মেলা বছর আগের কথা। মশিউল আলমের একটা উপন্যাস পড়ছিলাম। সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞান। নামটা ২০৯৯ বা এ ধরনের কিছু। বুঝা যাইতেছে ভবিষ্যতের গল্প। ওই সময়ে যৌনতার মাধ্যমে সন্তান জন্মদান ছিল নিষিদ্ধ বা লজ্জার বা অপ্রচলিত বিষয়। মানুষ তৈরি হয় কারখানায়। প্রেম হইতো পুরুষে-পুরুষে বা নারী নারীতে। তো, দুই তরুণ-তরুণী প্রেমে পড়ে আদিম পদ্ধতিতে সন্তান পয়দার সিদ্ধান্ত নেই। সবাই তাদের ঘৃণা করতে থাকে। সমাজ তাদের এক ঘরে করে। শেষদিকে, তারা নির্জন এক উপজাতি এলাকায় গিয়া বাচ্চা জন্ম দেয়। একজন মাওলানা বাচ্চার কানে আজানও দেয়। এইরকমই বোধ হয়।
অনেকদিন পর বইটার কথা মনে পড়ে গেল। উপলক্ষ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। একসময় তার বই দেদারসে পড়তাম। বছর কয়েকের বিরতির পর পড়লাম ‘রিটিন’। এ মেলার বই। বেশ কিছু লুপ হোল নিয়া গল্প আগাইছে। তার উপ্রে গল্পের প্রথম অংশের লগে ‘দ্য ম্যাটিক্স’ সিনেমার দারুণ মিল। অতি সরলীকৃত মিল! যার কাছ থেকে বইটা নিয়া পড়লাম— উনি জানালেন নকলের ঘটনা ড. ইকবালের ক্ষেত্রে নতুন না। নকল আর অনুকরণের স্বীকৃতির মহত্ত্ব আর কবে বুঝব? আমরা ছোটবেলায় জানতাম ড. ইকবাল টিভি-সিনেমা দেখেন না! এটা বড় অনুপ্রেরণাদায়ক ঘটনা মনে হইলেও কখনো ফলো করতে পারি নাই। উনিও বোধহয় করেন না।
ছোটবেলায় মানুষের নাম নিয়া তামাশা হইতো। কারো কারো নাম নাকি স্ক্রু ডাইভার টাইপ। তো, আপনি এমন নাম সায়েন্স ফিকশনের পাইবেন। ড. ইকবালের বইগুলার নায়কের নাম রিটিন, টিটি, পিটি— এমন টাইপের। আবার কিছু কিছু গ্রেকো-রোমান সভ্যতা থেকে পাওয়া মনে হয়। তবে ‘রুহান’ নামটা সুন্দর। ওই বইটা পড়ি নাই দেইখা বলতে পারতেছিল না সেটা কোনো ক্যারেক্টার কিনা! যদিও ভবিষ্যত সমাজের ভেদাভেদ দেখাইছেন তিনি নানা সময়ে, বাট বুঝাইতে পারেন নাই এ নামের মধ্যেও ভেদাভেদ হাজির থাকে।
‘রিটিন’ পড়তে গিয়া দেখলাম— রিটিন হাজার হাজার গুলির সামনে থেইকা বাঁইচা ফিরে আসে। এটারে ব্যাখ্যা করা হয়, প্রকৃতি রিটিনরে বিশেষ একটা কাজের জন্য বাঁচায়া রাখে। বিশেষ সে কাজের কথা আমরা পরে জানতে পারি। তবে এ প্রকৃতি জিনিসটা কী জিনিস তা কিন্তু স্পষ্ট না। সায়েন্সের লগে তার সম্পর্কও না। এখনো কী মানে ২০১৭ সালেও প্রকৃতি বইলা কিছু আছে, যেটারে হাজার বছর পরও ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। হয়তো ব্যাখ্যার ভেতর ন্যূনতম অভিজ্ঞতাজাত কিছুর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে বাট না পাওয়ারেই প্রকৃতি বলা যায়। এটা জ্ঞানবান কোনো সত্ত্বা নাকি কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম, যার কারণে অপরাপর নিয়মের ব্যাতায় ঘটে। জানি না। এটা হয়তো অনেক ধরনের বলাবলির একটা রূপ মাত্র।
তবে সায়েন্স ফিকশন মানে কী শুধু টেকনোলজির ও তার প্রতিক্রিয়ার বর্ণনা নাকি সমান্তরালে মানুষের আধ্যাত্মিক চিন্তাশীলতা, সমাজের বিবর্তন ধারা বা অর্থনৈতিক-ধর্মীয় নানা অবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে? সাধারণত এসব ফিকশনে টেকনোলজির দখলজনিত কারণে একটা গোষ্টীর ক্ষমতাশালী হয়ে উঠার গল্প দেখা যায়। টেকনোলজি অর্থে দুর্বল অনুন্নত একটা গোষ্ঠীর কাছে অবস্থাজনিত কারণে অতি সামান্য মানবিকগুণ বিদ্যমান থাকে। তাইলে সমাজ সংগঠনের অপরাপর উপাদানের কাজ কী? এর অর্থ হলো বিজ্ঞানকে স্রেফ টেকনোলজি আকারে দেখার প্রবণতা বিদ্যমান। এর কারণ হলো যুক্তি ছাড়া মানুষের অপরাপরের বৃত্তির দিকে আমাদের নজর থাকে না। একই সঙ্গে ক্ষমতাকে নেতিভাবে দেখানোর প্রবণতা।
এ উপন্যাসে একই বস্তুর একই সঙ্গে দুইটা জায়গায় থাকারে সমর্থন করে। যা লজিক্যালি সম্ভব না। তাইলে কীভাবে সম্ভব? যদি প্রকৃতি ব্যাপারটাকে সাপোর্ট করে। যেমন রিটিন তার বর্তমানে অন্য মানুষদের সঙ্গে বিপ্লবে সামিল থাকে, আবার টাইম ক্যাপসুলে শুয়েও আছে ৫০০ বছর ধরে। বেশ ইন্টারেস্টিং। কোয়ান্টাম ফিজিক্স বা অন্য অর্থে এ ব্যাখ্যা হয়তো সম্ভব। অনুমান করছি মাত্র। তা অবশ্য এখানে দরকার পড়ে নাই।
আরেকটা ব্যাপার হলো— ‘প্রকৃতি দ্বারা সবকিছু পূর্বনির্ধারিত’ এমন সত্য জানা সত্ত্বেও বিজ্ঞানবাদীদের সমস্যা নাই। কারণ মানুষ তো ভবিষ্যত জানে না। পূর্ব নির্ধারিত হলেও মানুষ কাজ করার পর ফলটা জানতে পারে। তাইলে বিজ্ঞানসম্মত লোকজন যখন নিশ্চিত ‘সবই প্রকৃতি দ্বারা পূর্বনির্ধারিত’, তখন তারা কাজকর্ম কইরা প্রকৃতিকে লঙ্ঘন করছে না। যদিও তারা জানে না প্রকৃতি আসলে কোন ব্যতিক্রম ব্যাপারটাকে নির্বাচন করেছে। আর ওইসব জায়গায় আপাতত যাকে লজিক্যাল বলছি তা ঘটবে না! অথচ ধর্ম সম্পর্কে বলা হয়, ধার্মিকরা মনে করে সবই পূর্ব নির্ধারিত— এটা ধর্মের বিরাট সমস্যা, কুসংস্কার, মানুষরে অলস করে দেয়। মানে হইলো, একই ঘটনা বিজ্ঞানে থাকলে সমস্যা না, ধর্মে থাকলে সমস্যা! আবার ধর্মের পক্ষের কেউ কেউ নিজের ‘পূর্ব নিধারণ তত্ত্ব’কে জায়েজ করতে বিজ্ঞানের যুক্তির আশ্রয় নিতে পারেন। সেটা আসলে বিজ্ঞানই না। ধর্ম কতটা?
লেখার শুরুতে মশিউল আলমের উদাহরণ দিছি। তার একটা কারণ আছে। ওইটা সায়েন্স ফিকশন হইলেও সাহিত্য যেমনে সমাজ-সংসাররে ডিল করে তার কিছু মজা পাওয়া যায়। যা ড. ইকবালের সায়েন্স ফিকশনে ততটা নাই। বরং বিজ্ঞানবাদ দিয়া ভুতুড়ে ও কল্পনার জগত তৈরির চেষ্টা আছে। সেটারে কি আমরা আমাদের বর্তমানের ধারাবাহিকতা হিসেবে মেনে নিই! এমনকি আমাদের স্থানীয় বিজ্ঞান, যেটা নানাভাবে চর্চা হয়ে আসছে হাজার বছর ধরে তার সঙ্গে পরিচয়ের কোনো চেষ্টাও নাই। গ্রেকো-রোমান সভ্যতার অনুকরণে আধা-খেচড়া ভবিষ্যত নির্মাণ করা হয় এসব বইয়ে। ‘রিটিন’র মধ্যে মাধ্যমে মানুষের বৈচিত্রের জয়োগান গাওয়া হয়। কতটা? বরং আমাদের সায়েন্স ফিকশন লেখা হয় পশ্চিমের ‘আমার মতো হইয়া আলোকিত হও’ ধারণার মতো। অথবা সায়েন্স ফিকশন পশ্চিমা ব্যাপার বইলা তার আছর কাটাইতে পারে নাই। যা উপন্যাসে সম্ভব হইছে।
অল্প বিস্তর অনুবাদের সুবাদে স্পেস অডিসি বা ফাউন্ডেশন পড়ার সুযোগ পাইছি আমরা। সেখানে কিন্তু ঠিক ঠিকই নানান ধরনের ব্যাপার আসছে। মানব সভ্যতা, তার বিবর্তন, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি বা নৈতিকতা— যেটা বলেন। ওইসব পইড়া মনে হয় তেমন লেখা যে বাংলায় কবে পাবো! বাংলা সায়েন্স ফিকশনের বাচ্চালোগ দশা কবে যে কাটবে?
এমন প্রশ্ন সত্ত্বেও বলি, ড. ইকবালের লেখার একটা গুণ আছে। এখনো মজা করে পড়া যায়! একই কায়দায় কলাম লিখতে গিয়া অবশ্য কল্পনার দফা-রফা করে ফেলেন তিনি। সে অন্য গল্প!