লাইফ অব পাই তেমন একটা চলচ্চিত্র যেটা দেখতে থাকি আর ভালো লাগে। কিন্তু শেষে কেন জানি মনে হয় ভালো লাগে নাই। ভালো লাগে নাই এটা কোন বাইনারি মিনিং না। এই যেমন ধরেন একা একা রাস্তা ধরে হাঁটতেছেন। একটু উদাস উদাস। ভালো লাগে আবার লাগে না। ফুল দেখলেন— ধরলেন, পাতা দেখলেন— ধরলেন, শিশু দেখলেন— আদর করলেন এবং আরো অনেক কিছু করলেন না। কিন্তু আপনি কি করতে চাচ্ছেন তা জানেন না অথবা কি করে ফেলছেন তাও বুঝছেন না। যেহেতু জিনিসটা ডিফাইন করা যাচ্ছে না, তখন স্বগতোক্তি করে বলতে পারেন, ধুর কিছুই বুঝতে পারছি না।
লাইফ অব পাই ভালো না লাগার মধ্যে কি যেন মিস করছি। কি মিস করছি সেটাও বুঝা যাচ্ছে না। পরের বার দেখলে হয়ত মনে হবে আসলে মিস করছি। এবারও প্রশ্ন হবে কি মিস করছি। এটার কোন উত্তর হবে না। একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে পাইয়ের আসল কাহিনী লোকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার একটা ছক আছে। মানে বে-লাইনে কোন ঘটনা ঘটলেও দুনিয়ারে বুঝাইতে হবে কোন একটা লাইন নিয়া। দুনিয়ার এই মনস্তত্ত্ব পুস্তক আর চলচ্চিত্রের পাই ঠিকই বুঝছে। সে তখন আরেকটা কাহিনী বানাইয়া বলে। তখন লোকে বিশ্বাস করে। সেখানেও আরেকটা মজা লুকিয়ে আছে।
যাই ঘটুক না কেন, ২০০২ সালে বুকারজয়ী একটা উপন্যাস চলচ্চিত্র হইল। তাও আবার থ্রিডি। থ্রিডি শুনলে যে অ্যাকশন ভাব জাগে তা এতে নাই। ফলে চলচ্চিত্রে দেখা না গেলে পাই নিজেই লোকজনরে থ্রিডি-র কমন ফরমেটের একটা গল্প শুনাইয়া দেয়। সে গল্পে মানুষেরা নিজেরা মারপিট করে। খুনাখুনি করছে। তাইলে দাঁড়াচ্ছে মানুষ মানুষরে খারাপ জায়গায় দাঁড় না করাইয়া পারে না। মানুষের ইতিহাস যে সংগ্রামের ইতিহাস। মানুষের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। তাদের হৃদয় আর্দ্র হোক।
সম্প্রতি সময়ে ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকা একটি তালিকা ছাপিয়েছে। তালিকা শিরোনাম বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘চিত্রায়ন হয় না এমন দশটি উপন্যাস’। সৌভাগ্যের বিষয় হলো একটি বাদে সবগুলির চিত্রায়ন হয়েছে। যার একটি হলো কানাডিয়ান লেখক ইয়ান মার্টেলের ‘লাইফ অব পাই’।
পাইয়ের গল্পটা এইরকম যে, ইন্ডিয়ার পিসিন পাই প্যাটেল খুবই কৌতূহলী কিশোর। তার কৌতূহলে জীব বিজ্ঞান গণিত ধর্ম কিছুই বাদ নাই। আবার সে সবকিছুকেই বিশ্বাস করতে চায়। কিন্তু তার বাবা বলে সবকিছুকে বিশ্বাস করা যায় না। কেরালার পুদুচেরি বোটানিকাল গার্ডেনে পাইয়ের বাবার একটি চিড়িয়াখানা ছিল। