খোদা নিয়ে আমার এই ভাবনা পুরোনো। তবে কোথাও টুকে রাখছি কি-না মনে নাই। একটা বইয়ের ভূমিকা পড়তে গিয়া আবার মনে হলো। যেখানে লেখা, “শুরুতে তাঁরই গুণগান করি, দ্বীন-দুনিয়ার মালিক, খোদা সকল প্রশংসা তোমার। পরসমাচার হজরত শাহ আলী’র (র:) নাম নিয়ে এই বহির প্রস্তাব রাখলাম।” তো, এই পড়াপড়ির মধ্যে খানিকটা ভুল বোঝাবুঝির শিকার হইছিলাম। মিরপুরের হজরত শাহ আলী’র (র:) বদলে পড়ে ফেলছিলাম হজরত আলী (র:)।
যা বলছিলাম। ভাবনাটা হলো- বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে খোদারে পাওয়া যায় কি-না! পাওয়া যায় নিশ্চয়। নইলে খোদারে না পাওয়ার পাশাপাশি কেউ কেউ কীভাবে দাবি করেন এই সূত্রে খোদা পাইছেন। এবং ওই পাওয়ার মধ্যে ধর্মের যুক্তির চেয়ে বুদ্ধির প্রতি আস্থাই তো বেশি। অন্তত দর্শনের বুদ্ধিবাদী ইতিহাসটা দেখতে পারেন। সেখান থেকে হয়তো মনে হইতে পারে- একটা চিন্তা পদ্ধতি বা সূত্র দিয়ে জগতরে ব্যাখ্যা করতে গিয়া যখন আর কুলায়া উঠতে না পেরে আমরা- তখন খোদার ধারণার মুখোমুখি হই। যেমন ডেকার্টের সত্তার ভাগাভাগির ধারণার মীমাংসাটা আসলে কী? ওই খোদাই। বা হেগেলের ‘খোদা’ কী? আরও পেছনে ফিরলে অ্যারিস্টটলের খোদা ব্যাপারটা কী?
বাট, যুক্তির ‘খোদা’ দিয়ে ধর্ম হয় না। এর পেছনে সম্ভবত এমন ব্যাপার হইতে পারে এই ‘খোদা’ যুক্তিশীল সত্তার চিন্তার একটা অংশ হয়ে আবির্ভুত হয়। যিনি ওই ব্যক্তির চিন্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটা নিয়া বুদ্ধিমান মানুষের গর্ব থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নাই। সীমিত আকারে বলা আরকি, কারণ ব্যক্তি তো তার ইতিহাসের অংশ। যদি না তিনি ‘হাই ইবনে ইয়াকজানের’ মতো কেউ হন। (রবিনসন ক্রুসো না, তার লগে একটা বাইবেল কিছু কিন্তু!) তো, এভাবে আবিস্কৃত চিন্তার মধ্যে ‘দৃশ্যত’ ওই খোদার কোনো হস্তপেক্ষ নাই। তার হাজিরানা একটা কাঠামোর শূন্যস্থান পূরণ মাত্র। এর বদলে ধরেন পরম কোনো কণা। কণার বদলে খোদা! এমনও হইতে পারে এই মহাজগতকে অনন্ত নৈরাজ্য বা দ্বৈতচয়িত বিষয় আকারে না দেখার চেষ্টা। দুর্বল চিত্তের ওপর ভর করে নৈরাজ্য নিয়ে চিন্তা করলে আমারে তো পাগলই হয়ে যেতে হবে।
এক অর্থে খোদার দিক থেকে তাদের দেওয়ার মতো কিছু লাগে না। এরা যে চিন্তাশীল সত্তা হইছে- এটাই যথেষ্ট। এমনকি কার্যকারণপুষ্ট এই জগতে খোদা হস্তপেক্ষের ক্ষমতাও হারান। এ দিক থেকে খোদা থাকার প্রক্রিয়াটা খোদা থেকে জারিত না, উল্টা দিক থেকে।
এ দিক থেকে এ ধরনের চিন্তার জন্য দার্শনিকও হওয়া লাগে না। উইলিয়াম পেলের বিখ্যাত ‘টেলিওলজিক্যাল’ যুক্তি আছে না- যেখানে বলা হইতেছে মরুভূমিতে বেড়াতে গিয়া আপনি একটা ঘড়ি দেখতে পাইলেন। তো, আপনি এতো বোকা নন যে ভাবতে শুরু করবেন- এটা এমনি এমনি এখানে আছে। বরং কখনো না কখনো এটা কেউ বানাইছে। কারণ এর নিখুঁত ব্যাপার-স্যাপার এই সাক্ষ্য দেয়। বা দুনিয়াবি অভিজ্ঞতা দ্বারা এটা আপনি জানেন। তেমন এই নিখুঁত ও নিয়মবদ্ধ এই দুনিয়াও কেউ না কেউ বানাইছে। সেটা হলো ‘খোদা’। মানে এভাবে অভিজ্ঞতারে বিশ্লেষণ করে ‘খোদা’ পাওয়া সম্ভব। খেয়াল করেন ঘড়ির নির্মাতা যেভাবে ঘড়ির মধ্যে থাকেন না নিছক নির্মাতা হিসেবে তার উপস্থিতি অনুমান করা যায়। তেমনি খোদাও এই জগতের মধ্যে নাই। আছে দূরে দূরে! তাইলে এই খোদার লগে বাতচিতের কোনো ব্যাপার নাই আসলে। হ্যাঁ, আপনি যদি প্রকৃতিরে বোঝার ভেতর দিয়া মনে করেন এক ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে। তাইলে, ‘ওকে’। কিন্তু খোদার দেখা পাইতেছেন না। হয়তো কোনো শৃঙ্খলিত উপায়ে যুক্তিরে বানানো যাচ্ছে না- এটা ভেবে নিতেন পারেন- জগতের শৃঙ্খলার স্বার্থে একজন স্বাধীন চিন্তাশীল মানুষ উপরওয়ালা বলে কেউ একজন আছে ভেবে নিতে পারেন। কিন্তু এটার পক্ষে থেকে সত্য-মিথ্যা ভেদের কোনো দরকার পড়ে না। একইভাবে সঙ্গতিবিধানের এই খোদাকে এভাবে অতিবর্তী না ভেবে অন্তবর্তীও ভাবা যায়। যা আমার লগেই মিশে আছে- যুদা আছে! যা আমাদের অনেক ক্ষমতার প্রকাশ বটে!
তাইলে আমরা কীসের কথা বলছি। সেটা হলো- খোদার পক্ষ থেকে নিজেরে খোদা বলে দাবি! সেটা কেমনে? যতদূর জানি, সেটা ঘটে নব্যুয়তের মাধ্যমে। এ কারণে নবির দরকার পড়ে। যারা ভেড়ার পালরে পথ দেখান। পবিত্র বানীই শুধু পবিত্র রে জানাইতে পারে। এমনকি আমাদের ঈমান বা আস্থা বারবার পরীক্ষার সম্মুখীন হইলেও এখানেই ফিরে আসতে হয়। এটা ঠিক যে ‘খোদা’ সম্পর্কিত যে ধারণাগুলো আমরা আবিষ্কার করি বলে ভাবি, সেটা যে ইট-কাঠ বা স্বয়ং আমির মতো করে প্রমাণের বিষয় নয়। ‘খোদা’ নামডাক বা শব্দের ভেতর একটা সংজ্ঞা বা অর্থ লুকায়া আছে। সেটা কখন কীভাবে ইতিহাসে হাজির হইছে- সেটা নিয়াও ভাবতে পারি। এটা দিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি এই যে গ্লাস আছে, ‘খোদা আছে’ বলে যে প্রশ্ন- তা কি এক? নিশ্চয় না। তো, এখানেই নব্যুয়তের ব্যাপারটা আসতেছে। তার ব্যাখ্যাটা হয়তো হাজির হচ্ছে একটা পুরোনো ভাষাগত পাঠাতনের উপর থেকে। কিন্তু অর্থ পাল্টায়া যাচ্ছে। কিন্তু বলা হচ্ছে- খোদ খোদার কাছ থেকে। তো, এই খোদারে জারি রাখা সহজ হয়তো। আস্থার জায়গা থেকে। বাট, ভাবতে ভাবতে আমরা যে সিদ্ধান্তে যাইতেছি- সেটা আমার মধ্যে আবদ্ধ শুধুই। সেই ‘ধারণার খোদা’ না থাকা অর্থে কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি নাই। এমনকি যুদ্ধি-বুদ্ধি কারো কারো ক্ষেত্রে ‘খোদার থাকা’ অর্থকে ‘নেগেশন’ হিসেবে বিবেচনা করে! আমাদের অন্যান্য বোঝাপড়ার মতো নয় বলে।
যাই হোক, এই সব নিছকই ভাসা ভাসা কিছু কথা। এই বেলায় কথাগুলো শেষ করি। হজরত আলী (রা.) প্রসঙ্গ কেন আসলো? মাঝে মাঝে কারো কারো কথায় দেখি- মহানবীর (স.) খোঁজ নাই- আলীর (র.) প্রতি ভক্তি বেশি দেখানোর চেষ্টা। কেমন যেন অদ্ভুত লাগে? হজরত আলীর (র.) প্রতি আমার অসম্মান নাই, থাকার প্রশ্নও নাই। বাট, আল্লাহ যখন নিজের থাকার বিষয়টা বলেন, তা নবীকে পাঠানোর ওহির মধ্যেই তো বলেন। এটাই মাথায় আসলো আরকি!