হাতে মুঠোয় আনা’র সঙ্গে তার পার্থক্য আছে। তার সবচেয়ে দুর্বল অংশ পালক মেয়ে গামোরা (জো সালডানা)। তাকে বলেন, “এটা সহজ হিসাব। এই মহাবিশ্ব সসীম। এর সম্পদ সসীম। জীবনকে এভাবে যদি ছেড়ে দিই, এর অস্তিত্বই থাকবে না। এর সংশোধন প্রয়োজন।” গামোরা এর প্রতিবাদ করে। কিন্তু শেষতক সফল হয় না। কারণ থ্যানোসের মতে, সে একমাত্র সত্য জানে। তাকে এগিয়ে আসবে হবে। এই হলো ছয় ইনফিনিটি স্টোন দখলে নেওয়ার রহস্য।
এই ধারণার সঙ্গে অনেকের পরিচয় আছে। একটু অন্যভাবে। থমাস রবার্ট ম্যালথাস ১৭৮৯ সালে প্রকাশ করেন বিখ্যাত বই ‘আন এসে অন দ্য প্রিন্সিপাল অব পপুলেশন’। যেখানে বলা হচ্ছে, সম্পদের প্রাচুর্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে, যা একসময় অস্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে যায়। আরও বলে, খাদ্যশস্যের উৎপাদন যখন গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পায় তখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। এখন তথ্য যদি কোনো অত্যাচারী শাসকের হাতে পড়ে কী ঘটবে- তা যেন চরম পরিণতির কথা বলে। সেটাই বলছে ‘অ্যাভেঞ্জার্স’। কাল্পনিক সুপার ভিলেন দর্শন এভাবে তৈরি হয়।
ব্যাপারটা বাস্তব তথ্য থেকে ভাবুর, শিল্পবিপ্লবের পর মানুষ দিন দিন বেড়েছে। বর্তমানে এই সংখ্যা ৭৬০ কোটি, ২০৫০ সাল নাগাদ ১ হাজার কোটিতে ছড়িয়ে যাবে। কম মানুষ মানে বেশি খাবার ও কম ক্ষুধার্ত, মহামারি ছড়ানোর ভয়ও কম। এর ফলে জীববৈচিত্র্য আর হুমকির মুখে পড়বে না। নোয়াহ হারিরির ‘স্যাপিয়েন্স’-এ মানবজাতির আজকের অবস্থানে আসার ব্যাখ্যা এই ক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে!
‘ইনফিনিটি ওয়ার’-এর পাঁচ বছর পর ব্ল্যাক উইডোর (স্কারলেট জোহানসন) সঙ্গে কথায় কথায় ক্যাপ্টেন আমেরিকা তথা স্টিভ রজার্স (ক্রিস ইভান্স) জানায়, হাডসন নদীর ব্রিজ পার হওয়ার সময় তিমি দেখতে পেয়েছে। তার মানে হলো- পরিবেশবান্ধব অবস্থায় আছে পৃথিবী। আর রজার্স বলছে, হাডসন নদীতে এখন জাহাজ কম। তাই পানিও পরিষ্কার। এর মানে হলো থ্যানোসের গণহত্যার সুফল ভোগ করছে পৃথিবী। থ্যানোসও বিশ্বাস করে, সে হলো আবশ্যকীয় অপশক্তি। তার কাজের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের দীর্ঘমেয়াদি জীবন।
এখন সুপারহিরোদের কাজ হলো ইনফিনিটি স্টোন ব্যবহার করে মহাবিশ্বকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা। খুবই স্বার্থবাদী মনে হতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি হলো- মানুষই সবকিছুর কেন্দ্র। অর্থাৎ, সুপারহিরোর চোখও আটকে আছে একদিকে।
