আয়নাবাজি ও অবশিষ্ট

‘আয়নাবাজি’র শুরুর দৃশ্যে একটি লাশ দেখা যায়। হাসপাতালে। লাশটা কার? পুরো সিনেমা বিছড়াইয়া তার হদিস পাই নাই। দুইজনকে জিজ্ঞেস করে দুই ধরনের উত্তর পাইলাম। এবেলায় ‘লাশের রাজনীতি’র দিকে পা না বাড়াইয়া স্মৃতির আয়নায় ‘আয়নাবাজি’র অবশিষ্ট দেখা যাক!

সিনেমাটার মূল চরিত্র আয়না (চঞ্চল চৌধুরী)। সিনেমায়ও তিনি অভিনেতা। যার অভিনয়ে বুঁদ হয়ে দর্শক হয়ত গল্পে না থাকা বিষয়গুলা নিয়ে ভাবতে ভুলে যায়। গুণতে থাকে কয়টা চরিত্রে অভিনয় করছেন তিনি, সেই ‘পরিসংখ্যান’। অথবা হাততালি দিতে দিতে সিনেমা শেষে তারা সেলফিতে গুরুত্ব দেন।

আয়নাবাজির প্রধান কয়েকটি চরিত্র- চঞ্চল চৌধুরী, লুৎফর রহমান জর্জ, পার্থ বড়ুয়া, গাউসুল আলম শাওন ও মাসুমা রহমান নাবিলা

আয়নাবাজির প্রধান কয়েকটি চরিত্র- চঞ্চল চৌধুরী, লুৎফর রহমান জর্জ, গাউসুল আলম শাওন ও মাসুমা রহমান নাবিলা

পরে যখন ভাবতে বসি আয়নাকে নিয়া। সে কেন এমন? যিনি বাচ্চাদের নিয়া অভিনয়ের নাটক চালান। যে নাটকের রিহার্সাল দেখা যায় বারবার— ‘তাসের দেশ’। সাধারণত পুনপুন সংঘটিত নাট্যালাপে রেশ সংশ্লিষ্ট সিনেমায়ও থাকে। তবে এ সিনেমায় থাকে নাই বোধহয়! যদি না আয়নার সংশ্লিষ্ট সমাজের ভেতরকার রূপ হিসেবে ধরতে ব্যর্থ হতাম। হয়তো বর্তমানের গল্প, যে বর্তমান এত এত কাঁচা— ‘কোথায় পাবো তারে’। তাই ‘তাসের দেশ’ শুধুই নাটক ও নন্দন। সমসাময়িক অবস্থার বর্ণনা, পর্যালোচনা বা আয়নাবাজি নয়।

বাচ্চাদের স্কুলে দেখানো একটা দৃশ্য মুগ্ধ করবে। আয়না যখন তার ছাত্রদের অভিনয়ের গভীরে নিয়া বলেন, তীব্র শীত লাগছে। তারা তা অনুভব করতে পারে। এটাই হয়ত শিল্পনিষ্ঠার ভেতরকার পাঠ। এই দেখতে হয়ত কখনো কখনো আমরা সিনেমা হলে, থিয়েটারে বা মঞ্চে ঢুঁ মারি। ‘আয়নাবাজি’তেও কি আমরা তা আশা করি?

শিল্পনিষ্ঠা হইলে হয়ত আরাম লাগে। এমন হইলেও আয়না কেন কয়েদির অভিনয় করে তা বোঝা যাইতো। সে কি অপরাধীর ভেতর জীবনের কোনো অর্থ উদ্ধার করে? কিন্তু তা দেখা যায় না। সে কি টাকার জন্য করে? প্রথমবার টাকার জন্য করে তা জানা যায়। পরে? সে কি মানুষের রূপ বদলানোর কোনো ঘটনায় প্রতারিত? তার উত্তর নেই। আর শেষবার কেন করে তা জানা যায়। বাধ্য হয়ে। এমন ক্লাইমেক্স দরকার ছিল। যাতে ব্যাপারটা সিনেমা সিনেমা লাগে! লাগেও।

