রিজওয়ান। নাটবাঙলার প্রযোজনায় সৈয়দ জামিল আহমেদের পরিচালনায় ঢাকার মঞ্চে সম্প্রতি ঝড় তোলা নাটক। টানা ১৯টি শো শেষেও অনেকেই দেখতে না পারার আক্ষেপ করেছেন। আবার কেউ কেউ বারবার দেখতে চেয়েছেন, তাও হয়ে উঠেনি। এমন একটি প্রযোজনা সফল হওয়ার পেছনে রয়েছে গল্প নির্বাচন, মঞ্চায়নের শেষেও রেশ ধরে রাখা পরিবেশনা কৌশল। আর অবশ্যই চিন্তার খোরাক হয়ে উঠা, যাকে বলছি— অখণ্ডের তালাশে বিভাজিত আত্মা। মৃতের মুখেও ভাষা ফোটার গল্প। অথবা জীবন্মৃত হয়ে থাকা সময়ের ভাষ্য।
এক.
নাটকের গল্প এক জনপদকে নিয়ে যেখানে সৈনিকের বুট, বুলেটের আঘাতে প্রতিদিন ঝরে প্রাণ। ধর্ষিত হয় নারী। স্বাভাবিক মৃত্যু কদাচিত ঘটে। নাটকে এক নারী বলছে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। সৈনিকের ধর্ষণে নয়, ধর্ষিত হওয়ার পর ঠাণ্ডায় জমে মরে গেছেন তিনি।
সেখানকার এক তরুণের গল্প, তার নামেই নাটক ‘রিজওয়ান’। যার অর্থ জান্নাতের পাহারাদার। যে কি-না বাবাকে হারায় জন্মের আগে। বাবা শাল বিক্রির টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন ট্রেনে করে। একটা বুলেট ঢুকে যায় তার খুলি ভেদ করে। ঠিক যেন একটা ধুলো কণা। রিজওয়ানের বোন ধর্ষিত হয়ে মারা যায়। ভাই হয় নিরুদ্দেশ। বাড়ি দখল করে নিতে চায় সৈন্যরা। আকস্মাৎ মারা যায় মা ও দাদা। খুনী সাব্যস্ত করা হয় দুর্ভাগা রিজওয়ানকেই। তারপর তাকে হত্যা করে সৈন্যরা। নাটকে বলা হচ্ছে ‘এ দুনিয়ায় যদি কোনো জান্নাত থেকে থাকে, তবে সে জান্নাত এ মাটিতে।’ আর খুন করা হয় জান্নাতের পাহারাদারকে! পরিহাস বটে! সেই পরিহাসের ভেতর কথা বলেন মৃত ভাই-বোন। তালাশ করেন আত্মার সৌন্দর্য, অখণ্ডতা।
কাশ্মিরকে ভূ-স্বর্গ বলা হয়। সম্ভবত এ কারণে ‘এ দুনিয়ায় যদি কোনো জান্নাত থেকে থাকে, তবে সে জান্নাত এ মাটিতে।’ সংলাপের একটা মানে আমরা দাঁড় করাতে পারি। অথবা মাতৃভূমিকে নিজ নিজ কেবলা বানালে যা হয়। অথবা একটা সেক্যুলার বয়ানে মানুষের যাবতীয় কেবলাকে ইহজগতে সীমাবদ্ধ করতে পারি। যেমন শুনি কবিতায় ‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বা বলে বহুদূর’।
নাটকের কোথাও সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্ন করা হয় নাই। কিন্তু যাদের হাতে প্রচারণা উপকরণ গেছে— তারা জানিয়েছেন অসাম্প্রদায়িকতার বাণী এর মূল উদ্দেশ্য। যদিও আপনি এমনটা নাটকের পাবেন না হয়তো। থাকলেও কারো কারো কাছে অবোধ্য রয়ে গেছে।
তবে হ্যাঁ, যারা নাটকের শেষদিনের শো উপভোগ করেছেন তারা অনেক প্রাণবন্ত অভিনয় (দীর্ঘ ১০দিনের শেষ শো হওয়ায় যথেষ্ট ক্লান্ত ছিলেন কলা-কুশলীরা) মিস করলেও পেয়েছেন সৈয়দ জামিল আহমেদকে। শো শেষে ফুলের শুভেচ্ছা গ্রহণ করতে এসে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যও পেশ করেন। এক পর্যায়ে জানান, ঈদের মৌসুমে টানা নাটক মঞ্চায়ন করে একটা ঘটনা ঘটাতে চেয়েছেন। ঈদকে ধর্মীয় উৎসবে সীমাবদ্ধ না রেখে সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপান্তরিত করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ নিধর্মীকরণের চেষ্টা। এ চেষ্টা তো আমরা টিভি বা সংবাদমাধ্যমের ঈদ আয়োজনে হালফিল দেখে আসছি! সে চেষ্টার ফলাফল বা কার্যকারণের মধ্যে কি নেই ‘রিজওয়ান’? ঢের আছে। বরং বলতে হয় এ বিশিষ্টতা গৌণ। ‘রিজওয়ান’কে আমরা আরো বেশি বাহবা দেবো।
