এক.
অনেকদিন আম্মারে দেখি না। তার কথা ভাবার আগেই ঘুমায়া পড়ি। আর যখন ঘুমায়া না পড়ি মনে পড়ে নাজির হাটের কথা। অনেককাল আগের কথা। তাই হয়ত বর্তমানে আসতে আসতে চোখ খোলা রাখতে পারি না।
নাজির হাট কোথায়? এ এক রহস্যময় জায়গা। ওই যে পাহাড়সারি তার ওই পাশে। পাহাড়ে কতো গেছি। কোনো একটা পাহাড়ে উঠেছি হয়ত। আকাশ পরিস্কার থাকলে পশ্চিমে ছায়া ছায়া কিছু দেখা যায়। আমাদের মতে ওটা ছিল সন্দ্বীপ, মানে এখনো আছে। হয়ত দেখা যায় না— এরপর দৃষ্টিতে কারো আলো আঘাত করে না আর কি! অসীম তো না! আর পূব দিকে তাকালে আরও আরও পাহাড়! আরও আরও ছায়া। আমার মনে হয় ওই পাহাড়ের ওপারে দুনিয়া শেষ। তো ওইখানে গেলে কী দেখব। ভাবতে পারতাম না, মানে মাথায় ধরত না! তারপরও আমার লোভ হতো। একদিন। হ্যাঁ, একদিন হাঁটতে হাঁটতে সবগুলো পাহাড়, যারা সবুজ মখমলের ঢিপি যেন, হেঁটে হেঁটে পার হয়ে দুনিয়ার শেষ প্রান্তে পৌঁছায়া যাবো। তখন অবশ্য আম্মার কথা মনে পড়বে না। অনন্ত সময় ধরে হাঁটলে কি এতো কিছু মাথায় থাকে। নাকি আম্মা নিজেও অনন্তের অন্তর্গত?
ওইখানে যাইতে না পারার আনন্দ নস্যাৎ করে দেয় নাজির হাট। নাজির হাট! পাহাড়ের ওপারে তবে ঘুরে যাইতে হয়। ট্রেনে। যেখানে কখনো যাবো ভাবি নাই। কারণ যাদের আত্মীয় স্বজন আছে— তারা যায়, আমাদের কেউ নাই।
নাজির হাটের গল্প শুনি। ট্রেনের গল্প ছাড়াও আরও যেটা ভাল লাগে! সবাই খালে গোসল করে। খালে গোসল করার ব্যাপারটা নিশ্চয় মজার। আমার খানিকটা কষ্ট হতো।
তো, একবার আম্মা গেলেন নাজির হাট। বেবি আপার বিয়েতে। এমনিতে বেবি আপা আমাদের আপন কেউ না। কিন্তু মাহবুবা খালাকে যেহেতু খালাম্মা বলি, তার বোনের মেয়ে তো আমাদের আপাই হবেন। খালাম্মা যেহেতু আম্মাকে ভাবি বলেন, আম্মাও নিশ্চয় তার বোনের ভাবি।
অন্যের বাড়ি যেতে আমার কেমন যেন লাগে! লজ্জাগোছের কিছু। আমাকে রেখে যাবেন বাবার কাছে। অথবা এতো পোলাপান নিয়া যাইতে চান না। সোহেল আর রুমি যাবে। তখন আমার খারাপ লাগল। আম্মার জন্য কী!
