ব্যাপারটা এমন যে, হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস, গল্প, নাটক, গান লিখেন। আবার সিনেমা, নাটক বানান। তিনি যদি ছবি আঁকেন— প্রথমে খানিকটা অবাক হতে পারেন। আবার এও ভাবতে পারেন- জগতে প্রতিভার একটা সর্বগ্রাসী রূপ রয়েছে। হুমায়ূনের না হয় আরও কিছু থাকল।
এটা ঠিক যে, তার অন্য দুই ভাই ছবি, কার্টুন ও ছবি আঁকিয়ে হিসেবেও পরিচিত। তাদের লেখক পরিচিতিও কম মূল্যবান নয়। সে ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের ছবি আঁকাআঁকি দারুণ একটা বিষয়। বিশেষ করে তিনি যে বয়সে আঁকাআঁকিটা সিরিয়াসলি (লেখকরা বলেন মনের আনন্দে) নিলেন বা বিষয়টা রাষ্ট্র হলো, তখন তা মজাদার বিষয় বটে। যতদূর জানা যায়, এর একটা নিয়মতান্ত্রিক চর্চা করতে চাইছিলেন তিনি। তাই শিল্পী ধ্রুব এষের শরণ নেন।
এ শুরুটা আসলে মাঝখান থেকে না। সে মতে আপনি হুমায়ূনের কাজে যা দেখবেন তার মধ্যে চোখ আটকে যাবে ফুলের টবের ছবিটিতে। টবে পাতার মাঝে নানা রঙের ফুল উঁকিঝুকি মারছে। মোটামুটি আমরা যারা এক-আধটু বা পুরোপুরি ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করি— এ ভাবেই করি। নিশ্চল ফুল-ফল, ঘটি-বাটি আমাদের দারুণ আকর্ষণ করে। যাকে স্টিল লাইফ বলে। সে আকর্ষণটা আমরা এড়াতে পারি না। আবার নিয়ম মেনে চর্চাটা এভাবেই হয়। এখানে একটা দ্বিধা তৈরি হয়। আমরা ওই সব জিনিসের প্রতি আগ্রহী হই বলে আগে এ সব আঁকি, নাকি এভাবে শুরু করার নিয়মটা আমাদের প্রাকৃতিক মনে হয়!
এরপর আপনি কোন কাজটি করবেন? হুম, ঠিকই ভাবছেন। প্রকৃতিই আপনাকে টানবে। নিশ্চল জীবন থেকে খানিক পরিবর্তনে পা রাখতে চাইবেন। খালি মাঠ, বন, নদী, একলা বৃক্ষ এমন কিছু তো করবেনই। হুমায়ূন আহমেদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি এ্যাবস্ট্রাক্ট লেভেলে যাইনি— একটা টান দিয়ে ছেড়ে দিলাম। একটা বিশাল কিছু হয়ে গেল, আমি এর মধ্যে নাই। প্রকৃতি নিয়ে কিছু কাজ করছি।’
একজন লেখকের চিত্রশিল্পী হয়ে প্রকৃতিতে ফিরে যাওয়াকে আমরা অন্যভাবেও দেখতে পারি। মানুষের কথা মালায় সাজাতে গিয়ে লেখক অহর্নিশ কথার সমুদ্রে ভাসতে থাকেন। এ ভাসাভাসি হয়ত তার অপরাপর শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটায়। সে ক্ষেত্রে নিস্তরঙ্গ প্রকৃতি বা যা লেখকের মতো একা— তার চর্চা খানিক করাই যেতে পারে। হুমায়ূনের প্রকৃতির ছবি দেখতে দেখতে আমার মাথায় আসে মধ্যাহ্ন উপন্যাসের শেষ অংশটুকু। যেখানে লাবুসের শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আবার পৃথিবীর অন্য একটি প্রান্ত জাপানের হিরোশিমায় পরমাণু বোমার আঘাতে পুড়ে যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। মানুষের অনুভূতি-সমাজ বিজ্ঞানের এ ঐক্য মানুষকে কোথায় নিয়ে যাবে। তার একটা জায়গা হতে পারে খালি মাঠ, বন, নদী ও একলা বৃক্ষ। তারপরও মানুষ মানুষের কাছেই ফিরে আসে। এ আসাটুকু কতটা মূর্ত বা কতটা বিমূর্ত— তা ভাবা যেতে পারে। যেহেতু হুমায়ূন নিসর্গ এঁকেছেন— নিসর্গের মাঝেই তিনি জেগে থাকুন।
আরেক ধরনের অনুমান জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না। সেটা হলো হুমায়ূন কি আসলে বিমূর্ততায় নেই! ধরেন একটা গাছ আর একটা মানুষ। আর তার আশপাশে কিছু নেই। এত একলা কোথাও কিছু দেখছেন। ভাববেন কল্পনায়। কল্পনায় আমরা যা করি, তাকে যদি বাস্তবে দেখাতে যাই তাহলে এমন কিছু একটা হয়ত দাঁড়ায়। কিন্তু তার আড়ালে কিছু কথা থাকে। সেটা কী? সেটা হয়ত এমন মানুষ। যেহেতু মানুষ নিজে একটা বিমূর্ত ধারণা— তাই তার অসম্পূর্ণ ছায়া হতেই পারে। তো এখানে বিমূর্ত না হলেও বিমূর্তাদির সুবিধা জারি থাকে। সে সুবিধার মাঝেও তিনি আছেন অথবা আমরা চাইলে রাখতে পারি।
