শিশুশিক্ষা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করা বই

নেদারল্যান্ডসের শিশুরা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নাকি সুখী! জাপানের মানুষ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নিয়মানুবর্তী! আর বাংলাদেশের শিশু, মানুষ? তিন বাঙালি বাবা-মা তিন দেশে তাদের শিশুসন্তানের শিক্ষা নিয়ে যে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন তারই এক সহজ-সরল স্মৃতিচারণমূলক উপস্থাপন ‘তিন ভুবনের শিক্ষা: জাপান, নেদারল্যান্ডস, বাংলাদেশ’। এই বইটি প্রতিটি বাঙালি বাবা, মা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য। এই বই শিক্ষা নিয়ে ভাবেন, কাজ করেন এমন সকল মানুষের জন্য। কথাগুলো আছে তানজীনা ইয়াসমিন, তানবীরা তালুকদার ও রাখাল রাহা রচিত বইটির ব্যাক কাভারে। যার সঙ্গে দ্বিমত করি। বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা অভিভাবক না হওয়া সত্ত্বেও ‘তিন ভুবনের শিক্ষা’ যে কাউকে ভাবতে বাধ্য করবে। এটাই বইটির সার্থকতা।

তিন ভুবনের শিক্ষা : জাপান, নেদারল্যান্ডস, বাংলাদেশ
লেখক : তানজীনা ইয়াসমিন, তানবীরা তালুকদার ও রাখাল রাহা প্রকাশক : শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলন (শিশির)
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৯
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সব্যসাচী মিস্ত্রী, মূল্য : ৩০০ টাকা

এক. 
বইটির জাপান অংশটি লিখেছেন তানজীনা ইয়াসমিন, শিরোনাম ‘প্রতিটি শিশু এক-একটি ফুল, প্রতিটি ফুলই স্বতন্ত্র’। উচ্চতর ডিগ্রি নিতে দূরপ্রাচ্যের এ দেশে যান লেখিকা। ভিসাজনিত জটিলতার কারণে সন্তান জন্মের সময় স্বামীকে কাছে পাননি। আত্মীয়হীন পরিবেশে ল্যাব থেকে হাসপাতালে, সন্তান তোতনকে নিয়ে বাড়ি ফেরা, আবার ল্যাবে যোগ দেওয়া রূপকথার মতোই মনে হয়। এরপর ডে কেয়ার থেকে সন্তানের উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পার হওয়া পর্যন্ত বলে গেলেন প্রাঞ্জলভাবে। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা সাজানো-গোছানো, নিয়মানুবর্তী। সৃজনশীল, আবার (আপাতভাবে) কঠোরও। বাচ্চাদের একই ধরনের পরিবেশ দেওয়ার চেষ্টা, নানান ভেদ মুছে দেওয়ার চেষ্টা আছে। আছে বাচ্চাদের নিজের কাজ নিজে করে বেড়ে ওঠার চর্চা। বিদ্যমান অবস্থা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার সজীব চেষ্টা  আছে। এখানে শিক্ষাকে শুধু বই মুখস্থ নয়, আরও বড় অর্থ উৎপাদনের দিক থেকে দেখা হয়। তানজীনার লেখার বড় একটা অংশ জুড়ে আছে- ছেলের বাস্কেটবল টিমে ঠাঁই করে নেওয়ার লড়াই, পরে উচ্চতর শ্রেণিতে ভর্তির লড়াইয়ে ছেলের কম গ্রেড নিয়ে হতোদ্যম না হওয়ার বর্ণনা। নিজের শিক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে ওই ধরনের বিদ্যায়তনের পরিবেশে তানজীনার সাড়া কেমন ছিল- এ তুলনা করতে পারি সহজে। পাশাপাশি একজন বিদেশি হিসেবে ঠিক কোন কোন দিক থেকে বৈষম্যের আশঙ্কা ছিল আর কতটা মোকাবিলা করতে হয়েছে- তারও বর্ণনা আছে।

