জার্মান দার্শনিক হাইডেগারের ‘আছে’র আছে হয়ে থাকা

Martin Heidegger: হাইডেগার ১৮৮৬ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ জার্মানীর এক ক্যাথলিক পরিবারের জন্ম গ্রহন করেন। তার বাবা গীর্জার বাদক দলে সেক্সটন বাজাতেন। ছোটবেলায় তিনি যাজক হবার প্রস্ততি নিয়েছিলেন। সতের বছর বয়সে হাইস্কুলে পড়াকালে ফ্রান্ক ব্রানটানোর ‘অন দ্যা মেনিফোল্ড মিনিং অব বিয়িং অ্যাকোর্ডিং টু এরিস্টিটল’ পড়ে দর্শনের প্রতি তার আগ্রহ তৈয়ার হয়। তার স্বীকারোক্তি মতে, এই বই তাকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে। পরে তিনি ফয়েরবার্গ ইউনিভার্সিটিতে ধর্মতত্ত্বে ভর্তি হন। আরো পরে যাজকগিরির চিন্তা বাদ দিয়ে তিনি দর্শন, গণিত ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নিয়ে পড়েন। এইসবের পেছনে তার দুর্বল স্বাস্থ্যের প্রভাব আছে। এই সময় এডমন্ড হুর্সাল তাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। তিনি হুর্সালের ‘লজিক্যাল ইনভেস্টিগেশন’ পড়েন। এই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার আগ্রহ জন্মে। সে বাসনায় একটা থিসিস করেন। থিসিসের শিরোনাম, ‘ডানস স্কটাস ডকট্রিন অব ক্যাটাগরিজ এন্ড মিনিং’। ১৯১৫ সালে থিসিস শেষ করে লেকচারার পদে যোগদান করেন। এরপরও তার নানা ইতিহাস আছে। জর্মনবাসী এই দার্শনিক অস্তিত্ববাদ এবং অবভাসবিদ্যায় তার বিয়িং এর প্রশ্ন তুলে খ্যাতিমান ও অনুস্মরণীয় হয়েছেন। দার্শনিক নৃতত্ত্ব, সাহিত্য, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজিন্সে তার ভূমিকা আছে। তার উল্লেখযোগ্য বই হলো ‘বিয়িং এন্ড টাইম’, ‘কান্ট এন্ড প্রোব্লেম অব মেটাফিজিকস’, ‘এন ইন্টোডাকশান টু মেটাফিজিকস’, ‘দ্যা কোশ্চেন কনসার্নিং টেকনোলজি’ প্রভৃতি। এর মধ্যে ১৯২৭ সালে প্রকাশিত ‘বিয়িং এন্ড টাইম’ তার সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ। তিনি ১৯৭৬ সালের ২৬ মে মৃত্যু বরণ করেন।

পাঠক! আমি আছি, আপনিও আছে’ন। কিন্তু আমি কি আসলেই আছি? ‘আছি’ মানে ‘আছে’ হয়ে থাকা মানে কি? আমি কি করে ‘আছি’?

এই চিন্তা নিশ্চয় শুধু আমার নয়, বরং আমরা- এই জমানার মানুষেরা দর্শনের জায়গা থেকে এই চিন্তা করে আসছে অনেকদিন ধরে। এই জমানার বলতে কী বুঝব? একসময় ধরে নেওয়া হোত যে ‘আছে’ বা ‘আছি’ ব্যাপারটা কি সেটা আমরা আপনাআপনি বুঝি, এমনতিতেই জানি। আগের জমানায় প্রশ্নটা ‘আছে’ বা ‘আছি’ কথাটার মানে খোঁজার মধ্যে ছিল না, মানে তো জানাই আছে ধরে নিয়ে আগের জমানায় প্রশ্ন তোলা হত আমি যে ‘আছি; বা আমার বাইরের জগত যে ‘আছে’ সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় কিভাবে? এই জমানার মানুষরা বরং ‘আছে’ বা ‘আছি’ কথাটাকে প্রশ্ন করতে শিখেছে মার্টিন হাইডেগারের হাত ধরে। তাহলে ভাব বা দর্শনের দিক থেকে আগের জমানা আর এখনকার জমানা ভাগ হয়ে যাচ্ছে এই প্রশ্ন তোলার গুরুত্ব ও তাৎপর্য ধরতে পারার মধ্য দিয়ে।

