ছোটবেলায় বায়েজিদ বোস্তামি টানত। মনে হইত, আমিই যেন মায়ের শিয়রে পানি হাতে দাঁড়ায়া আছি…
বায়েজিদ বোস্তামির দরগায় এর আগে একবার গেছিলাম। বাবার সঙ্গে। হাইস্কুলের শুরুর দিকে বোধহয়। একদিনে অনেকগুলা মাজারে গেছিলাম। আমরা সকাল সকাল গেছিলাম মাইজভান্ডার শরীফে। ওইখানকার কিছু মনে নাই। একটা পুকুরের ঘাটলা আর অনেকগুলো গরু দেখছি; এমন কিছু মনে পড়ে।
মানতের সুতা বাধছেন এক নারী
তারপর বায়েজিদ বোস্তামির দরগায় আসলাম। পুকুরের কচ্ছপরে যারে আমরা গজারি-মজারি বলে জানতাম; খাবার দিয়ে থাকতে পারি। দোকান থেকে কেনা কাঠির ডগায় সাদা রঙের কোনো একটা বস্তু। মানুষজনকে দেখলাম— কচ্ছপের গায়ে পানি বাচ্চাদের শরীরে ছুঁয়ে দিচ্ছে। পরে পাহাড়ের উপরে মাজারে গিয়ে জেয়ারত করছি। তখন মাজার হিসেবে জানতাম।
মানুষজনরে গাছে সুতা বাধতে দেখছি। আমরা যে তেমন কিছু করি নাই; মনে আছে। এরপর গেছিলাম আমানত শাহর মাজারে। এ মাজারে একটা শান্ত ভাব ছিল বোধহয়। মসজিদে বাবার সঙ্গে নামাজ পড়ছিলাম। সেটা ছিল শীতের দিন। একটা পাঞ্জাবির ওপর (নানার হাতে বোনা) সোয়েটার পরছিলাম। দুটোই আমার অপছন্দের পোশাক। শহরে আসতে আসতে পাঞ্জাবিটা (বেশ পাতলা ছিল) প্যান্টের ভেতর ঢুকায়া ফেলছিলাম। এখন অবশ্যই কেউ সোয়েটার বুনে দিলে কৃতজ্ঞতাসহ পরবো। এরপর আরো বড় হওয়ার পর দু-একবার আমানত শাহর মাজারে গেছিলাম।
বায়েজিদ বোস্তামির দরগা
গত মাসে (অক্টোবর ২০২৪) যখন চট্টগ্রাম গেলাম। ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানে। যেহেতু আমি খানিকটা অসুস্থ। তাই অন্য বন্ধুদের মতো গেলাম, দেখলাম আর চলে আসলাম তেমন তরিকা ফলো করি নাই। অনুষ্ঠানের পরদিন বেলা পর্যন্ত ঘুমায়া বাকি সময়টা ঘুরাঘুরিতে কাটালাম। দুপুরে আমার বন্ধুরে বললাম, চলো বায়েজিদ বোস্তামির দরগায় যাই। সেদিন ছিল ২৮ অক্টোবর। অনেক বছর আগে এদিনে দিন-দুপুরে পিঠায়া অনেক মানুষ মারা হইছিল। এ বছর ওইদিনে ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ। বিষয় আতংককর অবস্থা। সে তুলনায় চট্টগ্রামে কিছুই হয় নাই নাই ভাব। রাস্তায় গাড়ি কম। কর্ণফুলী নদীর নিচে বাপের নামে টানেল উদ্বোধন শেষে শেখ হাসিনা পটিয়া সমাবেশ করবেন। তাই নাকি শহর পরিবহন ছাড়া হয়ে গেছে।
খালি খালি রাস্তায় প্রথমে নিউ মার্কেট আসি। সেখান থেকে হকার্স মার্কেটের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে লাল দিঘির পাড়। ওইখানে অনেকক্ষণ থাকার পর দুই নম্বর গেইট গেলাম। সেখান থেকে রিকশায় বায়েজিদ বোস্তামির দরগায়। তেমন লোকজন নেই সেই ২৮ অক্টোবরে। সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে দেখি উপরের চাতালে একটা কুকুর দাঁড়ানো। তাকে এক লোক তাড়ানোর চেষ্টা করছে।
