বই হাতে নিয়া যা ভাবতেছিলাম

দার্শনিক জর্জ বার্কলে, যিনি আবার বিশপও ছিলেন। তার একটা কথা আছে—‌ ‘অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণ নির্ভর’। যেহেতু আমার পড়ালেখা গাইড বই মার্কা, সেহেতু ভাবতাম— ‘ধরেন ভাত রান্না করতে গেছি। তো আমি দাঁড়ায়া না থাকলে, কখনো আমার ভাত রান্না হবে না।’ আসলেই তা হয়। বছরে দুই-একবার রান্না করতে হয়। আমার অবস্থা দাঁড়ালো দুই-এক মিনিট পর রান্নাঘরে হাজির হচ্ছি। এটা হতে পারে ছেলেমানুষী দশা। তবে বার্কলের এ কথার অনেক তাৎপর্য। আবার অনেক সমালোচনাও। কোনো এক দার্শনিক একটা পাথরে লাথি মেরে বলছিলেন— এভাবে বার্কলের থিওরিতে প্রত্যাখান করছেন। এবং তিনি পায়ে ব্যথাও পেয়েছিলেন। আবার ইয়াস্তান গার্ডারের উপন্যাস ‘সোফির জগত’ যেখানে বিরক্তিকর হয়ে উঠে, সেখানে বার্কলে এসে দারুণ বাঁক তৈরি করেন। মানে নিজে এখানে অপরের চিন্তার সাবজেক্ট হয়ে উঠার মতো ভয়াবহ বিষয় থাকে! তারপরও আমরা কারো চিন্তায় থাকারে ঠেকাতে পারি না।

উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে । ওয়াহিদ সুজন । মে ২০১৫। প্রকাশক : ঐতিহ্য

উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে । ওয়াহিদ সুজন । মে ২০১৫। প্রকাশক : ঐতিহ্য

মজার বিষয় হল, এই যে দেখাদেখির বিষয়— তা কিন্তু জ্ঞানতাত্ত্বিক জায়গা থেকে অভিজ্ঞতাবাদ, মানে যা অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানের মূখ্য উপাদান মনে করে। আবার অন্যদিক থেকে ভাববাদ। মজা না! এমনি এমনি ভাবলে মনে হয় অভিজ্ঞতাবাদের লগে শুধু বাস্তববাদের বন্ধুত্ব হবে। অন্যদিকে বাস্তববাদের আকার-প্রকারভেদে গেলে অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় চলে আসবে। মানে আপনি যে দেখাটারে ‘বস্তু যা অর্থে’ ভাবেন— তা আসলে তা-ই কিনা। অর্থাৎ, আপনার দেখাটা দুনিয়া যেমন তাকে তেমন করে দেখায় কিনা! নাকি অন্য কোনো মাধ্যমের কারণে আমার দেখা ভিন্ন রকম হয়। এ ছাড়া ভাববাদের লগে ভাল বন্ধুত্ব সংশয়বাদের। যেহেতু পশ্চিমা চিন্তার শুরুর কথা সংশয় করতে হবে।

আমার আলাপ এ জায়গায় না। ঘটনা হইল ‘ভাত রান্না’ বিষয়ক ঘটনা উল্টে গেল। কারণ দুনিয়াটাকে বৃহত্তর জায়গা থেকে দেখতে হইতেছে। বা দার্শনিকরা এভাবে দেখতে বাধ্য হন। যখন প্রশ্ন উঠল আমরা না দেখলেও দুনিয়ায় অনেক কিছু ঘটতেছে। তার উত্তর দিতেছেন বার্কলে, ‘ক্যান! ঈশ্বর দেখতেছে।’ মানে খোদা-তায়ালা আপনার চিন্তা ফাঁকফোকর বুজাইয়া দিচ্ছেন। তা সত্ত্বেও ঈশ্বর এখানে মুশকিল আসান করলেও দর্শন কখনোই ধর্ম বা ধর্মতত্ত্ব না। মানুষের চিন্তার দৌড়ের কসরত। বার্কলেরা যতই আমাদের (এমনকি ডেকার্টও) এ জায়গায় হাজির হইতে চান, ততই ঈশ্বরকে দুনিয়ার অন্য জিনিসের মতো খানিকটা করেই ফেলছেন। ফলে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর থাকল না। যেহেতু তাকে পরীক্ষা করা যাইতেছে না। ফলে মুসলিম প্রাচ্যের প্রথমদিকের দর্শনকারীদের অন্যতম মুতাজিলাদের অনেকে গালাগালি করেছেন। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা এমন যে ‘খোদা’ একটা ধারণা হইয়াও যুক্তিবুদ্ধির মধ্যে হাজির হইতে পারেন। অবশ্য খোদাকে এভাবে ব্যাখ্যার ফলাফল হাতে-নাতেই পাওয়া গেল। কিন্তু আফসোস এখনও অনেকে এরিস্টটল দিয়া খোদা আছেন প্রমাণ করতে চান। সেটা আবার ধর্ম আকারেই করে। কিন্তু ব্যাপারটা তো আলাদা। তাই সবসময় ধার্মিকরা দর্শনকে মানবেন সেটা মনে করার কারণ নাই। আবার ধরেন অনেকে ধর্ম মানেন না। এ জায়গায় ডিলেমা তো আছেই। আমি দর্শন ও ধর্মের কথা বলছি— কিন্তু এটা তো আলাদা কোনো মানুষ করে না। একজনই করে। এ জোড়া হয়ত ঈশ্বরই লাগাইতে পারেন না। আপাতত সেখানে না গেলেও চলবে।