ঘুরে-ফিরে সেই আয়না— যে কোনো ধরনের টানাপোড়ন ছাড়াই অন্যের হয়ে জেল খাটে। কেন খাটে জানা যায় না। যদি জানা যেত হয়ত সিনেমাটা আমাদের প্রশ্নে ফেলত। হয়ত এ সমাজ-সংসার নিয়া অস্বস্তিও হইতো। আবহমান ‘বাংলা সিনেমা’ এটা করে বলে ‘চকচকে বাংলা সিনেমা’ করবে না— ব্যাপারটা এমন না। তাইলে হয়তো কেউ কেউ বিনোদন সমেত ‘আয়নাবাজি’র অবশিষ্টে আক্রান্ত হইতো। এর জন্য আমাদের কার্ল মার্কস, হেগেলও পড়া লাগে না। স্রেফ যদি জানতাম আয়না কেন এমন?

ঘটনা কি এই— প্রশ্নহীন একটা সিনেমা আরামদায়কভাবে দেখা যায় সেটাই স্বস্তি। ঢাকার সিনেমায় এমনিতে দড়কিবাজি পছন্দ করা লোকের বিনোদনের অভাব! আর দড়কিবাজির সঙ্গে প্রচারণার কলা-কৌশলও যথাসম্ভব বন্ধুত্ব রেখে চলে। এ সিনেমা তার সফল উদাহরণ।

অমিতাভ রেজা, পরিচালক

অমিতাভ রেজা, পরিচালক

সিনেমায় বাঙালি মুসলমান ফিল্মমেকার একটা কারণ দেখাইছেন এমন— আয়নার মা, যিনি যাত্রা অভিনেত্রী ছিলেন। মৌলবাদীদের কারণে তাকে হেনস্থা হতে হয়। তার ক্যান্সার উপশমের জন্য আয়না জেলখানার বদলির কাজ বেছে নেন। মায়ের মৃত্যুজনিত বিড়ম্বনায় ব্যাপারটা এখানেই মিটতে পারত, মিটে নাই।

আয়নাকে আমরা স্রেফ অভিনেতা বানাইয়া রাখতে চাই যদি—আইডিয়াল অর্থে। যে অর্থে আমাদের চারপাশে শিল্প-সংস্কৃতি বিরাজ করে বলে ভাবি। এ বদলির কাজে শিল্পনিষ্ঠার সে লোভ-লালসার পরিচয় পাইলাম না। শিল্পী সত্ত্বা দর্শক চায়, তার কারিগরির প্রতি সুবিচার চায়, হাততালি চায়, প্রশংসা চায়, আরো বৃহত্তর দিকে যাইতে চায়। আয়না কোথাও তা চায় না। তাইলে আয়না কী স্রেফ অনুকরণ করে? একটা রোবট! যদি শিল্প হয়, তার পরম্পরাও নাই।

এমন প্রশ্ন সত্ত্বেও এ গল্প আমরা বিশ্বাস করতে চাই। জেলে আসামি পাল্টানোর ঘটনার বাস্তব ভিত্তি আছে। ভেলকি দেখানোর গল্পের কারণে সে বিষয়ের পাশ কাটাইয়া আরেকটা সম্ভাবনা দারুণভাবে ছিল। চমৎকার হরর গল্প হওয়ার সম্ভাবনা। হরর হইলেও আমরা এ লজিক অবশ্যই আশা করি চঞ্চলের ক্যারেক্টার পাল্টানোর পর মাসের পর মাস তার চুল দাড়ি কেমনে একই থাকে। কখনো চুল একদম ছোট করে কাটা, কখনো পাক ধরা বা পাকা দাড়ি সমেত। না হরর নয় এ গল্প। শোনা যাচ্ছে ‘আয়নাবাজি’ পলিটিক্যাল থ্রিলার!