বেশ শান্ত শান্ত দুপুরে আমরা দরগাহর ভেতর গেলাম। আমার বন্ধু সেখানে বসে প্রার্থনা করতে লাগল। যেহেতু আমার মনে হইলো এখানে কোনো কবর নাই, কিছু করার মতো পাইলাম না। নিজের ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগল। কারণ কিছু না থাকার ভেতরেও থাকার ব্যাপারটা ধারণ করতে সক্ষম নই। সেটা শুধু রিচুয়ালের ব্যাপার না, মানুষ হিসেবে অপরাপর মানুষকে বোঝাপড়ারও। এবং মানুষের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুর না হওয়ারও ব্যাপার। তো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম; অস্বস্তি সমেত। এক লোক বারবার বলছিল, মানত করে টাকা দিতে। দেয়ালে একটা লেখা দেখে স্বস্তি পাইলাম যে বলা হচ্ছে, শরিয়ত এখানে সিজদার অনুমতি দেয় না। সেখান থেকে বাইর হওয়ার সময় সাবধানই থাকতে হইলো যাতে এলাকার মর্যাদা নষ্ট না হয়। কারণ, পেছন ফিরে নাকি যাইতে হয় না। বাবার সঙ্গে সফরে তেমনই করছিলাম। এরপর উঠার রাস্তা দিয়ে না নেমে সামনে দিকে যাইতে থাকলাম। নিচে জুতো রেখে আসায় আমাদের পা খালি আসতে রইল; এভাবে বায়েজিদ বোস্তামির দরগাহর রাস্তার দুপাশে থাকা অনেক কবর পাড় হইলাম। অন্যপাশের রাস্তায় নামলাম। খালি পায়ে কষ্ট হইতেছিল। বোঝার চেষ্টা করলাম, কত কত তীর্থে মানুষ কত কত কষ্ট করে। মাঝে চা পান শেষে আমরা আবার হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে একটা পাহাড়ে দিকে আগাইতে থাকি।
খাইরুল্লাহ শাহ মাস্টার বাবার দরবার শরীফ
হযরত খাইরুল্লাহ শাহ মাস্টার বাবার দরবার শরীফ। উনি মাইজভান্ডারী রিশতার মানুষ। কয়েক দশক আগে মারা গেছেন। ঢুকতেই দু-পাশে ফুলের বাগান। দেশি জাতের গোলাপ ফুটে আছে। অল্প-স্বল্প। সেখানে বোর্ডে কিছু নিয়ম লেখা। ছবি তোলা যাবে না, নারী-পুরুষ একত্রে গল্প করা যাবে না। এখানে ঢুকতেই একজন লোক বলল, কবরে সালাম দেন। মানত করেন। সালাম দিয়ে দোয়া পড়লাম। আমার বন্ধু সিজদা করল। তারপর কিছুক্ষণ প্রার্থনা করল। আমি আশপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। একপাশে একদম খাড়া পাহাড়। পাশে কিছু কবর। এখানকার কোনো রীতিনীতি জানি না, কিছুর ব্যাখ্যাও জানি না। অস্বস্তি লাগে আবার। নানান কিছুর দ্বন্দ্ব মনের ভেতর। তবে এসব জায়গা আমারে কিছুটা হলেও টানে। মানুষের ওপর মানুষের এ প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। ইভেন, মানুষ তো এখানে তার ভেতরকার সেই টানেই আসে, যেটা আসলে তার ভেতরে সুপ্ত থাকে বলে তারে আসতে হয়। এরপর আমরা আবারও খালি পায়ে অনেকটা পথ পার হই। তারপর সুতো বাধা সেই গাছ; যেখানে একজন নারী সুতো বাধছেন। ছবি তুলি। তারপর বায়েজিদ বোস্তামির দরগা। তারপর সিড়ি-রাস্তা হয়ে আমরা ফিরে আসি। মানুষ প্রতিদিন যেখানে যেভাবে ফিরে যায়। শুধু যেখানটাই আলাদাভাবে যায়, সেটাই শুধু আমরা মনে রাখি। কারণ, সেখানে তার অর্থও খানিকটা পাল্টে যায়। নাকি খানিকটা স্থানের ধর্মও পালন করে!