আবার ধরুন, আমার-আপনার-অন্য অনেকেরই মনে হতে পারে কাশ্মির প্রসঙ্গ আসলে অসম্প্রাদিয়কতার গল্প আসা অনিবার্য। যদিও এ গল্প যতটা না প্রতিরোধের গল্প তার চেয়ে বেশি বেশি জানান দেওয়া— ওহে সৈনিক আমরা তোমাদের সঙ্গে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আমরাও মানুষ, তোমরাও মানুষ। তা যদি ভারত হয়, তবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে। খেয়াল করবেন, সৈনিক যখন রিজওয়ানের বাবাকে মারে সে তখন নিজেকে খুন করে, আবার রিজওয়ানকে বোনকে ধর্ষণ করে, তখন নিজের স্ত্রীকেও খুন করে। এমনটা বলছে রিজওয়ানের বোন। কীভাবে? কারণ মৃতরা জেনেছে জীবনের মানে!
এ বিচারকে ছোট অর্থে ধরলে ভারত তার আত্মাকে ভাগ করছে, খুন করছে। আর যখন মৃতেরা ফিরে আসে, কথা কয় তারা মূলত অখণ্ডের অনুসন্ধান করে বিভাজিত আত্মায়। এটাকে দর্শক হিসেবে আমার আড়াল ধরতে পারেন। আত্মা আর অখণ্ড এখানে ধর্মীয় ধারণা নয়! আবার তা না হয়েও যেন চলছে না।
আবার মানবজীবনকে একটা সত্ত্বার অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। এমনটা করেও রোধ করা যাচ্ছে না হত্যা-ধর্ষণ। যেখানে অপরকে শেষ করার মধ্যে নিজেই খুন হচ্ছে। কেন? তার উত্তর কি ‘রিজওয়ান’-এ আছে? আমার জানা নাই। ঠিক, জাতীয়তাবাদকে কেবলা করলে কি এর মেকাবেলা সম্ভব? আপাতত এ প্রসঙ্গও থাক। এটুকু বলা যায়, জীবনে অনেককিছু পাওয়া বা না পাওয়া হোক— মৃত্যু হলো নিশ্চিত ঠিকানা। আর মৃত্যু দিয়ে মীমাংসা চলছে না। হয়তো প্রতিরোধ দিয়েও লেখকর কাছে মীমাংসা ঘটছে না।
নাটকে হুট করে চাকমা সংলাপের ব্যবহার অন্য কোনো ধারণা দিতে পারে। নিপীড়নের কাঠামোকে সার্বজনীন করে দেখা হয়তো বা। মনে রাখতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কাশ্মিরের সমস্যাকে এক করে দেখতে গেলে কিছু কিছু ‘কিন্তু’ দিয়ে আগাতে হবে। অবশ্য কেউ কেউ বলছেন ‘রোহিঙ্গা’ পরিস্থিতির সঙ্গে এর মিল পা্ওয়া যায়, তা আসতে পারত। এটা অবশ্য প্রতীকায়নের মধ্য দিয়ে আপনি এমনিতেই পেতে পারেন। কীভাবে? এ বিষয়ে পরে আসছি।
তবে হ্যাঁ, কাশ্মির আর মুসলিম প্রশ্ন আপনি আলাদা করতে পারবেন না। একইভাবে রোহিঙ্গা ও মুসলিম প্রশ্ন। তাই কি সম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন ব্যতিরেকে ‘রিজওয়ান’ মঞ্চায়ন যাচ্ছে না! অথবা প্রশ্নটা ‘ভারত’ সম্পর্কীয় সাহসী ব্যাপারও। এ বিষয় ব্যতিরেকেও নাটকটি দারুণভাবে উপভোগ করা যায়। যদি না ‘সম্প্রদায়িক’ ব্যাপারটা ‘গুরুত্বের সাথে’ আপনার চোখে না পড়ে বা আপনার আগ্রহের বিষয় না হয়!