‘এন্ডগেম’-এর একদম শুরুর দিকে দেখা যায় নিঃসঙ্গ একটি গ্রহে বসবাস করছে থ্যানোস। সে ইনফিনিটি স্টোনগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। ধ্বংসের কারণ হলো, যাতে স্টোন ব্যবহার করে মহাবিশ্বকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা না যায়। অর্থাৎ, ইনফিনিটি স্টোন হাতে রেখে ‘ক্ষমতাধর ঈশ্বর’ হয়ে থাকার অভিলাষ নেই তার। বরং মানবতাকে পেরেশানি মুক্তি দেওয়া তার কাজ।
তখন মনে হতে পারে, নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি থ্যানোসের মাঝে আছে বড় হৃদয় আর (দেখি) বুকভরা বিষণ্নতা! যার সঙ্গে ভিলেনগিরি ঠিক খাপ খায় না। আর আমরা জানি, কমিক বুকের ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাধর একক ব্যক্তি আসলে থ্যানোস।
যদি পুরো চিত্র মাথায় রাখা যায়, তবে থ্যানোস কতটা ভয়ংকর এটা মূল বিষয় নয়। উল্টো উপযোগবাদী সুরে বলা যায়, তার মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল মহাবিশ্বকে বসবাসের জন্য আরও উপযুক্ত করে তোলা। যেখানে থ্যানাসের শক্তির অহংকার বা ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা একটা হাতিয়ার মাত্র।
হ্যাঁ, থ্যানোসের সমস্যা আসলে গড় মানুষের সমস্যা না। বিচক্ষণতার সমস্যা হলেও সে জগতকে দেখে তার হোলেস্টিক অবস্থান থেকে। অন্যদিকে মানুষ ও সম্পদের অসমতার ধারণা ‘অ্যাভেঞ্জার্স’দের সামনে সত্যিকারভাবে নৈতিক সমস্যা আকারে হাজির হয়। তাই আঙুলের থুড়ি দিয়ে মহাবিশ্বের জনসংখ্যা অর্ধেক কমানো আসলে তাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে মেলে না। কারণ বৈশ্বিক লুণ্ঠন ও সম্পদ বরাদ্দের সমস্যা মোকাবিলা করার চেয়ে এর ভার অনেক বেশি।
তখন থ্যানোসের হাতে একটাই অস্ত্র থাকে- যারা তার প্রজ্ঞা বহনে অক্ষম, তারা বেঁচে থাকার অযোগ্য। এখানে এসেই থ্যানোস দানবীয় শক্তি বলে প্রতীয়মান হয়। মনে হয়, মহৎ কারণটি মুখোশ ছাড়া কিছু নয়। ফলে জগতকে লালন করা, প্রতিপালনের ধারণা তার সঙ্গে যায় না। দরকার পড়ে সুপারহিরো। যারা জগতকে একদম স্বাতন্ত্র্য অস্তিত্বের দিক থেকে দেখতে সক্ষম।
থ্যানোসের বিপরীতে যুক্তি আসে টনি স্টার্ক বা আয়রন ম্যানের (রবার্ট ডাউনি জুনিয়র) কাছ থেকে। তার আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে বিপন্ন মানবতা বেঁচে যায়। যদিও এটাই ছিল ওই পরিস্থিতিতে একমাত্র বিকল্প। কিন্তু আয়রন ম্যান উত্থান আসলে কীভাবে?
সিনেপর্দায় আয়রন ম্যানের সঙ্গে পরিচয় ২০০৮ সালের একই নামের সিনেমায়। সেখানে তাকে একজন অস্ত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। যার কাছে লাভই হচ্ছে মুখ্য। অর্থাৎ, যত হাইটেক অস্ত্র ব্যবহার হবে স্টার্ক ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা আরও রমরমা হবে। ওই কিস্তিতে আফগানিস্তানে সফরে যায়। উদ্দেশ নিজেদের তৈরি ক্ষেপণাস্ত্রের শক্তি পরীক্ষা। সেখানে তাকে অস্ত্রের জোরে আহতাবস্থায় ধরে নিয়ে যায় সন্ত্রাসবাদীরা। সেই অস্ত্র আবার স্টার্কের প্রতিষ্ঠানে তৈরি।
