কাফকার অনশন শিল্পী

একজন অনশন শিল্পীর জীবন ও শিল্প নিয়ে রচিত ফ্রানৎস কাফকা (জুলাই ০৩, ১৮৮৩- জুন ০৩, ১৯২৪)-র এক অনশন শিল্পী গল্পটি। এই গল্পের মূল শিরোনাম Ein Hungerkünstler. ইংরেজীতে ‘আ হাঙ্গার আর্টিস্ট’ ছাড়াও বিভিন্ন নামে গল্পটি অনুদিত হয়েছে। এটি কাফকার বিরল লেখাগুলোর একটি, যেটি তিনি বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে পুড়িয়ে ফেলতে বলেন নাই। এটি শুধুমাত্র বিষয়ের ব্যাপ্তি ও দার্শনিকতার কারণে নয়, পাঠকের সাথে গল্পটির সম্পর্কও এর অন্যতম কারণ। কারণ ইতিমধ্যে ১৯২২ সালে একটা পিরিওডিক্যালে ছাপা হয়ে গল্পটি পাঠকদের কাছে পৌছে গেছে। পরবর্তীকালে আরো তিনটি গল্প সমেত একই নামে মলাটবদ্ধ হয়। সব পাঠকই যদি তার ইচ্ছেমত বইটি পুড়িয়ে ফেলত হয়ত তিনি খুশি হতেন। কিন্তু দুনিয়াবাসী হারাত অমূল্য রত্ম।

গল্পটি কাফকার প্রথাগত হেয়াঁলির উৎকৃষ্ট নির্দশন। এই গল্পে আমরা দেখতে পাই শিল্পের প্রতি নিবেদিত একজন অনশন শিল্পীকে। একজন মানুষের দিনের পর দিন না খেয়ে বেঁচে থাকা ইউরোপে দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শনীর বিষয় হয়েছিলো। একটা খাঁচার মধ্যে অনশন শিল্পী থাকতেন। তাকে ঘিরে রাখত উৎসুক জনতা, ম্যানেজার ও পাহারাদার।

আমাদের এই শিল্পীর অনশনের মেয়াদ চল্লিশ দিন। চল্লিশ দিন মানব ইতিহাসের নানা ঘটনা ও তপস্যার সাথে জড়িত। এখানে চল্লিশ দিন কেন? কারণ অনশন শিল্পীর ম্যানেজারের ধারণা চল্লিশ দিনের পর কোন বিষয়ে মানুষের কৌতুহল আর জারি থাকে না। অনশন শিল্পী জানেন চল্লিশ দিন কোন সময়ই না, প্রায় অনন্তকাল তিনি অনশন করে যেতে পারবেন। তার ইচ্ছে অনশনের দাগ দেয়া সময় টপকে যাওয়া, যদিও প্রতিবার প্রায় জোর করে তার অনশন ভাঙ্গানো হয়।

ইউরোপে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধোত্তর এমন সময় আসে যখন অনশন আর শিল্প বিলাসিতা নয়। ক্ষুধা ও দারিদ্রতা তখন ইউরোপের দৈনন্দিন বাস্তবতা। সেই বাস্তবতার তোড়ে হারিয়ে যায় অনশন শিল্প। কাফকার গল্পের শিল্পী একক পরিবেশনা জৌলুশ হারিয়ে ঠাঁই নেয় সার্কাসের খাঁচায়। সার্কাসের খাঁচায় না থেয়ে কতদিন কেটে যায়- কেউ জানে না, খবর রাখার প্রয়োজনও মনে করে না। এমনকি, অনশন শিল্পী নিজেও ভুলে গেছেন সময়জ্ঞান। কিন্তু পাঠকের অপেক্ষা পুরায় না। যে ইউরোপের মানুষ খেতে না পেরে মারা যায়, সেখানে অনশন শিল্পীর সত্য ভিন্ন। তিনি দেখতে পান এই জগতে খাবার মতো কিছু নাই। এমন কিছু নাই, যা দেখলেই চেটে পুটে খেতে ইচ্ছে করে।