চঞ্চল চৌধুরী ও মাসুমা রহমান নাবিলা

চঞ্চল চৌধুরী ও মাসুমা রহমান নাবিলা

প্রথাগত সিনেমায় দর্শকদের মাঝে নায়কের জন্য সিম্প্যাথি উৎপাদন দরকার পড়ে। এখানে আয়নার ক্যারেক্টারের কোনো ব্যাখ্যা নাই। আবার যেহেতু তিনি নায়ক তাই সিম্প্যাথির দরকার। তখন মায়ের মৃত্যুজনিত একটা আলটপকা কারণ হাজির করা হয়। নানান কিসিমের অপরাধ করা সত্ত্বেও সাংবাদিক সাবের (পার্থ বড়ুয়া) তাকে বারবার বলছেন ‘নিরাপরাধ’। প্রোটোগনিস্টের ‘নিরাপরাধ’ হওয়ার দায় নাই। সে ক্রিমিনাল হলেও আপত্তি কে করে? সে রিস্ক নিয়া শাহরুখ খান কতগুলা সিনেমায় খলনায়কের পার্ট করছেন! ওই সব সিনেমার নায়ক কেমনে কার্যকারণে হাজির ছিল দর্শক মাত্রই জানে।

অথবা অপরাধীকে এ তরিকায় নিরাপরাধ বানাইতে গেলে অন্য খারাপ চরিত্রগুলো একই ধরনের স্পেসের দাবি করতে পারে। একইসঙ্গে ‘নিরাপরাধ’ আয়নার লগে অপরাধবোধের সম্পর্কের জোরালো কোনো সূত্র নাই। না থাকাতেই বোধহয় আয়নারে খারাপ বানানোর ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। শেষতক হলিউড টাইপ সমাপ্তিতে আমরা খুশি হলাম। কথাটা ‘টাইপ’ কিন্তু হলিউড নয়। হলিউড সিনেমায়ও এমন সম্পর্কহীন সমাপ্তি পাবেন না। সাপের লগে বা নেকড়ের লগে মানুষের প্রেম হোক!

প্রথমদিকে শোনা যায় ‘আয়নাবাজি’ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। হতেও পারত। বাট রূপবদলনো সাইকোলজিক্যাল নতুন কী ফ্যাক্টর আমদানি করে অস্পষ্ট। পরে এক সাক্ষাৎকারে, অমিতাভ বললেন ‘পলিটিক্যাল থ্রিলার’। এখানে পলিটিকস কই? দুই-একজন পলিটিক্যাল ফিলোসফারের নাম আছে বলে!

সিনেমার ট্রেইলারে অমিতাভ একটা সংলাপের জাদু দেখালেন। সাঈদ নিজাম চৌধুরী, যিনি আবার খুবই টিপিক্যাল জায়গায় গিয়ে ফাঁসলেন। অতি চেনা স্কুল মাস্টারকে খুন করার অভিযোগ। স্কুল মাস্টাররা এখন মূলত বিজ্ঞাপনে ভালো টিন বোঝাবুঝির কাজটাই করেন! তারপরও নেতা খারাপ, স্কুল মাস্টার ভালো। তো, জানাইলেন ‘রাজনীতি হলো সবচেয়ে বড় অভিনয়’। এ মাল আমরা খাইতে খাইতে এখন সকল ভালোত্বের দায় পড়ছে বিদেশের সুশাসনের উপ্রে। কর্পোরেশন এখন বিশুদ্ধ পানি থেকে সমাজ বদলানোর হাতিয়ার। খারাপ রাজনীতির সমান্তরালে দেখানো হয় আওলা-ঝাওলা সাংবাদিক। খুবই ক্লিশে রাজনীতি-সংবাদমাধ্যমে বর্ণনার মধ্য দিয়ে আয়নাকে হাজির করা হল! ভাগ্যিস চঞ্চল ও পার্থের অভিনয়ে দর্শক হাসানোর উপাদার ছিল তাদের অভিনয়, সংলাপে। হাততালিও পেয়েছেন।

গাউসুল আলম শাওন ও চঞ্চল চৌধুরী। শাওন এ সিনেমার কাহিনীকারও।

গাউসুল আলম শাওন ও চঞ্চল চৌধুরী। শাওন এ সিনেমার কাহিনীকারও।

দৃশ্যগতভাবে দেখলে ‘আয়নাবাজি’র লোকেশনগুলো সুন্দর। আকাশে উড়াউড়ি করা ড্রোন দিয়া ঢাকা শহরের সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখানো হলো। এর সঙ্গে পুরো সিনেমার কাহিনীর সম্পর্ক কোথায়? মানে দৃশ্যগত অর্থে সামগ্রিক একটা অর্থ আশা তো করা যায়। একটার পর একটা দৃশ্য আসে— তা জোড়া দিলে আমরা কী পাবো। যেমন আয়নার একটার পর একটা কাণ্ডের ব্যাখ্যা নাই। এ শহর কী তবে আয়নার মতো? সে ইঙ্গিত কোথায়? এমন কী দৃশ্যগুলো কোনো কথা বলে না। সংলাপ দিয়ে বোঝাতে হয়।

