আমি তোর পিরীতের মরা
তুই চাইয়া দেখনা এক নজর
বন্ধুরে অপরাধী হইলেও আমি তোর
ঘটনাটা নেত্রকোনার। শুনছিলাম ঢাকায় বসে, বলছিলেন হবিগঞ্জের সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া সাব্বির। হয়তো অর্ধ শতাব্দী বা তারও আগের ঘটনা। পীর সৈয়দ শাহ মোজাফফর আহমেদ মুরিদানের সাক্ষাতে গিয়েছিলেন নেত্রকোনায়। সেখানে ভক্ত উকিল মুন্সীকে (১৮৮৫-১৯৭৮) কোনো কারণে গালমন্দ করেন। উকিলের খুবই অভিমান হয়। পুকুর পাড়ে বসে থাকেন। অশান্ত চিত্তে গেয়ে ওঠেন, ‘অপরাধী হইলেও আমি তোর’। এরপর পীর সাহেব তাকে নিতে পুকুর পাড়ে নিজেই আসেন। তাদের এ মান-অভিমানের খেলা অন্য ভক্তদের কাছে অপরিচিত কিছু নয়।
১১ জুন চলে উকিল মুন্সীর জন্মদিন। এ দিবসটি স্মরণ করে যাওয়া যাক ‘দক্ষিণের দেশ’ হবিগঞ্জে, যেখানে শুয়ে আছেন সৈয়দ শাহ মোজাফফর আহমেদ।
এক.
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি একদিন (১ মে ২০১৪) রাত আড়াইটায় হাজির হলাম হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ। উদ্দেশ সৈয়দ মোজাফফর আহমেদের দরগায় যাওয়া। ঢাকায় যে ধরনের গরম পড়ছিল, তাতে কিছুটা ভয়েই ছিলাম। কিন্তু রাতটা বেশ ঠাণ্ডায় আরামদায়কভাবেই কাটল। ঠিক হলো দুপুরের পর রিচির দরবারে যাবে। দূরত্বও কম নয়। এর মধ্যে একরাশ বৃষ্টি হয়ে গেল। বাঁচা গেল গরম থেকে। কিন্তু জেঁকে বসল প্রচণ্ড মাথাব্যথা। তার মধ্যেই সিএনজিতে এলাম হবিগঞ্জ শহরে। দুইটা আচার আর দুধবিহীন চা পান করে রিকশায় রিচি গ্রামের দিকে যাত্রা। রিচির পথে যেতে যেতে খানিকটা সুস্থবোধ করছিলাম। উদ্দেশ-বিধেয় সব মিলিয়ে এক ধরনের আধ্যাত্মিক প্রণোদনা পাওয়া যাচ্ছিল যেন! যদিও আমাদের অনুভূতির কাল্পনিক তুষ্টি সাধনার সরল-গরল দিকগুলো প্রায়শ উপেক্ষা করে। তাই কোনো ধরনের নিষ্ঠা বা মনোযোগ ছাড়াই মাথাব্যথা সারার গল্প মাথায় ফেনিয়ে ওঠে। হয়ে উঠি আশীর্বাদপ্রাপ্তদের একজন। বাহ! অবিশ্বাসই যেখানে বিশ্বাসের মৌলিক অনুষঙ্গ, সে যুগে এ কথা।
দুইপাশে খোলা মাঠ। মাঝে পাকা সড়ক। হুহু হাওয়া আসছে। হাওয়ারা ছুটে যায় দক্ষিণ থেকে উত্তরে। যেখানে উকিল শুয়ে আছেন। আমাদের গন্ধ যায় কি! বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ মুছে যায়নি তখন। সে বাতাসও পারে কলবকে সাফ-সুতরো করতে। ততক্ষণে বাতাসে উড়তে উড়তে মাথাব্যথা উধাও। এ সে হাওয়া, যাতে মিশে আছে সৈয়দ মোজাফফর আহমেদের দেহ মোবারকের ঘ্রাণ। যার সুবাস শুধু ভক্তই অনুভব করেন। উকিল লিখেছেন, ‘দক্ষিণ হাওয়া রে চোখে নাহি দেখা যায়। দ্বিগুণ জ্বালা বাড়ে আমার লাগলে হাওয়া গায়।’
