পিচ্চিটার বয়স কত হবে? বলেছিল বটে, ভুলে গেছি। ১০ অথবা ১২। নাম হতে পারে শাকিল বা এমন কিছু। আমরা খালের পারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যদিও বলা হচ্ছিল নদী। আমি এর চেয়ে শীর্ণ নদী দেখেছি ঢের। তখনই তার সাথে কথা-বার্তা।
যে দেশের যেমন ভাব! এর ঘণ্টাখানেক আগে বলেশ্বর ও বিষখালীর যে ব্যাপ্তি দেখছিলাম তার তুলনায় এটা খাল মনে হতেই পারে। পিচ্চিটাও বলছে নদী। তখন মনে হচ্ছিল— এটা খাড়ি গোছের কিছু, খানিকটা দূর গিয়ে নদীতে পড়েছে। অনেক পরে মনে পড়ল সকালে পাথরঘাটা উপজেলা সদরে আসার পথে একটা ব্রিজ পড়েছিল। তখন একজনকে দূরের নদীর নাম জিজ্ঞাসা করছিলাম। উনি বললেন, বলেশ্বর। যাই হোক, এটা মনে হয় ভুল শুনছিলাম। ম্যাপ দেখে মনে হচ্ছে বিষখালী। ম্যাপ আরো একটা জিনিস জানাইলো এ খালের মাধ্যমে দুই নদীর একটা যোগাযোগ আছে। যা-ই হোক, আগে বলে নিই আমরা কোথা থেকে আসছি।
বরগুনার পাথরঘাটার লালদিয়া বন দেখে আসছি। বন দেখা শেষে পাথরঘাটার হোটেলে ভাত খাইতে খাইতে জিজ্ঞাসা করি বরগুনা শহরে যাওয়ার উপায় কী? দুটো পথ। ইলিশ, চিংড়ি ও ফ্রি সবজি দিয়া খেতে খেতে শুনি। হয় বাসে করে বরগুনা (পথে ফেরি পড়বে, যে পথেই যে জায়ঘা থেকেই বরগুনা যাওয়া-আসা করেন ফেরি বা খেয়া ঘাট মাস্ট!) নয়তো ঘাট পার হয়ে ওপার থেকে গাড়িতে। দ্বিতীয়টায় সময় কম পড়বে। এছাড়া নৌকায় নদীর পারাপারের লোভ তো ছিল।
লালদিয়া বনের ভেতর যে খাল— তার শেষ বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর মোহনায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় মোহনায় পানি অনেক উচা হইয়া আছে। এর সঙ্গে যেন পৃথিবী গোল হওয়ার যোগ আছে। যদিও অল্প জায়গার মধ্যে বোঝা কঠিন— পৃথিবী গোল! ছোটবেলায় বইয়ে পড়ছিলাম— পৃথিবী গোল এটা বোঝার জন্য নদীর মধ্যে কয়েক মাইল অন্তর অন্তর কাঠি পুঁতে দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বোঝা যেতে পারে, অথবা জাহাজের মাস্তুল সমুদ্র তীর থেকে প্রথমে দেখার ঘটনা থেকে।
শুধু লালদিয়াই নয়, কোনো বনের বর্ণনার ভার আমি নেবো না। একটা কল্পনার কথা বলা যায়, আমরা যখন বনের ভেতর ওয়াকওয়ে দিয়া হাঁটতেছিলাম— আমাদের ধারণা ছিল বনের শেষে সমুদ্রের দেখা হবে। কয়েকটা ওয়েবসাইটও তাই বলছে। বেশ বেশ! সাদা বালুর তীর ধরে হাঁটব।
আমরা বারবার বৃষ্টিতে ভিজে ভাঙা ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে হাজির হই— যেখানে পথ শেষ। হুট করে কথা নেই বার্তা নেই মাঝপথে ওয়াকওয়ে শেষ। শেষ মানে— দেখা গেল গাছের চিকনা ডালে কাঠ লাগিয়ে সিড়ি বানানো হয়েছে। এটা বন বিভাগের কাজ নয়। বনচরদের কাজ। আর কোথায় সমুদ্র? সেই সিড়ি বেয়ে আমরা আসলাম খালের পারে। অথচ সুন্দরীর শ্বাসমূলের আশপাশে থাকা নানা লক্ষণ দেখে বলছিলাম জোয়ার কতটুকু আসে আর কী কী সব। এখন ভাবছি, নৌকায় গেলে পাওয়া যাবে সমুদ্র।
