আমি বরাবরই ভীতু প্রকৃতির মানুষ। যাদের অন্তরে মায়া দয়া নাই তাদের কেউ কেউ এটাকে হীনমন্যতা বলে। আবার খেয়াল করেছি কিছু লোক এমন নিরবতা ও ভীতিকে খুব পছন্দ করে। শুধুমাত্র এরমধ্যেই তারা নিজেদের প্রকাশ করতে পারে। নচেৎ এরা খুবই দুর্বলগোছের মানুষ। এরাও আমাকে পছন্দ করে। যেমন লোকে চেয়ার টেবিল এমনকি মাঝে মাঝে নিজের হাতের সাথে পায়ের সাথে কথা বলে, তেমনি আমার সাথেও কথা বলে। তারা একদম বুঝতে পারে না এদের প্রাণ আছে কিনা। বুঝতে পারছি না এসব বলে নিজেকে কি হীনতর কিছু করে তুলছি কিনা।
হায়! কি দ্বিধা আমার মনে।
কিন্তু আমার বাবা একদম উল্টো কিসিমের। তিনি ভাবেন নিজেকে চেয়ার টেবিলের মতো ভাবাভাবির মধ্যে আকর্ষণীয় কিছু নাই যে, সে ভাব নিয়ে বসে থাকতে হবে। ভাব এমনই জিনিস যারে একদম উল্টো করেও গায়ে দেয়া যায়। তার কথাটা একদম ফেলনা, এমন না। এটা ঠিক যে, কথাবার্তার মাধ্যমে এমন শক্তি যোগানোর জন্য বাবাদের বিকল্প নাই। আমি অবশ্যই আপনাদের কাছে ব্যক্তিগত উন্নয়ন বিষয়ক গল্প ফাঁদতে আসি নাই। এমন গল্প আপনার জীবনে ঢের পাবেন। তবে এরচেয়েও কমন বিষয়ে গল্প করা যায়। যেমন- বাবা। শুধুমাত্র তিনজন লোকেরই বাবা ছিল না। হযরত আদম (আ:) ও হযরত হাওয়া (আ:)ও হযরত ঈসা (আ:)। তবে উনারা আমার মতো সাধারণগোছের কেউ না। তাইলে তাদের বাদ দিলে বাবা থাকাই অতিসাধারণ ঘটনা।
অনেক কথা তো হলো। এবার আমার গল্পটা শুরু করা যাক। সে অনেকক্ষণ ধরে লোকটা কিভাবে যেন তাকিয়ে আছে। কিছুটা স্নেহ আর কিছুটা প্রশ্রয়। প্রশ্রয় শব্দটা কেন ব্যবহার করছি জানি না। অজানা অচেনা একজন লোকের ক্ষেত্রে প্রশ্রয় কথাটা কি অর্থ দাঁড় করাবে আমার জানা নাই। এক্ষেত্রে প্রশ্রয় একটা সন্দেহজনক শব্দও বটে।
লোকটা মানে আমার সহযাত্রী, একঘন্টা যাবত পাশাপাশি সিটে আছি। ভীতু মানুষ হতে পারি আমার কৌতুহল তো কম নয়। কৌতুহলেরই জয় হোক। জিজ্ঞেস করি করি বলে একসময় বলেই ফেলি-
‘এক্সকিউজ মি, (কাশি দিয়ে) আপনি কি আমায় কিছু বলতে চান’?
লোকটার চেহারায় কি যেন খেলে গেল বুঝতে পারলাম না। প্রশ্রয় কি স্তিমিত হয়ে আমার কপালে ঠাই নিয়েছে!
‘না। কি বলব’……
যত্তোসব! ফাউল লোক। নিজে নিজে অনুতপ্ত হই।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। অদ্ভুত রোদ উঠেছে আজ। চেখে ঝলসে যাচ্ছে। তারপরও তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। ধরে নিন লোকটার কথা ভুলে গেছি। ভুলে না গেলে আমার নিজেরই খারাপ লাগবে।
‘আপনার বয়েসী আমার একটা ছেলে আছে। আপনাকে দেখে তার কথা মনে পড়ল’।
চোখ ফিরিয়ে লোকটার দিকে তাকাই। কিভাবে যেন এক টুকরো রোদ লোকটার চিবুক গড়িয়ে বুকের কাছটায় ছড়িয়ে পড়েছে। তার সাদা জামায় তেজ হারিয়ে মোলায়েম এক খণ্ড মেঘের মতো ভাসছে। রোদের এই কারিশমায় আমি মুগ্ধ হয়। হঠাৎ মনে হলো লোকটি এক টুকরো রোদ হয়ে ভেসে আছে। আমার বাবাকে দেখলে যেমন করে রোদের কথা মনে পড়ে।
আমি রোদ ভালবাসি!
