লতিফ সরকার ও লিপি সরকার। পালা গানের দুই সুপারস্টার। সম্পর্কে গুরু-শিষ্য। সেদিনের বাহাসের বিষয়ও ছিল গুরু-শিষ্য সম্পর্ক। লতিফ সরকার গুরু পক্ষ আর লিপি সরকার শিষ্য পক্ষ।
প্রতি বছরের মতো (সম্ভবত ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি বা মার্চের দিকে) পালাগানের আয়োজনটি করেছিলেন বাউল ক্ষ্যাপা শাহ, ‘ক্ষ্যাপা শাহ বাউল সোসাইটি’র পক্ষ থেকে। মিরপুর বারো নম্বর, সেখানে সব বাসই থেমে যায়। বারো নম্বর থেকে হাতের ডান পাশের রাস্তাটি ধরে গেলে বাংলাদেশের একমাত্র সিরামিক ইটের ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরি বয়স অনেক, সেই পাকিস্তান আমলের। সিরামিক ফ্যাক্টরির দুই নম্বর গেট বরাবর জায়গাটির নাম টেক বাড়ি। টেক বাড়িতে ক্ষ্যাপা শাহের আস্তানা।
রাত এগারোটায় ব্যাটারিচালিত রিকশায় চড়ে যখন যাচ্ছিলাম, দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল আলো-ঝিলমিল প্যান্ডেল আর গেট। গেটের উপরে ঝিলমিল করছে আল্লাহ আর রাসূলের (স.) নাম। শোনা যাচ্ছিল লতিফ সরকারের সুরেলা বন্দনাগীতি। এই ঝিলমিল আলো আরো বেড়ে যায় যখন লিপি গেয়ে উঠেন শাহ আবদুল করিমের ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করে ময়ুরপঙ্খী নাও’। হ্যাঁ এটা হলো সেই কারিগরির প্রশ্ন- যে কারিগর আজব নৌকাটা বানিয়ে তার মধ্যে নানা প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এই প্রশ্নই পালাগানের প্রাণ। সেই প্রশ্ন-উত্তরে উঠে আসে নানান কারিগরি বয়ান। সেখানে যেমন থাকে হাস্য-রসাত্মক বয়ান। আবার থাকে সিরিয়াস বিষয়াদি।
পালাগান প্রতিযোগিতা তো বটে। লতিফ একে তো বয়সে বড়, তার উপর লিপি তার শিষ্য। অন্যদিকে লিপির আছে বয়স কমের গৌরব আবার ওস্তাদের সাথে বাহাস জেতার লোভ। এই দুইয়ের মধ্যে আছে ক্ষ্যাপা বাউল। এই ভদ্রলোক প্রতি গানের পরপর পুরস্কার দিয়ে বাহাসের উৎসাহ দিচ্ছিলেন। শিষ্যা গুরুকে ঘায়েল করার জন্য বলে, লতিফ সরকার ভালোই পালা করেন। তার পুরস্কার পাওয়াটা ঠিক আছে। গুরু ছাড় দিবে কেন? তিনি পালাগানের নিয়মানুযায়ী একটা গল্প শুনিয়ে দেন। সেই গল্প আমাদের সকলের জানা। ‘যেমন- এক দাওয়াতে কোন এক ভদ্রলোক খেয়াল করলেন তার পাতে মাংস নাই। তখন তিনি পাশের জনকে দেখিয়ে বললেন, উনার পাতে মাংস নাই। উনারে মাংস দেন’। বুঝা যাচ্ছে পালাগানে প্রতিপক্ষের প্রশংসাও প্রতিযোগিতার বাইরে নয়।
এই অঞ্চলে যেকোন ধরণের শিক্ষার জন্য গুরু-শিষ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাউকে গুরু মানা, গুরুর রঙ ধারণ করারই প্রচেষ্টা। গুরু তিনি- যিনি নিজেকে জানেন। যিনি নিজেকে জানেন তিনিই পারেন নিজেকে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে। ফলে গুরু বলে কাউকে মানা হলো ঈমানী বিষয়। গুরুর উপর কোন সন্দেহ রাখা যাবে না। লিপি ও লতিফের আলোচনায় বারবার সূফি তরিকার বিষয়াদি চলে আসছিল। এই প্রসঙ্গে লতিফ সরকার বলেন নিজাম উদ্দিন আউলিয়া ও আমির খসরুর কিচ্ছা। নিজাম উদ্দিনের একনিষ্ঠ শিষ্যদের একজন আমির খসরু। একবার আউলিয়া তার শিষ্যের কাছে জানতে চান যে, তিনি যা চাইবে তা শিষ্য করতে পারবে। আমির খসরু বলে, হাঁ পারবে। নিজাম উদ্দিন বলেন, এরপর থেকে আমির খসরু যেন দরবারে না আসে। আমির খসরু গুরুর কঠিন বিরহে পড়েন। কিন্তু আদেশ অমান্য করে দরবারে আসতে পারেন না। শিষ্যের কঠিন বিরহকালে গুরু নিজাম উদ্দিন বসেছেন কাওয়ালীর আসরে।
