‘আমরা পশুর মতো। শুধুমাত্র, আমাদের বৃহত্তর আত্মসচেতনতার কারণে, আরও বেশি দুঃখী।’ কথাটা আর্থার শোপেনহাওয়ারের। ‘পশু’ বলাটা সম্ভবত ‘ভালোত্ব’-এর বাইরের কন্ট্রাডিক্টগুলাকে ব্যাখ্যা করার তরিকা হিসেবে। অথবা যে সব ব্যাপারকে জীব জগতে এজমালি বলে ধরে নেওয়া হয়, সেগুলোকে। তো, এর মধ্যে বেটার কি কি আছে?
পশু হওয়া নিয়ে অবশ্য আমার আগ্রহ নাই। তার বাইরে ‘আত্মসচেতনতা’র ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মানুষের স্বাধীনতার ধারণার সাথে যোগ করে দেখলে। আত্মসচেতনতা আরও বৃহত্তরের সাথে যুক্ত করে অপূর্ণতাকে আরও বেশি অস্তিত্বশীল করে তোলে। এটা ছাড়া মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্যকে ভাবা যায় না। যদিও সে অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে, তা শুধুমাত্র নিয়মের দাস হয়ে। স্বাধীন ইচ্ছার অধীন হয়ে নয়।
অবশ্য শোপেনহাওয়ারের কাছে দুঃখ, মৃত্যু, হতাশা এসবের দেশে জীবনকে শয়তানের সৃষ্টি মনে হয়। এখন যদি তা-ই মনে হয়, কেউ কি শয়তানের সঙ্গে কানেক্ট করার বা আত্মসচেতনতায় অন্তর্ভুক্ত করার বাসনা পোষণ করে? মনে হয় না। হ্যাঁ, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপার থাকতে পারে। শোপেনহাওয়ার গৌতম বুদ্ধের ভক্ত ছিলেন। কান্টেরও। এ নোকতা থাকলো।
বিশেষ করে দার্শনিকরা যখন ভালো বা মন্দের ফারাক তৈরি করেন- সেখানে ‘হতাশা’ থাকা সত্ত্বেও শুভ কেমন করে হতে পারে তার একটা বিবরণ থাকে। অথবা জগতে মানুষ কীভাবে সুখ তালাশ করে ও ব্যর্থ হয়- তার একটা খতিয়ান দেওয়া হয়। এবং দুইয়ের মাঝামাঝি একটা ভারসাম্যের কথাও বলেন কেউ কেউ।
তবে দুনিয়া যদি শয়তানি বিষয় না-ই হয়, ‘আত্মসচেতনতা’র লক্ষ্য আরও বৃহৎ। যেমনটা আগে বলছিলাম। মানে সে নিজেকে অতিক্রম করে গিয়ে আরও কিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়। নিদেন পক্ষে যুথবদ্ধতার যৌক্তিক স্থরটুকু পার হওয়া। যা স্রেফ অপরাপর মানুষকে বোঝাপড়ার বাসনা না। মানুষ, এমনকি এই জগত সংসারের অস্তিত্বের প্রশ্নে টান দেওয়া। সেই প্রশ্ন ও উত্তরের অন্তহীনতার সামনে মানুষ দুঃখী না হয়ে কী হবে?