মার্টিন হাইডেগার। আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক রেনে দেকার্ত’র ধারার সর্বশেষ দার্শনিক এডমন্ড হুসার্লের শিষ্য এই হাইডেগার। আধুনিক দর্শনে ‘আছি’ চিন্তার সূত্রপাত ঘটান দেকার্ত। তার আবিষ্কৃত সুনিশ্চিত পরিষ্কার সুত্রটি হলো, ‘আমি চিন্তা করি তাই আমি আছি’। মানে, কর্তা হিসাবে মানুষ চিন্তা করে যে ‘আমি’ আছি, কাজেই আমি ‘আছি’- কর্তাবাদের মূল কথা। কিন্তু এই খোদ ‘আছি’ ব্যাপারটা যে কি তার হদিস তিনি করতে যান নাই। বরং ‘আমি’ নামক কর্তা নির্ধারণ করেই তিনি খুশী। এই জায়গায় শিক্ষক হুসার্লের যেমন অমত আছে, তেমন আছে ছাত্র হাইডেগারেরও। কারণ হাইডেগারের কাছে দর্শনের মূল মামলা এই ‘আছি’র মামলা। হাইডেগারের তার Being (sein) এর আলোচনায় ‘দাজাইন’ (dasein) বা ‘ওই আছে’র মধ্যে যা বোঝান, তা দেকার্তের কর্তাবাদের বাইরে থেকে যায়। কারণ দেকার্ত শুরু করেছেন ‘আমি’ থেকে, ‘আছি’ বা ‘আছে’ থেকে নয়।

দেকার্তের এই সুত্র মেনে নিলে, আমি নিজেকে আছি প্রমাণের আগেই ‘আমি’ নামক ব্যাপারটা আছে। তার মানে এর মধ্যে ‘আমি’র আগে আমির থাকার একটা ‘আছেময়তা’ থাকে- যেই ‘আছেময়তা’র মধ্যে আমি ‘আছে’ হয়ে থাকি। আমি তখন আমাকে ‘আছি’ বলে দাবি করতে পারে। এক ‘আছেময়তা’-র ইশারা মেলে এর মধ্যে। কিন্তু দেকার্তের ‘আমি’ দিয়ে সেই ‘আছেময়তা’-কে বোঝা যাচ্ছে না। কারণ, তিনি ‘আমি’র নিশ্চয় অস্তিত্বে পৌছতে পেরেছেন তাতেই খুশী। তাই চিন্তার কেন্দ্রে যে ‘আছে’র ধারণা তাকে তিনি বাদ দিয়ে রাখলেন। এইটাই হলো অধিবিদ্যার ফাঁদ। সেইখানে মূর্ততার চেয়ে বিমূর্ততার কদর বেশী। ফলে এইসব কিছুর আগে হেইডেগার বলছেন, ‘আমি’ কী- এটা বোঝার চেয়ে ‘আছে’ কী কিম্বা ‘আছে’ কি করে হয় সেই তালাশ জরুরি।

হাইডেগারের ‘আছে’ তালাশ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে এখন থেকে দার্শনিক ফরহাদ মজহারের ‘ভাবান্দোলন’ বই থেকে অকৃপণভাবে ধার নেবো

