সারাদিন ঘরে কাটাইয়া হাত-পা-চোখের আরাম দিতে বাইর হইয়া চোখ আটকে গেল উচাঁ উচাঁ বিল্ডিং-র কার্নিসে। শেষ বিকেলের আলোক তরঙ্গে কি সুন্দর চকচক করছে। কত কাছের অথচ দূরের জিনিস। হাত বাড়াইলে নাই টাইপের। আগের দিন মানিকগঞ্জ টু গুলিস্তানের বাসে চাইপা পিছনের যাত্রীদের কথা শুনতে শুনতে ঘুমাইয়া পড়ি। একজন বলে, দেখ চৌদ্দতলা বিল্ডিং। অপরজন গুনে বলে, বারো তলা। আগের জন বলে, নীচে আরো কততলা আছে কে জানে? ঘন্টা দুয়েক পর মাহবুব মোর্শেদের ‘গুরু ও চণ্ডাল’ বইখানা হাতে পাইলাম। ততক্ষণে ভুলে গেছি মাটির নীচের তলার কিচ্ছা।
গুরু ও চণ্ডাল পাঠ করে আরামের খোঁজে যখন বাইর হইলাম গুরু সেলিম আল দীন আর চণ্ডাল মাহবুব মোর্শেদ কোত্থেকে সবকিছূর মধ্যে আইসা হাজির হইলেন। আসলেই হাজির হইলেন নাকি আমি এর মধ্যে তাদের হাজির-নাজির করে ছাড়লাম। তাইলে বলতে হয়, মাহবুব তার লেখায় এতটুকু স্পেস রাখছেন যে, দুনিয়াদারির ঐকতানের মধ্যে তাঁরে দেখা যায়। সেটা কি তার লেখার গুণে না আমার কল্পনা। পাঠকরে কল্পনার-চিন্তার সুযোগ করে দেয়াও লেখকের উত্তম গুণ।
এই দুনিয়াদারিরে একই সুতার মধ্যে দেখন যায়, এমন কথার সুত্রে দেখা যাক মাহবুব কি বলতেছেন। কি বলতেছেন সেটা বর্ণনা করিব না, যা বলিব তাহা চুমুক মাত্র। মাহবুব প্রথম ফ্ল্যাপে জানিয়ে রাখছেন, সেলিম আল দীনরে লইয়া তার পাঁচ-ছয় বছরের অনেক অনেক স্মৃতি আজ গুম-খুনের স্বীকার। তবে যেটুকু মনে আছে তা এই বইয়ে পেশ করেছেন। পেশ করেছেন কথ্য ভাষায়। অর্থাৎ, ভাষার গুনাগুনে তিনি গুরুর চেয়ে ফারাক হচ্ছেন। তার জবানে সেলিম আল দীন তৎসম ও তদ্ভব বহুল লেখা লিখতে পছন্দ করতেন।
গুরু ও চণ্ডালের কথা শুরু হইছে জনৈক ড. মাহবুবকে দিয়া। সেলিম আল দীন তার মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে মাহবুব মোর্শেদকে ড. মাহবুব মনে কইরা দুইবার কল দিছেন। তারপর এই কথা সে কথা ধরে তিনি বললেন, তার লগে সর্বশেষ দেখা বছর কয়েক আগে। মহুয়া উৎসবে। এই ইন্টারেস্টিং হুল্লোড় বাংলাদেশে আর কোথাও হয় বলে জানা নাই। হুল্লোড় সেলিম আল দীনের পছন্দের শব্দ। যাই হোক, সেই উৎসবের পর জীবিত গুরুরে তিনি আর দেখেন নাই। স্মৃতি তাজা হবার মতো কোন জায়গায়ও তিনি যান নাই। ফলে চণ্ডালের চিন্তায় গুরু গুরুপাকেই সজীব। সর্বশেষ মহুয়া উৎসবের কোন বর্ণনা এই বইখানায় নাই (বিলকুল গুম খুনের বিষয় নহে), মাহবুব রাশি রাশি স্মৃতির পসরাকে সাজিয়ে দিয়েছেন পাতায় পাতায়।