অবাক ব্যাপার হলো খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে ভালো লাগছিল না। যার ওপাশেও জঙ্গল। কেমন যে গা ছমছম করছিল। কেউ যেন আশপাশ থেকে নজর রাখছে। তখনই শুরু হলো বৃষ্টি। বললাম, বাঁচায়া দিল। কেউ চায় না আমরা এখানে থাকি। এরা কারা— যারা চায় না আমরা জঙ্গলে থাকি? ফিরতি পথ ধরতে একদম ভিজে জবজবে অবস্থা। ভাগ্যিস ছেড়াখোড়া হলেও আমাদের ব্যাগ ওয়াটারপ্রুফ ছিল।
ফিরতে ফিরতে একবার বৃষ্টি আসে, থেমে যায় আবার ফিরে আসে এ অবস্থা। বনে ঢোকার মুখে সুন্দর ব্রিজ, তার নিচে খাল। ওখানে এসে নৌকার মাঝির সাথে দরদাম চলে।
কিছু নৌকা ফিরছিল, ইলিশ মাছ নিয়ে। সাইজ লক্ষণীয় রকমের বড়। আর প্রতিটি নৌকা থেকে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছিল একটা করে ইলিশ। কুড়িয়ে নিচ্ছিল একজন লোক। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কী? উত্তরে মিনমিন করে কী যেন বললেন। আসলে তিনি জানাতে চান না ব্যাপারটা কী! আন্দাজ করলাম, কোনো পক্ষকে ভেট দেওয়ার মতো ব্যাপার। বন বিভাগের কেউ নাকি রাজনৈতিক কোনো পক্ষ? তারা এত মাছ দিয়া কী করে?
আবার ফিরি পিচ্চিটার কাছে। ওর হাত-পায়ের নখে নেইলপলিশ। জিজ্ঞাসা করলাম, ছেলে মানুষ নেইলপলিশ দিছো ক্যান? ও নিরুত্তর। এরপর জিজ্ঞাসা করি, নামাজ পড়ো? মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। এবার বললাম, নেইলপলিশ দিলে তো ওজু হবে না। এ কথায় সামান্য মাইন্ড করে।
ওর কথা কেন বলছি? একটা ঘটনা তো আছে। আমরা কড়া রোদের মধ্যে হেঁটে আসছিলাম। নদী পার হওয়ার নৌকা খুঁজছি। একটা নৌকা দেখিয়ে দিল পিচ্চি। খালি দেখে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। লোক উঠছে কিন্তু আরেক নৌকায়। পিচ্চি জনে জনে বলছে, ওটা যাবে না। মাত্র ওই পার থেকে আসছে! সিরিয়াল অন্যটার। কিন্তু লোকজন তার কথা গ্রাহ্য করছে না। ও বলল, লোকজন উঠলেও তাদের এ নৌকায় ফিরতে হবে।
শেষ পর্যন্ত ওর কথা ফলে নাই। ঘাটে বান্ধা খালি নৌকাটা খালিই থাকলো। কিন্তু একটা ব্যাপার, এই যে নিশ্চিত হওয়া তা কোনো নিয়মে তো নিশ্চয় চলে। নাকি হঠাৎ কোনো একটা ঘটনা উদয় হওয়ার মতো। যেটা আমাদের মনে আর স্পর্শযোগ্য দুনিয়ায় একইসঙ্গে ঘটে! যদি সব লোককে পিচ্চিটার দেখানো নৌকায় ফিরতে হতো! অথবা পিচ্চিটা ভাবতে পারে অন্য নৌকাটা যাওয়া মানে কোনো একটা নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটা যা আসলে হওয়ার কথা না, এর ফলে তার কাছে জগতটা অনিয়মের কারখানা হয়ে যেতে পারে। নাকি অনিয়মের মধ্যেও আমরা একটা শৃঙ্খলা আবিস্কার করি ধীরে ধীরে। এছাড়া ধরেন একটা ব্যতিক্রম ঘটনার প্রভাবে দুনিয়াতে কত ঘটনা উল্টে যেতে পারে! আবার এটা অজস্র বা নির্দিষ্ট সম্ভাবনার একটাও হতে পারে। এমনও হতে পারে ছেলেটা ভুল জেনেছে বা ভুলভাবে জেনেছে। মানুষ তো সহজে ভুল স্বীকার করে না সাধারণত!