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলিকে আমেরিকায় এক সার্কাস কোম্পানিকে বিক্রি করে কানাডার অভিবাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পাইয়ের মা-বাবা। জাহাজে বাঘ, ওরাংওটাং, জেব্রা সকলকে তোলা হয়। মাঝসমুদ্রে জাহাজ ডুবে যায়। পাইয়ের মা বাবা বড় ভাই সকলে মারা যায়। একমাত্র মানুষ পাই-ই লাইফবোটে বেঁচে থাকে। লাইফবোটে পাইয়ের সঙ্গে একটি জেব্রা, ওরাংওটাং ও হায়না চলে আসে। কয়েক দিন পরে দেখা যায়, বোটের নীচে বসে আছে রিচার্ড পার্কার নামের বাঘ। যে বাঘটাকে পাই প্রায়শ অনুসরণ করত। এমনকি এটা তার প্রথম প্রেমের স্বাক্ষী। বাঘ বোটের অন্য জন্তুদের সে খেয়ে ফেলে। শুধু বেঁচে থাকে পাই। বাঘ মাঝে মাঝে আক্রমণ করতে চায় কিন্তু পারে না। একই সময় কিন্তু কিশোর পাই তাকে বাঁচাতে নানা বুদ্ধির আশ্রয় নেয়। মিষ্টি পানি যোগাড় করে, সমুদ্রের মাছ ধরে খাওয়ায়। পাই বুঝতে পারে এই সংগ্রাম না থাকলে সে নিজেও বাঁচত না। হিংস্র বাঘ ও মানুষের মধ্যে একটা অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সম্পর্কের মধ্যে আছে এক ধরনের ঐক্য। সে ঐক্যের মধ্যে পাই খুজে পায় জীবনের রহস্য। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বিশ্বাস। সে তো বিশ্বাসের খোঁজে অনেক কিছু বিশ্বাস করতে গিয়েছে। কিন্তু এমন মহাজাগতিক বিশ্বাস কিছুই তার মাঝে জাগাতে পারে নাই।
মিথ্যা গল্প নিয়ে যে কথা হচ্ছিল— ২২৭ দিন পর যখন পাইয়ের ভেলাটি তীরভূমি স্পর্শ করে। প্রথম সুযোগে বাঘটি জঙ্গলে ফিরে যায়। জঙ্গলে ঢোকার মুহূর্তে দ্বিধা নিয়ে পাইয়ের দিকে ফিরে তাকায়। ফিরে তাকায় সম্পর্কের দিকে। আসলে ফিরে তাকায় না। এটা পাইয়ের মনের ভুল। আসলে কি ভুল! এই সম্পর্ক অব্যক্ত বলে অন্য কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু দৃশ্যটি লেগে থাকে। বিশ্বাসহীনতা থেকে গোল বাধে তখনই যখন পাই বলছে, আমি মিথ্যা বলছি। দুইজন জাপানী লোককে যারা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে আসে। তারা পাইয়ের গল্প বিশ্বাস করে না। পাই বাধ্য হয় মিথ্যে করে কাহিনী বলতে।
পাই নামেরও রহস্যের শেষ নাই। পাই হলো এমন রহস্যময় সংখ্যা যার মানের শেষ নাই। বাইশ সংখ্যাটাকে তিন দিয়ে ভাগ করলে যা দাঁড়ায় সেটাই হচ্ছে পাই (অর্থাৎ π=22/7= 3.14159….. ∞)। সংখ্যাটির আবিষ্কারও ইন্ডিয়ায়। একইভাবে মানুষ পাইয়ের গল্প অসীমের ভেতর আটকে থাকা সসীম একটা অস্তিত্বের আকুতি। যে আকুতির কাছে সত্য নানা নামে নানারূপে আসে। যদিও বলা হচ্ছে জার্নি অব লাইফ টাইম। কিন্তু সে একবারই ধরা দেয়। তারপর কুয়াশার আড়ালে অথবা হাতের কাছেই থাকে— ধরা যায় আবার ধরা যায় না এমন কিছু।
