কয়েকদিন আগে। একটা বই পড়ার অবসরে দেখলাম, ওই বইয়ের চরিত্রের মতো করে ভাবতেছি। মূলত তারে ভাবতেছিলাম। সঙ্গে নিজেরেও। নিজের অভিজ্ঞতার একটা বোঝাপড়া হইতেছিল। তখন মনে হইল, সেই বইগুলো ‘ভালো’, যেগুলো আমাদের কথা বলতে দেয় বা নিদেনপক্ষে নিজের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া তৈয়ারে সামর্থ্য তৈয়ার করে।
ফলত ওই বইটার লগে লগে, আর যেটা মনে পড়ল। সম্প্রতি মুরাদ কিবরিয়ার উপন্যাসটা আমি নাদানের মতো পড়ছি এবং নিজের লগে কথা বলছি। ব্যাপারটা ও নিজেরে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করছি। নিজেরে নিয়ে ভাবা মানে নিজের সঙ্গে কথা চালাচালি। সঙ্গে দুনিয়ার সঙ্গে একটা অর্থবহ যোগাযোগের চেষ্টা। যেহেতু আমাদের শরীর-মনের মধ্য দিয়ে দুনিয়া প্রকাশিত। এই যোগাযোগ অনেক কিছুরে ফুঁ দিয়ে উড়ায়া দেয়া। বটে।
যেহেতু আমার পড়াশোনা বেশিদূর না, তাই কোনো খতিয়ান তুলে ধরতে পারব না। বাট, আশপাশে যে ভাবসাব দেখি, তাতে মনে হয় যে ঘটনাগুলোর ভেতর দিয়ে ‘নিনাদ’ উপন্যাসের মূল ক্যারেক্টার ‘কুফা রশিদ’ হাঁইটা গেছে, এবং অন্যরা; তার একটা অনন্য ভার আছে বাংলার সাহিত্যে। আমাদের সাহিত্য সচরাচর যে মতাদর্শের বাহক হিসেবে হাজির হয়, সেখানে খোদ রশিদ বা রশিদের দেখা চরিত্রগুলো এভাবে হাজির থাকে না। আবার তার বিস্তার পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ভারত যাইতে পারে; এটা কল্পনার অধিক। এই না বলা বা এড়ায়া যাওয়া বা বলতে চাইলেও মতাদর্শের লাশ বহনজনিত ঘটনার কারণে সেটা আর সম্ভব হয় না।
একইসঙ্গে বাংলাদেশে যেকোনো ঐতিহাসিক উপন্যাস সুনির্দিষ্ট কিছু ইভেন্টকে ঘিরে পাক খায়। সেটা আমরা নাম উল্লেখ ছাড়াই অনুমান করতে পারি। ‘নিনাদ’ একটা গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টে এসে ব্রেক কষলেও সেই সব ঐতিহাসিক ইভেন্টরে পাত্তা না দিয়ে আগায়া গেছে। এবং ‘আবহমান বাংলা’র মতো দেশ বলে যে ধারণা জাহির আছে; তার বাইরে নতুন এক দেশ হাজির হইছে। এই সহজিয়া ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের ভাব-ভাষায় খুব হাজির হলেও সাহিত্যের জগতে তেমন হয় নাই। রশিদের মতো চরিত্রকে বাংলাদেশের মাটির জন্য যে হাহাকার করতে দেখা যায়; যা মানুষের আত্মার ভেতর থেকে আসে। সেই হাহাকারের ভেতর বাংলার মানুষের কোনো ভেদাভেদ নাই। যে মাটি সবাররে আশ্রয় দিতে পারে।
পুরানা কথায় ফিরি। কুফা রশিদের মাধ্যমে দুনিয়ারে বোঝার সুবিধাটা হইলো; কুফা রশিদ যেহেতু একজন উন্মুল, একজন আগন্তুক, একজন নবিশ; তারা পূর্বানুমানের বোঝা বহন করতে হয় নাই। দেশ ধারণার ভেতর, মানুষকে বোঝার ভেতর এইটা পাবেন। ঠেকতে ঠেকতে বুঝতে হইছে তারে, নিজের রূহের মালিকের ওপর আস্থা রাখতে হইছে। পাঠক হিসেবে আমারও সে দশা। না, ব্যাপারটা এমন না যে, আমি ‘সাদা কাগজের’ মতো একটা মন নিয়ে হাজির ছিলাম। বা ইবনে তোফায়েলের উপন্যাসের চরিত্র হয়ে। ব্যাপারটা এমন যে, আমার অভিজ্ঞতা বা ধারণারে একপাশে রেখে কুফা রশিদের দুনিয়াটারে বোঝার চেষ্টা করতে হইছে; উপন্যাসের লেখনির গুনে (এখানে ‘লেখনি’র জায়গায় ‘বয়ান’ চলে আসছিল; কিন্তু মনে হইল, আজকাল অনেক লোক উইচহান্টের মতো করে ফরহাদ ভাইয়ের লগে মিলামিশা করা লোকের ভাষার ভেতর কিছু কমন শব্দ খোঁজে; যাই হোক)। মানে উপন্যাসটা পড়তেছি; নিজের সাথে কথা বলতেছি। পরে সুবিধাজনক সময়ে আগে থেকে যা যা জানি এবং এখন যা যা পড়লাম; তা তা ভাবছি। ফলাফল আনন্দদায়ক ছিল। শেষটাই এমন জায়গায় নিয়ে গেছে; যেখানে মানুষের সাধনা সম্পর্কিত পূর্বানুমানকে প্রশ্ন করেছে।
নিনাদে কুফা রশিদের জীবনের ঘটনাগুলারে কয়েকটা দাগে ভাগ করা যায়। যেগুলা বাংলাদেশের গ্রাম-মফস্বলের লগে জড়িত রাজনীতি, আরেক ভাগে জাতীয় রাজনীতির বামপন্থা চেহারা ও ইসলামআশ্রিত রাজনীতির আন্তর্জাতিক রূপ। এবং জাতীয় রাজনীতি ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ট্রানজিশন পয়েন্টটাকে লোকেট করে। আছে কিছু নারী চরিত্র; যারা দীর্ঘশ্বাস বাড়াইতে সাহায্য করে। এর সঙ্গে আছে মানুষের দার্শনিক অভিযাত্রা। কীভাবে তার অভিজ্ঞতার জগত ক্রমশ বিস্তৃত হয়, চিন্তার বিমূর্তায়ন ঘটে। এবং এমন কিছু যারে আমরা ইনটুশন বলি; ব্যক্তির জীবনে তার প্রভাব। জ্ঞান থেকে প্রজ্ঞার জগতে মানুষের উত্তরণ। সবচেয়ে বড় জিনিস হইলো, এই সবের আগে মানুষের জীবনে কিছু থাকে; যেটা কোন একসময় জীবনের সঙ্গে ফিট হয়া যায়, এড়ানো যায় না; তার আভাসও মেলে। তবে মানুষ যে এমন একটা মানুষ হইতে চাই; যার মধ্যে সাধারণ কিছু চাওয়াতে তার শান্তি। এমন ‘অসাধারণ’ চাওয়াটাও আছে। এবং নিনাদ অনুরণন ছাড়াইতে থাকে!