আবার দেখুন হুমায়ূন আহমেদ একজন সাহিত্যিক। উপন্যাস, গল্প লিখেছেন। সিনেমা, নাটক নির্মাণ করেছেন। সে অর্থে তার কোনো চলনসই ক্রিটিকও চোখে পড়ে না। তাই হুমায়ূন বলতে একটা ভাসা ভাসা ধারণা, অতি উজ্জ্বল সাহিত্যের প্রাসাদের বাইরে তার অবস্থান চোখে পড়ে। বিখ্যাত লোকেরা তাকে নিয়ে যা যা লিখেছেন তা স্মৃতিকথা মাত্র। সে বিবেচনায় হুমায়ূন আহমেদ নিজেই কোনো কংক্রিট ধারণা নয়। বিমূর্ত একটা ধারণা। তাই তাকে হয়ত চিত্রকলায় বিমূর্ত হওয়া দরকার পড়ে না। তবে হওয়া-না হওয়া যে একটা ব্যাপার সেটা হুমায়ূনের ওই কথায় বোঝা যায়। এটাও ঠিক বিমূর্ত হওয়াটা চিত্রকলার উৎকর্ষের মানদণ্ড নয়। বরং, এ সূত্রে হুমায়ূন সম্পর্কে খানিক কথা বলা মাত্র। আরেকটা বিষয় হলো- এত এত প্লট বা গল্প থাকা সত্ত্বেও তার ছবিগুলো এত সাধারণ কেন? এর সহজ উত্তর হতে পারে— এটা ছিল হুমায়ূনের আঁকাআঁকির শুরু। অথবা হুমায়ূন এই-ই।
তিনি মৃত্যুর আগে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন নিউইয়র্কে। সে সময় অনেকগুলো ছবি এঁকেছেন। এগুলোর প্রদর্শনীও হয়েছে। সে সম্পর্কে মেহের আফরোজ শাওন একটি লেখায় বলেন, ‘‘নিউইয়র্কে চিকিৎসার সময়টাতে জ্যামাইকার বাড়ির এ্যাটিকে সময় কাটানোর জন্য পুত্র নিষাদকে নিয়ে ছবি আঁকা শুরু করেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর ভাষায় সেটা ছিল আঁকাআঁকি খেলা। নিজের আঁকা ছবির সবচেয়ে বড় ভক্ত ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ, আর তাঁর ভাষায় সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিল তাঁর পুত্র নিষাদ। ছোট্ট নিষাদ বিজ্ঞের মতো ‘ছবি ভালো হয়নি’ বললে পুত্রকে খুশি করার জন্য সেই ছবি ছিঁড়ে ফেলে আবার আঁকতেন হুমায়ূন।’’ এখানে একটা মোটাদাগের কথা বলা যায়, এ ছবিগুলো আসলে এক অর্থে মানবিক সম্পর্কের স্মারক।
তার আঁকাআঁকির মাধ্যম জলরং; ছবির নামও চমৎকার। আসুন কয়েকটির নাম জানা যাক- ‘ক্লান্ত দুপুর’, ‘তৃষ্ণা’, ‘সুন্দরবন’, ‘মেঘবালিকা’, ‘ফেরা’, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, ‘যাত্রা’, ‘ফাগুনের নবীন আনন্দে’, ‘বনমর্মর’, ‘ঝরো ঝরো মুখর বাদর-দিনে’, ‘পুষ্পকথা’ ইত্যাদি।
এ ছাড়া এ সব ছবি দেখতে দেখতে দূরতমভাবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মনে পড়তে পারে। তিনি গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটক-গান লিখেছেন। তার ছবি আঁকার হাতও ছিল অসাধারণ। হুমায়ূনের ক্ষেত্রে দেখা যায়— তার রবীন্দ্রঋণ কম নয়। বিশেষ করে বিবিধ উপন্যাসের নামকরণ, বাস্তব জীবনে জোসনা ও বৃষ্টির বিলাস হয়ত এভাবে আসা। ছবি আঁকাতে হয়ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অনুপ্রেরণা। অথবা না।
(২০১৪ সালে নভেম্বরে হুমায়ূনের আঁকা চিত্রকর্ম ও ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে প্রদর্শনী হয় শাহবাগের জাতীয় যাদুঘরে। লেখা সে উপলক্ষে দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত। এখনকার প্রাসঙ্গিক না হওয়ায় লেখার শেষ প্যারাটি বাদ দেয়া হলো।)