বড় পাইয়ের কাছে প্লট খুঁজতে আসা লেখক পাইয়ের বানানো গল্পটি শুনে পাইকে বিশ্বাস করে সে বলে, না তুমি মিথ্যা বল নাই। প্রতীকি করছ। বলে, ‘লাইফবোটে মারপিট হয়েছিল। এক অন্ধ চিনা নাবিক পাইয়ের মাকে মেরে ফেলেছিল। তাকে পাই খুন করে। মানে, সবই প্রতীক। মা ওরাং ওটাং। বৃদ্ধ নাবিক ছিল হায়না। আর রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার আসলে পাই। বেঁচে থাকার জন্য নাবিককে খুন করে সে।’প্রতিবাদ করে না পাই, বলে ‘দুটো গল্প বলেছি। যেটা খুশি, আপনি নেবেন।’
ছবি দেখে আপনার যেটা ইচ্ছা, বেছে নেবেন। যদি এই রকম হয় আমরা যখন বানাইয়া বলি তখন কিছু না কিছু সত্যরে এর মধ্যে হজম করি। করি মানে যেটারে আমরা অন্য কোনখানে অন্যরূপে দেখছি। তাইলে নিজের রূপের বাইরে আলাদা আলাদা হাজির হইতে হয়। তবে মানব জাতির বিশ্বাসকে এতো ছোট জায়গায় না দেখলেও চলে। অথবা সবসময় সে গোল্ড হয়েও থাকতে চায় না। দর্শনশাস্ত্রে পড়াশুনা করা ইয়ান মার্টেলও সেটা করেন নাই। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির লোক বাঘের সাথে ২২৭ দিনের গল্পটা গ্রহণ করে।
২০০১ সালে প্রকাশিত ইয়ান মার্টলের উপন্যাস ‘লাইফ অফ পাই’ সেলুলয়েডে বন্দি করেছেন খ্যাতনামা তাইওয়ানিজ বংশোদ্ভব পরিচালক অ্যাং লি (ক্রচিং টাইগার হিডেন ড্রাগন, ব্রকব্রেক মাউন্টটেন, হাল্ক, সেন্স ওন্ড সেন্সিবেলিটি প্রভৃতি ফিল্মের পরিচালক)। ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া থ্রিডি এই সিনেমাটি এখন ঢাকাতেও দেখা যাচ্ছে। এই চলচ্চিত্রের জন্য সেরা পরিচালকের অস্কার জিতে নেন অ্যাংলি। পাশাপাশি সেরা সিনেমাটোগ্রাফি, ভিজুয়াল এফেক্ট এবং অরিজিনাল স্কোর বিভাগে অস্কারে সম্মানিত করা হয় ছবিটিকে।
সুরজ শর্মা, ইরফান খান, টাবু ও আদিল হোসেন অভিনীত চলচ্চিত্রে আছে আধুনিক মানুষের ভাবকল্প আকারে আধ্যাত্মিক চিন্তা। যার উৎস হিন্দু, খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্ম। যে চিন্তা ব্যক্তিকে খানিক নীরবতা দেবে, দেবে আরাম। অনেকটা মেডিটেশনের মত। কিন্তু কিশোর পাই বিশ্বাস করতে চায়। তার কিশোর মন চিন্তার বিবর্তনের ঐতিহাসিকতা খোঁজে না। অথবা এই প্রশ্নের উত্তর গড়পরতায় আধুনিকতায় ক্লান্ত মানুষের দরকার পড়ে না। তাই তার দর্শন ও সাহিত্যে সমন্বয় ও বৈচিত্র্যকে একীভূত করার অস্ত্র থাকতে হয়। ফলে মার্টেলই পাইয়ের রূপ ধরে মসজিদ, মন্দির, গির্জার অলিগলিতে ঘুরে। সবশেষে মহাসাগরের অসীম জলরাশির ভেতর সে সমর্পিত হয়। তার মধ্যে বিশ্বাসের নিদারুণ কষ্টকর অভিজ্ঞতাটির উদয় হয়। এই উদয়ে মানুষের সাথে বাঘের ভেদও মুছে যায়। মজার বিষয় হলো এই সম্পর্কের বীজটি পাইয়ের মধ্যে আমরা আগেই দেখি, যখন সে খাঁচার বাঘকে মাংস খাওয়াতে যায়। বুঝা যায়, তখন সে সম্পর্ক নির্মাণের তরিকাটা জানত না। উপযুক্ত পরিবেশে তা ঝাড়ে-বংশে বেড়ে উঠেছে।
