আংশিক সত্য মানে কী? কোনো কিছুর খানিকটা সত্য, বাকিটা মিথ্যা। তবে ধরা যাক পাঁচ। যার চার পর্যন্ত সত্য, বাকিটা মিথ্যা। কীভাবে সম্ভব? এ প্রশ্ন কমলের। গণিতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ এক বালকের। এমন সৌন্দর্যে শুধু যে কমল মুগ্ধ নয়- নিশ্চয় আরও অনেকে। নইলে জগতে গণিতের এমন বিকাশ ঘটত না। প্রকৃতির মধ্যে আবিষ্কার হতো না গাণিতিক সংগতি। গণিতের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক জানার বাসনা হতো না। যে জীবন একা মানুষের নয়, যা কিছু দৃশ্যমান অথবা দৃশ্যমান নয়- তারই! আর খোদ গণিত নিজে কি দৃশ্যমান। অথবা সত্য বা মিথ্যা-তারা?
হ্যাঁ, কমলের সঙ্গে এমন অনেকেরই একটা তফাত আছে। কমল অটিজম আক্রান্ত শিশু। তার জগতে সত্য-মিথ্যার তফাত গণিতের মতো নিশ্চিত। কোনো কিছু আধাআধি সত্য নয়। তার জগতে সব হিসেব মিলতে হয়। সব হিসেব মিলে যাওয়া মানে পরিস্থিতির অনুরূপ কোনো বর্ণনা। কিন্তু জগতের নিয়ম ঠিক ঠিক কেই বা বলতে পারে?
গণিত, সত্য-মিথ্যা, মূর্ত-বিমূর্ত এসব নিয়ে অনেক ভাবনার অবকাশ হয়তো আছে। আবার কারও কাছে নেই। এই থাকা আর না থাকা অথবা থাকা না থাকার মধ্য দিয়ে থাকার মূর্ত হওয়াকেই প্রকাশ করে ‘নদ্দিউ নতিম’। একই সঙ্গে সেই বিন্দু যেখানে সত্য-মিথ্যা, হওয়া-না হওয়া বা থাকা-না থাকা মিলে তার বয়ান।
হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘কে কথা কয়’ অবলম্বনে মঞ্চ নাটক ‘নদ্দিউ নতিম’ পরিচালনা করেছেন আসাদুল ইসলাম। ম্যাড থেটারের অন্য দুই সদস্য সোনিয়া হাসান ও আর্য মেঘদূতের সঙ্গে এ নাটকে অভিনয়েও আছেন তিনি। আর ঢাকার মঞ্চের টুকটাক খোঁজ-খবর রাখা দর্শক বা পাঠক মাত্রই জানেন, এই তিনজন একই পরিবারের সদস্য। বাবা-মা-মেয়ে। ফলত হুমায়ূন আহমেদ, ম্যাড থেটার-সব মিলিয়ে দারুণ আগ্রহ জাগানিয়া।
গল্প বেকার কবি মতিন উদ্দিনকে নিয়ে। কবিতা লিখে পাত্তা পায় না ঢাকার সাহিত্য সমাজে। তখন নিজের কবিতা উজবেক কবি নদ্দিউ নতিমের অনুবাদ বলে চালিয়ে দেন। মতিন উদ্দিনের উল্টো করলে হয় নদ্দিউ নতিম। কবিতার পাশাপাশি নদ্দিউ নতিমের ছোট গল্প, এমনকি জীবনীও লিখে ফেলে মতিন।
একসময় ঢাকার সাহিত্যাঙ্গনে খুবই পরিচিত নাম হয়ে উঠে নদ্দিউ নতিম, তাকে চিনতে না পারাটাই প্রকাশকদের জন্য সম্মানহানির ব্যাপার যেন। আন্তর্জাতিক নামি প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশ হয় নদ্দিউ নতিমের জীবনীর ইংরেজি অনুবাদ। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে মতিন হয়তো ঢাকার সাহিত্য সমাজকে বিদ্রূপ করে। আবার এভাবেও ভাবা যেতে পারে ‘জনপ্রিয় সাহিত্যিক’ পরিচয়ের কারণে অনেকটা অপাঙত্তেয়ই ছিলেন হুমায়ূন। সেই গল্পই কি রসিয়ে রসিয়ে করেছেন তিনি।
উপন্যাসে মতিনের সমান্তরাল আরেকটি চরিত্র কমল। যার টিউটর হিসেবে অতি অনাগ্রহে দায়িত্ব কাঁধে নেয় মতিন উদ্দিন। আপাতদৃষ্টিতে কমল ও মতিন উদ্দিন পুরোপুরি উল্টো চরিত্র। কমল গণিত ভালোবাসে, মিথ্যা সহ্য করে না। অন্যদিকে মতিন উদ্দিন গণিত বোঝে না, গণিতের প্রতি কোনো আকর্ষণই নেই, আর মিথ্যা? সে তো পুরোপুরি কাল্পনিক চরিত্রকে ঢাকার সাহিত্য সমাজে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। হ্যাঁ, এখানেই চরিত্র দুটির দাঁড়ি টানা যাচ্ছে না। নাটকের একপর্যায়ে দেখা যায়, মতিন আওড়ে যাচ্ছে মানসাঙ্ক! খুব আনন্দ নিয়ে ব্যাখ্যা করে কমলের কাছে। বোঝা যাচ্ছে, গণিতে যে মতিনের আকর্ষণ নেই- এটা সচেতন ভাবনা নয়। বরং, আকর্ষণটা তৈরি হয় ওই বিদ্যার সঙ্গে অনুভূতির সম্পর্কের মাধ্যমে। যার সঙ্গে স্থান-কাল ও সমাজের শ্রেণিগত ধরনের যোগ আছে।
