কতকাল বিদেশ রবে উকিল

এক.

উকিল পাগলা আর কতকাল থাকিব বিদেশে রে -উকিল মুন্সী

এ গানের প্রথম ক’টি লাইন ‘কুটুম পাখি রে ওরে পাখি, কুটুম কুটুম বলে, কারে তুমি ডাকিছ, বসি গাছের ডালে রে’। কুটুম পাখি ডালে ডালে দেশ-বিদেশ ঘোরে। আর উকিলের শ্যামা কালা- সেও দেশ-বিদেশে ঘোরে। তাইলে উকিল কেন বলে কত কাল থাকিব বিদেশে রে। উকিলের দেশ আর বিদেশের ভেদ কী?

উকিল মু্ন্সির গান। ভূমিকা: মাহবুব কবির। ঐতিহ্য, ঢাকা। ফেব্রুয়ারি ২০১৩। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ। ৩০০ টাকা।

উকিল মু্ন্সির গান। ভূমিকা: মাহবুব কবির। ঐতিহ্য, ঢাকা। ফেব্রুয়ারি ২০১৩। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ। ৩০০ টাকা।

উকিলের বিদেশ প্রশ্নটা আমারে ব্যতিব্যস্ত করে। সে ভেদ কিভাবে করে এই পামর! সে কথা না হয় থাক। তার সম্বন্ধে যা শুনি- উকিল মুন্সী (১৮৮৫-১২ ডিসেম্বর ১৯৭৮) বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের বৃহত্তর গীতধারাটির অন্যতম প্রধান নাম। এখনও এ অঞ্চলের গীতিকবিতার ধারার মধ্যে তার বিশিষ্টতা নিয়ে আলাদা করে গবেষণা করা হয়নি। তবে বলা হয়ে থাকে, এ অঞ্চলের গীতিকবিদের বড় অংশ রশিদ উদ্দিনের (জানুয়ারি ২১, ১৮৮৯-১৯৬৪) ছায়ায় বিকশিত হয়েছেন। সেই ছায়ার বাইরে অন্যতম গীতিকবি মানুষ উকিল মুন্সী।

নেত্রকোনার জৈনপুরে বেতাই নদীর ধারে উকিল মুন্সীর কবর। কবরবাসী উকিল জীবদ্দশায় কোনো সঙ্কলন বের করেননি। ১৯৭৮ সালের পর থেকে তার গানের আশ্রয় ভক্তের খাতা ও শিল্পীদের পুনরুৎপাদন। সেই পুনরুৎপাদনে এবার যোগ হলো একটি সঙ্কলন। মাহবুব কবির সম্পাদিত ‘উকিল মুন্সীর গান’। এ বইয়ে স্থান পেয়েছে ২০১টি গান। প্রায় অর্ধ শতাব্দীব্যাপী উকিল মুন্সীর রচিত গানের তুলনায় এটি নিঃসন্দেহে অতি অল্প। কিন্তু এ ক’টি সংগ্রহে ঝক্কি কম নয়। নানাবিধ সমস্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সঠিক বাণীতে লিপিবদ্ধ করা। মাহবুব কবির বলছেন- ‘শব্দ, রূপক, উপমা এমনকি বাক্য পাল্টানো। এছাড়া তাদের গান আছে লোকমুখে, বাউল শিল্পীদের গলায়। সংরক্ষণহীন অগ্রন্থিত বাউল গান লোকমুখে পূর্ণাঙ্গ ও অবিকৃতভাবে পাওয়া দুষ্কর’।

উকিলের গানকে নানা তত্ত্বে ভাগ করা যায়। এভাবে বিন্যাস করলে পাঠকের জন্য সুবিধা হয়। তবে কাজটি সম্ভবত এখনও করার সময় আসেনি- এ অর্থে যে সে বিচারের মতো মানুষ বিরল। যথেষ্ট প্রস্তুতি ও গবেষণার দরকার আছে। মহতী কাজের জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য মাহবুব কবিরের। তিনি কথাও দিয়েছেন সামনে এ প্রচেষ্টার চারাটি ডালপালা মেলবে। উকিলের গীত সংগৃহীত হবে সুরসহ। বইয়ের শেষে দরকারি শব্দার্থ ও টিকা যুক্ত করার জন্য তাকে আবারো ধন্যবাদ জানাই।

দুই.

