‘টাকাই তোমাদের কাছে সব হয়ে গেল। সম্মানটা দেখলে না!’ কথাটা শুনে থমকে গেলাম। যাকে বলা হচ্ছে তার মধ্যে কোনো বিকার দেখা গেল না। যিনি বলছেন, তিনি মিনিট কয়েক আগে আমাদের গন্তব্য শুনে খুশি হয়ে হাত মেলালেন। তার বয়স ৬০ হতে পারে। জায়গাটার নাম ভবানীপুর। আমরাও পৌঁছে গেছি গন্তব্যের কাছাকাছি। কোথায় যাচ্ছি তা শুনাতে আরেকটু পিছিয়ে আসি।
কার্তিকের অনুষ্ঠান শেষে (১৯ অক্টোবর, ২০১৫) আমাদের যাত্রা শুরু ফকির লালন শাহর আখড়া কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া থেকে। অনেকদিনের ইচ্ছা পাঞ্জু শাহর মাজার দেখতে যাবো। তিনি লালনের সময়ের পাঁচটি ঘরের একঘর। বছর তিনেক আগে পাগলা কানাইয়ের মাজার দেখতে ঝিনাইদহ যাই, সে বার পাঞ্জু শাহর মাজারের ঠিকানা পরিষ্কার ছিল না। এবার খানিকটা পষ্টই ছিল। এক সাংবাদিক বন্ধু পথ বাতলে দিয়েছিলেন কুষ্টিয়ার শেখ পাড়া হয়ে যাওয়ার। গুগল ম্যাপও তেমন দেখালো। কিন্তু চৌড়হাস মোড় আসার পর বাসের লোকজন অন্যরুট ধরতে বলল। প্রথমে জামজামি। তারপর ভবানীপুর হয়ে হরিশপুর। আর জায়গা পড়েছে হরিণাকুণ্ড উপজেলায়। ওখানেই পাঞ্জু শাহর মাজার। রওয়ানা দিলাম আমরা চার ভদ্রলোক।
বাস তো চলছেই চলছে। আমার সন্দেহ জাগল জামজামি অনেক আগেই পার হয়ে এসেছি। কারণ একই রকম একটা নাম কোথাও দেখেছি। একই কথা দাউদ বলার পর হু-হা করে চোখ বুজলাম। ভাবখানা যা ইচ্ছা হোক। কিন্তু মানুষের দুনিয়ায় যা ইচ্ছা হোক— তেমনটা কমই হয়। আর ইচ্ছাটাই বা কার!
জামজামি বাজারে নেমে তো অবাক! এটা ঝিনাইদহ না। চুয়াডাঙ্গা। মাইল দশেক পর আলমডাঙ্গা। যার নাম অনেক পড়েছি। পত্রিকার পাতায়। খোঁজ নিয়া জানা গেল, ওই যে কুমার নদীর (কোথাও লেখা খাল। আমার নদীই ভালো লাগে। তাই নদী বলব) উপর ছোট ব্রিজ— তার ওই পাশে কুষ্টিয়া, এ পাশে চুয়াডাঙ্গা। কুষ্টিয়া মানে ব্রিজের ও পারে গিয়া আলমসাধু করে ভবানীপুর যেতে হবে।
সবারই ক্ষিদে লেগেছে ভীষণ। দুপুর ২টা তো হবেই। ভাতের হোটেলের জন্য গরু খোঁজা শুরু হল। পার হয়ে গেল দেশীয় প্রযুক্তিতে বানানো গরু বোঝাই কিছু গাড়ি। সম্ভবত কোথাও হাট বসেছে। অথচ দেখেন এ সব অঞ্চলের বেশির ভাগ জায়গায় মাথা কুটে ফেললেও গরুর মাংস পাবেন না হোটেলে। যাই হোক ডিম দিয়া ভাত খাইলাম এক ছোট হোটেলে। সেখানে একটা জিনিস দারুণ পছন্দ হইছে। মরিচ ভর্তা। খাবারের লগে ফ্রি দেয়। এমনটা পরেরদিন ঝিনাইদহেও পাইছিলাম। বেশি খাইয়া তো পেট জ্বলতেছিল।