সম্ভবত দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছিল। সে বৃষ্টির শীতলতা নিয়ে আসছিল দূরগামী বাতাস। মানুষ কী কম দূরগামী। ধানের ক্ষেতের মাঝে মাঝে ছোট ছোট খাল। কোথাও দুই-একটা নৌকা আছে। বর্ষায় এসব মাঠ এমন থাকে না। যেদিকে চোখ যায় পানি আর পানি। এর কোনো এক দিক থেকে হয়তো আসত উকিলের নৌকা।
আমাদের এ যাত্রার শুরু দুই বছর আগে। চট্টগ্রাম থেকে আসা দাউদুল ইসলামের সঙ্গে হুট করে হাজির হই নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। উদ্দেশ্য উকিল মুন্সীর কবর দেখা। দেখে আসা মন উদাস করা সে প্রকৃতি ও মানুষগুলো যাদের সঙ্গে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন এ মহান সাধক। আমাদের সে ভ্রমণে অসাধারণ অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, জানতে পারি অজানা অনেক কথা। এর মাঝে একটা কথা ছিল, উকিল মুন্সীর পীরের নাতি বলেছেন তাকে শুধু উকিল মুন্সী বলবেন না। বলবেন হজরত উকিল মুন্সী।
সে পীর ও পীরের নাতির তালাশে দুই বছর পর হবিগঞ্জ আসা। হয়তো অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষের ইতিহাস তো এক-দুইজনের দেরিতে নির্ধারিত হয় না।
এবার আসা যাক রিচি প্রসঙ্গে। রিচি গ্রামটি নানা কারণে সমৃদ্ধ। একটা দিক হলো ৩৬০ আউলিয়াকে নেতৃত্ব দিয়ে আসা হজরত শাহজালাল (রহ.) এর প্রধান সেনাপতি নাসিরউদ্দিন সিপাহশালারের বংশধররা বাস করেন এ গ্রামে। সে পীরালি পরম্পরা এখনও টিকে আছে। তাদের বাড়ি এ অঞ্চলে সাহেব বাড়ি নামে পরিচিত। পরিচয়ের রেশ হবিগঞ্জ শহরেও টের পাওয়া গেল। লোকজন দিব্যি চিনতে পারছেন।
দু্ই.
আমায় যদি দাও তাড়াইয়া
এমন জায়গা নাইরে গিয়া
এই অভাগার জুড়াইতাম অন্তর
তুমি যদি ভিন্ন বাস আমি তোরে কইনা পর।।
আসরের নামাজের খানিক আগে আমরা সাহেববাড়িতে হাজির হই। সাহেববাড়িকে রীতিমতো একটা পাড়া বলা যাবে। এখানেই সৈয়দ মোজাফফর আলীর মাজার। দুইজন নারী ভক্ত মাজারের সামনে শ্রদ্ধাবতন ভঙ্গিতে বসে আছেন। এর মধ্যে একজন খাদেম সৈয়দ মোজাফফর আলীর কবরটি দেখিয়ে দিলেন। আমাদের উদ্দেশ্য জানাতে বললেন অদূরের ঘাটলায় বসতে। পুকুরের পর যতদূর চোখ যায় খোলা প্রান্তর। একপাশে একটি মাদরাসা। আমরা খড়ের ছাউনি দেয়া পুকুরের ঘাটলায় বসলাম। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনের সঙ্গ পাওয়া গেল। উকিল মুন্সী বলতে তারা সায় দিলেন, তিনি সৈয়দ মোজাফফর আহমেদের শিষ্য ছিলেন। তাদের সম্পর্ক নিয়ে কিছু গল্প শোনা গেল, যা আমাদের জানা।