আরও পড়ুন: সুপারহিরো মানুষরে বাঁচাবে না
২০১০ সালে ‘আয়রন ম্যান টু’তে টনি স্টার্কের স্বার্থপরতার আরেকটি দিক দেখা যায়। সেখানে ‘আয়রন ম্যান স্যুট’ নিয়ে ফেডারেল সরকারের আবদারের বিপরীতে বলে, “তুমি আমার সম্পত্তি চাও? সেটা হচ্ছে না!” পরে বলেন, “আমার নিজের আনন্দের জন্য মহান জাতির সেবা করছি।”
২০১৫ সালে ‘অ্যাভেঞ্জার্স: এইজ অব আলট্রন’-এ স্টার্ক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রোবোট আলট্রন (জেমস স্পাডার) তৈরি করে, যা মূলত স্টার্ক ও হাল্ক বা ব্রুস ব্যানারের (মার্ক রাফেলো) ভুল ছিল। আলট্রন বিশ্বাস করে আরও ভালো পৃথিবীর জন্য মানব প্রজাতিকে লুপ্ত হতে হবে। ফলে তাদের অ্যাকশনে সংঘটিত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি কিছুই নয়, বরং মানব জাতির বৃহত্তম স্বার্থে তারা কাজ করছে।
২০১৬ সালের ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা: সিভিল ওয়ার’-এ দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় রজার্স ও স্টার্ক। কারণ তৃতীয় পক্ষ দাবি করছে সুপারহিরোদের গণতান্ত্রিক জবাবদিহির মধ্যে আসতে হবে। যেখানে স্টার্কের পর্যবেক্ষণ ছিল, “যদি আমরা সীমানা গ্রহণ না করি, তবে আমরা বাউন্ডুলে, খারাপ মানুষের চেয়ে আমরা বেশি কিছু নই।” একপর্যায়ে রজার্সের পক্ষ নেওয়া সুপারহিরোদের বন্দী করা হয়। শেষে তারা পালিয়ে যায়। ‘ইনফিনিটি ওয়ার’-এর মাঝামাঝিতে এসে থ্যানোসকে ঠেকাতে রজার্স ও স্টার্ক হাত মেলায়। সেখানে পুরোনো বিভেদ অল্পই দেখা যায়।
এভাবে আদর্শবাদী অবস্থানে দেখা যায় থ্যানোস ও স্টার্ককে। দুই চরিত্রের আত্মশ্লাঘায় এক ধরনের ভারসাম্য আছে। যারা কখনো নিজেদের অহংকারের ভেতর হারিয়ে যায়নি। ‘আয়রন ম্যান’-এ বিলিয়নিয়ার প্লেবয়, ‘আয়রন ম্যান টু’তে লোভী পুঁজিপতি, ঘটনাচক্রে ‘সিভিল ওয়ার’-এ এসেও পরিণত নন যুক্তিসংগত সরকারি আইন মানা সুপারহিরোতে, আর ‘এন্ডগেম’-এর শেষে যিশুর মতো ব্যক্তিত্ব ধারণ করে। যে অন্যকে বাঁচাতে আত্মত্যাগ করে। অন্যদিকে মহাবিশ্বকে শাসন করার লোভ ত্যাগ করে দূরের গ্রহে গিয়ে আবাস গড়েছিল থ্যানোস। যাকে ধ্বংস করে অ্যাভেঞ্জার্স বাহিনী। দুটোই প্রচন্ড নৈতিক ধাঁধা তৈরি করে। ভালো ও মন্দের ধূসর রেখা অতিক্রম করে। কিন্তু তা থ্যানোসের ধ্বংস ও স্টার্কের আত্মত্যাগের নিচে চাপা পড়ে।
আরও পড়ুন: বুড়ো লোগানের মৃত্যুর আগে
দুই.
