জোকারের রাজনীতি

টড ফিলিপস পরিচালিত ‘জোকার’ সিনেমায় হোয়াকিন ফিনিক্স

মাল্টিপ্লেক্সে ‘জোকার’ দেখছিলাম। একটা দৃশ্যে জোকার আর্থার পুরোনো ক্ষোভ থেকে নৃশংসভাবে সহকর্মীকে মেরে ফেলে। ঘটনাস্থলে থাকা খর্বাকৃতির অন্য সহকর্মী মনে করে তাকেও মেরে ফেলবে। ভয় পেয়ে মানুষ কত কিছুই না করে! দর্শক হিসেবে গা শিরশির করারই কথা সাধারণত। অথচ আশপাশ থেকে থেমে থেমে হাসির আওয়াজ আসছিল। যদিও আর খুন করে না জোকার। কারণ ওই মানুষটি আকারে ছোট হলেও মনে বড়!

প্রশ্ন আসতে পারে, মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া মানুষের ভয় দেখা কী হাসির? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে ট্র্যাজেডি আর কমেডির ফারাক আমরা ভুলে গেছি। শুধু শিল্পের খাতিরে! উল্টোভাবে, বাস্তব হলো সিনেমা হলের বাইরে ঘটে তারই অনুরূপ কিছু। এখন প্রশ্ন হলো, মানুষ খুন কেন করবে? অজুহাত হিসেবে স্রেফ ন্যায়যুদ্ধ বা প্রতিশোধ। নিশ্চয় না। বিনোদনও নিশ্চয়। নইলে খুনের পদ্ধতিতে এত এত কারিশমা কেন বা কিছু কিছু খুনে মানুষ আনন্দ পায় কেন। এবং এই দর্শকরাই হয়তো বা কেউ কেউ আনন্দ-সহযোগে খুনের বিচার যখন চায় তখন বীভৎস কায়দায় খুনের কথা বলে! তারা মূলত খুন করার কথাই বলে। প্রতিশোধ বা ন্যায় বিচার হলেও আগের খুনের সঙ্গে পরেরটার প্রতিস্থাপন করা যায় না। তাহলে জোকারের কাজ কী এই?

পপ কালচারের এই অ্যান্টিহিরোর সঙ্গে ড্রাকুলা বা ফ্রাংকেনস্টাইনের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যারা পশ্চিমা সমাজের ভয়গুলোকে জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে তুলে ধরেছে। তাদের রীতিমতো উদ্‌যাপন করা হয়। তবে জোকার বা সার্কাসের সঙকে হাসির পাশাপাশি ভয়ের প্রতীক আকারে দেখা অনেক পুরোনো ঘটনা। শেক্‌সপিয়ারের নাটকে পাবেন বুদ্ধিমান কিন্তু বোকার বেশ ধরে রাখা চরিত্র। যারা অনেকটা জোকারের মতো দ্ব্যর্থক। সাম্প্রতিক সময়ে স্টিফেন কিং-এর জনপ্রিয় উপন্যাস ‘ইট’ সার্কাসের জোকারকে ভয়ের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে। এই চরিত্রগুলো ভয়কে উদযাপন করলেও বরাবরই নিজের কাল্পনিক সমাজের তুলনায় বিদ্যমান অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলে। সেই সব প্রশ্ন আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না।

কিন্তু পপ কালচারের অন্য চরিত্রের সঙ্গে জোকারের পার্থক্য আছে। তার ক্ষেত্রে নায্যতার প্রশ্নটি আলাদা। জোকারের এই উপলব্ধি গুরুত্বপূর্ণ যে, একসময় জীবনকে ভেবেছিল ট্র্যাজেডি, আসলে তা ছিলো কমেডি। অর্থাৎ, তীব্র বেদনা ও কৌতুক এক জায়গায় মিশে গেছে। সেটা হলো মানুষের জীবন। যখন দর্শক হাসে তখন জোকারকে হাসতে দেখা যায় না। সিনেমার শেষে যখন নৈরাজ্য চূড়ান্ত অবস্থায় যায়, নিজের ঠোঁটে রক্ত মেখে হাসির ভান করে। অর্থাৎ, গোথাম শহর শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুহূর্তে এই মনোভাব। যখন শাসনযন্ত্র জনগণের গলায় ফাঁসের মতো চেপে ধরে। তখন যে মূলত কাঁদতে ভুলে যায়, হাসতে থাকে-প্রলাপ বকে। প্রথা মাফিক হাসি-কান্না এক অর্থে পুরোনো প্রতিষ্ঠানকে জিঁইয়ে রাখা। কিন্তু সে নিজে নিজে ভেঙে পড়ে। জোকার উপলক্ষ মাত্র?

এখানে জোকার বা তার মতো আরও যারা, তারা বিদ্যমান সমাজ নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তোলে। একে সারানো যাবে না মনে করেই নাস্তিবাদী ভূমিকা নেয়। তার স্বাস্থ্য, পোশাক- কোনোটিই সাধারণ মানুষের না। সম্ভবত তার আকার, সাজ-পোশাক ভীষণ কৌতূহলের বিষয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভয়েরও। কিন্তু বাস্তব জীবনের দুঃখ-দুর্দশার বাইরে তো সে নয়। একটা দ্বৈত অবস্থায় তার মূর্তমান থাকা। ফলে তাদের চারদিকে এক ধরনের অস্পষ্টতা থাকে। এদের সুখী সুখী অবয়বে দেখা গেলেও প্রশ্ন থাকে- আসলে কি তাই? এই বিষয়টি প্রতিটি মানুষেরই। কিন্তু সেটা সমাজে খুবই অস্বাভাবিক। জোকার চোখে আঙুল দিয়ে বিষয়টি দেখিয়ে দেয়। সময়ের বিভ্রান্তিগুলো তাদের জড়িয়ে ধরে, যাকে আমরা তার ওপরই পর্যবসিত করি। এ কারণে হরর আর হিউমার এক হয়ে যায়। ব্যক্তিতে প্রকাশিত স্ববিরোধকে আরও বড় জায়গা থেকে দেখতে হয়- যা মূলত সমাজিক সমস্যা। যখন নিজের ভারে সে ভেঙে পড়ে।

জোকার সিনেমার নাস্তিবাদীতায় সৃষ্ট দুটো ভয় আমাদের ঘিরে ধরে। একদিকে যেমন বিপুল ভয় গ্রাস করে, অন্যদিকে রয়েছে ‘নেতৃত্বহীন’ একটা আন্দোলন। সম্ভবত সমাজে সব মানুষ নিজ নিজ খেয়ালে চলবে- এই ভয় মানুষের অনেক দিনের। যা সহসা স্বেচ্ছাচারে পর্যবসিত হওয়ার ভয় তার। এ কারণে কোনো কোনো অবস্থায় খারাপ শাসনকে আমরা তুলনামূলকভাবে মেনে নিই। এমনকি চরম ফ্যাসিবাদী সময়েও একটা অনুমিত কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত দেখলেও এতটা হতাশ হই না। এরপর জোকার যখন ক্ষোভ প্রকাশ করে- পুরোনো ব্যবস্থাকে উল্টে দেওয়ার। এটা হয়তো কল্পনায় সুখকর, কিন্তু বাস্তবিক নৈরাজ্য ভীষণ ভীতিকর। কারণ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