একজন নাসিরউদ্দিন সিপাহসালারের বংশবৃত্তান্ত নিয়ে রচিত বই আনলেন। সৈয়দ মোজাফফর আহমেদ তার দশম পুরুষ। তার পাঁচ খলিফার মধ্যে একজন উকিল মুন্সী। ঢাউস সাইজের সে বইতে এ বংশ সম্পর্কে অনেক তথ্য আছে। অদ্ভুত বিষয় হলো সৈয়দ মোজাফফর আহমেদের নাম উল্লেখ থাকলেও তার সম্পর্কে তেমন কিছু লেখা নাই। ঘাটলায় সঙ্গ দেয়া একজনের কাছে জানা গেল, সৈয়দ মোজাফফর আহমেদের মামা ছিলেন আম্বর আলী শাহ। তিনিও পীর ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে তিনিও যুক্ত ছিলেন। তার বাড়িতে পুলিশ আসা নিয়ে একটা গানও আছে বইতে। মোজাফফর আহমেদ আম্বর আলীর কাছ থেকে শিষ্যত্ব নেননি। তিনি তরিকতের ধারার খোঁজে যান সুদূর চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। সাতকানিয়ার মির্জারখিল দরবার শরিফে। সে অর্থে সৈয়দ মোজাফফর আহমেদের সিলসিলার এখানে প্রচলিত তরিকার লাইনে নতুন একটি অর্থ হাজির করে।
আরও জানা গেল উকিল মুন্সীকে নিয়ে কী কী কাজ হচ্ছে তারা খবর রাখেন। একজন জিজ্ঞেস করলেন, গত বছর তার গান নিয়ে একটি বই বের হয়েছে সেটা কি দেখেছেন? কোনটা? মাহবুব কবির সম্পাদিত বইটি। জানালেন, হাঁ সেই বইটা। একজন বললেন, যা তো বড় একটা ছবি আছে ওইটা নিয়ে আয়। আমরা বেশ কৌতূহলী হলাম। উকিল মুন্সীর ছবি কিনা। যদিও জানা ছিল উকিল মুন্সী শরিয়তের বেলায় বেশ কড়া ছিলেন। একতারার বাইরে কোনো যন্ত্রাণুষঙ্গ ব্যবহার করতেন না। যদি তার ছবি থাকে, তবে তা তো বেশ বড় আবিষ্কার। দেখতে পেলাম একজন বড় একটা ফ্রেম নিয়ে আসছেন।
যা দেখলাম তাতে খানিক হতাশা ও খানিক আনন্দ যুগপত হানা দেয়। ২০১২ সালে ‘উকিল মুন্সীর গানের ভেতর বাড়ি‘ নামে একটা লেখা ছাপা হয় দৈনিক যুগান্তরের সাহিত্য পাতায়। এখানে সে লেখার কাটিং বাঁধাই করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে চা-বিস্কুট আসে। আমরা চা-বিস্কুট খেতে থাকি। আর নানা কথায় ডুবে যাই। জানানো হলো, এখানকার গদিনশিন পীর আসরের নামাজে আছেন। এরপর উনার সঙ্গে দেখা হবে।
তিন.