এমন ঘটনায় একজন মানুষ নিশ্চয় কনফিউজড হয়ে যায়। নিজের পর্যবেক্ষণ বা আবিষ্কারলব্দ নিয়মের উপর বিশ্বাস হারায়? এ বিশ্বাসের মূল্য কেই বা দেবে। নাকি ভুল করতে করতে শুদ্ধটা বাছাই করতে শিখবে। ‘না হওয়া’র সাথে আমরা ‘হওয়া’র একটা সম্পর্ক তৈরি করি।
এইভাবে তার সঙ্গে আমাদের একটা মিল পেলাম। নইলে ভাত-মাছ-কাপড় এই সব ব্যাপার দিয়ে শুধু মানুষে-মানুষে সম্পর্ক দেখাতে হবে। এটা যে খুব একটা কার্যকর তা তো না। কীভাবে?
আমাদের ধারণা ছিল— লালদিয়ার খালটা সমুদ্রে মিশেছে, তাই একটা অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার ভাব ছিল। তার সঙ্গে মিলেছে অশরীরী ও অপরিচিত পরিবেশে। বৃষ্টি বা অন্য কারণ মিলিয়ে আমরা ছাড়া আর পর্যটক ছিল না। আমার সহযাত্রী মেলা কেটেকুটে যে রোডম্যাপ বানাইছে— সে মতে বন পার হলেই সমুদ্র। সমুদ্র সৈকত কোনো এক জায়গায় কিন্তু ছিল, কিন্তু ওই মুহূর্তের সকল সাক্ষি গোপাল উল্টো কথাই বলল। পরে জানছিলাম, ছোট একটা সৈকত আছে। কাদাময়। বনের অন্যদিকে। যদিও পত্রিকাগুলা এটারে ঠিক ঠিক মিনি কক্সবাজার বানিয়ে ফেলছি প্রশংসাসুলভ যুতসই বাক্যে। এর পর্যটন সম্ভাবনা নিয়েও তাদের দ্বিধা নাই। হায়! দ্বিধা!
নৌকা সমেত মাঝি ছিলেন কয়েকজন। তাদের সঙ্গে কথা বলতে মেলা টাকা চাইলো। সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে বন বিভাগের টিকিট কাউন্টারে ফেরত আসি, কিন্তু সেখানে কেউ নাই। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আমরা বসে থাকি। সেখানে একটা সাইনবোর্ডে লেখা দেখি জনপ্রতি নৌকা ভাড়া ৫০ টাকা। পরে জানা গেল, নৌকা ভর্তি হলেই এই দর। তাই ৩০০ কী ৪০০ টাকায় নৌকা মিলল। সাংবাদিক পরিচয় থাকায় বন বিভাগের ট্যাক্স লাগল না।
নৌকায় চড়ে যেন আমরা গহীন জঙ্গলে প্রবেশ করছি এমন ভাব উদয় হলো। খালের ঘোলা জল, হরিৎ প্রকৃতি, মেঘলা আকাশ, উৎকট ইঞ্জিনের শব্দ, নৈঃশব্দ্য মিলে যা ক্ষণে ক্ষণে উদয় হয়, আবার হারিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ঝাঁক বেঁধে আবোল তাবোল চিন্তার মতো ট্রলার ফিরছিল উল্টো দিক থেকে।
পরে পিচ্চিটার অনুমানের সঙ্গে আমাদের অনুমানের মিল খুঁজছিলাম। এখানে পার্থক্যও আছে। আগে একই ঘটনা ও তার নিয়মের বারবার সংগঠিত হওয়ার একটা অভিজ্ঞতা ছিল ওর। আর আমাদের? আমরা নির্ভর করেছিলাম ম্যাপ বা অন্য তথ্য উপাত্তের উপর। নৌকার মাঝিও বলছিল, কাছাকাছি সৈকত আছে। কিন্তু সে দেখাতে পারল না। নাকি ভুল বকছিল। হ্যাঁ, ভাবাভাবি বা অনুমানের সূত্র অন্যরকম। কিন্তু যাচাই করার জন্য অভিজ্ঞতার মধ্যেই হাজির হচ্ছে। এই তো! ওই পিচ্চির ক্ষেত্রে নিয়মের ভিন্নতা ঘটতে পারে, ভবিষ্যতে এটা হয়তো শুধু ব্যতিক্রমের উদাহরণ হবে। আবার আমাদের জন্য ভয়াবহ কোনো বিপর্যয় ছাড়া বনের পর সমুদ্র আসার কোনো আশঙ্কা নাই! যেহেতু ধরে নিয়েছিলাম, কাছাকাছি সৈকত নাই। কিন্তু ধরেন দুটো ঘটনাই চিন্তার মধ্যে ঘটছে— বস্তুগত ভিত্তি বলতে আমাদের মনের সাথে থাকা শরীর, তখন আসলেই কী হয়? চিন্তার এক্সারসাইজ হিসেবে এর মূল্য কেমন? মজা হলো, পিচ্চি ও আমাদের মধ্যে চূড়ান্তভাবে যাচাই করার ক্ষমতা ছিল না। দুই ঘটনারে আমরা খণ্ড খণ্ডভাবে দেখছি, মানে আমাদের সামনে তথ্য ছিল ছেঁড়াখোড়া।
এটাও নিশ্চয় বুঝতে পারছেন— আপনার কাছে শুধু তথ্য থাকলেই চলবে না। ঠিক ঠিক যাচাই করার পদ্ধতি বা উপায়ও জানতে হবে। নাছোড়বান্দাও হতে হবে। ঢাকা থেকে পাথরঘাটা যাওয়ার রাস্তা, সময় বা বারবার বৃষ্টির কবলে পড়লে নাছোড়বান্দা হওয়া মাথায় উঠতে পারে!