উকিলের গান নিয়ে অতি অল্প সময়ে মন্তব্য করা ধৃষ্টতা। উকিলকে যদি আমরা চিনে নিতে না পারি- তবে তো উকিল নিজ  দেশে বিদেশি বৈকি। আমরা গানের সঙ্গে উকিলকে চিনতে চাই। সমস্যা হয় ভাবচর্চায় গানকে ব্যক্তি মানুষ থেকে আলাদা করে দেখলে। সেদিক থেকে আমাদের পূর্ব ধারণা বা অনুমান নিয়ে কতটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব তা সন্দেহের বিষয়। শুরু হিসেবে আমরা মনোযোগ দিতে পারি বইটির নাতিদীর্ঘ ভূমিকায়। ভূমিকাটিতে পাওয়া যাবে নেত্রকোনার বাউল গানের ইতিহাস, এর ভূমিকা ও বাউল গানের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। তার ভেতরেই আছেন উকিল মুন্সী।

ভূমিকার শুরু যেভাবে ‘বাংলাদেশে সাধনসঙ্গীত ও ভাবান্দোলনে মরমি-সুফি চিন্তার যোগফলে যে বাউল ধর্মের উদ্ভব তাতে আমরা নতুন ধর্মগ্রন্থ না পেলেও মৌলিক ঐতিহ্যনির্ভর একটি স্বতন্ত্র সাহিত্য প্রবাহ পেয়েছি। বাউল সঙ্গীত পেয়েছি। এ ধর্মের সাধন-ভজন সঙ্গীত দিয়ে। এ সাহিত্য সঙ্গীতাশ্রয়ী’।

এখানে আমরা অনেক ধারণা বা ঘটনা একত্রে পাচ্ছি- সাধন, সঙ্গীত, ভাবান্দোলন, মরমি, সূফি চিন্তা, বাউল ধর্ম, ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ ও সাহিত্য। অর্থাৎ একটি লাইনের মধ্যে গুরুতর অনেক বিষয়ের সংশ্লেষ ঘটছে। শুধু ধর্ম বললেও দ্বিধা জাগে। ধরে কি নেব ইসলাম বা হিন্দুর মতো একটা ধর্ম। কিন্তু সুফি চিন্তা নিজেই তো ইসলামের অংশ বলে দাবি করে, নাকি করে না! না করলে কোথায় করে না। আমরা জানি না। আর বাউল বলে একাট্টা চালিয়ে দেয়ার মতো কোনো শব্দ কি আমরা ঠিক করে নিতে পেরেছি। বাউলিয়ানার দিক থেকে এর মীমাংসায় বা কি? সেভাবে ধর্ম দাবিটাই বা কি? গোড়ার এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পরিষ্কার নয়। সাম্প্রতিক বাউল তর্ক থেকে এটা পরিষ্কার। বাউলকে নিজের অনুমান দ্বারা নির্মাণের সম্ভাবনা এখানে ষোল আনা। ধারণা যদি অপরিচ্ছন্ন হয়, তবে এ ধারণা কাকে কিভাবে নির্মাণ করবে তাও বলে দেয়।

এখানে মাহবুব কবির উকিলকে চেনানো সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাউল বিষয়ে আধুনিক মননকে বুঝতে সাহায্য করেন। এ চর্চার বাইরের একটা অংশ ধর্ম বা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বিরাট ঝাণ্ডার ভেতর উকিলকে হাজির করেন। শঙ্কার কারণ বটে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এই নাম-ডাক বা সেসব পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে উকিলের যোগ স্পষ্ট হবে কিনা। বিশেষ করে দুটি ঘটনা যেমন- ১৯৫১ সালে বাউলবিরোধী সভার বিপরীতে গান পরিবেশন ও উকিলের নামে মামলা। গানের ভেতর দিয়ে উকিলের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল আমরা জানতে পারি না। ফলে একটা সার্বিক ধারণার ভেতর উকিল কোনো দিশা জোগায় না। এ লড়াইয়ে আমাদের ভূমিকাই কি বা, যেখানে আমাদের চর্চায় না আছে মাওলানা সাহেব বা ভাবচর্চার নিমগ্নতা। না আছে ধর্ম, না আছে জিরাফ!

তিন.