.ধান কাটার মৌসুম চলছে। তার চিহ্ন বাড়ির সর্বত্র। প্রথম দেখায় আলাদা কোনো বিশেষত্ব চোখে পড়ল না। সাধারণ গৃহস্থের বাড়ি। দুইজন ভক্তকে দেখলাম, তারা এ বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা। বারান্দায় হাতলওয়ালা একটা সাধারণ চেয়ারে বসে আছেন বর্তমান পীর সৈয়দ গোলাম মোস্তফা। তার পেছনে দেয়ালে সাঁটানো ওরস শরিফ বা মাহফিলের পোস্টার। সালাম দিলে বসার জন্য সামনে রাখা খাটো টুল দেখিয়ে দেন। হাফ হাতা গেঞ্জি আর লুঙ্গিপরা একজন মানুষ। মাঝে মাঝে আটার দাম বা এ ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন বাড়ির লোকদের সঙ্গে। খুবই সাদাসিধে কথাবার্তা। কিন্তু উনার চোখ দুটি অদ্ভুত। আকর্ষণ করে বা প্রত্যাখ্যান করে। প্রায়শ মনে হয় উনি দূরে কোথাও তাকিয়ে আছেন। এমনকি পরে তার কিছু ছবি দেখেছিলাম, সেখানেও একই বিষয় দৃশ্যমান। এ ধরনের দৃষ্টির সামনে আকস্মিক সঙ্কোচ এসে যায়। পরিবেশকে ভারি করে তোলে।
উনাকে বলা হলো আমরা কেন এসেছি। জানালেন, উকিল মুন্সীর সঙ্গে বেশ ক’বার দেখা হয়েছে। নেত্রকোনা ও হবিগঞ্জ দুই জায়গাতেই। বেশ জোর দিয়ে বললেন, তিনি একজন কামেল পীর ছিলেন।
আমরা জিগ্যেস করি, সাধারণত শুনে থাকি ইসলামে গান জায়েজ নাই। কিন্তু আপনি বলছেন উকিল মুন্সী পীর ছিলেন। এটা কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন। তিনি বলেন, এটা যারা বলে তারা হাদিসকে আশ্রয় করে বলে। কিন্তু হাদিস তো রহিত ও স্থগিত হতে পারে। হাদিসে তো এমন কথাও আছে, রাসূল বলছেন কেমন গান করো নৃত্য আসে না। আমাদের অনুসরণ করতে হবে কোরআনকে। কোরআনে কোথাও নেই গান গাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে ওহাবিরা এসব কথা প্রতিষ্ঠা করেছে।
বোঝা গেল আলাপটা বেশ সিরিয়াস।
তিনি বলেন, গান খুব সহজ কোনো বিষয় নয়। এটা একটা ইবাদত। তবে নফল, সবার জন্য না। যে নামাজ, রোজাসহ পাঁচ মৌলিক ভিত্তির দাবি পূরণ করতে পারবেন তার জন্য গান। অন্যরা যেটা গায়, সেটা গান ওই গান নয়। এটা ইসলামে জায়েজ নাই।
এ প্রসঙ্গে নিজের চর্চা সম্পর্কে বলেন, আমরা শরিয়তের বিষয়ে খুবই কড়া। এখানে নামাজ-রোজা গুরুত্বপূর্ণ। এসব পালন করা না হলে এ লাইনে কোনো মূল্য নেই। মুরিদানের ক্ষেত্রে তিনি খুব কড়া। গত ৩০ বছরে তিনি মুরিদ করেননি। আমরা খলিফা শব্দটি বললে তিনি বলেন এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। এটা একটা পর্যায় মাত্র।
পুরো বিষয়টার মধ্যে আমানত-খেয়ানতের বিষয় আছে, মনে হলো। এটা ঠিক যে, ইসলাম ধর্ম মতে মোমিনের জীবন অনেক ধরনের আমানতদারিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখানে যেমন পীরের শিষ্যত্বের জন্য অনেক শর্ত পূরণ করতে হয়। অনুমান করলাম, গানের নিজস্ব সাধনার পাশাপাশি তাকে পীরের ধারার মধ্যে কতটা কঠিন তপস্যা করতে হয়েছে। এটাকে প্রচলিত অর্থে সমন্বয় বলা কঠিন। কারণ, এখানে গান বাইরের থেকে ধার করা কোনো বিষয় নয়। ইবাদতের ভেতর অন্তর্ভুক্ত একটা বিষয়। মারেফতের ক্ষেত্রে গানের চর্চা