আবার ব্রিজ পার হয়ে কুষ্টিয়া। এর আগে গেলাম এক দইয়ের দোকানে, যার পেছনে কুমার নদী। দাউদের ইচ্ছা দই খাওয়ার। কিন্তু আধ কেজির নিচে কোনো ভাণ্ড নাই। আমি আর মাহমুদ বললাম, দই খাবো না। ফলে দই না খাইয়া ব্রিজ পার হওয়া লাগল। আলমসাধু হয়ে ঐতিহাসিক লক্কর-ঝক্কর মার্কা একটা সড়ক ধরে ভবানীপুরের পথে। পথে পড়ল বাঁশঝাড়, পানের বরজ, বয়োবৃদ্ধ বৃক্ষ, মাটির ঘর। ভালোই তো লাগছিল! অবশেষে বিকেল চারটা নাগাদ কুমার নদীর আরেকটা ব্রিজের উপরে দাঁড়ালাম। রেলিংয়ে শুকাচ্ছে সোনালী আঁশ পাট। ব্রিজ উপরে দাঁড়ায়া আমরা পানি দেখতে দেখতে ভাবতেছিলাম, যে লোকটা মাছ ধরছে সে কোন জেলায়— কুষ্টিয়া না ঝিনাইদহ। অথবা আমরা কোন জেলায়। এ ভাগাভাগিটা অদ্ভুত না। যখন লিখছি কথাটা, ভাবতে গিয়া চোখে পানি চলে আসল। কেন, কে জানে?
মিনিট পনের হাঁটার পর ভবানীপুর বাজারের আরেকটা অংশে হাজির হলাম। সেখানেই হরিশপুর যাওয়ার ভ্যান খুঁজছিলাম। ওইখানে সে মুরুব্বীর লগে দেখা, যিনি বলেছিলেন— ‘টাকায় তোমাদের কাছে সব হয়ে গেল। সম্মানটা দেখলে না!’ উনাকে আমার সাহিত্যিক বা সংস্কৃতিকর্মী বা সিনেমাওলা টাইপ মনে হইল। যারা বলে, টাকাই কী সব হয়ে গেল। হয়ত উনি সাহিত্যিক না, সংস্কৃতিকর্র্মী না, সিনেমাওলা না। উনি নিজের গ্রামকে ভালোবাসা স্রেফ ভালো মানুষ। যাইহোক দাম কমাল না ভ্যানওয়ালা। আমরা তার বলা দামেই উঠলাম। মুরুব্বিকে সালাম জানালাম।
এবারও চলছি তো চলছি। এর উপ্রে ঝিনাইদহ শহর থেকে অনেক দূরে জায়গা এটা। তারপরও আলোচনায় সিদ্ধ হলো— পাঞ্জু শাহর মাজার হয়ে দ্রুত ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করব। মজার বিষয় হলো, এ লেখায় আপনাদের পাঞ্জু শাহর মাজার নিয়ে কিছু বলব না। কেন? নিচেই বলছি!
ভ্যানওয়ালা আমাদের তাজ্জবই করলেন। কারণ তিনি আমাদের হাজির করেছেন সিরাজ সাঁইর মাজারে। যাকে লালনের গুরু মনে করা হয়। লালনের গানেও তার কথা আছে। কিন্তু তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না। তার যে কবর আছে আমাদের জানা ছিল না। তাও আবার স্ত্রীর কবর সমেত!