মহিলারা সারারাত জেগে জেগে সৈ পাক্কন পিঠা বানালো। বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার সময় এ পিঠা নিয়া যাওয়ার রীতি। পিঠাটা অদ্ভুত! আমার কাছে পিঠা মনে হইতো না। এতো অনাড়ম্বর জিনিস পিঠা হয় নাকি! চালের গুড়ার সঙ্গে চিনি মিশিয়ে কাই করা হতো। নারিকেল দিতো কিনা মনে নাই। নানা ডিজাইন করে কাটা হতো, এরপর তেলে ভাজা হইতো। দুটা লেয়ার হতো ভেতরে। উপরেরটা একদম পাতলা, ঠাণ্ডা হইলে ছিঁড়ে যায় টাইপ। খাইতে অবশ্য স্বাদই ছিল। বিয়েতে মনে হয় চমচম নামের আরেকটা একটা জিনিস নেওয়া হতো। আটা গুলিয়ে চিনি-টিনি মিশাইয়া তারপর বানানো হতো। রোদে শুকানো হতো। এরপর তেলে ভাজা হতো মচমচে করে।
আম্মারা পিঠা বানালেন। তারপর ভোরে ভোরে চলেও গেলেন। কারণ শহরে গিয়া দোহাজারীর ট্রেন ধরতে হবে। অন্য ছেলেরা যারা মহিলাদের সঙ্গে গেলেন হিংসা হলো। তারা ট্রেনে চড়ছে, আমি পারতেছি না। আর খারাপের মধ্যে আম্মা ছাড়া থাকাটা একটু মজা লাগতেছিল।
দুই.
উপরের অংশটুকু লেখার পর ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে দুটা ভুল ধরা পড়ছে। সৈ পাক্কন পিঠায় নারকেল দেওয়া লাগে না। আপার কাছ থেকে জানলাম। আরেকটা বিষয় হলো আম্মা যে বার নাজির হাট গেছেন… তখন ট্রেনে যাওয়া লাগে নাই। উনারা সম্ভবত ট্যাক্সিতে গেছেন। কারণ ততদিনে ভাটিয়ারি হয়ে পাহাড়ী রাস্তা নির্মাণ করেছে আর্মি। যার কারণে প্রায় ২০-৩০ কিলোমিটারের পথ কমে যায়।
যাই হোক, একদিন ভোরে ভোরে আম্মা চলে গেছিলেন। শীতকাল ছিল। আমি মনে হয় লেপের নিচ থেকে তখনো বাইর হই নাই। সেদিন নিশ্চয় নৌকা নৌকা খেলা হয় নাই। শীতকালে আমরা তিন ভাই-বোন লেপকে নৌকা মনে করতাম। মনে করতাম সমুদ্রে ভাসতেছি। জোরে ঢেউ আসল। একজন পড়ে গেল। তারে নানা কসরত করে তোলা হতো। হঠাৎ তিমি বা ডলফিন দেখে চিৎকার করতাম। নিশান (ভাগ্নে) বলছে, এই খেলা নাকি তাদের সঙ্গেই খেলতাম। কী বিভ্রম!
তারপর দিনটার কথা তেমন মনে নাই। স্কুলে যাওয়ার ব্যাপার ছিল না। কারণ পরীক্ষা শেষ। রাতে যখন ঘুমাইতে গেছি আম্মার কথা মনে পড়তেছিল। খারাপ লাগতেছিল। আম্মা পাশে না থাকা খুব একটা মজার ঘটনা ছিল না নিশ্চয়।