সেই দিক থেকে ‘জোকার’ সেজে থাকা বা এর ‘ধারণা’ সাংঘাতিক ব্যাপার। আপাতভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেখলেও সে আরও গভীরে হানা দেয়। যার ওপর বর্তমান গণতান্ত্রিক কাঠামো সেই সামাজিক চুক্তি মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করে। ‘মানুষ স্বভাবত খারাপ’ এই অনুমানের ভেতর দিয়ে হবস-লক-রুশোর মারফত সামান্য তফাতের ভেতর দিয়া চুক্তির ধারণাটা আলাদা আলাদাভাবে আমরা পাই। জোকারের মতে, এই চুক্তির ফলে মানুষ প্রকাশ্যে (সমাজ সমর্থিত) ভালো কাজ করে। আর গোপনে সুযোগ পেলে অন্যের মাংসেও তার অরুচি নেই। মানুষের এই অবস্থা তার কাছে হিপোক্রেসি। শুধু তা-ই নয়, বিদ্যমান সমাজ সবার তরে ভালো এমন উসিলা দিয়ে কিছু লোককে ‘খারাপ’ ট্যাগ দিয়া মেরে ফেলে। বিচারেরও মুখোমুখি করে না। প্রতিবাদ তো দূরের জিনিস, একই রকম খবর বারবার মিডিয়ায় উৎপাদিত হয়। ঘটনা একই, শুধু ভিকটিমের নাম-পরিচয় আলাদা। এভাবেই ভাবা যায় সামাজিক চুক্তির আগে অন্তত কিছু জিনিস ছিলো না- জনগণের নামে সমাজ বা রাষ্ট্রের সম্মতিতে অনাচার ও অপরাধ ছিলো না। এই অনাচারের রক্ষাকবচ হিসেবে থাকে রাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ, আইন ও জাতীয় চেতনা। তো, যে মানুষ ‘স্বভাবত খারাপ’ ও ‘স্বার্থপরতা’র কারণে সামাজিক চুক্তি করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করছে বলে যায়, সেই মানুষ ওই চুক্তির দোহাই দিয়া খুন-খারাবি করছে। যেন বলি দিয়ে সমাজ শুদ্ধ হচ্ছে! এই ভাবনা মধ্যে মানুষ সম্পর্কিত আগাম অনুমানে কি গড়মিল নেই? এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে স্বার্থপরতার পথে ঠেলে দেয় না?

এমন সমস্যা ছাড়াও জোকারে জটিলতা আরও আছে। এই ব্যবস্থাগুলো যখন ফ্যাসিবাদী বা জাতীয়তাবাদী ধারণার মধ্যে চালিত হয় আমাদের দেখাদেখি মূলত বাইনারি। ভালো বা মন্দ, সাদা বা কালো, বন্ধু বা শত্রু- এভাবে ভাগাভাগি। উল্টো দিকে জোকার মানুষকে স্বরূপে বিচার করতে বলে। যেখানে জাহের-বাতেনের ভাগাভাগি করা চুক্তি থাকবে না। জোকারের মুখোশটাই দেখুন- যখন সে কাঁদছে মেকআপ বলছে হাসছে। এমনকি অসুস্থতার কারণে যখন সে হাসি থামাতে পারে না- সেটা অন্যরা মেনে নিতে পারে না। অসুস্থ, উন্মাদের ঠাঁই নাই এই সমাজে। উন্মাদের অন্তর্দৃষ্টিও সামাজিক চিন্তার অংশ। তো, একপর্যায়ে বাইনারি সিস্টেম কলাপস করে। এই পরিস্থিতিতে মানুষ আরও বেশি আত্মসচেতন ও রাজনৈতিক হয়ে উঠে।

কিন্তু রাষ্ট্র কেন এমন বাইনারি জায়গায় থাকে? তার নিশ্চয় অনেক কারণ থাকে। যেখানে একটি সভ্যতার শুরু আর শেষ আছে। জোকারের সময়ে রাষ্ট্র আর কল্যাণমূলক জায়গায় নাই। একের পর এক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দুর্নীতিবাজ আমলা, রাজনীতিবিদ, পুলিশ ও ব্যবসায়ী। সরকার মূলত তাদের স্বার্থ দেখভালের ঠিকাদারি করে। হ্যাঁ, জনকল্যাণের বাস্তবতা ততটুকুই, যতটা ঠিক করে দেয় করপোরেশন।