মাহবুব মোর্শেদ এর বই গুরু ও চণ্ডালগুরু ও চণ্ডাল কোন কিসিমের পুস্তক? স্মৃতিচারণ, আত্মজৈবনিক এবং তীহ্ম পর্যবেক্ষণের এক ধরণের মাখামাখি। ব্যাপারটা এমন না যে, অমুক অমুক জায়গায় গেছিলাম, অমুক ঘটনা, শুনছি- এই। বরং, তার বাইরের কিছু। সেলিম আল দীন আমাদের মাথার ওপরে সূর্যের মত জ্বলতেছেন। মাহবুব বিল্ডিং-র উচাঁ কার্নিসের আলোটারে নানাভাবে হাজির করতেছেন। এরমধ্যে আলোক তরঙ্গের কি ভেদ আছে তাও বলতেছেন। ফলে তিনি আর সেই তরঙ্গ থেকে আলিদা হয়ে থাকছেন না। তার যদি একটু শিল্প আলোচনার ইচ্ছে থাকে, মনে পড়ে সেলিম আল দীনের কথা। যদি বৃক্ষের লগে কোন বাতচিত হত সেখানে খাড়াইয়া থাকবেন সেলিম আল দীন। তিনি বাংলা সাহিত্য নিয়া কথা কইবেন সেখানেও হাজির হইবেন সেলিম আল দীন। এই খাড়াইয়া থাকা মানে মাহবুবরে ধইরা বাইন্ধা কোন কিছুরে মানাইয়া নেয়া না। বরং, মাহবুবের নিজস্ব আয়না দাড়াইয়া সেলিম আল দীনের মুণ্ডুপাত। এমন চণ্ডালের গুরু হিসেবে সেলিম আল দীন নমস্য। সুতরাং, গুরু ও চণ্ডালের কথা বার্তা শেষমেষ স্মৃতিচারণ না।
মাহবুবের লেখালিখির মধ্যে, ভাবাভাবির মধ্যে রাজনীতি, সাহিত্য নানা কিছু হাজির আছে। তিনি গুরুরে হাজির করেন সেসবের পর্যালোচনাসহ। তাঁর লগে তার যায় আর যাতে দ্বিমত আছে সেটা চমৎকারভাবে প্রকাশ করেন। এই বই মাহবুবের সেই ভাবাভাবির পরিচয় করাইয়া দেয়। একই সাথে লেখালেখির একটা শৈলীও দিচ্ছেন। কথ্য ভাষা। চার ফর্মার এই বইয়ের শেষে দশ পৃষ্ঠায় একখানা সাক্ষাৎকার আছে। সেটা মাহবুবের লগে নিছেন রায়হান রাইন ও সাইমন জাকারিয়া। বাকি পৃষ্ঠাগুলা হইল গুরু ও চণ্ডাল। কোন অধ্যায় ভাগ নাই। বাদ-বিবাদ নাই। সরল ভঙ্গিতে স্মৃতিচারণ ও মনের কথা কওয়া।
এই বইয়ে গোপনীয়তা লঙ্ঘন না করার একটা বিষয় আছে। যেমন মাহবুব কনফেশনের কথা তুলেন। কিন্তু কথাগুলো তুলে ধরেন না। এমনকি যেসব শত্রুর দল সেলিম আল দীনের মৃত্যুতে কান্নাকাটি করছে তাদের নির্বিশেষ করে তুলেন। তাদের নাম পরিচয় ফাঁস করেন না। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে। একই সাথে সেলিম আল দীনের একান্ত বিষয় আশয় নিয়ে কথা তোলেন নাই। কিছু কথা তোলেন। যেমন- ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে থাকতে পছন্দ, মৌলবাদ ও রাজনৈতিক আক্রমণ থেকে দূরে থাকার প্রক্রিয়া, শ্রদ্ধা পাইতে ও দিতে ভালোবাসা। মাহবুব তার চিন্তাগত পক্ষ-বিপক্ষ নিয়া বহু বাতচিত করছেন। কিন্তু বই পইড়া মনে হয় তিনি গুরুর সামনে দাড়াইয়া কথাগুলো বলতেছেন। এই বইয়ে তিনি বাংলা নাটক, সাহিত্য, ছাত্র রাজনীতি ও শিল্পের দায় নিয়ে নানা কথা হাজির করেছেন। সেগুলার বিবেচনার দরকার আছে।
