ধুর!! কার মুখ দেখে বাসা থেকে বের হলাম।’
দ্বিতীয়বারের মতো বললেন সুমন ভাই। আমি সবুজে নীল জলের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম। কারো চেহারা মাথায় আসলো না।
সুমন ভাইয়ের সাথে লঞ্চে পরিচয়। আমার মতো একই ভুল করেছেন। তবে তার আফসোসের সীমা নাই। নিজের দেশে কিনা ভুল করলেন। তার বাড়ি জাজিরা। আমার খুবটা আফসোস হচ্ছে না। তাড়াও নাই।
সকাল ছয়টার আগে বাসা থেকে বের হলেও বাতাস তখনো যথেষ্ট গরম। মনিং শো’জ দ্যা ডে। বাসযাত্রা শুরু হয়েছিল ফুল আর গাছ দেখতে দেখতে। খুব বেশি না চিনলেও ঢাকার পথের ধারে কৃষ্ণচুড়া, রাধাচুড়া, কাঠালচাঁপা, সোনালু ও জারুল দেখে সকালটা অন্যরকম সুন্দর হয়ে গিয়েছিল।এসব দেখতে দেখতে সকাল সাতটার মধ্যে পৌছে গেছি গুলিস্তান। খাসীর পায়া দিয়ে পরোটা আর চা খেয়ে ভিআইপি নামক বাসে মাওয়া ঘাট। সাথে শুরু হলো চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। মোটামুটি একটানেই পদ্মার মাওয়া ঘাটে পৌছে গেলাম। এইখান থেকে ঐপাড়ে যাবার লঞ্চ ও স্পিডবোটের ব্যবস্থায় আছে। স্পিডবোটের ভাড়া লঞ্চ থেকে কয়েকগুন বেশি। আগেই ঠিক ছিল যাবার সময়টা স্পিডবোটে, ফেরার পথে লঞ্চ।
মাওয়া ঘাট কিযে অদ্ভুত নীলে টইটুম্ভুর। জলে নীলের ছায়া অন্যরকম লাগছিল। তার উপর কড়া রোদ। পুরো দৃশ্যটা এতো সুন্দর যে আমি রীতিমত আত্মাহারা। মনে হচ্ছে এটাই কোথাও যাওয়ার ভালো দিন। যদিও পরবর্তী দুটো দিন রোদেই খৈ ভাজা হইছি। এটা তত আনন্দের ছিল না। আমাদের নামার কথা ছিল শরিয়তপুর কাঠালবাড়িঘাটে। কিন্তু আরো খানিক পথ এগিয়ে চলে আসি কাওড়াকান্দি। মাওয়া ঘাটে কাওড়াকান্দি লেখাটা আমাকে এতই টানছে যে, মনে হলো কাওড়াকান্দি যাবার জন্যই আমার এই জীবন। এমন কি স্পিডবোটওয়ালাকে যখন বললাম শরিয়তপুর যাবো। সেও যেন আমার বিহ্বলতায় আচ্ছন্ন। ব্যাপারটা পুরোপুরি তা নয়, টাকা হিসেবে নিয়ে তাদের মধ্যেও গণ্ডগোল ছিল। এই ফাঁকে একজন পথ না চেনা যাত্রীর উপর দুযোগের ঘনঘটা।
বছর তিনেক আগে যখন শরিয়তপুর গিয়েছিলাম মাঝনদীতে এসে হঠাৎ মনে হলো কূল কিনারা নাই। অথৈ সাগরে ভাসছি। যেদিকে তাকাই পানি আর পানি।সেদিন আর নাই। যেদিকে তাকায় স্থল। পানির কথা বলছিলাম- ফেলে আসা বুড়িগঙ্গার সাথে এই জলের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এ যেন সীমাহীন জলের বিস্তারে নিজের দেখার আস্পর্ধা। আকাশের মতো প্রশস্ত হতে চাই বলে হয়তো আকাশে আমার হয়ে জলে ছায়ার বিস্তার ঘটায়। মাঝনদীতেই দুইবার স্পিডবোট বিকল হলো। পাশে দিয়ে যাচ্ছে ফেরি, লঞ্চ, স্পিডবোট নানান জাতের নৌযান। একসময় দুটো চরের মাঝখান দিয়ে যেতে হয়। এই চর দেখলে মনটা কেমন করে। মনে হয় অনন্তকাল সবুজ ঘাসে বসে থাকি, শুয়ে থাকি। চর যাপনে এখনো কোন বন্ধুকে রাজি করাতে পারি নাই। খুব বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকি। ভালো লাগে।
মিনিট বিশেক পর কাওড়াকান্দি এসে নামি। পানির বোতল কিনতে কিনতে দোকানিকে জিজ্ঞেস করি শরিয়তপুরের বাস ছাড়ে কোন দিক থেকে। তিনি জানান, আমি ভুল জায়গায় এসে পড়েছি। এইখান সড়ক পথে গেলে অনেক ঘুরতে হবে। ভাড়াও বেশি পড়বে। সহজ রাস্তা হলো আবার লঞ্চ ধরা। আমার ভয় হলো আবার লঞ্চে উঠলে না মাওয়ায় চলে যাই। উনি বললেন, সে সম্ভাবনা নাই, যদি লোকাল লঞ্চে উঠি। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লোকালের লঞ্চের খোঁজ করি। পেয়েও যায়। উঠার পাঁচ মিনিটের মধ্যে লঞ্চ ছাড়ে। তখনই সুমন ভাইয়ের সাথে পরিচয়। মেহমানদারির শুরু। তিনি বারবার আফসোস করছিলেন। আমি আফসোস না করে জলের দিকে তাকাই। তখন মনে হলো ভুল করি না। ধীরে চলা লঞ্চ থেকে পানি খুবই সুন্দর দেখায়। তীরঘেষে চলছে। দেখতে ভালোই লাগে।
তীরের উঠার আগে চরে যে জিনিসটা চোখে পড়ে (আসলে আমার মনে ছিল)- এইখানকার বাড়ির প্যার্টান। আমি নতুন কোথাও গেলে বাড়ির প্যার্টান খেয়াল করার চেষ্টা করি। শরিয়তপুরের মতো এমন বাড়ি আর কোথাও দেখি নাই। সাধারণ টিনের তৈরি দোতলার মতো বাড়ি। উপরের তলা নিচের দিকের চেয়ে ছোট। পলকা ভাব আছে। টিনের উপর কালো কাঠের জোড়। এমনকি পাকা দালানেও এমন ডিজাইন চোখে পড়ে।
এরমধ্যে সুমন ভাইয়ের সাথে অনেক গল্প হলো। এক ফাঁকে আরেকজন জানালেন এই লঞ্চ শরিয়তপুর ঘাটে (মাঝির হাট) থামবে না। থামবে কাঠাঁলবাড়ি। আমি আগে যখন এসেছিলাম তখন কাঠাঁলবাড়ি ছিল মূল ঘাট। এখন ঘাট মাঝির হাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নগদ ফল হলো এখান থেকে শরিয়তপুরের বাস পাবো না। সুমন ভাই জানালেন হোন্ডায় করে কিছু পথ গেলে বাস পাওয়া যাবে। কিছুটা বিরক্ত হলাম। সে দরাদরির মামলা। যা আমি একদম পারি না।
ঘাট যে এখন নাই তা ঢের বুঝা যায়। জুতা ভিজিয়ে পাড়ে নামতে হলো। উপরে এসে দেখি সুমন ভাই আমার জন্য দাড়িয়ে আছেন। জানালেন, পথঘাট চিনি না এই হেতু আমি চাইলে তার সাথে যেতে পারি। বললেন তার বাড়ি জাজিরা পর্যন্ত একত্রে হোন্ডায় যেতে পারি। তারপর বাসে বাকি পথ যেতে পারব। জাজিরা পর্যন্ত আড়াইশ টাকায় হোন্ডা নেয়া হলো। উনি আমাকে পচিঁশ টাকা দিতেই দিলেন না।
