আল মাহমুদ কাব্য করেন, বুড়া হইয়েন না!

আল মাহমুদ কে? এইটা নিয়া নতুন করে কিছু বলা কাজের কথা না। আমার মতো অভাজন বললে হয়তো সেই কথাগুলো হবে ফাউল কিসিমের। তারপরও এমন হয় মাঝে মাঝে ফাউল কিসিমের কথা বলতেই ভালো লাগে। তাই ভাবলাম আল মাহমুদের কিছু গীত গাওয়া যাক।

তার পায়ের কাছে বসে ছিলাম। কিছু জিগেশ করি নাই। চুপচাপ বসে তিনি কি করেন, কেমনে করেন, কি বলেন, কেমনে বলেন শুনতে ছিলাম।

তার পায়ের কাছে বসে ছিলাম। কিছু জিগেশ করি নাই। চুপচাপ বসে তিনি কি করেন, কেমনে করেন, কি বলেন, কেমনে বলেন শুনতে ছিলাম।

আল মাহমুদকে সাকুল্যে চারবার দেখছি। প্রথম দেখছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক সাংস্কৃতিক উৎসবে। বুদ্ধিজীবি চত্বরের সেই প্রোগ্রামে হাজির হইয়া তার মুখে নোলক কবিতাটা শুনছি। বলতে দ্বিধা নাই প্রথমবারের মতই শুনছি। বুঝেন আল মাহমুদ পড়ার দৌড় কতটুকু। কোন ইয়ারে পড়ি মনে নাই। তবে, বিরক্ত হইছিলাম কালচার বুঝে না এমন লোকের মাঝে তার কি কাজ। তবে এই প্রশ্ন এখন তোলার মানে হয় না।

প্রথম আল মাহমুদ পড়ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকেণ্ড ইয়ারে। এক জায়গায় চুপচাপ বসে থাকা আমার কারবার। তখন আবার কবিতা পড়ার একটা ঢং চালু করছিলাম। ফজরের নামাজের পর রুমের সামনের রেলিংয়ে ঢক করে বসতাম। সূর্য উঠার দৃশ্য কি সুন্দর দেখা যাইত। তারপর কবিতা পড়া, চা/কফি বানাইয়া খাওয়া সাথে পাতলা কিসিমের মালয়েশিয়ান বিস্কুট। তারপর চড়ুই পাখিদের ছোলা অথবা বিস্কিট খেতে দেয়া। হলের সামনের কাঁঠাল গাছে সারাদিন চড়ুই পাখিরা কি চমৎকার ডাকাডাকি, উড়াউড়ি করত! তখনই প্রথম জানতে পারি কাঠাল গাছের লগে চড়ুইয়ের সখ্যতা। ব্যাপারটা ঢাকায়ও খেয়াল করছি। এখনো মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি- শেষ বিকেলের রোদে সোনারঙা কাঁঠাল পাতায় চড়ুই খেলছে। শেষের মধ্যেও অপূর্ব সৌন্দর্য আছে। প্রকৃতির এইসব বিষয়গুলার মধ্যে একটা কাব্যিক ঢং আছে। সকালবেলা আল মাহমুদ রেশটাও সব মিলিয়ে লেগে থাকত শরীরে মনে।

বুঝা যাইতেছে কবিতারে খুব পবিত্রভাবে নিছিলাম। কবিতা এতো পবিত্র জিনিস কিনা জানি না। আমার এক কবি বন্ধু (যারে খুবই ভালোবাসি) কইছিল কবিরা হলো ঈশ্বর, তাদের সমালোচনা করতে নাই। কথাটা মনে পড়লে খুব হাসি আসে। কারণ সে ঈশ্বররে অস্বীকার করে নিজেই ঈশ্বর হইতে চায়! তার তুলনায় তিমি মাছ আল মাহমুদরে কখনো ঈশ্বর মনে হয় নাই, মনে হইছে আর্শিবাদ।

 আল মাহমুদরে দ্বিতীয় বার দেখলাম তার গুলশানের বাসায়। তার জম্মদিনে আরো কয়েকজনের সাথে গেছিলাম। সবুজ পাঞ্জাবী পড়া টুকটুকে বাচ্চার মতো বসে আসে। তার স্ত্রী তখন শয্যাশায়ী। তারে অনেকটা বিহ্বল দেখাচ্ছিল। তেহারি খাইছিলাম। কিছূদিন পর আমারে একজন ফোনে বলে, ভাই আপনেরে বাংলাভিশনে দেখছি। শুনে খুশি হইছি। ইনি ইউনিভার্সিটিতে এক ইয়ার জুনিয়র ছিলেন। বছরখানেক স্নেহের রুমমেট হইয়া একত্রে ছিলাম। পাতি নেতার হওয়ার পর,  অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার মধ্যে আমারে হল থেকে বের করে দিছিলেন। সেই দগদগে ঘাসহ তারে শুভাশিষ জানাইলাম। ইনারা আল মাহমুদের মধু কতটা বুঝে জানি না, তবে রাজনৈতিক কারণে তারে খুব ভালোবাসে।