উর্দু কবি আগা শহীদ আলীর কাব্যগ্রন্থ ‘আ কান্ট্রি উইদাউট আ পোস্ট অফিস’ অবলম্বনে ভারতের অভিষেক মজুমদার লিখেছেন ‘রিজওয়ান’। নাটকের চরিত্রগুলোর প্রতি নিঃশ্বাসে রয়েছে নিজের ভূমিতে অপর হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণার মধ্যে অনায়াসে পুরে দেওয়া যায় যাবতীয় নিপীড়নের গল্প। এ এক পৌরণিক গল্প। যা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, শতকের পর শতক কেটে যাওয়ার পরও পুরনো হয় না। বরং মানুষের নতুন নতুন অভিজ্ঞতাকে নতুন নতুন ভাষা দেয়। যুক্ত করে অপরের জীবন ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে। ব্যথার কথা হলো পুরো গল্পটাই ট্র্যাজেডির। যা কিছু ফুল হয়ে ফোটে তার শক্তির যোগায় চোখের জল বা বুকের তাজা রক্ত।
শুধু রাজনীতির প্রশ্ন নয়, প্রযুক্তি বা সমাজ-সংসারের জটিল মারপ্যাচে ক্রমশ মানুষ দিন দিন নিজে থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। শুধু অপর থেকে নয়, সে অনুভব করে নিজেকেও নিজের রূপে পাচ্ছে না। এমন একটা সময়ের আপনি আছেন যেখানে মানবিক মর্যাদা, সাম্য, ইনসাফের দাবিদার হলেও আপনি তা পান না। ফলত যে ভূমিকে আপন স্বর্গ বলে কল্পনা করবেন তা স্বর্গ হবে না। অথবা এমন এক যন্ত্রণার কথা আমরা বলতে পারি যাকে আমরা চিনি বলে প্রতীতী হই, কিন্তু তা আসলে আমরা ধরতে পারি না। তাকে বির্মূতভাবে বর্ণনা না করে উপায় কী? তার রেশ পাওয়া গেল নাটকটির মঞ্চায়নে। তাই যদি কাশ্মির নামডাক নাও থাকে ‘রিজওয়ান’ দারুণ অর্থবোধক। আবার ধরে নিন, বাংলাদেশকে প্রাসঙ্গিক করে একটা ভাষ্য নির্মাণ করা গেলেও তা আমার কল্পনাকে যতটা সীমায়িত করে বা বিতর্ক তুলে দেয়— সেখানে একটা নিরাপদ দুরত্ব তো রাখা গেল! এমন ঝুঁকি বাংলাদেশে কতটা নেওয়া যায়?
‘রিজওয়ান’-এর মধ্যে নানা কালে নানা স্থানে ঘটে চলা দখলদারিত্বকে পুরে দেওয়া যাবে এক খোলসে। তার বিরুদ্ধে আমাদের বিবেক কী বলে সে ভাষ্য আমরা পাই। এখানেই ‘রিজওয়ান’ তার স্থানিক বা কালিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যায়। বার্তা হয়ে আসে মানবিকবোধের। দ্রোহ তার মাঝে নাই, সমর্পণ। তাতেও আমাদের চলে যায়।
শুধু গল্প বয়ানই নয়, মঞ্চ ও আলোর ব্যবহারে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার স্বাদ পাওয়া যায় ‘রিজওয়ান’-এ। যেন দর্শককেও পারফর্মার বানালেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে সাধারণত তিনদিকে দর্শক বসেন। মাঝখানে পরিবেশিত হয় নাটক। এ নাটকে দুইপাশে দর্শক আর মঞ্চ, গ্রিন রুম, আশপাশের এমনকি দর্শকের পেছনের খালি জায়গা বা উপরে আরো দুইটা স্থর মিলে নাট্যক্ষেত্র। হ্যাঁ, ঘাড়ের পেছনে কেউ দৌড়ে যাচ্ছে, তা আবার মাথায় ঘুরিয়ে দেখা একটু অভিনব বটে। আবার দেখেন মৃত মানুষেরা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে, বা নিচে নেমে আসছে— অপর জগতের সাথে সন্ধি তৈরি করছে। আবার যেমন জীবন আর মৃত্যুর মাঝে যে ধূসর রেখা তা অতিক্রম করছে। অবশ্য মৃত রিজওয়ানই বলছে যদি কোথাও জান্নাত থাকে তা এই মাটিতেই। মঞ্চের এ বিন্যাসের মধ্যে একদম উপরের স্থরটি একবারই ব্যবহার হয়। সেখানেই ভেঙে যাচ্ছে আকাশে মানে জান্নাতে উঠার মেটাফোর। সেটা শুধুমাত্র তখনই— যখন সৈনিকরা রিজওয়ানকে খুঁজছে। একদম উপরের স্থরে দৌড়াদৌড়ি করছে তারা অর্থাৎ মঞ্চ বিন্যাসকে প্রতীকায়িত ধরলেও পারলৌকিক জগতকে অগ্রাহ্য করছে।
মঞ্চের এমন বিন্যাসের কারণে নাটকের মতো করে একটা অস্থিরতা যাপন করে দর্শকের ভাবনায়। আবার যখন দীর্ঘ বর্ণনার ভেতর দিয়ে যায় বরফ শীতল নৈঃশব্দ্য জমে গহনে। নাটকের শুরু থেকে অনেক প্রতীকায়িত বিষয়াদি আছে। যা কখনো কখনো অবোধ্য, বিরক্তিও উৎপাদন করে। আবার ঝিলের জলে পোস্টম্যানের নৌকা চালিয়ে আসার মতো সুরিয়েল দৃশ্য আছে। যখন বাচ্চারা খেলাধূলা করে বা ভাই-বোনের কথপোকথন বা গোলাপ বাগানে মৃত দাদার তিনটি সত্ত্বা। এ সব নির্মাণ ভুলবার নয়।
অনেক মুহূর্ত হয়তো উল্টোভাবে অনেকদিন স্মৃতিতে থেকে যাবে। যেমন কিছু সংলাপ। ‘কী হয় যদি কোনোকিছুই আর চিরদিন না থাকে, তার কী হয়ে, যে থাকে না চিরকাল’ অথবা ‘মানুষ যখন মরে যায় তখন কেবল দেহটাই শেষ হয় কিন্তু বেঁচে থাকলে অন্য কিছু হওয়া যায়।’ বারবার উচ্চারিত এ সব সংলাপ সবল হওয়ার জন্য নয়, দুর্বলতার জন্য মনে থাকবে। তবে নাটকের গীতল ছন্দের সংলাপ অনেকটা সময় ভালো লেগেছে, সার্কাসের মতো পরিবেশনা বা প্রক্ষেপণে সমস্যা সত্ত্বেও। ওই যে একটু দার্শনিকতার চেষ্টা কিছু কিছু সংলাপ বারবার শুনিয়ে। সেটা অর্থপূর্ণ হয়নি।
এভাবে ধরতে পারা বা না পারার মধ্য দিয়ে নিজস্ব অর্থ তৈরি করে ‘রিজওয়ান’, মানে আমরা ভেবে নিই। অমানবিকতার উল্লাসের সময়ে তা ‘শুধু নাটক’ বলে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। যা বাংলা নাটকের জন্য উল্লেখযোগ্য সংযোজন। আমাদের মুক-বধিরতাকেই যেন নাট্যমঞ্চে তুলে নিয়ে আসে। এই তো ‘রিজওয়ান’। যারা ভাবছে তারা জীবিত, ‘রিজওয়ান’ বলে দিলো তারা আসলে মৃত! আর মৃতরাই বিভাজিত আত্মার মাঝে অখণ্ডের তালাশ করে।
ছবি : সংগৃহীত, কৃতজ্ঞতা : আশবাবির রাফসান।