এখানে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা আসলে নেতৃত্ব তৈয়ার হতে না দেওয়া। যাতে করে কোনো পরিস্থিতিতে মানুষ এক না হতে পারে। কিন্তু মানুষের স্বভাব হলো একত্রিত হওয়া। বিপদের সময় গায়ে গা লাগিয়ে উত্তাপ নেওয়া। তখন মানুষগুলো আলাদা আলাদা হয়েও একত্রে থাকে। তাদের মাঝে নৈরাজ্য তৈয়ার হয় বলে দাবি করি। জোকার আমাদের নেতৃত্বের ইশারা দেয় না। কিন্তু এখানে যে সংহতি আছে- তার নাম কী? এরা বরং বিদ্যমান পক্ষগুলোকে ধ্বংস বা নির্মূলের কথা বলে। আগেই বলেছি, এটা যেন সেই আত্মবিধ্বংসী সিস্টেম যা নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলছে। জোকার সেই সিস্টেমের অংশ। সে থাকে বলেই হয়তো নতুন কিছু করার কথা ভাবতে হয়। কারণ ন্যায্যতা তো তখন পরিপূর্ণ হয়- যখন সমাজের একদম প্রান্তিক জায়গায় তার আলো পৌঁছায়। কিন্তু এমন সময় তো আসে তখন গরিব, প্রান্তিক মানুষদের অস্বীকার করাই রাষ্ট্রের মূল চরিত্র হয়ে উঠে। মিডিয়া তাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে। যা ওই সিস্টেমের নিজেরই আত্মঘাতী প্রবণতা।

শুরুর কথায় ফিরি। সিনেমাটি দেখা সংবেদনশীল মানুষের জন্য আসলেই কষ্টকর। কারণ সিনেমার বাস্তবতা থেকে সহিংসতাকে আলাদা করা যায় না। কখনো কখনো মনে হতে পারে- সহিংসতার গ্লোরিফাই করা হচ্ছে। কিন্তু একটু ধৈর্য ধরলে দেখা যায় বিষয়টা আমরা মেনেই নিচ্ছি। না, ব্যাপারটা এমন নয় যে- সিনেমার সহিংসতা আমাদের কাছে স্বাভাবিক হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। বরং এর মাধ্যমে বাস্তবতাকে আমরা আড়াল করতে পারি। সহজভাবে নিতে পারি। প্রতিনিয়ত বৃহত্তর কল্যাণের নামে নানান কায়দায় মানুষ খুন হচ্ছে, সমাজ ধ্বংস হচ্ছে, রাষ্ট্র ক্ষয়ে যাচ্ছে- এগুলো সিনেমার চেয়েও বীভৎস। সিনেমার নেতিবাচক দিক হলো বাস্তবতাকে মেনে নিতে শেখায়। বলতে চায়- জোকার না হওয়ার। এখানে (অ্যান্টি)হিরোর কাজকর্ম জাস্টিফাই হয় এভাবে, সমাজের প্রতি তার কোনো দায় নেই। আসলে বলতে চায় দায় আছে। অর্থাৎ, জোকারকে যদি সিরিয়াসভাবে না দেখি, ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে- তার মতো সহিংসতা আমরা চায় না।

আদতে রাষ্ট্রই বরং এর চেয়ে বেশি সহিংস। যার কারণে সততায়ও লাগাম পড়ে। এই অসহায়ত্বকে আমরা বারবার অস্বীকার করি, তখন জোকার মুখোশ পরে তা তুলে ধরে। এখন প্রশ্ন হলো জোকার যদি এই বিদ্যমান ডিলেমাকে ভাঙতে পারে, আমরা কোথায় যাবো? কোনো নেতৃত্ব নেই, প্রতিশ্রুতি নেই। আসলে কি তাই! মানুষ তো লড়তে লড়তেই শিখছে। এই জায়গায় হয়তো আমরা বর্তমান বাংলাদেশকে রেখে ভাবতে পারি।

Comments

comments