ও হা, আরেকবার দেখছিলাম। আল মাহমুদ আসবেন শুনে কি একটা প্রোগ্রামে গেছিলাম। বেচারা আসতে আসতে অসুস্থ্য হয়ে পড়ছেন। এইজন্য কিছুক্ষণ এসি রূমে বিশ্রাম নিতে হইল। এরমধ্যে দিগন্ত টিভি-র সাংবাদিক তারে আরেক যন্ত্রণা দেয়া শুরু করছে। তাদের টিভি-র বর্ষপূর্তি নিয়া কিছু বলতে হবে। এই মচ্ছব দেইখা সেখান থেকে চইলা আসছি। আল মাহমুদের উপ্রে খুবই বিরক্ত হইছি। অন্যের বাছ-বিচার নিয়ে কথা বলা হতে পারে, বাচ্চালোগের মতো কথা। এই বিরক্তিতে তাঁর কি আসে!  কিন্তু এটা আজব হইলে এই বিরক্তির ব্যাখ্যা নিশ্চয় আছে। কবিরা সেটা বুঝতে পারে কিনা জানি না। তারা কাব্যের মধ্যে দিয়া একটা জাদুর খেলা খেলে মানুষরে খরিদ করে। ফলে মানুষেরা তার লগে প্রিয়তমের মতো রাগারাগি-ভালোবাসাবাসি করে। এই খেলা তো সেই খেলেতেছে। অভাজনের এই রাগারাগি মধুর একটা ঘটনা হইল আরকি!

কয়েকদিন আগে যেটা হলো- বইমেলায় দেখি নতুন পুরাতন বই মিলায়া আল মাহমুদ নানাভাবে হাজির। যদিও তার ভাষ্যে নতুন করে পুরানো বই ছাপলে সেটা আর পুরানা বই থাকে না। সে নিজেই নিজে নতুন। সে মোতাবেক বইমেলাব্যাপী ঘটতেছে ঐ নতুনের কেতন উড়ে। ব্যাপারটা হতাশাজনক এই যে, লোকে আল মাহমুদের বই ছাপায়। একটু যত্ম-আত্তি নিলেই তো পারে। একটু সুন্দর কাভার করল। ভালো বাঁধাই ও কাগজ দিলো। লস তো নাই। সোনা কিনতে হলে তো সোনার দামেই কিনতে হবে।

Al Mahmud_ws.com 2এই বিষয়টা নিয়া কিছুটা পেরেশান হইছি। ভাবলাম একটা রিপোর্ট হোক। আমার পাতার সম্পাদক মাহাবুব রহমান কইলেন, চলেন কথাগুলা মাহমুদ ভাইরে জিগেশ করি। বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ মনে হইছে। তার উপ্রে তাঁর লগে কথা বলার সুযোগ। গত বছর মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ছি যেভাবে বেড়ে উঠি ও বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ। যে এমন লিখতে পারে সে তো ভোঁতামুখো কবি নন।অবশ্য বই নিয়া কথা আগাই নাই। কেন না, তার জবান মতে, তিনি এখন দেখাশুনা করতে পারেন না। ফলে লোকে যা করে সেটাতেই সই। এত সহজ করে বলেন নাই। ক্ষোভ তার আছে। ইন্টারেস্টিং হইল কোন বই কারা করছে, কাভার কে করছে, কি কাগজে ছাপছে- সব খবরই তিনি রাখেন।