ukil munshir chinno dhareঈশ্বরকে এভাবে হাজির করা কার্টেশিয়ান ট্রাডিশনে একটা দারুণ বিষয়। আপনি চিন্তা করার সুবিধার্থে ভাব-বস্তুকে আলাদা করছেন, কিন্তু ঐক্য করতে পারছেন না। অথচ একটা ঐক্য দরকার। তখন ঈশ্বর এসে হাজির হন। কিন্তু পদ্ধতি কিন্তু ঈশ্বরে হাজির হওয়া নয়। ভাব-বস্তুরে আলাদা করা।

আসলে এতো কথা কোত্থেকে উদয় হইতেছে? সেটা হলো ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ বইটা প্রকাশ হইছে ২৭ মে। কিন্তু বিবিধ জটিলতায় আমার হাতে পৌঁছায় নাই। আমি এবং নাইম ভাইয়ের (প্রকাশক) যোগাযোগে বিবিধ যান্ত্রিক গোলযোগ এর কারণ। অবশ্য এটা একটা অনন্য ঘটনা! বই নিয়ে আমাদের কথা চালাচালি শুরু সে ২০১৪ সালের নভেম্বরে। কিন্তু আমাদের কখনো দেখা হয় না।

যাই হোক, উনি ফোন করে জানালেন, ২৭ তারিখ বই বের হচ্ছে। রাত-দিনের পরিক্রমায় দিনটা আসল, চলেও গেল। হইছে কী আমিও কাওরে বলতেছিলাম না বই বের হইছে। না দেইখা কোনো কিছুরে ক্লেইম না করার সমস্যা! ভেতরে ভেতরে হয়ত এমনই। কেউ জিগেস করলে বলি, হাঁ। কাঁটাবনে পাবেন। অথচ সেখানে যাওয়ার টাইম আমিই পাইলাম না। তাই ভাসা ভাসা বলতেছিলাম। শেষতক ৩০ মে বই হস্তগত হইল। শুকরিয়া। তো, তখন মনে হইল আমি ‘অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ নির্ভর’ এর দাস। মানে নিজেরে মুক্তভাবে দাস বানাইছি তা নয়। বরং, অভ্যাসের ভেতর এ রোগ ঢুকে গেছে।

যদিও যিনি বই দিলেন, তিনি বললেন, ‘বইগুলা তিনদিন আগে দেয়া হইছে। আপনি তো আসলেন না’। মানে বইগুলা অন্য কারো দেখাদেখির মধ্যে ছিল।

এই যে আমার লগে প্রকাশকের দেখা হয় নাই। মানে উনার লগে কখনো সামনাসামনি আলাপ হয় নাই। উনিও নিশ্চয় কারো দেখাদেখির মধ্যে আছেন। এখানে ঈশ্বর বিষয়ক উদ্দেশ্যমূলক যুক্তির প্রথম অংশটা খাটে। যেহেতু একটা ঘড়ি দেখলে আপনি ভাবেন— কেউ একজন এইটা বানাছে। সেহেতু একটা বই আপনার হাতে আসছে, কেউ একজন নিশ্চয় এর প্রকাশক। যদিও আপনি তারে দেখেন নাই। কিন্তু আমার মানসিক অবস্থা এমন ধারণা তৈরিতে সক্ষম। কারণ এমন ধারণাই বিদ্যমান।

নিজের বই হাতে পাওয়ার পর লোকে আগডুম-বাগডুম কত কী ভাবে! এটাও তেমন কিছু হইল!!

Comments

comments