লিও তলস্তয়ের সর্বশেষ পড়া গল্প ‘ফাদার সিয়ের্গি’। একজন মানুষ সন্ত হয়ে উঠতে গিয়ে কত বৈচিত্র্যময় পথ পাড়ি দেয়, তার অসাধারণ বর্ণনা নিয়ে এ গল্প। বয়স দিয়ে অবদমিত কামনাকে বিচার করা যায় না। বরং নানা ছলে সে নিজেকে চরিতার্থ করতে চায়। মানুষকে আদর্শের চূড়ার দিকে তাকিয়ে থাকলে হয় না, তাকে যাপনের মধ্যদিয়ে আয়ত্ত করতে হয়।
গল্পটি পড়তে পড়তে মনে হবে আমাদের গল্প যেখানটায় শেষ, সেখান থেকে তলস্তয়ের মূলগল্প শুরু। কেননা তিনি আত্মার দিকে তাকিয়ে থাকেন, যা হয়ত হারিয়ে গেছে। এ গল্প খ্রিষ্ট্রীয় চিরায়ত প্রেমময়-নৈতিক আবহে নির্মিত। এ নির্মাণে আদর্শবাদী ঈশ্বরের জগত যেভাবে বিদ্যমান, তার সমান্তরালে আরেকটি দ্বন্দ্বমুখর পঙ্কিল পৃথিবীর জীবন বিদ্যমান। তলস্তয় ভুলেন না বিশেষ মানুষের বিশেষ অভিজ্ঞতা। এ বিশেষ বোধের মাধ্যমে যে সামগ্রিকতার ধারণা হাজির হয়- তা বিস্ময়কর। ফলে তার খ্রিস্টীয় নৈতিক আদর্শ বিশেষের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নতুন অর্থ তৈরি করে। সার্বিকের মধ্যে তার মানুষগুলো হারিয়ে যায় না। তারা প্রত্যেকেই নিজস্ব আলোতে উজ্জ্বল। তলস্তয় একের পর এক সিঁড়ির ধাপ পার হয়ে অতি আশ্চর্য বোধের জগতে পৌঁছেন। সে জগতের রং কেমন?
অদ্ভুতভাবে ঈশ্বরের স্বরূপ বুঝতে পারা মানুষটির জগত কেমন যেন ধূসর হয়ে ধরা পড়ে আমাদের কাছে। সেটা কি দিব্য অনুভূতির রং! তাই হয়ত তলস্তয়ের ছবির রং সাদা-কালো হবে এমনটাই সবসময় মনে হতো। গির্জার ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা- গম্ভীর একটা ব্যাপার থাকে, এর মাঝে অনেক উঁচু থেকে জানালা গলে হাত বাড়িয়ে দেয় সাদা আলো। কিন্তু তার ১৮৬তম জন্মদিনের (৯ সেপ্টেম্বর, ১৮২৮) কাছাকাছি সময়ে অনলাইনে থুঁজে পাওয়া গেল রঙিন একখান পোট্রেট। যদিও ফটোগ্রাফির জগতে এটি খুবই বিখ্যাত। এটি আবার রাশিয়ার প্রথম রঙিন পোট্রেট। এ ছবি নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাবের সঙ্গে তলস্তয়ের মোলাকাতের চিরস্থায়ী চিহ্ন। সে ছবি নিয়েই কিছু কথা হোক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সাম্প্রতিককালে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সাদা-কালো ছবিকে রঙিনে রূপান্তর করছেন অনেকে। এর মধ্যে ওয়াল্ট হুইটম্যান, চার্লি চ্যাপলিন, হেলেন কিলার, মার্ক টোয়েনসহ অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব আছেন। কিন্তু কেউ কি চিন্তা করে দেখেছেন সাদা-কালোর ধ্রুপদি আবহে তাদের সিম্বলিক রূপটি ব্যাহত হচ্ছে কিনা? মানে তাদের কথা-লেখা, কর্মের সঙ্গে এ সব ছবির মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবটা ভাবছেন কি? তাদের সাদা-কালোর মধ্যেই কত কত রং আছে, নতুন রঙে তাদের সিম্বলিক রূপটি খানিক হারায়; এমন নয় তো? তবে সে তুলনায় অনেক ভাগ্যবান লিও তলস্তয়। ১৯০৮ সালে তোলা তার প্রথম রঙিন ছবিটি সকল ঐশ্বর্য নিয়ে দীপ্যমান। কেউ কি জানত এটি হবে রাশিয়ার পোট্রেট ফটোগ্রাফির ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত প্রতিকৃতি। এটা ‘ফাদার সিয়ের্গি’র কথক হিসেবে এমন একজন ব্যক্তিত্বকেই মানায় যেন।
তলস্তয় মারা যান ১৯১০ সালের ২০ নভেম্বর। এ ছবিটি তোলা হয় মৃত্যুর মাত্র দুই বছর আগে, ১৯০৮ সালে। একে হাতে প্রিন্ট করা সাধারণ রঙিন ফটো ভাবলে ভুল হবে। এ কৃৎকৌশল লুমিয়ে ব্রাদার্সের অটোক্রোমস প্রযুক্তিরও আগের। কিন্তু এর সঙ্গে ইতিহাস, গভীর নিষ্ঠা ও নন্দনের সম্পর্ক যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে পাঠকের চোখে তলস্তয়কে মূর্ত করে তোলার চ্যালেঞ্জ।