আরও পড়ুন : শরিয়ত মারেফত পালা: আল্লাহর বান্দার রকমফের
তিনি কাওয়ালী শুনতে শুনতে এতই মগ্ন হলেন যে নিজের কাছে যা কিছু ছিল সবই দান করে দিলেন। যখন শেষ কাওয়ালীটি শুনলেন দেখলেন তার কাছে দেওয়ার মতো আর কিছু নাই। তখন তিনি শিল্পীকে বলেন, ভাই তোমাকে দেয়ার মতো কিছু তো নাই। আমার এই খড়ম জোড়া নিয়ে যাও। শিল্পী নিজাম উদ্দিনের খড়ম জোড়া নিয়ে বনের মধ্য দিয়ে বাড়ির দিকে চলে। ঐ দিকে গন্ধে মাতোয়ারা আমির খসরুর উম্মাদ দশা। কিসের গন্ধ! সে খুঁজতে খুঁজতে কাওয়ালী শিল্পীকে বের করে। সে গিয়ে বলে, ভাই বলো এই খড়ম কার? তখন শিল্পী খড়মের বৃত্তান্ত বলেন। শুনে খসরু বলেন, ভাই আমার যা আছে সবই নিয়ে যাও, এই খড়ম আমার চাই।
মনে পড়ে উকিল মুন্সীর কথা। যাকে দখিনা বাতাস পাগল করে তোলে। পীর যে তার বাড়ির দখিনে থাকে। এই হাওয়া অঙ্গে লাগলে অঙ্গ জ্বলে। তারে না দেখে আর থাকা যায় না। নিজাম উদ্দিনের খড়ম জোড়া খরিদ করেও আমির খসরুর আশ মিটে না। তিনি আরো পিপাসার্ত হয়ে উঠেন। পাগল পারা। গুরুর সান্নিধ্য চাই। এদিকে তুমুল ঝড় উঠে। নিজাম উদ্দিন দরবারের খাদেমদারদের বলেন তোমরা দরোজা জানালা লাগিয়ে দাও। যাতে কেউ দরবারে ঢুকতে না পারে। যথা আজ্ঞা তথা কর্ম। এই তুফানি রাতে আমির খসরু এসে দরোজা ধাক্কায়, কেউ খুলে না। কিন্তু আমির খসরুর তো পীরদর্শন ছাড়া চলে না। এবার তিনি দরবার থেকে পানি বের হবার নালা দিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে, খাদেমরা নিজাম উদ্দিনকে এসে বলে, হুজুর নালায় কিছু একটা আটকে গেছে। পানি বের হচ্ছে না। তিনি বলেন, হাতের কাছে যা আছে তা দিয়ে চেষ্টা করো। কোন ময়লা আটকে গেছে বোধহয়। খাদেমরা লাটি, বল্লম নানা কিছু দিয়ে চেষ্টা করে। আমির খসরু কোন শব্দই করেন না। যখন সেই ময়লাটা দূর হয় না তারা ভালো করে দেখে। দেখে বুকে খড়ম আকড়ে ধরা আমির খসরু। দেহে প্রাণ নাই।
নিজাম উদ্দিনকে দ্রুত খবর দেয়া হয়। তিনি বলেন, তাকে গোসল করাইয়া কবর দাও। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। এই বলে নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে দেন। আমির খসরুকে গোসল করিয়ে কাফন পরানো হয়। কবরে শোয়ানোর আগে মুখ খুলে সবাই চমকে উঠে। এ-তো আমির খসরু না। নিজাম উদ্দিনের লাশ। সবাই এবার নিজাম উদ্দিনের ঘরে আসেন। যে লোকটি শুয়ে আছে তার মুখের পর্দা সরিয়ে দেখে আমির খসরু শুয়ে আছে। এই হলো নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার রঙে রাঙানো আমির খসরু। এইভাবে যুগ পরম্পরা গুরু-শিষ্য একই সাধনায় শরীক হন। লতিফ সরকার গল্পটি বলেন লিপি সরকারের প্রশ্নের উত্তরে। প্রশ্ন ছিল, এমন কে আছে যে গুরুর আদেশ অমান্য করেও গুরুর আশীর্বাদ পেয়েছে। এই তর্ক চলে আসছে, সাধারণ দৃষ্টিতে আমরা যেভাবে কোন বিষয়কে বর্ণনা করি- তার বাইরে কোন পরিস্থিতি আছে কিনা। গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের অনন্যতা অন্য কিছু দিয়ে ধরা যায় না। সে আলোচনার অধরা ইশারাটুকুই যেন হৃদয়ে নানা রূপ ধরে প্রস্ফুটিত হয়।