মতিন উদ্দিন ও তার অল্টার ইগো নদ্দিউ নতিম চরিত্রে অভিনয় করেছেন আসাদুল ইসলাম। আর্য মেঘদূত ও সোনিয়া হাসান যথাক্রমে কমল ও কমলের মা চরিত্রে অভিনয় করলেও মতিনের সংলাপের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে তার বান্ধবী নিশু, নিশুর বাবা, আর্যর বাবা ও আহমেদ ফারুকসহ কিছু চরিত্র। অন্য চরিত্রগুলোকে বয়ানের মধ্য দিয়ে তুলে আনা কতটা দরকারি এমন প্রশ্ন আসতে পারে কিন্তু এই তিন চরিত্রের বিশেষ করে মতিন উদ্দিনের আবহ তৈরিতে দরকার মনে হতেও পারে। উপন্যাসের মূল সুর ধরে রাখতে গিয়ে এমনটা ঘটেছে সম্ভবত। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগতে পারে মূলানূগ কিংবা ভিন্ন বয়ানের মধ্য দিয়ে মূল কীভাবে উঠে আসে বা কাছাকাছি যায়।
উপন্যাস অনুসারে মনে হতে পারে- মতিন উদ্দিন ও কমল আসলে একই মুদ্রার দুই পিঠ। যারা পরস্পরের পৃষ্ট দেশ ছুঁতে পারে না কিন্তু নিজেদের আলাদাও ভাবতে পারে না। যা মূলত মানুষের মধ্যে বিপরীত সত্তার দ্বন্দ্বের চিরায়ত রূপের একটা প্রকাশ। অনুমান করতে পারি- উপন্যাসের মূল সুরও এটা। যেখানে নদ্দিউ নতিম শুধু বিদ্রূপ বা ঠাট্টা-মশকরার বিষয় না। বরং নিজের ভেতর দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা মানুষের চিত্র, এমনকি এই সমাজ-সংসারের। আমরা যা হতে চাই এবং যা হয়ে থাকি-এই চিত্র তুলে আনা হয়েছে। কিন্তু হুমায়ূন খুব সম্ভাবনাময় জায়গা থেকে নয়, এক ধরনের পলায়নপর মীমাংসা ঘটান নাটকের শেষ দৃশ্যে। খুব বিষাদ জাগে, রয়ে যায় প্রশ্ন। হায়! এ দ্বন্দ্ব কি কোথাও গিয়ে মিলবে না। অথচ এ জগতের সদর্পে বৈপরীত্য মিলে-মিশে রয়।
‘নদ্দিউ নতিম’ গল্পের দিক থেকে ঢাকার নাটকে খানিকটা ব্যতিক্রম। তার শ্রেণি সচেতনতা, গল্প বা সংলাপের ঢং মিলেও। সে দিক অবশ্যই আকর্ষণীয়। করুণ রসের মাধ্যমে সমাপ্তি একটা বিষাদের রেশ রেখে যায়। যা হুমায়ূনের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। ভাবনা বিষয় হলো- উপন্যাসটি যে দ্বন্দ্ব নিয়ে লেখা তা কতটা ফুটে এসেছে। মনে হয়, নির্যাসগতভাবে উপন্যাসের মূল ভাবনা থেকে খানিকটা সরে এসেছে ‘নদ্দিউ নতিম’। মূল চরিত্র মতিন উদ্দিনে আসাদুল ইসলাম দ্বন্দ্বগুলো ফুটিয়ে তোলার ব্যাপক চেষ্টা করেছেন। একাধিক চরিত্রে অভিনয়, কণ্ঠস্বর ও শরীরী ভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে বহুস্বর হয়ে উঠেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ অদলবদল চমকে দেয়। আর পুরো নাটকটি দাঁড়িয়ে আছে এ চরিত্রের ওপর ভর করে। তবে মূল চরিত্র মতিনের ক্ষেত্রে তাকে অনেকটা উচ্চকিত মনে হয়। আসা দুলের মতো অভিজ্ঞ অভিনেতা-নির্দেশকের মাঝে আরও পরিশীলিত অভিনয় আশা করা যায়। অন্য দুজনের মধ্যে সোনা ভাসানের চরিত্রটি যথাযথ। আর চমকে দিয়েছে ছোট্ট আর্য মেঘদূত। তাকে বেশ লেগেছে। গণিতের প্রতি ভালোবাসা, সরলতা, সত্যনিষ্ঠা, জেদ, রাগ সব মিলিয়ে খুব কাছে টানে।
নাটকের মঞ্চসজ্জায় তেমন কোনো আয়োজন নেই। একদম না হলেই নয় ধরনের আয়োজন। যথাযথই মনে হয়েছে। অবশ্য অভিনয় ও আকর্ষণীয় সংলাপে মনোযোগ দিলে ওই দিকে তাকানোর ফুসরত মেলে না ‘নদ্দিউ নতিম’ দর্শকের। তবে আবহসংগীতের ক্ষেত্রে একই অ্যাপ্রোচ ভালো লাগেনি। আরও বিশদ পরিকল্পনা করা যেতো। আলোর ব্যবহারও মাঝে মাঝে সংগতিহীন মনে হয়েছে।
*লেখাটি দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত