এ দুনিয়ায় সোরেন কিয়ের্কেগার্ডের দুই-একটা ছবিই মিলে। বিষণ্ন চেহারার একজন মানুষ। রাজ্যের বেদনা-বিরক্তি ভর করেছে তার চোখে-মুখে। সে মানুষটিকে আমি বলি রাজার ছেলে। দর্শন সেতো রাজা। মরিস শ্লিক বা যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদ সম্পর্কিত এক দার্শনিক বলেছিলেন বিজ্ঞানের এ কালে সত্য খোঁজার মতো কোনো কাজ দর্শনের এখতিয়ারে আর নেই। তার কাজ ‘মিনিং’ নিয়ে। সে কোনো কিছু মিনিংফুল কিনা জানাবে। সে মোতাবেক বিজ্ঞান ওই বিষয়ের সত্য খুঁজবে। তাই দর্শন আজ বড় জোর ‘জ্ঞানের রাণী’, রাজা নয়।
কিন্তু রাজা বড়জোর ফকির হতে পারেন, রাণী নন। দুইটা আলাদা বিষয়। রাজা ফকির হলেও লোকে তাকে রাজাই বলে। তাই আমি বলছি রাজার ছেলে সোরেন কিয়ের্কেগার্ড।
স্বভাবই এ চেহেরা সুরত একটা সময়, জ্ঞানকাণ্ড ও ইতিহাস পরম্পরার বিষয়। তিনি একাকীত্ব, বিষয়ীগত ভাবনা, উদ্বিঘ্নতা, মৃত্যু নানা বিষয়কে আলোচনায় প্রধান করে তুলছিলেন। এবং অবশ্যই বেছে নেয়াই মানুষের স্বাধীনতা। ভাববাদের প্রবল জোয়ারের যুগে তিনি অস্তিত্ববাদের গোড়াপত্তন করেন। যা দর্শনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এমনকি দার্শনিক রোমান্টিসিজমের দিক থেকেও। সোরেনের এ আবির্ভাব ও ব্যক্তি মানুষের সংকট পরবর্তীকালে আমাদের আরো অনেকে দার্শনিকের পরিচয় করিয়ে দেয়। এ সংকট অবশ্য আর কাটে নাই।
বলা হয়ে থাকে, তার কাজে সামান্যতম হলেও হেগেলের প্রভাব আছে। আবার তিনি হেগেলের দ্বান্ধিক পদ্ধতিতে দারুণভাবে সমালোচনা করেছেন। হেগেল বুদ্ধি বা রিজনের যে জয়োধ্বনি তুলেন তিনি তার বিপরীতে দাঁড়ান। তিনি মনে করতেন, হেগেলের নীতিবিদ্যা ব্যক্তি মানুষের আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলে না, বরং সমাজের মধ্যেই তার স্বতন্ত্র হারিয়ে যায়। ফলে এর মধ্যে মানুষের কোনো ধরনের বিকাশ ঘটে না। এটা তো সত্য যে কোনো ধারণা এজমালি বিষয়, কিন্তু তার প্রয়োগ তো ভিন্ন ভিন্ন।
এর জন্য আমরা অতি পরিচিত সার্বিক-বিশেষ ধারণায় সাঁতার কাটতে পারি। একই শব্দের ভেতর সার্বিক-বিশেষ হাত ধরাধরি করে থাকে, তারে আলাদা করে চিন্তা করা মুশকিল। সে মুশকিলরেই তিনি বেছে নিছেন। ‘সার্বিক’ বা আগাম ধরে নেয়া ‘সর্বজনীন’ ধারণার বাইরেই তিনি দাঁড়াতে চান। এটাকে চিন্তার নানা দিকের প্রতি বিদ্রোহ আকারে দেখা যেতে পারে।