এই তো গেল চণ্ডালের দিক। গুরুর তরফে কি হাজির। মোটাদাগে এই বইয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে আগাইয়া সেলিম আল দীনকে একটা নিমোর্হ বিশ্লেষণের সামনে দাঁড় করাইছেন। যদিও নিমোর্হ কথাটার মধ্যে আমার ফাঁকিবাজি আছে। এখানে ব্যক্তি সেলিম আল দীনের ঘটনা ধরলে একটা বিষয় হলো ঘটনার সত্যাসত্য নির্ধারণ করা। সে অর্থে মাহবুবকে চাপের মুখে ফেলার মতো কিছু নাই। যদি থাকে, তাইলে তা আশে পাশের মানুষের চিন্তার খোরাক হতে পারে। তবে এইটুকু তো সত্য- অনেকে গুরুগিরি করেন, সবাই তো চণ্ডালের ঘাড়ে গুরুরে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব চাপাইতে পারে না। মাহবুব সেলিম আল দীনের মোহের কথা বলেছেন প্রশ্নসংকুল অর্থে। কিন্তু নিবেদন সেইসব প্রশ্নরে ঘাই মেরে যোগ্য নিবেদন বটে।
সুতরাং, সেসব ঘটনা-অঘটনার সত্যাসত্যের বাইরে গুরু ও চণ্ডালের সম্পর্কটাই হয়তো আসল হয়ে ওঠে। কিন্তু মাহবুব যেভাবে তফাত হওয়া হাজির সে অর্থে এটা যতটা না সম্পর্কের অনন্যতাকে ধারণ করে, তারচেয়ে বেশি সেলিম আল দীনরে সামনে রাইখা দুনিয়ায় নিজেকে চিনতে পারার আকাঙ্খা। এই চিনতে পারার মধ্যে দারুন কিছু অনুমান আছে। যেমন উপন্যাস শহরে উদ্ভাবিত জিনিস হইলেও সাহিত্য দিয়া অপরকে আয়ত্ম করার শহুরে মানসিকতা। অপরকে না বুঝে অপরকে বর্ণনার শহুরে কেতা মাহবুবকে বহুত চোট দিসে। কিন্তু এর বাইরে দুনিয়ারে পাঠের বিষয় করার আর কি তরিকা আছে তা প্রশ্ন বটে।
সেলিম আল দীনকে মর্মশাস থেকে দেখার চেষ্টা আছে। সেলিম আল দীনের বলয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিল্প চর্চার চমৎকার চিত্র পাওয়া যায় এই বইয়ে। তফাতে থাকা মাহবুব আপনার জন্য সুখপাঠ্য। কার্নিশে পড়া আলোর মতো অদেখা সেলিম আল দীনের সৌন্দর্য ও দূরত্ব যেন বোঝা যায়। এই তো গেল মাটির ওপরে থাকা সেলিম আল দীন। তিনি লুকাইয়া আছেন কতটুকু। প্রশ্নটা খারাপ না।
মাহবুব বলেন সেলিম আল দীনের লগে মেশার কারণে রাজনৈতিক সতীর্থদের কাছে নানাভাবে তাকে হেনস্থ হতে হয়েছিল। অথচ সেসব রাজনৈতিকতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই এখন তার মনে নাই। সাহিত্য বা শিল্পের দায় বা অ-দায়ভিত্তিক যে সংঘর্ষ এখানে পষ্ট। মাহবুব বলেন, গুরুর লগে যে বাতবিচ তা বিলকুল স্মরণযোগ্য- সেখানে সেলিম আল দীনের দিকটা স্পষ্ট। মাহবুব যেভাবে নিজেকে ক্রিটিক্যাল বলতেছেন, সে দিক থেকে চরিত্র আকারে সেলিম আল দীনকে পাঠ অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ।
* লেখাটি আরটিএনএন.কম-এ পূর্ব প্রকাশিত।
মাহবুব মোর্শেদ হলেন ‘আগেই কইছিলাম…’ টাইপের কলমজীবী
আগেই যদি কইয়া দিতে পারে…। ভালো তো, ভালো না!