শিবের বাড়িতে নজরুল

জায়গাটার নাম শিবালয়। মানে শিবের আলয়। যখন জানলাম নদীও আছে, আনন্দ পেলাম। নদীর নাম স্মরণ করে আনন্দ বাড়ল। পদ্মা! এদিকে তো তারই থাকার কথা।  দেবী মনসার আরেক নাম পদ্মা। যার বাবা শিব, মা পার্বতী। চাঁদ সওদাগরের কাহিনি নিশ্চয় মনে আছে। এ বিদ্রোহী কন্যা পুজো পাওয়ার জন্য কত কিছু করলেন। তো, এই হলো শিবালয়। আর সেখানে আসলেন মনসা। এর চেয়ে মজার বিষয় কী হতে পারে!

এসব ভাবতে ভাবতে মোটর রিকশা থেকে নামলাম। বিকেল শেষ হয়ে আসছে। হাওয়া জানান দিচ্ছে হিম নেমে আসতে দেরি নেই। দিঘির পাড়ের দোকানে রং চা পান করে আপ্লুত হওয়ার পালা। দিঘিতে ফুটে আছে বেশ বড়সড় শাপলা। খানিকটা ভুল হলো! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় শাপলা তার পাখনা বন্ধ করে দিয়েছে। সুন্দর একটা বাঁধানো ঘাট। ঘাটের পাশে রাস্তা লাগোয়া নবরতœ মঠ। বেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এ মঠের সঙ্গে কি শিবের সম্পর্ক আছে? ঘাটের কাছে যেতেই সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল। তার একপাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী প্রমীলার ছবি। অন্য পাশে কী যেন লেখা।

shivaloy-nazrulসেটা অবশ্য ইতিহাসই। যা লেখা আছে, “জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২২ সালে পত্নী প্রমীলার পৈতৃক বাড়ি তেওতা গ্রামে প্রথম বেড়াতে আসেন। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক কবিতা লেখায় দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কবির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে ১৯২২ সালে দ্বিতীয়বার তেওতায় আসেন। এখান থেকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯২৬ ও ৩৮ সালে কবি তেওতা আসেন। তেওতায় অবস্থানকালে তিনি নবরতœ সংলগ্ন এ দিঘির ঘাট ও বকুলতলার গোলঘরের লোহার বেঞ্চে বসে অনেক কবিতা ও গান রচনা করেন। তিনি এ দিঘিতে সাঁতার কাটেন। তেওতা গ্রামে অবস্থানকালে জমিদারের কারুকার্যখচিত স্থাপত্যকর্ম, উৎসবমুখর পরিবেশ ও পাশে বয়ে চলা যমুনা নদীর নৈসর্গিক দৃশ্য কবিকে মুগ্ধ করে। তিনি স্মৃতিতে  লেখেন, ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী এ কোন সোনার গাঁয়’। কবি ‘ছোট হিটলার’ কবিতা লেখেন, ‘মাগো! আমি যুদ্ধে যাব, নিষেধ কি মা আর মানি? রাত্তিরে রোজ ঘুমের মাঝে ডাকে পোল্যান্ড-জার্মানি। ভয় করি না ‘পোলিশ’দের জার্মানির ঐ ভাঁওতাকে, কাঁপিয়ে দিতে পারি আমার মামার বাড়ি ‘তেওতা’কে।’ কবিতা-গান ও কালজয়ী সাহিত্য রচনায় মুগ্ধ হয়ে তেওতা এস্টেটের ভূতপূর্ব জমিদার প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, লেখক ও পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিরণ শংকর রায় চৌধুরী কবি নজরুলকে পরম স্নেহ ও আদর করতেন। এ কারণে জমিদারের আমন্ত্রণে কবি নজরুল কয়েকবার তেওতায় আসেন।”

সাইনবোডের কথাগুলো প্রচার করছে ‘তেওতা নজরুল-প্রমীলা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’ ও ‘শিবালয় নজরুল-প্রমীলা ইনস্টিটিউট’। শিবালয় হলো উপজেলা আর গ্রামের নাম তেওতা। এ উপজেলায় পড়েছে আরিচা ফেরিঘাট। যার পাশ বেয়ে আমরা এসেছি তেওতায়।

লেখাটা পড়ার পর শিবের বাড়িতে মনসা আসার কাহিনি কল্পনা থেকে অতিকল্পনায় রূপ নেওয়ার আশঙ্কায় হাঁসফাঁস শুরু করল। তারপরও আমরা ভাবতে থাকি, তারা ভুল করেই পদ্মাকে যমুনা লিখেছে। আরে, নজরুলের ‘ওরে নীল যমুনার জল’ তো আগ্রার যমুনা। আর ‘পদ্মার ঢেউ রে’ খাঁটি বাংলাদেশের জিনিস। ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবনায় আপ্লুত হলাম। শাপলাকে ভুল করে ‘হৃদয় পদ্ম’ ভাবতেও ভুল করলাম না।

এসব ভাবনায় নিয়ে ঘুরতে থাকি তেওতার জমিদার বাড়িতে। বিশাল বাড়ি। কিন্তু কিছুই অক্ষত নেই। একটা মন্দিরমতো বিশাল ঘর আছে ভেতরে। সেখানে সরস্বতী মূর্তি। এটারই যত শ্রী। হালকা গোলাপি রঙের মূর্তি। সম্ভবত পুজো হয়; মনে হয় নিয়মিত। না-কি! মনসার উপস্থিতি চোখে পড়ল না। অবশ্য অনিন্দ্যকান্তি সরস্বতী, বীনা ও রাজহাঁস তত ভীতপ্রদ নয়, যতটা মনসা ও সাপ। আবার, সরস্বতী ও শিব সম্পর্ক রহিত নয়। সরস্বতী হলেন ব্রহ্মার কন্যা। সরস্বতীকে অপমানের দায়ে শিব তো একবার ব্রহ্মাকে শরবিদ্ধ করে হত্যা করে। পরে অবশ্য প্রাণ ফিরিয়ে দেয়।

শিব ও মনসা কাহিনিটা খানিক জেনে নেওয়া যাক। পার্বতী হলেন শিবের স্ত্রী। তাকে ছাড়া শিবের কাম হয় না। একবার পার্বতীর কথা চিন্তা করে কাম চেতনায় বীর্য বের করে দেন। সেই বীর্য পদ্মপাতার ওপরে রাখেন। বীর্য পদ্মের নাল বেয়ে পাতালে চলে যায়। সেখান থেকেই মনসার জন্ম। বাসুকীর কাছে বড় হয় মনসা। বাসুকী তার কাছে গচ্ছিত শিবের ১৪ তোলা বিষ মনসাকে দেন। তরুণী মনসা বাবার কাছে ফিরে এসে তার পরিচয় দেয়। আবদার করে কৈলাসে বাপের বাড়ি যাবার। শিব স্ত্রী পার্বতীর ভয়ে কন্যাকে নিতে চান না। পরে মন্দিরে ফুলের ডালিতে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু পার্বতী মনসাকে দেখে ফেলে। মনসাকে সতিন মনে করে একচোখ অন্ধ করে দেয়। মনসা পার্বতীকে দংশন করে, শিবের অনুরোধে আবার জীবিত করে তোলে। পার্বতীর রোষে মনসাকে বনবাস দেওয়া হয়। এর মধ্যে ব্রহ্মার বীর্য ধারণ করে মনসা ঊনকোটি নাগ জন্ম দেন। এরপর মনসা সর্পদেবী আকারে হাজির হন। বনবাস থেকে ফিরে মনসা নিজের পূজা প্রচলনের আবদার প্রকাশ করে শিবের কাছে। শিব বলেন, যদি চাঁদ সওদাগর মনসার পূজা দিতে রাজি হয়, তবে দুনিয়ায় মনসার পূজার প্রচলন হবে। খেয়াল রাখা দরকার মনসার জন্ম কোনো নারীর গর্ভে না। সন্তানের মধ্যে মা-বাপ দুইয়ের অংশ থাকে। আর মনসায় পুরোটাই বাপ। তার মানে কী। মনসার ভেতর-বাইরে শিব ছাড়া অন্য কথা নাই। এখানে শিব নারী হয়ে ওঠেন। শিব কে?

শিবের মধ্যে এ ভূখণ্ডের কৃষকদের আদিকল্প আছে। পুরাণ হিসেবে সে পাঠ দারুণ। শিব কৃষিকাজ করে, অলস, আফিম-ভাং খায়। তার কাম চেতনা লৌকিক। কোন অর্থেই দেবসুলভ না। তার মধ্য দিয়েই কৃষিকাজ দেববৃত্তি হিসেবে কায়েম হয়। শিব স্ত্রৈণ। পিতৃতান্ত্রিকতার বাইরে না। আবার মনসার চরিত্র কোনোভাবেই দেবীসুলভ না। অমার্জিত, রুক্ষ। ভক্তের পূজার কাঙাল। একটু ভক্তিতে সব অবহেলা, লাঞ্ছনা ভুলে যায়। বাম হাতে পুজো দিলেও চলে। এই দিক থেকে যতই আর্য মিশেল থাক না কেন, শিব অনার্য পুরুষ, অন্যদিকে মনসা অনার্য নারী। শিব একই সাথে প্রকৃতি আবার পুরুষও বটে। সেই অর্থে মনসার জন্মের ভেতর দিয়ে মানবজন্মের পুরোটাই উপলব্ধ হয়। তাই মনসার লড়াই এই অর্থে শিবের নিজেরও লড়াই বটে। তাই মনসাকে পূজা দেওয়া মানে শিবকে পূজা দেওয়া।

নজরুলের শিবালয় প্রসঙ্গে শিবের অন্য একটা গল্প মনে পড়ল। দেবতারা সাগর মন্থন করে সব অমৃত নিজেদের করতলে নেবেন। কিন্তু গরল রাখবেন কোথায়? ভূমিতে রাখলে তো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। দেবতারা মানবজাতিকে রক্ষা করতে যা করলেন না, শিব তা-ই করে দেখালেন। সে গরল গলায় পুষে রাখলেন। না পারছেন গিলতে, না পারছেন ফেলতে। কণ্ঠ তার নীল হয়ে গেছে। কৃষ্ণের মতো নিরঞ্জন হওয়ার নীল নয়। শিব যন্ত্রণা রুখতে গলায় সাপ ঝুলিয়ে রাখেন। এমন গল্প আর বাস্তব ইতিহাসের নজরুলের সঙ্গে কী যায়! ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য; আমি কৃষ্ণ-কণ্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির। আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।’ লাইনগুলো নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার। উল্লাস, যন্ত্রণা, জীবন-মৃত্যু একাকার। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি। নজরুল নিজেকে বারবার উন্মাদ বলেছেন এ কবিতায়। বাংলায় তো শিবের মতো পাগল আর কেউ নাই। একই কবিতায় কী মনসার স্বভাব নাই! যথা শিব তথা মনসা! মজার বিষয় হলো কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। একই বছর তেওতায় আসেন নজরুল। এ ছাড়া, পুরো বিষয়টাই কল্পনা। উপলক্ষ শিবালয়, পদ্মা, নজরুল-প্রমীলা।

shivaloy-nazrul1তখনো পশ্চিম আকাশটায় সামান্য লাল আভা অটুট ছিল। একটু পর মাগরিবের আজান দেবে, এমন সময় সুঘ্রাণওলা একটা মাজারের পাশ দিয়ে আমরা দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিলাম। পদ্মাকে দেখব বলে। কত পথ মাড়িয়ে হিমালয় থেকে শিবালয়ে এসেছে জলধারা। আমরা কাছে যাব না, তা কি হয়! কোথায় জলধারা? পাড়ের কাছাকাছি সামান্য পানি জমে আছে। ধারা নয়। একপাশে শুকনো। আমরা পা না ভিজিয়ে দিব্যি বালি চরে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলি। একটা ছবিতে আমি হেঁটে যাচ্ছি। ক্যাপশনে? ‘কোথায় তোমার বাড়ি?’ আহা! পদ্মা আমার বাড়ি হবে কেন!

রাডইয়ার্ড কিপলিং’র একটা উপন্যাস আছে। কিম। একটা পবিত্র নদীর খোঁজে থাকে সে উপন্যাসে। যে নদীতে স্নান করে শুদ্ধ হয়েছিলেন বুদ্ধ। নদীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হয়তো তেমন নয়। কিন্তু এ জনপদ, ভূগোলের যত সমৃদ্ধি, ইতিহাস তার সঙ্গে নদীর সম্পর্ক তো অঙ্গাঙ্গী। শিব ও মনসার সম্পর্ক প্রকৃতির সঙ্গে। যে প্রকৃতিতে সৃষ্টিকূলের প্রতিপালন হয়। নদী বিদ্রোহী। তা সত্ত্বেও মানুষ চিরকাল তাকে এই হালতেই আপন করেছে। কিন্তু এখন কোথায় সে বিদ্রোহ। এলোমেলোভাবে বালুচরে হাঁটতে থাকি। তারপর শেষ আলোটুকু নেভার আগে ফিরতি পথ ধরি। শিব, পদ্মা, নজরুল সবাইকে ছেড়ে।

দিন দুয়েক পর অনলাইনে বিষয়টা নিয়ে বসলাম। হ্যাঁ, এ নদীর নাম যমুনা। এ যমুনা সে যমুনা দেবী নয়, যে নদীর রূপ ধরে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলতে চায়। পুরাণের ওই নদী ভারতে। কংসের হাত থেকে বাঁচাতে শিশু কৃষ্ণকে কোলে নিয়ে সে নদী পাড়ি দিয়েছিলেন বসুদেব। মানিকগঞ্জে কৃষ্ণপুর বলে একটা জায়গা আছে। যমুনা থাকবে কৃষ্ণ থাকবে না! আমাদের যমুনা ব্রহ্মপুত্রের উপনদী। ব্রাহ্ম তো পুরাণে দেবকুলের শিরোমণি। আরো জেনেছি এখানে মহাদেবপুর বলেও একটা জায়গা আছে। শিবের মার্জিত নাম মহাদেব।

তো, এ নদী যমুনা। যার বালুচরে হাঁটছিলাম। আরও খানিক গিয়ে পদ্মার সঙ্গে মিলেছে। কিন্তু কোথায় নীল যমুনার জল? নীল নিরঞ্জন। কোথাও নাই!

> লেখাটি সাম্প্রতিক দেশকালে প্রকাশিত। কৃতজ্ঞতা : শাহনেওয়াজ খান ও রওশন আরা মুক্তা।

Comments

comments