এভাবে পাইয়ের আধ্যাত্মিক ভ্রমণটি পূর্ণ হয়। ফলে এই আধ্যাত্মিকতায় গরহাজির ঘটে দৈনন্দিন জীবনের। এমনকি পাইয়ের জীবনের সবচেয়ে দুর্লভ মুহূর্তের বিমূর্তায়ন ঘটে। এই চলচ্চিত্রের আধ্যাত্মিকতা আমাদের মুগ্ধ করবে। দূরের স্মৃতির মতো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠে। কখন যে আমি পাইয়ের নৌকায় উঠে গেছি, তা বেমালুম হই।
থ্রিডি দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক— পাইয়ে আছে বর্ণিল নীলের আলোকচ্ছটা। এত এত নীলের অভিজ্ঞতায় আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। সাগরের জলের রহস্যময় রং পরিবর্তন। দৃশ্যায়নের অভিনবত্ব প্রতিমুহূর্তকে টানটান করে রাখে। আমরা বাস্তবে যা মিস করি, অথচ করতে চাই বলে কল্পনা করি। থ্রিডি সে বিলাসিতার চমৎকার সুযোগ দেয়। এই যেমন— জলে নামছেন ভিজছেন না। হুট করে দুর থেকে ছুটে আসা কিছু আপনাকে চমকে দেবে। পর্দার ভেতর পর্দার মতো বিষয়। কিন্তু মিস করেছি টুডি-র কিছু বিষয়। যেমন ক্লোজআপ দৃশ্যে যখন একটা চরিত্র কথা বললে দূরের দৃশ্য ঝাপসা হয়ে উঠে। থ্রিডি যখন বাস্তবকে দৈঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতার সূত্রে হাজির করে, তখন মনে হয় আমরা তো কোন কিছুকে এভাবে দেখি না। টুডি-তে হয়ত অভ্যস্ততার কারণে চোখ মেনে নেয়। এখানে কেমন বেখাপ্পাভাবে মঞ্চ মঞ্চ লাগে। কারণ ক্লোজ আপে যখন কাউকে দেখানো হচ্ছিল তখন তার মাথা গোল মনে হচ্ছিল না। কেমন যেন চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা। ধরেন কাগজের উপর একটা ছবি এক উল্টো দিকে আঁকা লাইন বরাবর নখ দিয়ে দাগ টানলে যেমন হয়।
এছাড়া পর্দা কেমন ছোট ছোট দেখায়। এইসব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে বিকেল বেলার ভালো না লাগার সম্পর্ক নাই। এমন কি এটা লাইফ অফ পাই-কে খাটো করে না। রিচার্ড পার্কারের হঠাৎ আবির্ভাব ভয় পাইয়ে দেয় না এমন দর্শকও বিরল। জয়তু থ্রিডি। অনলাইন ঘেটে জানতে পারলাম উপন্যাসটি চিত্রায়ন নিয়ে প্রযোজক বুঝে উঠতে পারছিলেন না— একটা কিশোর, বাঘ আর সাগর দিয়ে কি হবে। কিন্তু মার্টেলের চিন্তার অভিনবত্ব, আধুনিক মানুষের চিন্তার মর্মশাঁস তুলে আনার দক্ষতা অসাধারণভাবে ঠিকই তুলে এনেছেন অ্যাং লি। অ্যাং লি-র সাধ্য ও সীমা অসাধারণ। তারও জয় হোক।
লাইফ অব লাইফ
কাহিনী : ইয়ান মার্টেল
চিত্রনাট্য : ডেভিড ম্যাগী
পরিচালনা : অ্যাং লি
অভিনয় : সুরজ শর্মা, ইরফান খান, টাবু, আদিল হোসেন
সংগীত : মাইকেল ডানা
সিনেমাটোগ্রাফি : ক্লডিও মিরিন্ডা
স্টুডিও : রিদম এন্ড হুস ও ফক্স পিকচার্স
মুক্তি : ২১ নভেম্বর ২০১২, বাংলাদেশে ১৫ মার্চ ২০১৩
রেটিং : ৪/৫
*লেখাটি ২০১৩ সালের মার্চে আরটিএনএন.নেটে প্রকাশিত।