জেমস ওয়াইজ নামের এক ইংরেজ সিভিল সার্জন ঢাকার বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণের মানুষের উপর একটা ডকুমেন্ট লিখেছিলেন ১৮৬০ সালের দিকে। নোটস অন দ্যা রেসেস, কাস্টস এণ্ড ট্রেডস অব ইস্টার্ন বেঙ্গল নামের সেই ডকুমেন্টে পূর্ববাংলার এই অঞ্চলকে জলাময় বলে বর্ণনা করছেন। তখন এটি ছিল ফরিদপুর জেলার অধীনে। এইখানে জম্ম হাজী শরিয়ত উল্লাহ, দুদু মিয়া ও তীতুমীরসহ অনেক বীরনায়কের। যদি হাজী শরিয়ত উল্লাহর নামে কিন্তু জম্ম-মৃত্যু দুইই পাশের জেলা মাদারীপুরে। মাদারীপুরের শিবচর পাড় হলাম হোন্ডায়।
ওয়াইজের কথার স্বাক্ষী আজো চোখে পড়বে। হোন্ডায় যেতে যেতে চোখে পড়ে শুকিয়ে যাওয়া খাল-বিল ও নদী। কিছু নদীতে সামান্য পানি আছে। এর একটা হলো কীর্তিনাশা। এই অঞ্চলের রাস্তাঘাট যা আকাঁবাকাঁ। গাড়ি চালকদের জন্য খারাপ আর কি। প্রচুর ব্রীজ আর কালভার্ট চোখে পড়ে। জলের সাথে এদের সম্পর্ক জানান দেয়।
জাজিরা এসে বুঝা গেল সহজে বাস মিলবে না। এদিকে সিটিং ননস্টপের ট্রাডিশন আছে। সুতারাং, আবার হোন্ডা যাত্রা। এবার যাবো প্রেমতলা। এর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দুরত্বে শরিয়তপুর শহর। সহজে গাড়ি মিলবে।
এবার বিদায়ের পালা। সুমন ভাই জানালেন তার চাচাতো ভাইয়ের নাম সুজন। আমি জানালাম আমার জ্যাঠাতো ভাইয়ের নাম সুমন। মায়া এমনেও লাগতে পারে। জানি, ধন্যবাদ দিয়ে কিছুই করা যাবে না। বার বার তাকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি বাড়িতে যাওয়ার দাওয়াত দেন। কখনো সুযোগ পেলে তা হয়তো ঘটবে। হোন্ডায় চড়তে চড়তে মনে পড়ে অগণিত মানুষের কথা। যারা নানান সময় এমনিভাবে পথে সাহায্য করেছে। চলতি হোন্ডা থেকে দেখলাম সুমন ভাই বাড়ির পথে রওয়ানা দিয়েছেন।
বন্ধুরা, আপাতত এখানে বিদায়। পরের পর্বে জানাবো শরিয়তপুরের বন্ধুরা আমায় কি কি দেখিয়েছেন। যদিও তারা আশ্বস্ত করে বলেছিল দেখার কিছু নাই। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি, একটা নতুন জায়গায় দেখার মতো কিছু না থেকেই পারে না।
ধুমাইয়া ঘুইরা বেড়াইতাছেন
আরে না! মাসে একটা ভ্রমন ম্যানেজ করা কিযে কষ্টকর।
একটা নতুন জায়গায় দেখার মতো কিছু না থেকেই পারে না।
শুধু থাকা দরকার একজোড়া দেখার মত চোখ।
😛 দেখার কিছু থাকবেই।। শুকরিয়া।
সৃজনশীল মানুষের-
চোখের ক্ষুধা মিটলেও মনের ক্ষুধা মেটে না।
😛