তার লেখালেখিও সম্ভবত প্রথাগত দর্শনচর্চার মতো ছিল না। তার হেয়াঁলিমূলক লেখাকে ‘সক্রেটিক’ বলা হয়। তার দর্শনচর্চা ফেরত যেতে চায় সক্রেটিসের জামানায়। যিনি মানুষের দেহ-মনের আলাদা ভাগ করেন। এমনকি মরার আগে ও পরে বলে দুই জগত। সে আলাদা থাকার ধারণা পরবর্তী দুই হাজার বছর শাসন করে। এর সাথে ‘বিশেষ’ আর ‘সার্বিক’ এর ধারণা ভাগাভাগি করে থাকবে। সেটা সম্ভবত অস্তিত্ববাদেও ঘটে। ফলে তারা আমি’রে অন্যখান থেকে আলাদা করতে গিয়া ছবির ‘গাছ’, ‘মাছ’, ‘আকাশরে’ আলাদা করে দেখে। কিন্তু সব মিলে কী দাঁড়ায়? অনেক কাল পর হাইডেগার ফিরে তাকাইছেন পারমেনাডিসের দিকে। তিনিও কিয়ের্কেগার্ড বিজ্ঞান, পুঁজি নানা কিছু জাত বিচ্ছিন্নতা থেকে চোখ ফিরাইয়া ‘ফেনোমেনলজি’তে নোঙ্গর করেন। তবে একদম আলাদা।
ধর্মীয় অভিজ্ঞতার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চারও সমালোচনা করেন কিয়ের্কেগার্ড। অথচ তার খায়েশ ছিল ভালো খ্রিস্টান হওয়া। হেগেলের সার্বিকে বিলীন হওয়ার খ্রিস্টানগিরি হয়ত তার ভালো লাগে নাই। কিয়ের্কেগার্ড মানব জীবনরে তিনটা ভাগে দেখছেন। তার মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায় হলো প্রকৃত খ্রিস্টান হওয়া। বাকি দুটো সম্ভবত নন্দনতাত্ত্বিক ও নৈতিক জীবন। কিন্তু খ্রিস্টানগিরিরে আপনি চান আর না চান, তা তো এজমালি ব্যাপার। খ্রিস্টান আর যাই হোক মানুষের মতোই বিষয়। দুনিয়াতে সব মানুষে মানুষ পাবেন, কিন্তু মানুষ খুঁজলে মানুষ মিলবে না। সে অর্থে খ্রিস্টান হওয়ারে তার বাইরে নিতে পারবেন না। অবশ্য আজকের দুনিয়ায় তাকান— জনপ্রিয় খ্রিস্টানগিরি কিন্তু পুঁজি, বিজ্ঞান সবার সাথে একাকার। সে অর্থে কিয়ের্কেগার্ডের দিকে চশমা লাগিয়ে তাকানো যায়। টাকা সম্পর্কে তার বিমূর্ততার ধারণাও চমকে উঠার মতো।
তার লেখা পড়ছিলাম দশবছর আগে। তা সত্ত্বেও বলি যে দ্বন্ধ কাটে নাই- প্রকৃত জিনিসটা তো আগাম একটা ব্যাপার, স্বতন্ত্র্যতার বজায় রাখতে হলে ‘প্রকৃত’র মধ্যে ডুব দিলে চলবে না। এখানে একটা মজা আছে- ওই কথার মধ্যে আপনি ‘প্রকৃত’র কোনো এসেন্স সরাসরি বা আগাম পাবেন না। তা হলো প্রকৃত খ্রিস্টান হইতে হলে আপনারে চোখ বন্ধ করে শূন্যে ঝাঁপ দিতে হবে। প্রকৃত মুসলমান হইতে চাওয়া আমার কাছে বিষয়টি ইস্টারেস্টিং মনে হইছিল। পরে ভেবে দেখলাম ইসলামে কোনো কিছুরে এভাবে নেওয়ার সুযোগ নাই। ঝাঁপ দিলেও তোমারে চোখ খোলা রাখতে হবে। চোখ বন্ধ করে ভাবা তো একটা ভাববাদী বিষয়, তাই নয় কি!