কাফকার এই গল্পে নানান মাত্রার হেয়াঁলি আছে। যে ইউরোপিয়ান সভ্যতা পুরো দুনিয়াকে চেটেপুটে খেতে চায়- পুরো দুনিয়াকে নিজেদের ক্ষমতামত ভাগ ভাটোয়ারা করে নিয়েছে, তার বুকে বসে একজন বলছে এই দুনিয়ায় আসলে খাবার মতো কিছু নাই। নাই বলে সে খুঁজে না এমন না। বরং না খাওয়ার ভেতরই আছে সৌন্দর্যকলা। অনশন শিল্পী মরণকালে তার অতৃপ্তির কথা যাদের বলেন, সাক্ষি মানেন, তাদের মধ্যে তা কোন ভাব জাগায় না। হয়তো এটাই ইউরোপ। তারা অপেক্ষা করে চিতাবাঘের। যে চিতা বাঘটির ঠাঁই হয় অনশন শিল্পী খাঁচায়। উদরপূর্তি করে কাঁচা মাংসখেকো বাঘ সবাইকে আকর্ষণ করে। সবাই আগ্রহ নিয়ে তার কীর্তি দেখে। সবাই ভুলে যায় অনশন শিল্পীকে। অনশন শিল্পী সভ্যতার গ্লানি হয়ে যেন স্মৃতির আস্তাকুড়েতে ঠাঁই পান।

অনশন শিল্পী জীবন ও শিল্পের সীমানাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। এমন এক জীবনকে ইঙ্গিত করে – যেখানে শিল্প নিজেকে দুলঙ্ঘনীয় রহস্যের আবরণে জড়িয়ে রাখে। যে জীবনে আমরা রহস্যের দ্যৃতি খুজিঁ। রহস্য বলার ছলে রহস্যের বাসনারই উম্মোচন। মানুষময় রহস্য অথবা রহস্যময় মানুষ। মানুষ তাকে ভালোবাসে বলেই হয়ত রহস্য জাগায়। কিন্তু তার বাইরে সাধারণ-বিশেষ আর বোঝা- না বোঝা গল্প আছে। ফলে সাধারণ্যের ভেতর বিশেষকে হারিয়ে যাওয়াকে ব্যাখ্যা করে এই গল্প। একই সাথে সহসা অব্যাখ্যাত এই বিশেষ শিল্প নামে সাধারণের জগতে হানা দেয়। ফলে প্রতিটি ক্ষুধার্ত মুখকে অনশনকারীর সামনে হাজির করলে চলে না। একজন অনশন শিল্পী আর ক্ষুধার্ত মানুষের তফাত অনেক।

জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মানুষ বেঁচে থাকে। সেটা হোক নিত্যবাসনায় অথবা শিল্পে। এই বেঁচে থাকা কতটা আলাদা। কাফকা তার গল্পে হেয়াঁলির পর্দা ছড়িয়ে দেন, টানেন ভেদ ও অভেদের দোলাচালে। নাকি কাফকা কোন একটা মুখোশ পড়ে হাজির হন। শিল্প আকারে অনশন হয়ত গল্পের উপলক্ষ্য মাত্র (ক্ষয়রোগের কারণে কাফকা নিজেও সেই সময় প্রায় কিছুই খেতে পারছিলেন না, যেমন একই বইয়ের প্রথম গল্পের সার্কাস দলের ট্রপিজ শিল্পী- যিনি দড়ির উপর থেকে কখনো নামেন না, এমনকি ট্রেনে চললেও মালপত্র রাখার জায়গায় উঠে বসে থাকেন।