পরদিন আমরা অনেকে মিলে বেবি আপুদের বাড়িতে গেলাম। সেদিন ছিল গায়ে হলুদ। টেম্পুতে করে গেছিলাম। পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা পথ ধরে ভাটিয়ারি থেকে বড় দীঘির পাড় পার হয়। কিন্তু বুঝতে পারি নাই এই পাহাড়টুকুই পার হওয়া ছিল আমার স্বপ্ন। যেখানে পৃথিবী শেষ। কী অদ্ভুত ভুলে গেছিলাম স্বপ্নের কথা। ভুলে যাওয়া স্বপ্ন এখন ধাক্কা দিচ্ছে। মনে থাকলে তখনই নতুন কোনো স্বপ্ন বানাইতাম।
একসময় নাজির হাটে পৌঁছি। তার আগে একটা রাস্তা দেখায়া কে যেন জানালো (মাইজভাণ্ডার) দরবার শরীফ ওইদিকে। তখনও দরবার শরীফ মানে অদ্ভুত কিছু ক্ষমতাওলা মানুষের গল্প, ওরশের বিরিয়ানি ও পাশের বাড়ির চুবুনির (সম্ভবত ভালো নাম সুফিয়া) বাবা। মাইজভাণ্ডারের ওরশের কতো দূর-দূরান্ত থেকে গাড়ি মাইক বাজিয়ে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যেতো। মাওলানা সাঈদীর তাফসির মাহফিলের সময়ও একই কাণ্ড হতো। তবে দুই সময় গান ভিন্ন হতো। মাইজভাণ্ডারের গাড়িই ছিল বেশি। কারণ অনেক দূরের জেলা থেকে ভক্তরা যেতেন। পরে সিক্স বা সেভেনে থাকতে বাবার সঙ্গে মাইজভাণ্ডার গিয়েছিলাম। শীতের সময়। নানার বানায়া দেয়া সুয়েটার পরে। অবশ্য আর তেমন কিছু মনে নাই— কী দেখেছিলাম। শুধু দুটা ব্যাপার মনে আছে। অনেক গরু দেখেছিলাম। মহিষও থাকতে পারে। একটা পুকুরে ওজু করেছিলাম কী! সম্ভবত ওই পুকুর পাড়ে ওজু করা অবস্থায় মাইজভাণ্ডারের একজন পীর দূরে কোথাও বদনা ছুঁড়ে মেরে একজনকে বাঘের কবল থেকে উদ্ধার করেন। এ গল্প অনেক শুনতাম তখন। সর্বশেষ বার শুনেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু মাসুদ সিকদারের মায়ের কাছে, রাঙ্গুনিয়ায়। ভদ্রমহিলা এখন বেঁচে নেই। কি যে মায়া জাগানিয়া কণ্ঠ ছিল উনার। ওই ভ্রমণে জিয়ারত বিনে কিছু করি নাই। কারণ, আমাদের পরিবার মাজারে ভক্তি শ্রদ্ধার ব্যাপারে খানিকটা কড়া। পীর দরবেশদের সম্মান করো, কবর জেয়ারত কর। কিন্তু ছোঁয়াছুঁয়ি, সুতা বাধা বা মাথা নোওয়া যাবে না। এরপর কখনো যাওয়া হয় নাই, আগ্রহও জাগে নাই। আমার অনেক বন্ধু এখন ফি বছর যান। হয়তো তাদের সঙ্গে যাওয়া হবে কোনো একদিন।
নাজির হাট সম্ভবত একটা বাজার মতো জায়গা। অনেক পাকা দোকান-পাট ছিল। বেবি আপাদের বা তার চাচাদের দোকান ছিল। সেখানে গিয়ে বসেছিলাম মনে হয়। বাজার থেকে একটা উচুঁ রাস্তা ধরে, যার একপাশে খাল— গেলে তাদের বাড়ি। লোকজন গমগম করছিল। বাড়ির প্রথম সন্তানের বিয়ে বলে কথা!
