নির্মাণাধীন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংসের জন্য রাঙামাটিতে ডিনামাইট পাঠাচ্ছে ইন্ডিয়া। পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের (পিসিআই) মাসুদ রানা যাচ্ছেন তা ঠেকাতে। এভাবে আবির্ভাব বাংলাদেশি সাহিত্যের একমাত্র বৈশ্বিক গোয়েন্দার।
কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই প্রকাশ হয় ১৯৬৬ সালে। ৪৪৭তম বই প্রকাশের মাধ্যমে ১৭ মে ৫০ বছর পূর্ণ করছে ঐতিহ্যবাহী সেবা প্রকাশনীর সিরিজটি। এ লেখার বিষয় স্থানীয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতির পালাবদলে সিরিজটির চরিত্রগত রূপান্তরের কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হবে। গভীর কোনো বিশ্লেষণের আশ্রয়ও নিলাম না। সূচনা লেখা হিসেবে থাকুক আপাতত।
এক.
স্বাধীনতার পর সংস্থাটির নাম হয় বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স (বিসিআই)। নাম থেকে বোঝা যায় রাষ্ট্রীয় প্রভাব বলয়ের বাইরে নয়। জাতীয় স্বার্থ রক্ষাই এর কাজ। উইকিপিডিয়া জানায়, কয়েকবার সিরিজটি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। যেমন; স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিতি পায় ইন্ডিয়া। তখন বাধ্য হয়ে কয়েকটি বই থেকে কিছু অংশ বর্জন করতে হয়, ২টি বই নতুন করে লিখতে হয়।
একটা মজার তথ্য দেওয়া যাক। সিরিজের ৫ম ও ২৭তম বইয়ের কাহিনী একই, শুধু প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ‘মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা’তে ইন্ডিয়ায় বন্দি একজন বিজ্ঞানীকে রানা তুলে নিয়ে আসে পাকিস্তানে। তাকে সাহায্য করে কাশ্মিরের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। ‘বিপদজনক’-এ একই কায়দায় বস মেজর রাহাত খানকে পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে রানা।
পাকিস্তান-ইন্ডিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিবর্তন সিরিজের চরিত্র থেকে স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের পরও ইন্ডিয়ার সঙ্গে বিসিআই’র টক্কর লেগেছে। সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বর্ণনা পাওয়া যায় ৪৮তম বই ‘এসপিওনাজ’-এ। তাতে এ দেশীয় ভারতীয় এজেন্ট হিসেবে মোহাম্মদ ফারুক আলমগীরের বর্ণনা দেওয়া হয়। দৈনিক পত্রিকার এ রিপোর্টারের কাছে কালচারের প্র্র্রধান মানদণ্ড রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে বুঁদ হওয়া, গায়ে হালকা সেন্টের মতো মস্কোপন্থীর গন্ধ। তাহলেই প্রগতিশীল। কপালে সিদুঁরে টিপ আর মেঝেতে চন্দনের আলপনা দেখলেই চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে আসা। এসবই হচ্ছে সত্যিকারের সংস্কৃতি ও বাঙালিত্বের উৎস। পয়লা বৈশাখে সাতসকালে ‘এসো হে-এ-এ বৈশাখ’ বলে হাঁক ছাড়া খুবই দরকার। অন্যদিকে ঈদ, শবে-বরাত বা মিলাদ শরীফ রুচিহীন, কমিউনাল ব্যাপার। আর একাত্তরের ‘গোলমালে’ স্রেফ প্রাণ বাঁচাতে ভেগেছিলেন কলকাতায়। কাহিনীও ভারতীয় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে।