শিল্পের সাথে সাধারণ মানুষ ও মিডিয়ার সম্পর্কের দিকটি উম্মোচনে এই গল্পটি একটা পর্যালোচনা দাঁড় করায় বলে কোন কোন পাঠক মনে করেন। আজকের মিডিয়ার নিজের প্রয়োজনেই নানা মানবিক কাহিনিকে তার দর্শকদের  সামনে করুনরসে পরিবেশন করেন। মানবিক ট্রাজেডি ফ্রেমের ভেতর ততক্ষণই উপস্থিত থাকে, যতক্ষণ তা বিপননযোগ্য। এরপর মিডিয়াও ভুলে যায়, আমজনতাও ভুলে যায়। যেমন- বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া রানা প্লাজার ট্রাজেডি। এই পাঠকেরা চিহ্নিত করেন ট্রাজেডির বিপনন ও বিনোদনের সাথে মানুষের প্রবৃত্তিগত খারাপ খাসলতটিই উম্মোচিত হয়। আপাত যা খুবই বিপর্যয়কর ও শোকাচ্ছন্ন তার মর্মে সাধারণ মানুষ পৌছতে পারে না। এখানে পাঠকের দিক থেকে একটা হেয়াঁলি উপস্থিত। কেন না, যে নিজের খাসলতের অস্পর্শ্যতার কথা বলে তাকেই আক্রমন করছে।

এই বিবেচনাকে উহ্য রেখেও দাবি করা যায়, জীবন আর শিল্পের প্রান্তিক যে রেখাটি আমরা রাখি তা এই গল্প ধূসর করে দেয়। প্রশ্ন তোলে চিরনবীন সখাসখি শিল্প আর জীবনের সম্পর্ক কি? শিল্পের জগত কি অর্থে শুদ্ধ বা যাপন থেকে আলাদা অথবা শিল্প জীবন থেকে কি করে মর্মশাঁস চুরি করে নেয়। নিলেও বা কতটুকু। কাফকার এক অনশন শিল্পী গল্পটি সেই বোধ নিয়ে চির দ্বন্ধমুখর এক পাঠাতনের সামনে আমাদের হাজির করে। অনশন শিল্পী যিনি একটা নিখুঁত অনশনের জন্য অপেক্ষা করছেন- যা আপাতত শিল্পী অর্থে সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির বিষয়। আবার একই সাথে এর ভেতর জীবনের প্রশ্নটা কি! সেটা হাজির হয় যখন সে খাওয়ার মতো কিছু না পাবার কথা বলে। সেটা চলমান সভ্যতার সমালোচনাও বটে। কিন্তু সাধারণভাবে যেকোন শিল্পের এই বিরল মুহুর্তগুলো সমাজের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে গড়পরতা ঘটনা আকারে হাজির হয়। শিল্প-শিল্পী ও ভোক্তার সম্পর্কের ফারাকটা বুঝা যায় না। ফলে শিল্পটুকু সময়ের মাঝে তলানি হয়ে শিল্পীর জন্যই পড়ে থাকে। ফলে এক অনশন শিল্পীকে মৃত্যু স্বাভাবিক।

কাফকার হাজির করা দ্বন্ধ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের। যার উত্তর কোন নিরেট বাক্যের মধ্যে হাজির নাই। তবে মানুষের এই শিল্পকাতরতা ও যাপনের সংকটের পেছনে চলার দরকার আছে। নইলে কি শিল্প ধরা দেয়! এ যেন ঝলকানি দিয়ে হারিয়ে যাওয়া। আমরা ভাবি কোন একটা জায়গায় গেলে হয়তো এর ভেদ সাফ হবে- তাই তার পিছু পিছু চলতে থাকি।

হদিস:

এক অনশন শিল্পী- ফ্রানৎস কাফকা, অনু: মাসরুর আরেফিন, ঢাকা, পাঠক সমাবেশ, ২০১৩।

*লেখাটি ২০১৩ সালের। এখানে অপরিবর্তিতরূপেই প্রকাশিত।

Comments

comments