শোপেনহাওয়ারের নৈতিকতার ধারণা এমন যে, অন্য মানুষকে আঘাত করা মানে নিজের ক্ষতি করা। যেমন, কাউকে মেরে ফেলা মানে জীবনীশক্তির একটা অংশকে ধ্বংস করা, যা আমাদের একসঙ্গে যুক্ত করে। মানে অন্য মানুষরা আমার বাইরের জিনিস না। হুমম। অনেক দার্শনিক/ধর্ম বলে- নিজের জন্য যা পছন্দ করবে, তা যেন অন্যের জন্য পছন্দ করো। এটা অবশ্য পুরোপুরি এমন না। তবে ছকে ফেলা যায়।
যাই হোক, শোপেনহাওয়ারের ধারণা নিয়ে একটা বাস্তব ঘটনা নির্ভর সমালোচনা আছে, এই দার্শনিকের জীবন থেকেই। কিন্তু আমার মনে হয়, এই যে যৌক্তিকভাবে দেখার চেষ্টা আর সেটার উদাহরণ হতে না পারার মধ্যে যে বিরোধ উপস্থিত থাকে- সেটা সবসময় কাজের জিনিস না। যখন না কেউ প্র্যাকটিসের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। আবার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটা অবস্থা সাপেক্ষে বিবেচনা হতেও পারে।
ঘটনা হলো- একবার এক বৃদ্ধা শোপেনহাওয়ারের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। এতে দার্শনিক এতই বিরক্ত হলেন তাকে ধাক্কা দিয়ে সিড়ি দিয়ে ফেলে দেন। মহিলা ভীষণ আহত হয়। পরে আদালত শোপেনহাওয়ারকে আজীবন ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেন। এর কয়েক বছর পরই বৃদ্ধা মারা যান। আর শোপেনহাওয়া ছড়ায় ছড়ায় ডেথ সার্টিফিকেট লেখেন, যার মানে দাঁড়ায়, ‘বৃদ্ধা মারা গেলে, বোঝাও চলে গেল।’
তো, নৈতিকভাবে শোপেনহাওয়ার একটা খারাপ কাজ করলেন। অনেকে বলতে চান এটা নিজের কথারই বরখেলাপ। ব্যাপারটা হয়তো এ রকম না। ঘটনাটিকে যতটা না অপরের ক্ষতি আকারে দেখা যাইতে পারে, তার চেয়ে শোপেনহাওয়ারের নিজের ক্ষতি আকারে দেখা যাইতে পারে, তিনি জগতের সঙ্গে সম্পর্কের একটা অংশ ধ্বংস করে ফেললেন। এখন কথা হলো- ব্যক্তি চাইলে কি নিজের ক্ষতি করতে পারে? এটা নৈতিকভাবে কতটা ঠিক? আমার ধারণা এটা গুরুতর প্রশ্ন হতে পারে। এছাড়া ‘আত্মসচেতন’ হয়ে উঠার জন্য এটা প্রতিবন্ধক কিনা? নাকি এটা দুঃখ কমানোর একটা উপায়- নিজেকে আর বিকাশ হতে না দেওয়া।
এখানে ব্যঙ্গ করে ছড়া লেখা তো তুচ্ছ ব্যাপার। আমাদের সমাজে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের পেছনে অনেক হতাশা কাজ করে যাকে আমরা সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে পারি। সমাজের উচিত এর উপশমের ব্যবস্থা করা! কিন্তু অদৌ সমাজ এই বোঝাপড়ায় যেতে পারে কি? এছাড়া এমন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে শোপেনহাওয়ার কি নিজের বানানো নিয়ম অতিক্রম করেন নাই? যদি করে থাকেন- তাইলে দেখেন- সোসাইটি যারা নিয়ম বানাই- তারা সাধারণত এমন অবস্থায় থাকেন- যারা নানা উসিলায় এর ব্যতিক্রম ঘটায়।
আবার নৈতিক নিয়ম নিজেই তো একটা প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। কোনো বিবৃতিমূলক ঘটনা থেকে আমরা যখন উচিতের প্রশ্নে যাই- এটা পুরোটাই স্বার্থ সম্পর্কিত আলাপ হয়। যাকে যৌক্তিক করার জন্য একটা নিয়মে পরিণত করা হয়। সেখানে ‘উচিত’ ব্যাপারটাই প্রশ্নবোধক। এসব নিয়ম হলো কোনো একটা যুক্তি প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ। যা আসলে আপাতত সুশৃঙ্খল আদতে বিচ্ছিন্ন কিছু বর্ণনার ঐক্য। তো, সেই জায়গায় কোনো কিছু সিদ্ধান্ত আকারে বৈধ, কিন্তু পারফর্ম কীভাবে করতে সেটা অন্য ব্যাপার। তবে, হ্যাঁ, মানদণ্ড থাকা আমাদের বারবার চিন্তার ঝামেলা থেকে বাঁচাইয়া দেয়। এবং এটাও সত্য যে, আমরা জগতে নানা কিছুর ধারাবাহিকতা প্রত্যাশা করি। সেটা দেখিও।