একটা সরকারি স্কুলের মাঠের একপাশে বাঁধানো কবর দুটি। মাটি থেকে উচুঁ করে বাঁধানো। উপরে টিনের চাল। টিনের সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা ‘দরবেশ সিরাজ সাঁইজির মাজার’। উপরে ছোট হরফে লেখা ‘ফকির লালন শাহ’র দীক্ষা গুরু’। নিচে লেখা হরিশপুর, হরিণাকুণ্ড, ঝিনাইদহ। অন্যপাশে একটা শ্বেতপাথরে লেখা আছে, ‘ফকির লালন সাঁইজীর গুরু দরবেশ সিরাজ সাঁইজীর রওজা মোবারক, আবির্ভাব- ১১২৫ বাং/১৭১৮ ইং, তিরোধান-১২০৫ বাং/১৭৯৮ ইং’। লালন সাঁইজীর মৃত্যু ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর। মানে লালন আর সিরাজ সাঁইজীর মৃত্যুর মাঝে ফারাক ৯২ বছর। আর বলা হয়ে থাকে লালন দেহ রেখেছিলেন ১১৬ বছর বয়সে। সে অনুসারে সিরাজের মৃত্যুর সময় লালনের বয়স ২৪।
সামনের স্কুলটার নামও লালন শাহর নামে। তার মাঠে কিছু একটা ঘটছিল। সে বিষয়ে পরে আসছি। মাজারের পাশে টিউবওয়েলে আমরা হাত ধুয়ে নিলাম। আমি মুসলমানি রীতিতে কবরকে সালাম দিলাম। লালনের ঘরে চাল-পানি নেওয়া মানুষ দাউদ। সে রীতি মোতাবেক ভক্তি দিল।
সিরাজ সাঁইকে নিয়ে খুব বেশি জানা যায় না। অনেকেই তাকে মিথিক চরিত্র বলতে চান। তবে লালনের ঘর তো সিলসিলা ছাড়া নয়। সিরাজ সাঁই সম্পর্কে বলা হয়, তিনি পালকি বাহক ছিলেন। তার কোনো গানের সন্ধান পাওয়া যায় না। এ নিয়ে নদীয়া কিছু গল্প প্রচলিত আছে। সে সূত্রে চলে আসে শ্রী চৈতন্য, নকশবন্দিয়া তরিকার বারো ফকির, ডুমুর গান ও নানান গল্প। সে গল্প আমার আয়ত্বে নাই। এই লেখাও নিছক ভ্রমণ কাহিনী। সিরাজ সাঁইয়ের উল্লেখ আছে— আপাতত তেমন কিছু গানের লাইন পড়া যাক—
১. দিব্যজ্ঞানী যে জন হল
নিজতত্ত্বে নিরঞ্জন পেল
সিরাজ সাঁই কয় লালন লো
জন্ম-অন্ধ মন গুণে
২. তুন্ডে তুন্ডে করিল কাহার
সেই কথাটি শুনতে চমৎকার
সিরাজ সাঁই কয় লালন তোমার
বোঝ জ্ঞান দ্বারে।
৩. দিবাকর নিশাকর সদাই উভয় অঙ্গে উভয় লুকায়।
ইশারাতে সিরাজ সাঁই কয়, লালনরে তোর হয় না দিশে।
সে কথা কী কবার কথা, জানিতে হয় ভাবাবেশে
৪. এখনও শ্বাস আছে বজায়, যা করো মন তাই সিদ্ধি হয়।
সিরাজ সাঁই তাই বারে বার কয় লালনেরে।
কে তোর মালেক চিনলি না রে।
মন তোর এমন জনম কি আর হবে রে.
৫. রাসুল কে চিনলে পরে খোদা চেনা যায় ।
রূপ ভাঁড়ায়ে দেশ বেড়ায়ে গেলেন সেই দয়াময় ।।
জন্ম যার এই মানবে
ছায়া তার পরে না ভুমে
দেখ দেখি ভাই বুদ্ধি মানে
কে আইলো মদিনায় ।।
………….