অথচ ৩৩তম বই ‘বিদেশি গুপ্তচর’-এ ইতালিতে ফেঁসে যাওয়া ভারতীয় গুপ্তচরকে সাহায্য করতে যায় রানা। তার আগে কলকাতায় বসেই কথা বলছে দেশটির গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে। দুই দেশের গোয়েন্দাদের মধ্যে সখ্যতারও শেষ নেই।
অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক কখনো তেমন সুবিধের হয়নি। কোনো এক বইয়ে একটা কেসে পাকিস্তানে যায় রানা। মুখোমুখি হতে হয় মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি নিধনে তৈরি করা বিশেষ কিছু যোদ্ধার। মজার বিষয় হলো, যুদ্ধের আগে রানার প্রথম শত্রু কবির চৌধুরী ছিলেন ভারতের বন্ধু, যুদ্ধের পর হাত মেলান পাকিস্তানের সঙ্গে। তেমনটা পাওয়া যায় ৩১৬ নম্বর বই ‘গোপন শত্রু’তে। বইটির বিষয় ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের গোপন জরিপ। যা বলছে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ খনিজ তেল আছে। ফোরবল নামে একটা ক্রাইম সিন্ডিকেট সেই তেল চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের মাফিয়ারা।
একই ধরনের বিষয় পাওয়া যায় ৩৭২ নম্বর বই ‘অরক্ষিত জলসীমা’য়। যার বিষয়বস্তুও জলসীমা নিয়ে পাকিস্তান আমলের জরিপ। পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মায়ানমার প্রধান ও মায়ানমারের এক সামরিক জেনারেল মিলে সমুদ্র্র সম্পদ মেরে দেওয়ার তালে থাকে। বইটি প্রকাশ হয় তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই বইয়ে রানার একটা সংলাপ, ‘ওহ গড, আমরা দেখি বড়লোক হয়ে যাচ্ছি! অবশ্যই আগে এসে যেতো সচ্ছলতা, যদি একের পর এক অসৎ, অদক্ষ, অক্ষম সরকার এসে চুরি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের স্বর্গ না বানাত দেশটাকে!’ ওই ডকুমেন্টের বরাত দিয়ে জানানো হয়, সমুদ্রে থাকা সম্পদ দেশের বাড়তি চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও করা যাবে। ভুলেও উল্লেখ নেই আমাদের অন্য প্রতিবেশীর কথা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এ বইয়ে পাকিস্তানি এজেন্টের ভাষায়, ‘বাঙালি মাত্রই হিন্দু।’
এছাড়া রাজনৈতিকদের নিয়ে সমালোচনা মাসুদ রানা সিরিজে কমই দেখা গেছে। ৫৩তম বই ‘হংকং সম্রাট’-এ আন্তর্জাতিক মাফিয়ার সঙ্গে হাত মেলায় পলাতক রাজনীতিবিদ। এমন উদাহরণ অল্প-বিস্তর পাওয়া যাবে। ‘হংকং সম্রাট’-এ প্রথমে মাসুদ রানা স্বর্ণ দোকানে লুঠ করে জেলে যায়। কারণ, দেশি-বিদেশি চক্রের মধ্যে জেল থেকে আসামিরা পালিয়ে যাচ্ছে। কোথায় যায়? ভারত হয়ে অন্য কোনো দেশে।
দেশের ভেতরের শত্রুদের কী খবর? সিরিজের গুটিকয়েক মৌলিক বইয়ের মধ্যে একটি ‘এখনও ষড়যন্ত্র’। বই নম্বর ২৫। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও লুকিয়ে থাকা রাজাকাররা দেশের ক্ষতি করতে চায়। রানাকে মারতে বোমায় উড়িয়ে দেয় গাড়ি। এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায় ২০০২ সালের ৩২২ নম্বার বই ‘আবার ষড়যন্ত্র’। ডাকাতির মাধ্যমে বড়লোক হওয়া রাজাকার মাওলানা কেরামতুল্লাহ ‘খাদেম বাহিনী’ নামে দলের নেতা— যারা পাকিস্তান বানাতে চায় বাংলাদেশকে। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস অস্ত্র দিয়ে তাদের সাহায্য করে কবির চৌধুরীর ছেলে খায়রুল কবির। ওই সময়ের দেশের পরিস্থিতি ভাবার চেষ্টা করুন।
দুই.
যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধ সারাবিশ্বের গোয়েন্দা কাহিনীতে নতুন নতুন রসদ জুগিয়েছে। সিআইএ ও কেজিবি শিবিরের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে দেখা যায় মাসুদ রানাকে। তারপরও কখনো সিআইএ বা কখনো কেজিবি-র হাত থেকে পালাতে হয়েছে। আবার কখনো মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এসেছে। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ‘শান্তিদূত ১’। স্নায়ুযুদ্ধকালে ১৩৬ জন ডিপ কাভার এজেন্ট ছড়িয়ে দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রে। যাদের সম্মোহিত করে রাখা হয়। একটা ফোন কলেই তারা মেতে উঠবে ধ্বংসলীলায়। যখন সারাবিশ্ব আশা করছে শান্তি, তখনই ফোনকল আসা শুরু হয়। তা ঠেকিয়ে রাশিয়ার মান বাঁচায় রানা। অন্যদিকে সিআইএ’র উপর ঠেক্কা দিতে দেখা যায় ৯২ নম্বর বই ‘জিম্মি’তে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে সন্ত্রাসবাদীরা আটকে রাখে, ত্রাতা হিসেবে হাজির হয় রানা। ৮৯ নম্বর বই ‘প্রেতাত্মা’য় দেখা যায়, নিজেদের বানানো জীবাণু অস্ত্রের ফাঁদে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। উদ্ধার করে রানা।
আরেকটা চিত্ত আকর্ষক বই ‘চারিদিকে শত্রু’। রাশিয়ার মিগ-২৯ চুরি করে ঢাকায় নিয়ে আসে রানা। এ নিয়ে সিআইএ, কেজিবি, মোসাদ তিনপক্ষই তার জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। শেষে দেখা যায়, বিমানটি চুরির পরিকল্পনা ছিল ইসরাইলের। তা ঠেকাতেই ঢাকায় নিয়ে আসে রানা। হ্যাঁ, এই একটা বিষয়েই মাসুদ রানা অনমনীয়। ইসরাইল প্রশ্নে আপোষ নয়।
স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রানাকে বিভিন্ন অভিযানে দুষ্ট লোকের হাতে পড়া ভয়ংকর অস্ত্র দখলে নিতে দেখা যায়। একাধিকবার ইসরাইলেও যেতে হয়। একটি বইয়ের চীন নিজেদের একটা অংশ দিয়ে দেয় মঙ্গোলিয়াকে। এছাড়া বসনিয়া, আফ্রিকার সংঘাতসংকুল এলাকায় রানা যায় ত্রাতা হিসেবে।
এত দেশ, এত ঘটনা নিঃসন্দেহে মাসুদ রানা সিরিজকে সমৃদ্ধ করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের কাল্পনিক ভাবমূর্তিও তৈরি করেছে। রানার কাজ সাহস-বুদ্ধিমত্তার চালে অন্যকে পরাজিত করা। অন্যকে মানে অন্যদেশের কৌশলকে। সে সুযোগও নেয় এ গোয়েন্দা। দেশের স্বার্থে দর কষাকষিও করতে দেখা যায় তাকে।
বাংলাদেশের সাহিত্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তো দূরবর্তী ব্যাপার, সমসাময়িক ঘটনাও সে অর্থে স্থান পায় না। একইসঙ্গে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়াকে গুরুতর অর্থে ভাবা হয়নি কখনো। রাষ্ট্রগঠনের অন্তর্গত বিষয় বাদ উপরের খোলস নিয়ে ব্যস্ত আমরা। শিল্প-সাহিত্যও এ জালের বাইরে নয়। মাসুদ রানা সিরিজের স্থানিক চরিত্র বা আন্তর্জাতিকতা তার অন্তর্গত প্রবণতা— সে প্রবণতা পপ সাহিত্য আকারে যদি কোন অর্থে রাষ্ট্রের শত্রু-মিত্রকে বুঝতে সাহায্য করে, কম কিসে!
লেখাটি সাম্প্রতিক দেশকালে প্রথম প্রকাশ হয়।