এ সিনেমায় ঢাকা শহর নিয়া একটা গান আছে। ওইটা অর্ণবের করা। শুনতে ভাল লাগে। এ গানের ভিডিও শেয়ারের লগে ফেসবুকে অমিতাভ ঢাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা পোস্ট দেন। তো, এ গান শুনে পরিচালকের অনুভূতিটাই সিনেমায় জাগ্রত হলো। নস্টালজিক ব্যাপার। এ অনুভূতি আয়নার না।

বাজার-সদাই নিয়া একটা গান আছে। গানটির ইউটিউব ভার্সনে কণ্ঠ দিয়েছিলেন শান। তার তীক্ষ্ণ গায়কী ও ঝাঁ চকচকে ভিজ্যুয়ালে একটা বিজ্ঞাপনী চমক ছিল। সিনেমায় একই গানে অর্ণবের গলা জমেনি। যতটা জমেছে ঢাকা নিয়ে গানে।

চিরকুটের গানটা দৃশ্যগতভাবে চমকপূর্ণ। জেলখানা ও বাইরের দুনিয়াকে একসঙ্গে দেখিয়ে আরাম দেন। বিশেষ করে গানের শেষ দিকে চঞ্চলের অদ্ভুত অভিব্যক্তি থাকে— যা ধারাবাহিকতা আশা করে, অথচ সিনেমার অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। (শুধু নাবিলার গানে যা একটু হুশ ফিরে!) এ গান ও জেলখানা নিয়ে দার্শনিক একটা সংলাপের কথা বলে। যেটা অমিতাভের সাক্ষাৎকারে পড়া। জেলখানায় কয়েদি থাকে না। অর্থ পরিষ্কার না হলেও চকচকে নিঃসন্দেহে। যেমন— জেলখানায় বদলির দরকার আছে। চঞ্চলের মতো ‘নিরাপরাধ’রা জেলখানায় থাকেন, আর ‘অপরাধী’রা বাইরে। তাইলে কি এ অবস্থার পরিবর্তন নিয়ে কথা বলে ‘আয়নাবাজি’? যে অবস্থায় একটা পালানোর দৃশ্য দর্শক বুঝছে কিনা— তা পরখ করার জন্য নির্মাতাকে অনেক কসরত করতে হয়, নানা কায়দা দেখাতে হয়। দর্শকের অবুঝ বলেই হয় এমন!

লুৎফর রহমান জর্জ ও চঞ্চল চৌধুরী

লুৎফর রহমান জর্জ ও চঞ্চল চৌধুরী

এছাড়া ‘ধীরে ধীরে’ রোমান্টিক ট্র্যাকটি আরামপ্রদ। যেমন অভিনয় ভালো লাগে। আর মানানসই আবহ সঙ্গীত। পরিপাটি সেট আরামদায়ক, যখন যা লাগে পাওয়া গেছে। মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি, রোদ্দুর, নদী, নৌকা, হাওয়াঘর, বাজার— কিছুই বাকি ছিল না। যেমন আকাশ-বাতাসে মন খারাপের ভাব না থাকলে আপনার মন খারাপ হবে না। তেমনি আয়নার ভেলকিবাজি ছাড়া ‘আয়নাবাজি’ হওয়া সম্ভব না।

বাজার বিবেচনায় চলতি বছরে কৃষ্ণপক্ষ, সুইটহার্ট, শিকারি, নিয়তি, রক্ত, মুসাফিরের পর আরেকটি দর্শকপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র পাওয়া গেল ঢালিউডে। আর ধৈর্য ধরে লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

*রিভিউ এর শিরোনাম সুভাষ দত্তের চলচ্চিত্র ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ থেকে অনুপ্রাণিত।

**বানান.স্পেসে পূর্ব প্রকাশিত।

Comments

comments