‘আপনার ছেলে কই থাকে’?
‘আমার সাথেই থাকে। আপনি কি করেন’?
‘কিছু না। পড়াশোনা শেষ। বাবার হোটেলে খাই’।
‘কিছু মনে করবেন না। আপনি তো আমার ছেলের বয়েসী। তাই বলছি- এই বয়েসে ছেলেদের কিছু করা উচিত। আমার ছেলেও কিছু করে না। সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। বাপের দুঃখ বুঝে না’।
তার চেহারায় আরেকটু দুঃখী ভাব ফুটলে মানাত বেশ। কিন্তু সে যে প্রশ্রয়…। আমি বলি-
‘একদম আমার মতো। বাবা কিছু বলেন না অবশ্যই। তার একটা ছেলে আছে এই তো ঢের। এখনো বাবা পিঠে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন’।
মনে হচ্ছিল ঘুম পাড়ানী গানটি শুনতে পাচ্ছি। কিছুটা বিভ্রান্ত হই। মনে হচ্ছে এই লোকটি গান গেয়ে যাচ্ছেন। আচ্ছা, বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি ছাড়া ঘুম পাড়ানী গান জমে না। তাদের মধ্যে কি সব মিল যেন আছে।
ধুর, কি সব ভাবছি! ফকফকা রোদের মধ্যে বৃষ্টির স্বপ্ন। অপরিচিত লোকের সাথে এতো এতো কিসের কথা। আর কোন কথা নাই। মুখ জানালার বাইরে না ফেরাতেই উনি বলেন-
‘আচ্ছা। একদম আমার ছেলের মতো। বিয়ে-সাদীর কথা বলে না’।
‘বলে না আবার। তার আবার নাতি-নাতনীর শখ। আমি পাত্তা দিই না’।
খুব বেশি বলা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার জিব আরো কিছু বলতে কেমন যেন নিশপিশ করছে। এমনকি কানও আরো কিছু শুনতে চায়।
‘একদম মিলে যাচ্ছে। অদ্ভুত না’।
‘কিছুটা তো অদ্ভুত। তবে আমাদের যুগের ছেলেরা হয়তো এমন। আপনার ছেলের সাথে দেখা হলে ভালো লাগত। কি নাম তার’?
বিড়বিড় করে কি যেন বলে ভদ্রলোক একদম চুপসে গেলেন হঠাৎ। আমি আর কথা বাড়ালাম না। মোলায়েম রোদটা কোথায় হারিয়ে গেল। মাথার মধ্যে শূন্যতা ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার জানালা দিয়ে তাকাই। মানুষ জন গাছ-পালা দেখি। ভালো লাগে। এক জায়গায় কিছু লোক কি যেন খুঁজছে। ইচ্ছে হয় আমিও গিয়ে তাদের সাথে যোগ দিই। ঐ যে ঐখানে কি যেন বিক্রি করছে। লোক জমে গেছে।
পাশের লোকটির নাড়াচড়া টের পায়। উঠে দাড়িয়েছেন। তার স্টেশন এসে গেছে বোধহয়। সৌজন্য বশত: ফিরে তাকায়। হাসিমুখে মাথা নাড়াই।
‘আমি যে বয়স থেকে একটা ছেলের স্বপ্ন দেখছি সে বয়সে যদি একটা ছেলে থাকত, আজ সে আপনার বয়েসীই হতো’।
কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লোকটি নেমে যান।
জানালায় মুখ বাড়িয়ে লোকটিকে আর দেখতে পাই না।
কি জানি! হয়তো রোদ হয়ে মিলিয়ে গেছেন।
তাকে বলার মতো আমারও একটি কথা ছিল। কথাটা বলতে না পারায় ঘুমকে হারিয়ে দেয়া মাথাব্যথা ফিরে আসে যেন। আমার বাবা বেঁচে থাকলে তারই বয়েসী হতেন। আরো খানিকটা সময় পেলেও আমি তার মতো করে সত্য কথাটা বলতে পারতাম না। এটা আমার স্বভাবের সাথে যায় না।
ভাববেন না, ভীতু লোক বলে সবকিছুর মধ্যে গুঢ় অর্থ খুজতে হবে। এমনকি আপনি সন্দেহ পোষণ করতে পারেন এমন কোন লোক ছিল কিনা, অথবা খোদ গল্পটাই উড়িয়ে মতো! আসলে এইসব ভাবাভাবির মধ্যে কি আছে? কিচ্ছু নাই। তবে এটা বলতে পারি নিজেই যখন নিজের গল্পের বিষয় হয়ে উঠি খারাপ তো লাগে না। ইচ্ছে হলো নিজেকে পিতা বানালাম বা পুত্র অথবা জামার উপর আলতো করে বসে থাকা এক টুকরো রোদের গল্প!