‘এন্ডগেম’-এর আরেকটি ধাঁধা হলো, এক বনাম সমষ্টির মৃত্যু। বিষয়টা কেমন? ইনফিনিটি স্টোন হাসিলের মাধ্যমে মহাবিশ্বকে মুক্ত করতে চান থ্যানোস। মাইন্ড স্টোন ছিল ভিশনের (পল বেট্টনি) মাথায়। স্কারলেট উইচ (ওয়ান্ডা ম্যাক্সিমফ) বুদ্ধি দেয়- ভিশনকে মেরে ফেলে পাথরটি ধ্বংস করার। তাহলে থ্যানোসের পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবে। কিন্তু রজার্সের মতে, “আমরা জীবন নিয়ে কারবার করি না।”
এই ধারণার সঙ্গে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের নৈতিক ধারণা মিল পাওয়া যায়। যেখানে বৃহত্তর ভালোর জন্য কাউকে উৎসর্গ করা যাবে না। মানুষ হতে পারে লক্ষ্য, কিন্তু উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার নয়। কারণ এটা হলো সাবজনীন নীতি।
অন্যদিকে থ্যানোসের নীতির সঙ্গে মিল রয়েছে জেরেমি বেনথাম ও জন স্টুয়ার্ট মিলের উপযোগবাদীতার। যেমন; আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত বেশির ভাগ মানুষের ভালো। বৃহত্তর ভালো কোনো ব্যক্তির একার বিষয় নয়। ‘সিভিল ওয়ার’ সিনেমায় আমরা দেখি সুপারহিরোদের দুই দলের ভাগাভাগি অনেকটা সামষ্টিক ও স্বাতন্ত্র্যবাদী। যদিও এই প্রেক্ষিতে বিষয়টি আলাদা।
আরও পড়ুন: বার্ডম্যান- ভালো লাগা আর না লাগা
মোটাদাগে, কান্টীয় ও উপযোগবাদী ধারণার এক ধরনের যৌক্তিক চরমপন্থা আমরা দেখি। যেমন, কান্ট বলেছেন দুজনকে বাঁচাতেও একজনকে মারা যাবে না বা দুজনকে বাঁচাতে একজনের সঙ্গে মিথ্যা বলা যাবে না। আবার উপযোগবাদী ধারণাকে আমলে নিলে নানা ধরনের অসামর্থ্য নিয়ে জম্মানো শিশুদের মেরে ফেলা যুক্তিসংগত। যেভাবে সুশৃংখল মহাবিশ্বের জন্য অর্ধেক প্রাণ গায়েব করে দেওয়া যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্র, জাপান বা জার্মানির দিকে তাকিয়ে দেখুন। অনেক লোকক্ষয়-অর্থক্ষয়ের পরও পাল তুলে দিয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নৌকা। ওপরে হাডসন নদীর উদাহরণ থেকে তেমন বিষয় জেনেছি আমরা। যার সাক্ষী অ্যাভেঞ্জার্স টিমের ক্যাপ্টেন আমেরিকা ও ব্ল্যাক উইডো। কিন্তু ঘটনা তো এমনই পর্যাপ্ত সম্পদ ও প্রযুক্তির সুবাদে দুনিয়াতে মানুষ (আধুনিক মানুষের জন্মহার কম- এই কথা মাথায় রেখেও) আবারও বাড়তে থাকবে। তাহলে কয়েক শতক পরপর থ্যানোসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। তাকে হয়তো অনেকেই ঘৃণা করবে, কিন্তু আদতে থ্যানোস হলো ‘উপযোগিতার ঈশ্বর’। এই কারণে থ্যানাসের পরিকল্পনা জানার পর গামোরা বলে, “তুমি উন্মাদ।”
কিন্তু স্টিভ রজার্সের সমস্যা একই ধরনের নয়। অর্ধেক মানুষ তো দূরের কথা, একজনকেও উৎসর্গ করতে রাজি নয় সে। অথচ যদি ভিশনকে উৎসর্গ করতো, তবে থ্যানোসের অ্যাকশনের আগে অসংখ্য ওয়াকান্ডাবাসী বেঁচে যেতো। অথ্চ সে উৎসর্গ না করলেও ভিশন মারা যাচ্ছে থ্যানোসের হাতে। এমনকি কেউ নিজে থেকে উৎসর্গ হতে চাইলেও ‘না’ বলছে। অবশ্য সুপারহিরো নিজেকে উৎসর্গ করতে চায়- মানবতার তরে। সেটা অন্য নৈতিক প্রশ্ন তোলে। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