কিন্তু আম্মা কোথায়? খুঁজে খুঁজে আম্মাকে পাইছিলাম। কেমন লাগছিল কে জানে? একটা ব্যাপার হতে পারে! কোথাও বেড়াতে গেলে আম্মারে কেমন যেন অচেনা লাগত। তার শরীর থেকে আলাদা আভা বেরুতো। অথচ উনার প্রসাধনী বলতে তিব্বত স্নো, পাউডার, কাজল, সুরমা আর আর্নিকা হেয়ার ওয়েল। কলেজে থাকতে বাবার মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে গেছিলাম। তো, বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আম্মাকে কী যে সুন্দর দেখাচ্ছিল! আমি তা-ই বললাম, আম্মা দারুণ লজ্জা পেলেন। আরেকবার ফুফাতো বোনের স্বামী মারা যাওয়ায় গেছিলাম— সেটা ছিল আম্মার নানার দেশ। কেউ কেউ বলতেছিল, এটা রূপসীর ছেলে। শুনে অদ্ভুত লাগলেও পরে জেনেছিলাম, সুন্দরী বলে আম্মাকে এ নামে ডাকা হতো। আহা! আমি রূপবান না হতে পারি, রূপসীর ছেলে তো।
ওইদিন সারাদিন বেশ মজা হলো। গায়ে হলুদে ঝাঁকালো একটা ব্যাপার ছিল। আমরা অনেক রাত পর্যন্ত চোর-ডাকাত টাইপ খেলা খেলি। ভাব হয়ে গেছিল কয়েক ক্লাস বড় একজনের সঙ্গে। পরেরদিনও তিনি অনেকক্ষণ সঙ্গ দিয়েছিলেন। পরে মনে হয় বিদেশ চলে যান। বাহরাইন হবে। তার সুন্দর চেহারা মনে পড়ছে। নাম। হুঁহু…। সকালে আমরা খালে গেছিলাম গোসল করতে। খুব মজা হলো। নামে খাল হলেও শীতে অনেকটা পানি ছিল, আমার কাছে মনে হচ্ছিল নদী। গুগল ম্যাপ ঘেঁটে অবশ্য হালদা নদী দেখতে পাচ্ছি! একটু ভয়ে ভয়ে নামি। ধাতস্থ হওয়ার পর হৈ হুল্লোড়। তারপর পানি দিয়ে পাড় পিছল করে গড়াগড়ি। এরপর ফিরে খাওয়া-দাওয়া। আর স্মৃতি মনে নাই। আমি আর জসিম ভাইয়া ওইখানকার একটা সিনেমা হলে গেছিলাম মনে আছে। চলতেছিল সাদা-কালো সিনেমা, শাবানা-আলমগীরের বিখ্যাত সিনেমা ‘সাম্পানওয়ালা’। নামটা সাম্পানের মতো করে ডিজাইন করা। সম্ভবত সনি টেপরেকর্ডারে সিনেমাটির ক্যাসেট শুনেছিলাম। শেফালী ঘোষ করেছিলেন টাইটেল গানটি। ওই গানের একটা লাইন মজা লাগত ‘সাম্পানওয়ালার বাবরি চুল কেড়ে নিল জাতিকূল’ টাইপ কিছু। শেষে মাহবুবা খালাম্মার সঙ্গে আম্মা পাঠায়া দিলেন। ট্যাক্সি করে সোজা বাড়ি না গিয়ে আমরা বিজয় মেলায় গেছিলাম, আউটার স্টেডিয়ামে। এরপর বাড়ি ফিরে মনে হয় অনেকদিন আম্মারে দেখি নাই… তিনি তখনো ফিরেন নাই… আরও একদিন পর ফিরেছেন…
আম্মা। উনার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। তার কথা ভাবতে ভাবতে বেশিদূর আগাতে পারি না। ঘুমায়া পড়ি। আর যদি ঘুমায়া না পড়ি… নাজির হাটের গল্প মনে আসে। পাহাড় ডিঙানোর গল্প। যার ওপারে গিয়া আম্মার সাথে দেখা হয়। আর আমার এ ভ্রমণ কাহিনী যদি আম্মা কখনো পড়েন। নিশ্চয় হাসবেন। কেমন করে… চোখ খোলা রেখেই বুঝতে পারছি!!
………………………………………….
ব্যবহৃত চিত্র : হুমায়ূন আহমেদ
কেমন স্বপ্নের মত লাগে আপনার ভ্রমণ কাহিনী পড়তে। এইবারও লাগল। ভ্রমণ কাহিনী আম্মা পড়ার পর তার কি অবস্থা হইল সেইটাও চোখে ভাসতেছে। যদিও আপনা আম্মারে আমি কখনো দেখি নাই। হয়তো কখনো দেখবো। তখন মিলায়া নিবো আরকি।
ভাল্লাগছে স্যার।
শুকরিয়া। ভালো থাকেন।