মাহবুব কবির বাউল বলে একাট্টা বর্ণনা তৈরি করলেও ভেদের জায়গায়ও আছেন। তিনি বলছেন, ‘বাউল গানে অঞ্চলভেদে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। জীবনযাপন রীতিতেও রয়েছে ভিন্নতা। ভিন্নতা রয়েছে তাদের পোশাকেও। নেত্রকোনার বাউলরা গৃহী। কুষ্টিয়ার বাউলরা আখড়াই। সিলেটের বাউলরা গৃহী। ঢাকার বাউলরা আখড়াই। নেত্রকোনার বাউল গানে বৈঠকি ও দীর্ঘলয়ের সুর। কুষ্টিয়ার বাউল গানের সুর আখড়াই। ঢাকার বাউল গানের সুর মরমিয়া। কুষ্টিয়ার বাউলরা শিষ্য পরম্পরা- তাদের গুরু আছে। নেত্রকোনার বাউলরা স্বতন্ত্র সাধক- তাদের আছে পীর। এতসব ভিন্নতা সত্ত্বেও কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না তাদের চেতনা, বুঝতে অসুবিধা হয় না তাদের তত্ত্বকথা কোন মত কোন পথের কথা বলে, বুঝতে অসুবিধা হয় না তাদের লোকায়ত দর্শনের মাজেজা। নেত্রকোনা পীর-ফকির-দরবেশ প্রভাবিত অঞ্চল। নেত্রকোনার প্রায় সব বাউলসাধকই কোনো না কোনো পীরের মুরিদ। তাদের গানে সুফি দর্শনের প্রবল প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। উকিল মুন্সি পীরের মুরিদ ছিলেন। ছিলেন খেলাফতপ্রাপ্ত। উকিলের মুরিদও ছিল। শিল্পী উকিল আর পীর উকিল। জগৎ শিল্পী উকিলকেই নিয়েছে। সভ্যতা সব সময় সৃষ্টির পক্ষেই যায়’।

বিষয়টা সহজ নয় কিন্তু এভাবে বললে মনে হয় বোঝাপড়াটা সহজই। বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের নিরিখে তিনি বাউলদের ভাগ করছেন। এভাবে ভাগ করে চিন্তা করলে আমাদের সুবিধা। বিজ্ঞানও এভাবে চিন্তা করে। কিন্তু এই ভাগের পর আবার জোড়া লাগিয়ে পুরোটা দেখতে গেলে অবিকল থাকে কি? উকিল এখানে ভাগ হয়ে যাচ্ছেন। পীরকে কবির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বলছেন আবার তাকে গানের বিপরীতেই যেন দাঁড় করাচ্ছেন। শিল্পী সৃষ্টির পক্ষে আর পীর কি তা জানা নাই। যদি উকিল ও উকিলের গানকে জানতে চাই- তবে এই অনুমিত ভাগাভাগি কতটা সাহায্য করবে? বিশেষ করে তার গানের একটা অংশ পীরকে কেন্দ্র করে। একই সঙ্গে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদার সুরাহা কিভাবে হবে। এত এত রীতি-নীতির মধ্যে কোনটি হবে বাউলিয়ানার বেদ আর কোনটি গীতা।

বাউল একটা ধারণা, ঘটনাও বটে। হয়তো একে আমরা সঙ্কীর্ণ অর্থে বা বৃহত্তর অর্থে ব্যবহার করতে পারি। একে ধর্ম বানিয়ে তারপর উকিলকে প্রতিস্থাপন দারুণ ফল মিলে। আরেকটি উদ্ধৃতি দেয়া যাক- ‘তিনি গৃহত্যাগী হয়েও গৃহী, শিল্পী হয়েও পীরের মুরিদ, বাউল হয়েও মসজিদের ইমাম। শরিয়তপন্থী উকিলের পীর ছিলেন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি (তরফ) জাঁহাগিরিয়া দরবার শরিফের হজরত সৈয়দ মোজাফফর আহম্মদ (রহ.)। রিচি দরবার শরিফের অবস্থান হবিগঞ্জ শহরের কাছাকাছি। সৈয়দ মোজাফফর আহম্মদ (রহ.) হজরত শাহজালালের (রহ.) প্রধান সেনাপতি সৈয়দ নাসির উদ্দিনের দশম পুরুষ। হজরত সৈয়দ মোজাফফর আহম্মেদের (রহ.) পাঁচ খলিফার একজন উকিল মুন্সি। উকিলের মুরিদও ছিল’।