এখানে যেটা হলো, জগতে আগাম বিষয়রে পাশ কাটাইয়া যাওয়া যায়। মানে আপনি ভাববেন এখানে পতিত (নিক্ষিপ্ত) হইছেন। অর্থাৎ, আপনারে লইয়া কারো কিছু করার নাই। বরং আপনারে লইয়া যা খুশি আপনিই করবেন। এখানে আপনি বলতে পারেন স্থান-কাল, বংশবৃত্তান্তহীন আপনি নন, আপনি টেবুলা রাসাও নন— তা সত্ত্বেও এ পতিত হওয়া আপনার যে আপন আবিষ্কার তা ইন্টারেস্টিংলি আপনারে পতিত করেই রাখে। নেট ঘাইটা দেখলাম তার পরিচিত ধারণার মধ্যে আছে ‘ফেইথ ইন দ্য অবসার্ড’ ও ‘ট্রুথ অ্যাজ সাবজেক্টিভি’। তাইলে ব্যক্তির আগে আর কিছু ‘না থাকা’র মধ্যে ব্যক্তিতেই সত্য-মিথ্যা হাজির হয়, এর বাইরে না।
তো এর জন্য হয়ত জোর দিয়েছেন উদ্বেগ ও হতাশার অস্তিত্বমূলক বিশ্লেষণে। পতিত হওয়া সঙ্গে উদ্বেগ ও হতাশার বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক আছে। সে যাই হোক, মা হাওয়া সহকারে সেমেটিক ধর্মের পিতা আদম দুনিয়াতে পতিত হইছিলেন। তার উদ্বেগ ও হতাশা থাকতে পারে। কিন্তু ওই পতন আগামরহিত নয়। তো, আপনি খ্রিস্টান হইতে চাইলে পতনের আগের বা পরের হিসাবটা বুঝে নিতে পারেন। কিন্তু কিয়ের্কেগার্ড তাই করেন নাই। সেখানেই ধাঁধা। সে ধাঁধা পরবর্তীকালের অস্তিত্ববাদীরা কাটায়া উঠছেন বোধহয়। কেন না, তাদের খ্রিস্টান হওয়ার দরকার পড়ে নাই। নাকি এ ঝামেলা তারা মোকাবেলা করার হিম্মত রাখেন না। ব্যপাকটা নিদান পক্ষে খারাপ না। তারা নাস্তিক হইয়াও তারা ভাল অস্তিত্ববাদী ছিলেন, আরও বেশি কুড়মুড়ে ছিলেন।
যেহেতু এ বিষয়ে আমার তেমন ধারণা নাই। তাই বলি, অস্তিত্ববাদ নিয়া নানা রোমান্টিকসিজম হইতে পারে। কিন্তু তার বাইরে মানুষের দ্বিধা ঘরে আড়াআড়ি দাড়ায়া থাকেন কিয়েরকেগর। আহা! রাজকুমার, দুঃখী রাজকুমার। শান্তিতে ঘুমায়া থাকুক।
এ লেখার সূচনা : সেদিন তার বিষাদমাখা মুখটা ভেবে অনেকক্ষণ দিলখুশার জনহীন রাস্তায় পায়চারি করছিলাম। পরে ফেসবুকে লিখলাম, আজ সোরেন কিয়ের্কেগার্ডের (Søren Kierkegaard) মৃত্যুর দিন। কাল থেকে মাথায় ঘুরতেছিল একটা লাইন- ‘রাজার ছেলে সারেন’! ক্যান? সে অনেক কথা। বিষণ্ন লোকটার কথা ভাবতে ভাবতে আজ সন্ধ্যায় মন ক্রমশ উত্তাপ হারাইতে থাকে। যেদিকে তাকাই খা খা করতেছিল। এর মধ্যে মানুষ কেমনে বেঁচে থাকে!! সোরেনের জন্য, খানিকটা নিজের জন্য দুঃখ হইতে থাকে।
Comments are closed.