পানি ধীরে ধীরে বাড়ছিল। জোয়ারের সময় এখন। খালের ভেতর দাঁড়ানো গোলপাতা গাছ অনেক কষ্টে মাথা উচিয়ে আছে পানির উপরে। আবার কোথাও বা বিশাল সুন্দরী গাছ আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো সোজাসুজি নয়— সামান্য বাঁকা। আরেকটা গাছ হয়তো সোজা, হয়তো কোনোটা ভেঙে পড়েছে। এই সব মিলিয়ে বনের নকশা! তন্ময় হয়ে দেখা যায়। ছবি তুললেও দেখতে সুন্দর লাগে।
একসময় আমাদের বাম পাশের তীরে জঙ্গল ফুরিয়ে আসে। ছোট ছোট ঝোপঝাড়ের পাশে গরু-ছাগলও দেখা যায়। দূরে দেখা যাচ্ছে অতল জলের হাতছানি। এটা বলেশ্বর ও বিষখালীর মোহনা। একে তো বর্ষা, তার উপরে পাশেই সমুদ্র— সব মিলিয়ে সমুদ্রের মতোই। ওপারে ঝাপসা মতন বন দেখা যায়। সফরসঙ্গী বলল, ওইটা তালতলী, যেখানটাই কাল যাবো। এখানে নাই, তবে ওইখানে সৈকতও আছে।
এক পাশে ঘাসে ঢাকা বিস্তৃত খোলা মাঠ। তার পাশে নৌকার নোঙর পড়ল। মাঝি জানালেন, এখন এ নৌকা নিয়ে নদীতে যাওয়া সম্ভব নয়। ভয়ংকর ঢেউ। নিমিষে ডুবে যাবে। আমরা বরং খোলা জায়গায় ঘুরে-ফিরে দেখতে পারি।
তখন হালকা হালকা বৃষ্টি পড়ছে। আর আমাদের বলারও কিছু নাই। সবুজ ঘাস পায়ের নিচে, কাদাময়। বসারও উপায় নাই। আমরা ঢেউয়ের গর্জন শুনি, দেখি, দুই-একটা ছবি তুলি, তারপর ভাবি ফেরা যাক। মাঝি বলেন, শীতের সিজনের আসলে দেখবেন মোহনায় পিকনিক পার্টি লেগে থাকে।
তারপর ধীরে ধীরে আমরা বিদায় নিই। তখন তো জানতাম না পরেরদিন পায়রা পাড়ি দিতে হবে। দুই নদীর ভাব দুই রকম। একটা থমথমে; মনে হচ্ছিল একটু পর ভয়ংকরভাবে রাগ ঝাড়বে। দ্বিতীয়টা ছিল উত্তাল। স্বস্তিতে ছিলাম এই ভেবে; নদী তো এমনই হওয়ারই কথা।
সমুদ্র দেখার আরো দুটি অপশন এখনো হাতে আছে। তালতলী আর কুয়াকাটা। তখনো জানতে পারি নাই— কাছে গিয়েও না দেখে ফিরতে হবে! আসলেই কি কিছুই নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় না?
………………………………….
লেখাটি দৈনিক ভোরের পাতার শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক সাময়িকী চারুপাতার ১৭ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত। কৃতজ্ঞতা : তানিম কবির।