তো অনেক পুরনো ব্যাপার। উপমহাদেশে প্রথম দিকের বিখ্যাত সুফিদের শামা গান নিয়ে তো নানা কেচ্ছা আছে। সেখানে ইবাদতের ফর্মেই আমরা গানকে পেয়ে থাকি। অথবা নাচের বিষয়টাও। সাধারণভাবে গানের সঙ্গে এ সম্পর্ককে শরিয়তের দিক থেকে শরিয়তপন্থীরা ও মারেফাতের জয়োধ্বনি গাওয়া গবেষকরা আলাদা করে রাখেন বা আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। বিষয়টা অনেকটা অনালোকিত। আবার নেত্রকোনা অঞ্চলের গীতধারার সঙ্গে স্থানীয় পীরদের সম্পর্ক আছে। কিন্তু উনি যেভাবে শরিয়তি বিধানের কথা বলছেন, সেখানে বিষয়টা বোধহয় ততটা কড়া নয়। এ লেখায় ব্যবহৃত শরিয়তি ও মারেফত পদ দুটি সমাজে প্রচলিত ধারণার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনোভাবে ‘নিজে যা’ অর্থে নয়। এছাড়া মারেফতের অনুষঙ্গ আকারে শরিয়তি মেনে চলাকে সাধনার প্রথম ধাপও বলা হয়ে থাকে।
মারেফতের যেদিকটা আমাদের মতো শহরের মানুষদের আকর্ষণ করে, তার মধ্যে একটা রহস্যের চাদর আমরা খুঁজি। জীবনযাপন ও এ রহস্যময় পরমার্থের একটা ফারাক করা হয়। এ ডাকাডাকির মধ্যে একটি কঠিন দেয়াল যেন জেগে ওঠে। প্রায়শ একে চিন্তার স্বাধীনতা আকারে হাজির করা হয়। এছাড়া শরিয়তি চিন্তা নিয়ে নঞর্থক অনুমান তো আছে। অবশ্য একই বিষয় যারা শরিয়তি তাদের ক্ষেত্রেও। মজার বিষয় হলো, রাষ্ট্র বা প্রায়োগিক ক্ষেত্রে আমরা চিন্তাকে আটকে রাখার চৌহদ্দিকে খারাপ কিছু না ভাবলেও আবার চিন্তার ক্ষেত্রে একটা কাল্পনিক স্বাধীনতার কথা বলি। সে স্বাধীনতা আমাদের কি দেয় সেটা গুরুতর প্রশ্ন। আমাদের প্রথাগত চিন্তায় মনে করা হয়, মারেফতের মধ্যে এমন কাল্পনিক স্বাধীনতা আছে। এর একটা কারণও আছে, শরিয়তপন্থীরা সাধারণত বলে থাকে, আল্লাহকে নিয়ে বেশি প্রশ্ন করা যাবে না। অন্যদিকে মারেফতপন্থীরা আল্লাহকে জানতে চায়। অবশ্য সেটা জ্ঞানতাত্তি্বক কাঠামোর মধ্য দিয়ে না। কিন্তু শরিয়তের সাধারণ প্রবণতায় আল্লাহ প্রশ্নটি এক ধরনের জ্ঞানতাত্তি্বক কাঠামো ধরে চলে। সে প্রসঙ্গে চলে আসে অতি নিচুস্তরের আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক।
আরেকটি বিষয় হলো গান গাওয়ার শরিয়তি অছিলা বাদ দিয়ে গানের শরীরে কী ধরনের পার্থক্য তৈরি সেটা বোঝা দরকার। খেয়াল করলেই দেখবেন, উকিল মুন্সীকে আচার-নির্ভর শরিয়ত ধারার মধ্যে দেখা হলেও তার মেটাফরগুলো বৈষ্ণবীয় ধাঁচের। এটা বাংলার কমন ট্র্যাডিশনের বিষয় হতে পারে, আবার ফারাকের জায়গা আছে এমন অনুমানও সম্ভব। সেটা কি! নাকি আত্মা আর পরমাত্মার সম্পর্ক দেশ-কালের রঙেই নিজেকে রঞ্জিত করে। এ চর্চার মধ্য দিয়েই আল্লাহর দুনিয়ার প্রতিটি ভাষার রূপকল্পের মহত্ত্ব ধরা পড়ে। এভাবে কী চিন্তা বা ধর্ম দেশ-কাল পর হয়ে যায়। কিন্তু আত্মা আর পরমাত্মা কি সব দেশে একই?
শরিয়তি ধাঁচের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সিলেট অঞ্চলের সাধক শিতলং শাহ। তিনি শরিয়তের কঠোর আচারের সঙ্গে বনবাসের মতো তপস্যার যোগ করেছিলেন। তার মেটাফরগুলো এ ধরনের।
চার.
একসময় আসে উকিল মুন্সীর নাতনির প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, আমার সামনে এখানে আলেয়া আর তার স্বামী বসা ছিল। আমি বলি তুমি নারী। আসরে তোমার গান গাওয়া ঠিক না। নারীরা গান গাইবে ঘরের ভেতর। নারীরা পুরুষের সামনে পর্দা করে চলবে। পর্দা হলো শরিয়তের বিধান। মির্জারখিল দরবারে আমরা শুধু নারীদের বোরকা ঢাকা অবস্থায় গাড়ি থেকে নামতে দেখেছি। কিন্তু কোনোদিন কারও মুখ দেখি নাই।
আমরা বিষয় পাল্টে অন্য দিকে কথা তুলি। সৈয়দ মোজাফফর আলীকে নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করি, এটা মানুষের মনের কোন ধরনের অবস্থা (হাল) কেন একজন মানুষ নিজের ঘরের কাছের পীর রেখে অনেকদূরের কারও বায়াত নেন। এ তালাশের প্রক্রিয়া কী! অথবা মানুষের মাঝে পীর তালাশের তাগিদ কী করে আসে। তিনি মৃদু হেসে জানান, এটা এভাবে বোঝা সম্ভব না। যার পীর দরকার হয়, তিনি নিজেই বোঝেন এবং খুঁজে নেন। তবে এটা ঠিক, পীর পেলেই ধরতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সময় নিতে হবে, যাচাই-বাছাই করে তারপর শিষ্যত্ব নিতে হবে। পীর পেলাম আর ধরে ফেললাম, এটা ঠিক না।
যাচাই-বাছাই শব্দটি জ্ঞানতাত্তি্বক হলেও পীর সাহেব কিন্তু আমার কথা ‘কী’ শব্দটিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এর অন্য কোনো রূপ নিশ্চয় আছে, কিছু প্রশ্নও আছে। কিন্তু আমরা যখন উকিল বা অন্য কারও বাণীগুলো পড়ি, তখন জ্ঞানতাত্তি্বক প্রশ্নের চেয়ে অনুভূতির বয়ানটা গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু বয়ান রাধা-কৃষ্ণের মাধ্যমে আসে, তাই বরানটা নারীসুলভ। ফলে এটা জ্ঞানতত্ত্বের মানদণ্ডে নিশ্চয়জ্ঞান আকারেও ধরা পড়ছে না। অনেকটা যেন জানার প্রক্রিয়ার সাধারণ ধরনটা হারিয়ে যায়! জ্ঞানতাত্তি্বক স্থান-কালের বাইরে গিয়ে কি সে আর্তি। এমন হতে পারে- এখানে প্রচলিত ধাঁচের প্রশ্নের ব্যাপার নেই। আরেকটি বিষয় হলো, আমি যখন বলি ‘মনের কোন ধরনের অবস্থা’, এখানে মন গড়পড়তা একটা প্রত্যয় মাত্র। এ ট্র্যাডিশনের মধ্যে মনের ভাগ আছে, তার কাজও আলাদা। তাইলে আমি কোন ‘মন’ নিয়ে বলতে ছিলাম বা কোন ‘মন’ নিয়ে এখানে বসে আছি। কেনই বা থাকি।
প্রসঙ্গে ফিরে যায়। উকিল মুন্সী পীর তালাশ করে এ দরগায় এসেছেন। অন্যদের তালাশের সঙ্গে তার কিছু তো ফারাক তো চোখে পড়ে। ব্যাপারটা এমন ‘যার দরকার সে খুঁজে নেয়’ এ খোঁজাখুঁজির সঙ্গে গান হলে বিষয়টা আমাদের চোখে আরও জটিলতা ধারণ করে। জিগ্যেস করি আপনার দাদাও কি গান করতেন বা আপনাদের ধারার মধ্যে গানের প্রচলন করেন। তিনি বললেন, না। আমাদের কেউ গান করে না।