ম্যান ইজ মর্টাল (Man is mortal) এবং ‘মানুষ মরণশীল’। এই দুইটি বাক্যের মধ্যে ফারাক কি? স্পষ্ট ফারাক- একটা বাক্য ইংরেজি ভাষায়, আরেকটা বাংলায়। কিন্তু তারা তো একই কথা বলছে। এর বাইরে আরেকটা বিষয় আছে। ইংরেজী যেটা is বাংলায় সেটা ‘হয়’। মাঝখানের এই ‘হয়’ বাংলা বাক্যটিতে ভাষা চিহ্নের আড়ালে আছে- উহ্য আছে। এখানে হয় বলতে কিছু একটা থাকাকে নির্দেশ করে, সেটাও এক প্রকার উহ্য থাকে। আসলে কি উহ্য থাকা? নাকি এই না থাকার তাৎপর্য আলাদা। এর সাথে গুরুতরভাবে দার্শনিক ও জীবন সম্পর্কীয় জিজ্ঞাসা জড়িত। পশ্চিমা এবং এই অঞ্চলের দর্শনের একটা গুরুতর পার্থক্য আছে। পশ্চিম ভয়াবহভাবে নিজের অস্তিত্বকে নিশ্চিতভাবে জানতে চায়। নিশ্চয় জ্ঞান চায়। আর প্রাচ্যে ‘যা আছে’ই তা নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন পড়ছে না।
এই ‘হয়’র উপর ‘অস্তিত্ব’ নির্ভরশীল। হয়-এর সাথে হয়ে ওঠার সম্পর্ক। এর মধ্যে কালের বিষয় যেমন আছে তাকে অতিক্রম করার বিষয়ও বর্তমান। এই হওয়া বা থাকার যে বুঝাবুঝির বিষয় তা নানাভাবে নানারূপে আলোচিত হয়ে আসছে। কিন্তু যাকে বলে তিয়াস মেটে না।
পাশ্চাত্য দর্শনে যাকে Being (sein) বলা হয়, প্রচলিত বাংলা পরিভাষায় আমরা তাকে ‘সত্ত্বা’ বলে ডাকি। যদিও সত্ত্বা দিয়ে হাইডেগারের Being (sein) পরিষ্কার বুঝা যায় না। এই ডাকাডাকির মধ্যে আমরা হাইডেগারের Being-কে খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করি। দুই হাজার বছরের পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাসে হাইডেগার এই Being-র তিনটি বৈশিষ্ট্য খুজে পেয়েছেন। যেমন- এটি সবোর্চ্চ সার্বিক ধারণা, অসংজ্ঞায়িত ও অস্তিত্বহীন এবং স্ব-প্রতীত। হাইডেগার এইসব তর্ককে নিরীক্ষণ করেন। এরপর সারাজীবন এই Being-র আলোচনায় নিজেকে সমর্পন করেন। এই নিরীক্ষণে তিনি বুঝতে পারেন মানব জাতি তার আসল প্রশ্নটাই ভুলে গেছে। সেটা হলো Being (sein) সম্পর্কীয়।

এই Being (sein) হাইডেগারের কাছে ধর্মতাত্ত্বিক বা অধিবিদ্যার মামলা নয়। এই মামলাটা আত্মপ্রকাশ করে ১৯২৭ সালে প্রকাশিত ‘বিয়িং এন্ড টাইম’ (জর্মন ভাষায় Sein und Zeit) বইয়ের মাধ্যমে। দর্শনের পরিচিত রাস্তায় মানুষকে পরিচয় করাতে যে কথাগুলো সামনে আসে, হাইডেগার সেইসবের কঠোর সমালোচক। সেই সব পরিচয়ে মানুষ বিমূর্ত ও অধিবিদ্যক কিছু একটা। যেমন- মানুষ হলো বুদ্ধিমান প্রাণী, ব্যক্তি, আত্মাসম্পন্ন, স্পিরিট [কঠিন বাংলায় চিদাত্মা] ধারী, বিষয়ী বা কর্তা।