দুই. 
চেরি ফুলের দেশ জাপানের পর টিউলিপের রানী নেদারল্যান্ডসের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে লিখেছেন তানবীরা তালুকদার। মেয়ে মেঘের প্রাক-স্কুল থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া নিয়ে লিখেছেন ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী শিশুদের শিক্ষা’। স্কুল তো নয়, যেন বছরব্যাপী পিকনিক। উৎসব-পার্বণ লেগে আছে প্রায় প্রতিটি মাসে। বাচ্চাদের প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে উঠতে দেন তারা। যেখানে বাচ্চাদের সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবাদের ‘শিক্ষিত’ হয়ে উঠতে হয়।  মূল্যায়ন করতে হয় স্কুলের প্রতিটি ধাপ। শিশুরা সমান যত্ন পায়। প্রতিভার বিন্যাস ও আগ্রহের নিরিখে ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছু ধাপ রয়েছে। যেমন, মাধ্যমিক স্তরে এসে কারোর মনে হতে পারে রসায়নেই ভালো করবে। কিন্তু পরখ করে দেখা গেল তার দক্ষতা পদার্থ বিজ্ঞানে। এভাবে নিজেকে উল্টেপাল্টে দেখার সুযোগ থাকে। শিক্ষার্থীরা নেদারল্যান্ডসের সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠলেও অন্য দেশ ও সংস্কৃতি নিয়ে ধারণা পাওয়ারও সুযোগ থাকে। তানবীরা একটা খেলার বর্ণনা দেন- যেখানে কালো ও সাদাকে কীভাবে অন্ধকার ও আলো হিসেবে বর্ণবাদীরা দেখায়- সেই বৈষম্যটা স্কুল দেখিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের দিক থেকে নেদারল্যান্ডসের সুনাম রয়েছে। কিছু বছর অন্তর অন্তর পাঠ্য বিষয়কে হালনাগাদ করা হয়। যা মূলত পুরো প্রক্রিয়ারই অংশ। জাপানেরও তেমন। দুই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বাইরের দিকে বেশ পার্থক্য দেখা যায়, কিন্তু অন্তর্গত মিল অনেক। আবার দুই দেশের সাম্প্রতিক সামাজিক অবস্থা অনেকটা নৈরাশ্যবাদী। সম্পর্কের প্রতিশ্রুতিগুলো আগের মতো নেই। কমেছে জন্মহার, কমছে কর্মক্ষম মানুষ। সামাজিক পরিসর ছোট হয়ে আসছে। এখানে হঠাৎ মনে হতে পারে- শৃঙ্খলা ও যান্ত্রিকতার সম্পর্ক কোথাও যেন ধোঁয়াশা। আত্মা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা নিশ্চয় তা খোঁজেনও। সামাজিক সমস্যার এই আছরগুলো জানতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এই বইয়ে আমরা আসলে ততটুকুই জানতে পারি, যা এর পরিসর হিসেবে নির্দিষ্ট। সেটুকু না জানা সত্ত্বেও একটুকু বলা যায়- শিশুদের শিক্ষাজীবনকে মসৃণ ও স্বচ্ছন্দ করতে জাপান ও নেদারল্যান্ডস সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। যা তাদের সামষ্টিক দায়িত্ববোধ ও রাজনৈতিক-সামাজিক স্থিরতার পরিচয়! এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণারও।

তিন. 
রাখাল রাহার বাংলাদেশ অংশের শিরোনাম ‘পাথরে লেখা আছে অধঃপতন’। ঠিক এই কথাটাই আমরা বলতে চাই। তার লেখার শৈলী তানজীনা ও তানবীরা থেকে একদম আলাদা। ঢাকায় থাকা এক বাবা মেয়েকে প্রাথমিক স্তরের স্কুলে ভর্তি করাতে ও পড়াতে গিয়ে যে পরিস্থিতিতে পড়েন- যার আছে একাধিক সাবপ্লট, টুইস্ট- যেন টানটান থ্রিলার। যেখানে মাফিয়াদের সঙ্গে লড়ে চলছেন একজন সাধারণ অভিভাবক। অনেক কষ্টে একটা স্কুলকে মেনে নিয়েছিলেন রাহা। বাচ্চার অহেতুক বইয়ের বোঝাটা হালকা করতে চেয়ে আকুতি জানিয়েছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে। এরপর স্কুল কমিটির সদস্য হয়ে ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ’ চড়িয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে হাল ছাড়তে হয়। শিক্ষার মৌলিক অধিকার নিয়ে আন্দোলন করার কারণে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলত জাপান-নেদারল্যান্ডস ঘুরে আসার পর মনে হবে ‘রূপকথা’ থেকে ধপাস করে পড়ে গেলাম অন্ধকারে।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু যে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যেনতেনভাবে পাস করিয়ে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং একে সফলতা দাবি করা হয়- সেখানে বলার স্বরটা ভিন্ন হতে হয়। যা রাখাল রাহা দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন সেই স্বর একা বা গুটিকয়েকের নয়। সামগ্রিক লুণ্ঠনতন্ত্র থেকে একে আলাদা করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের ক্ষয় আর ফাঁকফোকরের একটি আয়না হলো তার শিক্ষাব্যবস্থা। তিন অভিভাবকের ক্ষেত্রে যেটা সবচেয়ে মনোযোগ কাড়ে- তারা বরাবরই বোঝার চেষ্টা করেছেন সন্তানরা কী চায়, কীভাবে ও কেন চায়। বন্ধু হয়ে থেকেছেন। বাবা-মা, অভিভাবকদের শিশুসন্তানের বন্ধু হওয়ার এই গণ-চাওয়া দিয়েই বাংলাদেশে শিশুশিক্ষার ধারা বদলের জোরালো সুরটি বেজে উঠতে পারে হয়তো!

Comments

comments