একই সমস্যা কিন্তু ডক্টর স্ট্রেঞ্জারের ক্ষেত্রেও। সে দেখতে পায় ১৪ মিলিয়ন বিকল্পের মধ্যে মাত্র একবারই সুপারহিরোদের জেতার সম্ভাবনা আছে। তা সত্ত্বে আয়রন ম্যানকে বাঁচাতে টাইম স্টোন তুলে দেয় থ্যানোসের হাতে।
কাছাকাছি অস্থিরতা আমরা মার্ভেলের প্রতিপক্ষ ডিসি এক্সটেনডেড ইউনিভার্সেও পায়। যার পরিণতি খুব ভালো হয়নি। ২০১৩ সালের ‘ম্যান অব স্টিল’ ছিল সুপারম্যানের রিবুট সিনেমা। সেখানে নিষ্ঠুর উপযোগিতাবাদের আশ্রয় নেয় সুপারম্যান। জেনারেল জডকে শায়েস্তা করতে গিয়ে অগণিত মানুষের ক্ষতির কারণ হয়। যার প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, পরবর্তী ‘ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান: দ্য ডন অব জাস্টিস’ সিনেমায়। সুপারম্যান রাতারাতি ঈশ্বর থেকে শয়তানে অধপতিত হয়।
আরও পড়ুন: পিপিলীকার পাখা গজায় ‘অ্যান্টম্যান’কে বহিবার তরে
অন্যকে উৎসর্গ করার এই রীতি আসলে হিরোর নয়, এন্টিহিরোর। তাই সুপারম্যানেরও ভরাডুবি ঘটে। আবার ব্যাটম্যানের ক্ষেত্রে দেখা যায় সুপারহিরো ও এন্টিহিরোর ধূসর রেখার মধ্যে হাঁটতে। খুব ডার্ক থিমের মধ্যে হাঁটলেও দর্শক হিসেবে আমরা আশা করি না- সে রেখা অতিক্রম করবে।
আরও উদাহরণ দিলে- মনে করে দেখতে পারেন ‘হয় এমজে নয় বাসভর্তি শিশু’দের যে কোনো একপক্ষকে বাঁচাতে হবে স্পাইডার ম্যানকে। স্পাইডি দুই পক্ষকেই বাঁচাতে সক্ষম হয়। নিজেকে সুপারহিরো প্রমাণ করে।
তাহলে বিষয়টি এমন দাঁড়াচ্ছে- যেভাবে হোক আগে-পরে মরতে হবে ভিশনকে। কিন্তু সে কীভাবে মরবে?- এটা বড় ধরনের নৈতিক প্রশ্ন। যা আসলে সমাধানযোগ্য নয়। বরং রজার্স এই ক্ষেত্রে যা করতে পারে- অন্য কোন পরিকল্পনার করা বা বিশেষ ব্যতিক্রমের উদাহরণ তৈরি করা। তা কি নিয়মকে নিয়ম আকারে থাকতে দেয়! এই ধাঁধা শুধু তার সুপারহিরোর একার নয়- মানব জাতিরও।
তবে হ্যাঁ, সিনেমা প্রায়শ এই বিতর্ক বাড়তে দেয়নি। যদি না এমন ধাঁধা নিয়ে তার কোনো আগ্রহ থাকে। সিনেমার ক্ষেত্রে আমাদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। যদি কোনো টুইস্ট থাকে। সেখানে একই সঙ্গে ব্যক্তি ও সমষ্টি- দুই কূলই রক্ষা পাবে। এভাবে ধাঁধার পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। নায়ক সর্বেসর্বা বলে প্রমাণ দেয়। ‘ইনফিনিটি ওয়ার’-এর ক্ষেত্রে তেমন টুইস্ট নেই, কারণ বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ নিয়েও আমাদের অপেক্ষা করতে হয় ‘এন্ডগেম’ পর্যন্ত। যেন আমাদের আগাম বলে দেওয়া হয় সুপারহিরো সামষ্টিক ও ব্যাস্টিক দুই কূলই রক্ষা করবে। তাই-ই হয়।
আমরা দেখি হিরো কিভাবে হিরো হয়ে উঠে। অনেক ত্যাগ ও যন্ত্রণার মাঝে পরের পর্বে ঘুরে দাঁড়াতে দেখি সুপারহিরোদের। এবং অন্তিম মুহূর্তে উৎসর্গের প্রয়োজন হয়। এক অথবা বহু- এই দ্বন্দ্বে আয়রন ম্যান নিজেকে উৎসর্গ করে। আর উৎসর্গের ধারণা এতটা নৈতিক ও (ধর্মীয়) গাম্ভীর্যপূর্ণ যে- এটি অন্য যে কোনো বিকল্পের পথ নস্যাৎ করে দেয়। আমাদের আর অপেক্ষা করতে দেয় না। ফলে, ধাঁধার উত্তর মেলে না।
লেখাটি প্রথম প্রকাশ হয় দেশ রূপান্তর ঈদ সংখ্যা ২০১৯-এ।