তো, নিজের কথা কি কমু। তার পায়ের কাছে বসে ছিলাম। কিছু জিগেশ করি নাই। চুপচাপ বসে তিনি কি করেন, কেমনে করেন, কি বলেন, কেমনে বলেন শুনতে ছিলাম। মনে হইল এই লোকটার বয়স কোনদিনই বাড়বে না। সে কত কি করে, কত জায়গায় যাইব তা দিয়া আমার বিরক্ত হইবার কিছু নাই। তিনি ভালোই জানেন কি জন্য কি করেন। আল মাহমুদ এমন এক কবি তার কাঁচা-পাকা হইবার কিছু নাই। তার সাধনা আছে। সে সাধনার কারণে এখনো দুনিয়াটা তার কাছে রসালো। ফলে দুনিয়ার কাছে দেখার ও নেয়ার অনেক কিছু তার আছে। আল মাহমুদ অসুস্থ্য হইবেন- বইমেলায় যাবেন- হেতায় যাইবেন- হোতায় যাইবেন। লোকজনের সাথে মিশতে তিনি হুইলচেয়ারে করে এখানে সেখানে যাবেন। অসুস্থ্য হইলে এসি-র বাতাস খাইবেন। এইসবের মাঝেই একজন আল মাহমুদ সজীব থাকেন। নইলে তার তরুণ কবিতা কি করে তরুণ থাকবে। আর তিনি তরুণ না হইলে কবিতা কেমনে তরুণ থাকবে।

তিনি বলতেছেন অনেক কিছু ভুলে গেছেন। তারপরে বলেন, কাব্য-টাব্য করি। কথা শুনে এবং শুনার আকাঙ্খা থেকে মনে হইছে- ভুলে গেছেন তো কি হইছে! নতুন কিছু লিখতে তো ভুলেন নাই। আপনি তো প্রতিমুহুর্তেই নতুন আছেন। শূন্যতা মানেন না। কবির সমালোচনা করতে নাই- এই কামান যেখানে সেখানে দাগানোও ভুল। কোন কোন জায়গায় প্রয়োগ করলে ভুল নিশ্চয় হয় না।

এতক্ষণের বাতচিত ভুলে গিয়ে বলি- আল মাহমুদ, আপনি অনেকদিন বেঁচে থাকেন।

> ফটো: আফরিন জাহান

Comments

comments

8 thoughts on “আল মাহমুদ কাব্য করেন, বুড়া হইয়েন না!

  1. আল মাহমুদ-কে কবিতা দিয়ে না, গল্প দিয়ে চিনছিলাম। পরে কবিতাও পড়ছি। আর তারে দেখছিলাম একবার, সেইটাও দূর থেকে, কোন একটা অনুষ্ঠানের প্রধাণ অতিথি ছিলেন।
    আপনে ভাগ্যবান 🙂

  2. “ইনি ইউনিভার্সিটিতে এক ইয়ার জুনিয়র ছিলেন। বছরখানেক স্নেহের রুমমেট হইয়া একত্রে ছিলাম। পাতি নেতার হওয়ার পর, অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার মধ্যে আমারে হল থেকে বের করে দিছিলেন। সেই দগদগে ঘা’সহ তারে শুভাশিষ জানাইলাম।”- এতকিছু বাদ দিয়া আমার মনে ধরছে এই কথাটি। আমার কি দোষ, বলেন? আমিতো…

    • তোমারে তো দশ বছরের বেশি চিনি। কখনো কি ভুল ধরছি। তোমার ভুল তুমি ধরবা।

      এই লাইনটা কনসিকুয়েন্স আকারে লেখা। এই ঘটনা আমারে মহত্তর বা ভালো কিছু দেই নাই যে পাত্তা দিতে হবে। এছাড়া এটা আনন্দের কোন ঘটনা না। যেটারে পুষে রাখতে হবে। কোন ক্ষোভই শ্বাশত না।
      সুতরাং, তুমি তোমার মতো করে নিছ।
      দাবরানি খাওয়াকে আমি হিরোইক মনে করি না। সো, এটা আমার জন্য কোন ফল আনবে না।
      কোন দিন যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সিনা টান করে দাড়াইতে পারি- সেটা একটা বিশিষ্ট কিছু হতে পারে।

      আর কিছু বই কিনা দিলে উপকার হইত।

  3. তার লেখা একটা কবিতাই তাকে বাংলা ভাষায় হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখবে। আমার মায়ের সোনার নোলক… পুরা করিতাটা মনে নেই তবে ঘটনা মনে আছে। এই কবিতার জন্যই তিনি সেরাদের সেরা হয়ে থাকবেন।

    সুজন ভায়া, আপনার এই ছবি/লেখা গুলো একদিন আপনাকেও বিখ্যাত করে দেবে। অসাধারন।

    শুভেচ্ছা।

  4. ভাই, কথাগুলো আর একটু শুদ্বভাবে বললে আর ও ভাল হত। তবে কথাগুলো অনেক ভালো লাগল। ভালো থাকুন।

Comments are closed.