যেহেতু গান এখানে ইবাদতের গুরুত্বপূর্ণ ফর্ম, উকিলকে পীর বলা হচ্ছে, বিষয়টা গুরুতর। আরও জানতে চাই মাইজভাণ্ডারী প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে সুফি গানের কথা বলতে হলে মাইজভাণ্ডারীকে কেন্দ্র করে যে গানের বলয় গড়ে উঠেছে তা স্বীকার করতেই হবে। তিনি বলেন, মাইজভাণ্ডারীর নিজস্ব একটা হাল আছে, যার সঙ্গে উনাদের কোনো যোগাযোগ নেই। আর বেশি কিছু বলতে চান না। একই বিষয় হবিগঞ্জ শহরের রহস্যময় পুরুষ মাহবুব রাজাকে নিয়ে, কিছু বলতে চান না। মাহবুব রাজা সম্ভবত হাসন রাজার বংশধর। পরে তার মাজারেও যাই। সেখানে একটা শিখা চিরন্তন টাইপ কিছু আছে। ভক্তরা বলে সে আগুন সব সময় জ্বলে। আমরা দেখি সে আগুনে কাঠ দেয়া। হাঁ, কিছু আগুন তো লাকড়ি দিয়ে জ্বালিয়ে রাখতে হয়।
জানা গেল রিচির দরবারের ভক্তদের বড় একটা অংশ নেত্রকোনার অধিবাসী। সৈয়দ মোজাফফর আহমেদ যেমন যেতেন, এখনকার পীর সাহেবও মাঝে মাঝে মুরিদদের সাক্ষাৎ দিতে যান। এখন আর নৌকায় যাওয়া হয় না। যদিও উকিলের গানে নৌকার কথাই আছে। নৌকা যেমন বিরহের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গি করে জড়িত- অন্য কিছু কি হতে পারে! এখন তিনি মাইক্রোবাস করে ভৈরব হয়ে নেত্রকোনা যান। নৌকা থেকে নদীর কথা, পানির কথা আসে। তিনি বর্ণনা করেন এ অঞ্চলের বর্ষার রূপ। তবে তা অতীত। এখন পলি জমে নাব্য হারিয়ে জলভূমি। পরে ভাবতে থাকি- এ পলি কি শুধু জলাভূমিতে জমেছে, নাকি অন্য কোথাও।
এভাবে আমরা বারবার চুপ হয়ে যাই। তিনি স্বগতোক্তির মতো করে কিছু বলেন। কখনও মনে হয় অনেক দূর থেকে কেউ কথা বলছে। আবার মনে হয় আমাদের শিশুসুলভ প্রশ্ন শুনে মজা পাচ্ছেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। তিনি জানান, আমাদের আবার ডাকবেন।
সে ডাকের অপেক্ষা করব বলে আমরা বিদায় নিই। বিকেলের আলো ক্রমশ মুছতে মুছতে আমাদের পথটা বদলে যেতে থাকে। জানি না, বদলে যাওয়া পথের রঙ কতটা সময় এমন থাকবে। হয়তো সে রঙ পাল্টাতেই ভালোবাসে। এর মাঝে কী এমন কিছু খুঁজি কখনও পাল্টায় না, নাকি অন্য কিছু। তখন হয়তো দূরে কেউ গাইতে থাকে অথবা শুনতে থাকে অথবা কারও বুকের কথা ভাষা পায় না-
কত দুঃখ আমার বুকে
দেইখা হাসে পাড়ার লোকে
তর কি নাই কলঙ্কেরই ডর রে বন্ধু
আমি যদি যাই মরিয়া
কে করবে তোরে আদর।।
আহারে কিসের এ দুঃখ। কিসের এ দুঃখ। সন্ধ্যা নেমে আসে।
কৃতজ্ঞতা : -কামাল উদ্দিন, পীর সাহেবের সঙ্গে বেশির ভাগ কথা তারই তোলা। -সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া সাবি্বর, পীর সাহেবের ছেলে। ব্যবহৃত ছবি তার সৌজন্যে পাওয়া।
*লেখাটি আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার শুক্রবার পাতায় প্রকাশিত।
উকিল মুন্সী বিষয়ক আরো লেখার জন্য: উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে।