পুনর্জন্ম শুনলে আমার নাকে খানিকটা ধর্মতাত্ত্বিক গন্ধ লাগে! আবার খানিকটা রোমান্টিসাইজও করি। খামতিপূর্ণ মানবজীবন বলে কথা! এ জনমে যা হয় নাই- তা অপর জনমে হবে এরকম একটা ব্যাপার আছে। অথবা যা অপর জনমে করি নাই, তা এ জনমে চাই। অথবা অপর জনমে যা যা পাইছি তার ষোলআনা হক্ব আদায় করতে চাই। এমন ভাব ব্যক্তিভেদে কেমন হাবে-ভাবে প্রকাশ পায় সচরাচর জানা হয় না কিন্তু সাহিত্য এন্তার পাইবেন।
সিফাত বিনতে ওয়াহিদ তার পয়লা কাব্যগ্রন্থের নাম ‘পুনর্জন্ম’ রাখায় এমন কল্পনা বা বাতচিতের সুযোগ পাওয়া গেল। বইটা আগাগোড়া উল্টানোর পর মনে হলো অপরাপর অনেক বিষয়ের মতো কিছু মিনিং আমাদের কাণ্ডজ্ঞানে এমনে এমনে আসে না বা নতুন অভিজ্ঞতা আকারেও আসে না- অন্যকিছু (এখানে কবিতা) তারে জাগায়া তোলে। মনে হয় আমার মধ্যে অতীত হয়ে বা সমান্তরাল যাপনের চিত্র হয়ে আঁকা ছিল। কিন্তু একটা সময়ের আগে তারে বিচার করা দেখা হয় নাই। কেমনে? ‘পুনর্জন্ম’ সেখান উদাহরণ হতে পারে। যাক তবে অল্পবিস্তর কথায় নিজের স্মৃতির উস্কানো, কী বলেন?
কবিতা কী বা কবিতা কেনো লেখা হয় তা নিয়ে বিস্তর কথা আছে। এ বেলায় মনে হলো প্রতিটি কবিতায় কবিতার নিজস্ব অর্থ নিয়ে সটান হাজির থাকে। তাই আগাম অর্থ ধরে না হাঁটাই ভালো। বরং সপ্রাণ আবির্ভাবের ব্যাপারটা উপভোগ করা যেতে পারে। এর ওপর সিফাতের কবিতাগুলার আলাদা আলাদা কোনো শিরোনাম নাই। পুরো বইটা হলো উপলক্ষের পুনর্জন্ম।
তোমার কাছে গেলেই
ভয়ঙ্কর নিশ্চুপ হই
নিস্তব্ধতায় খুঁজে বেড়ায়
কথার আড়াল
(পৃষ্টা ২৩)
এই কবিতাসহ অপরাপর কবিতা ‘তুমি-আমি’তে পর্যবসিত। কবিতাকে ‘তুমি’ বলতে পারায় নিজস্ব একটা গল্প তৈয়ার করলেন সিফাত। যার কাছে নিজেকে সমর্পন করা যায়, আবার কবিতাও সমর্পিত হচ্ছে। প্রেম এমনই হয়। তার চিহ্ন পুরো বইজুড়ে আছে। তো একই কবিতায় বলা হচ্ছে-
অথচ
তোমার-আমার মাঝে
এখন আর কোনো
দৃশ্য অবশিষ্ট নাই।
না থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। দৃশ্যের আড়ালে যে নিখিল ভাবের উদয় হয়- যেখানে অপরাপর জন্মগুলো পরস্পরের ভেতর লীন হয় সেখানেই শুধু এমন কথা সম্ভব। কোথায় যে ভাব বা দৃশ্যের জড়াজড়ি আর কিছু থাকে না অবশিষ্ট। আবার তাদের আলাদা করা যাইতেছে অবলীলায়। কবিতা!
প্রতিবার আমি নিজেকে হারাই
গভীর শূন্যতাবোধে
অনিশ্চিত অস্থিরতায়
লিখে যাই অতীত
প্রতিটি ব্যর্থতার গান।
কিছু শব্দগুচ্ছ ছাড়া
আমাদের মাঝে নেই কোনো দৃশ্য
খুব সযতনে কেউ যেন
ইরেজারে মুছে দিয়ে গেছে
এক একটা চিত্রকল্প।
(পৃষ্টা ২৪)
এবার বোধহয় ব্যাপারটা ধরা যাচ্ছে। এখানেই এসে ভয় হয়। কবিতার মধ্য দিয়ে ভাবকে মানুষ থেকে আলাদা করছি না তো। মানুষের জ্বালা-পোড়ার কথা আড়াল হয় না তো! না। বোধহয় সে রকম কিছু না। কবিতার মধ্যে কবির সজ্ঞান, অবচেতন, যৌথ চেতনার প্রাপ্তি ঘটে। কবিতায় মানুষ সমর্পিত হয়। ফিরতে পথে আবার নিজেকে দেখে যায়। পুনর্জন্মের ব্যাখ্যায় শুধু কবিতাই নয়, বইটির ভূমিকায় সিফাত কী বলছেন তাতে চোখ বুলানো যেতে পারে। তিনি বলছেন, আমাদের সমগ্র জীবনব্যাপী- আমরা প্রতি মুহূর্তেই ‘জন্ম’ নেই, আবার প্রতি মুহূর্তেই ‘মৃত্যুবরণ’ করি- এই প্রক্রিয়াই আমাদের পরবর্তী জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমার এক মুহূর্তে আনন্দ লাভ করি, অন্য মুহূর্তেই বিষাদগ্রস্ত হই- মানসিক অবস্থা পরিবর্তনের এ মনোভাব ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতিতে ‘পুনর্জন্ম’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।
অর্থাৎ, পুনর্জন্ম সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা দিচ্ছেন। এ ধারণার সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক অপরিহার্য নাও ধরা যেতে পারে। পাঠের ক্ষেত্রে পাঠক স্বাধীন। এমনকি পুনর্জন্ম ধারণাটার ক্ষেত্রেও।
বইয়ের একদম শুরু থেকে দুটো কবিতা দেখা যেতে পারে-
কিছু হাহাকার অপ্রাপ্তিতায় মিশে
অযতনে বেড়ে উঠা বিষে
পাখি তার ডানা গুটিয়েছে খুব ধীর
বাকিটুকু পথ অবিশ্বাসের স্থির।
( পৃষ্টা :১২)
সীমাহীন সেই নৈঃশব্দ্যের পথে
হেঁটে যেতে যেতে
আজও সাধ হয়
তোমার নির্জনে একা পা বাড়াই…
চেতনাহীন উন্মাদ কিশোরীরর মত
ইচ্ছে করে- স্মৃতির সিড়িঁ বেয়ে নেমে যেতে
অনেকখানি নীচে-
যেখানে বোধহীন সব মানুষের বিস্তার।
(পৃষ্টা : ১৩)
পুনর্জন্মের এ পৃষ্ঠায় সকল আবির্ভাব ও সম্ভাবনাকে এক করে দেখতে পারে বাসনা আছে। এ যেন নতুন আবির্ভাবের মুহূর্ত। এখানেই কী কবিতারা এসে ধরা পড়ে। অনন্য হয়ে পড়ে মুহূর্তগুলো। এ যেন একাকীত্বের বিভ্রমের বিস্তারে সমগ্রের মাঝে আসা-যাওয়া। তা ক্ষণে ক্ষণে ধরা পড়ে অনুভূতির বিস্ময়কর আয়নায়। তার বর্ণনায় আঁকা হয়ে যায় বিহ্বল মুহূর্ত। কবির পুনর্জন্ম ঘটছে। কখনো তা যেন জিজ্ঞাসার ছলে অবিশ্বাস—
আকাশ জুড়ে ধূসর ছায়া
মেঘ গুম গুম করে
বেশ তো ছিলাম- নির্জনতায়
বৃষ্টি কেন ঝরে?
(পৃষ্টা : ১৯)
এইসব মুহূর্তিক বিস্ময়ে অনেক কিছু স্মরণ করা যায়, চাইলে গেয়ে উঠা যায় প্রিয় কোনো গান—
এভাবেই দেখা হবে আবার—
ভেবেছিলো কে কবে?
তবুও আকাঙ্ক্ষার স্রোত
কতবার তুফান তুলেছে
ভোরের সাগর,
পেছনে গানের সুর “খোয়া খোয়া চান্দ…”
(পৃষ্টা : ৪৪)
আমাদের সব কথা
বলা হয় না তবুও!
প্রতিদিন জেগে থেকে থেকে
কিছু নতুন শব্দ জমাই
ভাঙনের সুরে সাজাই
নতুন কবিতা।
বলা হয় না তবুও
কেবলই ভেঙে যাই। (পৃষ্টা : ৩০)
কবিতা নিয়ে এসব কথা চালাচালি বা কবিতার মুহূর্তে পুনর্জন্মের নানা অর্থ মিলতে পারে। তার সঙ্গে কবিতার কী সম্পর্ক অথবা কবিতার হয়ে উঠা খানিকটা উপলব্ধি করাও যায়। উপলব্ধির পেলব স্বরের ভেতরে নিজেকে ডুবিয়ে ছন্দে ছন্দে আবৃত্তি করা যায় সিফাতের কবিতা। এটা অতিশয়োক্তি নয়। সমষ্টির ভেতরে হাঁসফাঁস লাগে বলেই হয়তো কবিতায় নির্জনতাকে বেছে নেন কবি। তার ভেতরেই কত কথার জন্ম। ইঙ্গিত দিচ্ছেন ফেরত যাওয়ারও।
এই বইয়ের কবিতার মোটাদাগে কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। জ্বালা যন্ত্রণার ভেতরও গীতল ছন্দ আছে, পড়তে আরাম পাওয়া যায়। সমর্পন আছে— যে সমর্পণের অভাব যে দ্রোহ ভেবে ভেবে বারবার ভুল করি। কবিতাকে উপমানির্ভর না করে দৈনন্দিন কথামালার ভেতর আত্মাবিষ্কারের এ হাতছানিতে পরোয়া না করে এগোনো যায় না।
শেষে এসে কবিতা নিয়ে বলাবলিকে হেঁয়ালিই মনে হচ্ছে। কেন? তার কারণ বলার আগে বলি, সিফাতের কবিতা পড়ার জন্য আসলে এমন রিভিউ দরকার পড়ে না। চলচ্চিত্রকার ও লেখক রাজীব আশরাফ এ বইয়ের শুরুতেই ছোট্ট একটি আলোচনা লিখেছেন। বিনীত অনুরোধ— সে লেখাটা না পড়ে কবিতায় প্রবেশ করুন। নইলে লেখাটি দ্বারা ভীষণ প্রভাবিত হতে পারেন। যেমন আমি হয়েছিলাম। ওই লেখার কথাগুলো ভুলে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার বই পড়ে নিজের মতো অর্থ উদ্ধার করেছি, যাকে এখন রিভিউ বলছি। হ্যাঁ, সিফাতের বই পড়ার জন্য এ রিভিউতে চোখ রাখার মানে হয় না। সে ক্ষেত্রে আমি যদি প্রভাবক হই- পাঠক নিজেই অর্থ উদ্ধারে আপন আয়না হারাবেন। অপরের ভাবনায় নিজেকে হারানো আপনি উপভোগও করতে পারেন। কারণ এতক্ষণ আমরা সিফাতের আয়নায় কবিতার অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। আর বারবারং পুনর্জন্মের দেখা পেয়েছি। সে আনন্দে আরো দু’টি কবিতা-
বাতাসও কী কঠিন!
নিশ্চুপ নিশ্চল
ওসব জানার
তোমার কী দায়!
তুমি বরং থমকাও,
চমকে যাওয়ার ভণিতায়!
আমারও যেন কেমন লাগে—
এইসব অনুভূতি বহুদিন মৃত!
(পৃষ্টা : ৩৮)
মাঝরাতে কে যেন বলে ওঠে কথা
কেউ একজন ক্রমাগত কথা বলেই যায়…
হয়ত আমি,
আমিই ডেকে যাচ্ছি বারবার! (১৫, পৃষ্টা : ২৬)
*’কবিতায় পুনর্জন্মের আস্বাদ’ শিরোনামে লেখাটি ছাপা হয়েছিল আরটিভি অনলাইনে।