ছবিটি তুলেন বিখ্যাত রাশিয়ান বিজ্ঞানী ও আবিস্কারক সার্গেই মিখাইলভিচ প্রকুদিন-গোর্সকি (৩০ আগস্ট ১৮৬৩- ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪)। তাকে বিশ শতকের রাশিয়ান রঙিন ফটোর অগ্রপথিক বলে বিবেচনা করা হয়। তিনি স্কটিক গাণিতিক পদার্থবিদ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (১৩ জুন ১৮৩১ – ৫ নভেম্বর ১৮৭৯) প্রস্তাবিত থ্রি কালার টেকনিক ব্যবহার করেন। যেখানে প্রাকৃতিক রং আনার জন্য একইসঙ্গে লাল, সবুজ ও নীল ফিল্টার ব্যবহার করা হয়। ম্যাক্সওয়েলের সময়ে ফটোগ্রাফিক ম্যাটেরিয়ালের অভাবে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু প্রকুদিন-গোর্সকির সময়ে এসে তা একটি ঐতিহাসিক রূপ লাভ করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তার অসাধারণ ফটোগ্রাফিক সেন্স। তিনি প্রায় ১০ হাজার ছবি তোলেন। যা জার আমলের রাশিয়ার ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট।
তলস্তয়কে এক চিঠিতে প্রকুদিন-গোর্সকি লিখেন, ছবিটি তুলতে তিনি তলস্তয়কে বিরক্ত করবেন না। এর জন্য তার মাত্র ১-৩ সেকেন্ড লাগবে। সম্ভবত মে মাসের ২২-২৩ তারিখে তিনি তলস্তয়ের কাছ থেকে ছবি তোলার অনুমোদন পান। ছবি তুলতে তলস্তয়ের ইয়াসনায়া পলিয়ানা এস্টেটে আসেন তিনি। সে সময় তলস্তয় পরিবারের সঙ্গে এখানেই ছিলেন। না, আশিতে পা রাখতে যাওয়া তলস্তয়ের জন্য বিষয়টি বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। প্রকুদিন-গোর্সকি তলস্তয়ের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন এভাবে, ফটোতে প্রাকৃতিক রং আনার ক্ষেত্রে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি আরও নিশ্চয়তা দেন, ছবিতে সঠিক কালার পাওয়া যাবে। এমনকি তার কালার প্রোজেকশন ইউরোপ ও রাশিয়ায় খুব পরিচিত বলেও জানান।
তলস্তয়ের ছবিটি ‘দ্য প্রসিডিংস অব দ্য রাশিয়ান টেকনিক্যাল সোসাইটি’ জার্নালের ১৯০৮ সালের আগস্ট সংখ্যায় ছাপা হয়। সেখানে একে উল্লেখ করা হয় ‘দ্য ফার্স্ট রাশিয়ান কালার ফটোপোট্রেট’। আরও লেখা হয় তলস্তয়ের আশিতম জন্মদিন উপলক্ষে একটি অভিনন্দন বার্তা।
সম্পাদকীয়তে বলা হয়, এটি খাঁটি টেকনিক্যাল জার্নাল। তারা কোনো বিশেষ লেখা দিয়ে রাশিয়ান চিন্তা ও লেখালেখির জগতের এ মহীরুহকে সম্মান জানাচ্ছে না। বরং ফটোগ্রাফি প্রযুক্তির চূড়ান্ত উৎকর্ষ দিয়ে তাকে সম্মান জানাচ্ছেন। নিশ্চয়তা দেওয়া হয় ছবিটি সঠিক লোকেশন ও কালারে তোলা। যা ফটোগ্রাফিক পদ্ধতির একটি অর্জন। এখানে কোনো শিল্পীর ব্রাশ বা অন্য কোনো উপকরণ ব্যবহার করা হয়নি।
আসলে ছবিটি নিয়ে রাশিয়ান টেকনিক্যাল সোসাইটি ও প্রকুদিন-গোর্স্কাইয়ের খুশি হওয়ার অনেক কারণ ছিল। সাধারণ মানুষ ফটোগ্রাফির ইতিহাস বোঝে না, কিন্তু যখন প্রকুদিন-গোর্সকির কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়, পরিচিতির প্রধান কারণ হয় তিনি তলস্তয়ের রঙিন ছবি তুলেছেন। এ ছবিটি পোস্টকার্ড, ম্যাগাজিন ইলাস্ট্রেশন, বড় প্রিন্টসহ নানা মাধ্যমে পুনরুৎপাদিত হয়েছে। আজও হচ্ছে।
এ সবের বাইরে ছবিটি সমকালীন রাশিয়ান চিন্তাকে মূর্ত করে তুলেছিল। তলস্তয়ের চাহনি, পায়ের উপর পা রেখে বসার ভঙ্গি, হাতে ধরে রাখা ছড়ি ও পেছনের ঝাপসা দৃষ্টিপথ অতুলনীয় গাম্ভীর্য নিয়ে হাজির। এ পথ দিয়ে ইতিহাস মাড়িয়ে এসেছেন যেন। যা তার দৃষ্টিতে লেখা আছে। ছবির তলস্তয়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন, সেখানে কোনো দ্বিধা নেই। তিনি সরাসরি আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন। এক শশ্রুমণ্ডিত ঋষি আপনার আত্মার দিকে তাকিয়ে আছে। এটাই যেন তাকে মানায়। এ ছবি নিয়ে আরও বললে বলা যায়, গির্জার ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা- আলো আঁধারির তলস্তয়কে আমাদের সামনে নামিয়ে এনেছেন তিনি।