লিপি আর লতিফের বিতর্কে চলে আসে ভক্তি আর সেজদা এক বিষয় কিনা। গুরুকে কোনভাবেই আল্লাহর সাথে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। লতিফ গেয়ে শুনান লালনের গান- ‘যে মুর্শিদ সে রাসূল, খোদাও সে হয়’। লতিফ সরকার মনে করিয়ে দেন আগের দিন কানু শাহের মুখে শোনা আরেকটা গল্প। সিরাজ সাঁই একবার তার স্ত্রীকে ডেকে বলেন, যদি লালন আসে তার পা ধুইয়ে তিনি যেন পায়ে ভক্তি দেন। সিরাজের স্ত্রী অবাক হয়ে বলেন তিনি লালনের গুরু মা। তিনি কেন ভক্তি দেবেন। সিরাজ সাঁই বলেন তিনি যা বলছেন তা যেন করা হয়। এরপর তিনি কি দেখবেন তা যেন লালনকে জানানো না হয়। সিরাজের স্ত্রী লালনের পা ধুইয়ে যখন লালনের দিকে তাকান, দেখতে পান লালন নয় সিরাজই দাঁড়িয়ে আছেন।
আরও পড়ুন : হাশর-কেয়ামতের পালা: দুনিয়াবি সম্পর্কে আখিরাতকে জীবন্ত করার জিহাদ
পালাগানের জন্য বিশাল প্যান্ডেল করা হলেও মানুষজনে স্থানটি পূর্ণ হয় নাই। লতিফ সরকার বলেন, পালাগানে লোক বেশি না হলে তিনি গান গাইতে স্বাচ্ছদ্যবোধ করেন না। কিন্তু কি আর করা- মানুষ যেভাবে রক্ত ঝরাচ্ছে তাতে মনে হয় না সহজে সহিংসতা কমবে। তাই পালায় শ্রোতাও কম। এই নিয়ে তার মনে দুঃখ। এই যে ভক্তি তা তো কোন নির্দিষ্ট মানুষের বিষয় না। সমাজের মধ্যে যখন মানুষ অপর মানুষকে সম্মান করবে, ভক্তির চোখে দেখবে তখনই এর সুরাহা হবে। তিনি ভেবে পান না, মানুষ কি করে অপর মানুষকে মারে। মানুষকে ভক্তি করতে হবে এমনভাবে, যাতে কোন খারাপ কাজ করার সময় মা-বাবা সামনে এসে দাঁড়ায়। তাহলে মানুষ বেঁচে যায়।
সবকিছু কি তরিকার ভেতর দিয়ে হতে হয়! যার মর্ম তো তার কাছে। এই মর্মের বাইরে গিয়ে অপরকে বুঝা, ভালোবাসা সেটা জীবনের আরেক ধরনের মূল্য। তাই লতিফ আর লিপি বারবার ক্ষ্যাপা শাহকে নিজেদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। ক্ষ্যাপা শাহ তাদের বায়না দিয়ে এনেছেন মাত্র। গুরু নন। তিনি একজনকে সামনে রেখে ভক্তির অবগাহন। তিনি হলেন ক্ষ্যাপা শাহ। এটা উসিলা মাত্র, লক্ষ্য নয়। মানুষ যখন এভাবে একে অপরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, নিজের আয়না বানিয়ে নেয়- নিজের ভালোটুকু ছাড়া আর কোন কিছুই আসতে পারে না।
রাত বাড়তে থাকে। গুরু-শিষ্য হাস্যরসের মাধ্যমে কথা বলেন। এই কথা কোন জ্ঞানী-গুণীজন শুনছে না। শুনছে বস্তির সাধারণ মানুষ। হাসির কথায় হাসে। গূঢ় কথায় চুপ হয়ে শোনে। কি শুনে কি বুঝে সে প্রশ্ন করার স্পর্ধা আমার নাই। এইটুকু বলা যায়, ভক্তির যে মর্ম বাংলার কথা ও সুরে আছে- তাকে হৃদয়ে ধরলে অনেক ক্ষোভ, দুঃখ আমরা পর্যালোচনায় নিয়ে যেতে পারি। মিলতে পারে অমূল্য ধন।
পালাগানে কে জিতল? গুরু শিষ্যকে দোয়া করে দিচ্ছেন। তারিফ করছেন। তাহলে আপনারাই বোঝার চেষ্টা করুন কে জিতল। যেখানে শুধু ভক্তির জোয়ার, একমাত্র যেখানেই সবাই জেতে।
………………………………
*লতিফ সরকার ও ক্ষ্যাপা বাউলের ছবি তুলে দিয়েছিলেন এক ভদ্রলোক। এতদিন পর তার নাম মনে করতে পারলাম না।
*লেখা প্রথম প্রকাশ হয় আরটিএনএন ডটনেটে। শিরোনাম পরিবর্তিত।