আহমদ নাম লিখতে
মিম হরফ হয় নফি করতে
সিরাজ সাঁই কয় লালন তাতে
তোকে কিঞ্চিৎ নজির দেখায় ।।
গানের কথা বিবেচনা করলে সিরাজ সাঁইর গুরুত্ব ফুটে উঠে। নানান তত্ত্বের তালাশই করছেন লালন। লালনকে কী শিক্ষা দিচ্ছেন সিরাজ বা লালন তার বরাতে নিজেকে কী জানান দিচ্ছেন— সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। কথা তো হাওয়ায় জিনিস না। কারো মাধ্যমে জারি হইতে হয়। আর লালন-সিরাজ সাঁই সম্পর্ক। গুরু কোথায় জীবন্ত থাকেন! শিষ্যের মাঝেই তো। লালনের কালামে যিনি জীবন্ত আছেন— তার তথ্য তালাশ করি আমি কোন ছার!
লালন– যিনি নিজের পরিচয় গোপন করে গেছেন, তার তথ্য তালাশে হরিণাকুণ্ডকে মোটামুটি ঐতিহাসিক জায়গা বলা যায়। সেটা ভাবতে না ভাবতেই মূর্তমান উদাহরণ হাজির। একজন এসে পরিচয় দিলেন তিনি লালন শাহর বংশধর। হাতে কয়েকটা কাগজও ধরাইয়া দিলেন। কিন্তু যতদূর জানি, লালনের কোনো সন্তান ছিল না। ছেউড়িয়ার আখড়ায় তিনি শীতল শাহ, ভোলাই শাহকে সন্তান (শিষ্য) হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তখন বলা হইল, উনি লালনের ভাইয়ের দিকের বংশধর। সামনে লালনের ওরশ বা এ ধরনের কিছু হবে। তারই মিটিং হচ্ছে। লালনের উৎসবে হরিশপুরে হবে— এমন দাবিতে ইতোমধ্যে মানববন্ধনও নাকি হইছে।
আমি শুধু একটাই প্রশ্ন করলাম— যদি লালন এখানকার মানুষ হয়ে থাকেন। তারে তো ফিরে আসার পর গ্রহণ করেন নাই। গল্প তো এমনই বলে। তাইলে আবার ফিরাতে চান ক্যান? তারা অবশ্যই উত্তর দিল না। উত্তর আশাও করি না। ও আচ্ছা! লালনের এ বংশধর মুসলমান। আমাকে দেওয়া কাগজে বংশ বৃত্তান্ত আছে। সর্বকনিষ্ট বংশধর কলেজে পড়ে। সে আমাদের ছবি তুলে রাখল। যাই হোক, এ নিয়ে কথা না বলি। লালনের বংশ বৃত্তান্ত খোঁজা আমার কাজও না। অন্তত লালনের কর্মের দিক থেকে চিন্তা করলে এ সব আজাইরা প্যাচাল।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পাঞ্জু শাহর মাজার। এ যাত্রায় শামিল হলেন বয়োবৃদ্ধ নায়েব আলী। ইনি এ লাইনের জান-বোঝওলা মানুষ। কথায় কথায় অনেক কিছু জানালেন। এ গ্রামে আরও আছে দুদ্দু শাহর মাজার। যিনি লালনের শিষ্য। এমনকি লালনের সময়কার পাঁচঘরের এক ঘর জহরউদ্দিনের মাজারও নাকি আছে। যদি আমাদের জানা মতে, জহরউদ্দিনের কবর পশ্চিমবঙ্গে।
আপাতত জানিয়ে রাখি, হরিশপুরের ভ্রমণ শেষে আমরা যাবো পাগলা কানাইয়ের মাজার ও বিজয় সরকারের বাড়িতে। প্রথমটি ঝিনাইদহে, দ্বিতীয় নড়াইলে। সে গল্প না হয় অন্যদিন হবে!
Comments are closed.