আমরা দুনিয়াদারির যেকোন কিছুর অস্তিত্ব বুঝাতে বলি, অমুক আছে-তমুক আছে। ‘এই কোন কিছু’ হবার আগেই ‘আছে’ থাকে। আবার বলে থাকি, অমুক নাই তমুক নাই। আছে আর নাই বলার মধ্যে আমরা এই ‘আছেময়’কে এড়িয়ে যেতে পারি না। একই সাথে যেমন পারি না কোন কিছু ‘নাই’, এই ‘নাই’ থাকাটাকে না বলতে। এখন, ‘আমি’ ও ‘আছে’ উভয়ের সম্পর্ক বিচারের মধ্য দিয়ে কীভাবে মানুষ ‘আছেময়তা’র সামনে দাড়িয়ে থাকে সেটাই হাইডেগারের মাথাব্যথা। এর মধ্য দিয়ে তিনি অধিবিদ্যার মাথা কেটে ফেলেন।

এই আছি বা আছেময়তার মামলায় দেখা যাক, হাইডেগার যেটাকে Being বলেন সেটা আসলে কি জিনিস। আগেই বলা হয়েছে, বিয়িং নিয়া তার আগে যা বলা হয়েছিল, সেটা নিয়া তিনি সন্তুষ্ট নন। তিনি Being’র দুইটা ভেদ করেন। একটা লেখে ইংরেজি বড় হাতের বি [Being] দিয়া, এটাকে বলে অনটোলজিক্যাল [যেখানে সত্ত্বার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়] বিয়িং । এটি হলো ‘আছেময়তা’। এখানেই ‘আমি’র আগে যে ‘আছি হয়ে থাকে’ সেই ‘আছেময়তা’কে বুঝতে পারা যায়। অন্যটা ছোট হাতের বি দিয়া [being], একে বলা হয় অনটিক বিয়িং । এটা হলো সাধারণ জিনিস পত্র। যেমন- চেয়ার, টেবিল, মানুষ ইত্যাদি। এছাড়া ‘কোন কিছু নাই’ বলে আরেকটা বিষয় আছে। তো এই দুই বিয়িং-এর মধ্যে সম্পর্ক কী? কোন being আর Being বা ‘আছেময়তা’ থাকার মধ্যে সম্পর্ক কী? হাইডেগারের মতে, এই প্রশ্নের উত্তর না জানলে জগতের কোনো কিছুই বোধগম্য হবে না।
Being একটা গোপন জিনিস আর being প্রকাশিত। কিন্তু এমন না যে Being প্রকাশিত হয় না। উদাহরণ দেয়া যায় এইভাবে- বলা হলো কারো ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে। এখন আসলে ইনফ্লুয়েঞ্জা কি জিনিস। এই ইনফ্লুয়েঞ্জা তো দেখা যায় না। কিন্তু কিছু লক্ষণ বিচারে, যাকে রোগের উপসর্গ বলা হয়- সেগুলো বিচার করে বলা হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে। এইখানে ইনফ্লুয়েঞ্জা হলো Being আর এই being হলো ইনফ্লুয়েঞ্জার উপসর্গ, যেটা দ্বারা ইনফ্লুয়েঞ্জা নিজেকে প্রকাশ করছে।
বাংলা ভাষা ও ভাবের সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শনে পার্থক্য নির্ণয় ও সম্পর্ক নির্মাণের তাগিদে দার্শনিক ফরহাদ মজহার Being বলতে ‘পরম’ ব্যবহার করেন। তার মতে, এই ‘আছে হয়ে থাকা’ বা কোনো অস্তিত্বমান সত্ত্বার অস্তিত্বমান হয়ে থাকার শর্ত পরম ধরা দেয় মানুষের মধ্যে। যে মানুষ একই সঙ্গে জীব। জীব ও পরম বা ধরা ও অধরার সীমান্ত চিহ্ন বিচারের এতে খানিক সুরাহা হয়। অন্য দার্শনিকরা এই থাকার শর্ত ‘আছে হয়ে থাকা’ ব্যাপারটাকে অন্যান্য বস্তুর মতো বিবেচনা করেছেন। অথচ, বিয়িং সবসময়ই অধর।