ইসলামে শরিয়ত-মারেফত দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। কেউ কেউ বলেন একই ফলের জন্য দুই যাত্রা। হজরত শাহজালাল (র.) এর ক্ষেত্রে সে দ্বন্দ্বটা অন্যরকম। তার প্রতি শরিয়তি-মারেফতিদের নির্বিশেষ দরদ লক্ষ্য করা যায়। সে সিলসিলা আমরা দেখতে পাই উকিলের মধ্যে, যা এই দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে অন্যরকম দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তার সূত্র হতে পারে। এখানে উকিলকে ভাগ করলেও চিন্তা ও চর্চার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আমরা হারাব। এমনকি কথিত বাউল ইতিহাসের তলে চাপা পড়া নতুন ইতিহাস এখানে দানা বাঁধতে পারে। বিপরীত দুটি ধারার মধ্যকার কি ভেদকে উকিল অভেদ আকার হাজির করেন তা হয়তো কিছুটা ধরতে পারব।

শুধু মানবতাবাদ ও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা দিয়ে সে বিষয়টা ধরা যাবে না। তা না হলে আমরা দেখি উকিল দুই ধর্ম বা দুই নৌকার যাত্রী। যেখানে বাউল একটা ধর্ম আবার ইসলাম ধর্মাবলম্বী মসজিদের ইমাম উকিল বাউল ধর্মেরও মাঝি। সঙ্কলন ইতিহাসের সাক্ষী সাবুদসহ উপস্থিত করেছেন ধর্মান্ধদের কথা। গায়ক উকিল মুন্সীকে আমরা যেমন মাওলানাদের মুখোমুখি হতে দেখি আর আবার সেই মাওলানাদের পাশে বসতেও দেখি। মোনাজাত ও জানাজা পড়ানোর জন্য তিনি বিখ্যাত। রিভিউকারকে দেয়া তার পুত্রবধূর সাক্ষ্য মতে, গানবিরোধী মাওলানা মঞ্জুরুল হকের কোনো এক মাহফিলে উকিল মোনাজাত করিয়েছেন। তাহলে উকিলের অন্য কোনো কারিশমা এখানে অনুপস্থিত, যা শরিয়ত-মারেফতের মেলবন্ধনও গুরুত্বপূর্ণ ইশারা দিতে পারে। ফলে মূলধারার বয়ানের বাইরেও উকিলের খোঁজে হাতরাতে হয়। মাহবুব কবিরের কথার তার রেশ সামান্যই আছে। তার জন্য প্রয়োজন উকিলের গানের পূর্ণাঙ্গ সঙ্কলন ও গানের শ্রেণিকরণ।

সমাজকে সাদা বা কালো বা দুই আলাদা দলে ভাববার সুবিধা যেমন আছে তেমনি আবার অসুবিধাও আছে। আবার সমাজ একাট্টা সাদা বা একাট্টা কালোও না। এখানে সাদা-কালো শব্দদ্বয় ভালো-মন্দ অর্থে নয়, বৈপরীত্য বুঝাতে। আমরা ভাব-ভাষার মধ্যে যেমন সহজ তেমনি অসহজও। সেভাবে ভাবলে দুইয়ের মাঝখানে উকিল কি অনাঘ্রাত দীপ্তি নিয়ে হাজির নন! চাইলেও বোধহয় গড়হাজির করার সুযোগ নেই। কবিরের ভূমিকা ও সঙ্কলিত সেই ইশারা খানিক মেলে। সবশেষে উকিলের আর ক’টি লাইন পড়া যাক-

‘ওরে ফুলের গন্ধ লাগল না মোর গায়

প্রাণ যায়, যায়রে

ফুলের গন্ধ লাগল না মোর গায়

ফুলের গন্ধ লাগলো না মোর গায়

প্রাণ যায়রে ফুলের গন্ধ লাগলো না মোর গায়।’

…………………………………………………………………………

*উকিল মুন্সীকে নিয়ে আরো ক’টি লেখা-

১.উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে

২.উকিল মুন্সীর গানের ভেতর বাড়ি

৩.মধ্যাহ্নের উকিল মুন্সী

> লেখাটি আলোকিত বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশিত।

Comments

comments

Comments are closed.