আমি আছি, জানি। কিন্তু আমার এই আছেময়তার সাথে আমি’র কী সম্পর্ক? হাইডেগারের কাছে অস্তিত্ব হচ্ছে আছেময়তার বা Being এর সত্যের সামনে দাড়িয়ে থাকা। সেখানে যদি আমি এবং ‘আছেময়তা’র সম্পর্কের ফয়সালা না হয়, তবে অস্তিত্ব কথাটার কোন অর্থ হয় না। ‘আছে থাকার’ মধ্য দিয়ে ‘আছেময়তা’কে মানুষ যেভাবে রূপ দেয় হেইডেগার তাকে বলছেন ক্লিয়ারিং অব বিয়িং। এইখানে যে মানুষের মধ্যে অনটোলজিক্যাল প্রশ্ন হাজির হয়, তিনি এই ‘আছেময়তা’ কে জানতে পারেন। সে মুহুর্তকে সামনে রেখে, মানুষ জগতের মধ্যে ‘আছেময়তা’র পাহারাদার হয়ে দাড়িয়ে থাকে। তো, কেন মানুষের ভজনা করতে হয়। তার মধ্য দিয়েই তো পরম, জগতের সকল সম্ভাবনা ধরা দেয়। তার মধ্য দিয়ে যা হয় নাই, তা হয়ে উঠে।

এই আছেময়তা কিভাবে ধরা দেয়? Being বা এই আছেময়তাকে সরাসরি জানা যায় না। তাই এর প্রশ্নের ধাচও আলাদা। হেইডেগার মানুষকে প্রাণীকূলের মধ্যে অনন্য বলে তুলে ধরেন, এর কারণ আর কিছু না। সে Being এর প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। তার কাছে দুনিয়ার মৌলিক প্রশ্ন হলো Being এর প্রশ্ন। আবার দুনিয়ার নানা পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে Being কে জানার পদ্ধতি। আবার মানুষ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে গেলে বলতে হয় না, মানুষ ‘কি’ বরং মানুষ ‘কে’? এই প্রশ্নের উত্তর, মানুষ হলো সে- যে ‘আছেময়তা’কে ধরতে পারে।

মানুষের মধ্যে বিয়িং এর প্রকৃতি যেমন প্রশ্ন আকারে হাজির হয়। আবার Being প্রকাশ ঘটে মানুষের মধ্যে। এখানে তিনি দাজাইন [Dasein] ধারণা নিয়ে আসেন। দাজাইনকে মানব সত্ত্বা মনে করা যায় কিন্তু তা সরাসরি নয়। তাহলে Being কই? উত্তর এমন যে, Being সেখানে [দা-জাইনের অর্থ হলো Being is there]। এখানে নয়। কেন নয়? কিন্তু এই Being কে বুঝার জন্য একমাত্র মানুষই উপযোগী। Being মানুষের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। মানুষ হলো এই Being এর চিন্তার সাড়া দানকারী। তার প্রকাশ মানুষ গ্রহন করে। এটি আলোর মতো মানুষের মাঝে ছড়ায়। এই Being দেকার্তের মতো মন থেকে জড়কে আলাদা করে না। যেমন দাজাইন জগত থেকে আলাদা কিছু না। তাদের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তাই, যখন বলা হয় ‘আমি আছি’ আসলে বলা হয় ‘আমি এই জগতে আছি’। হাইডেগার বলেন, জগত আর মন আলাদা না। মানুষ এই জগতের অংশ, সে এই জগতকে পর্যবেক্ষণও করে। পর্যবেক্ষণ করে বলেই ‘আছেময়তা’র প্রশ্ন করে। being-এ থাকা জগতের ভাগাভাগির বিলোপ ঘটাতে আমাদের দরকার পড়ে Being -এর ধারণা। আবার, এখানে স্থান অর্থে আছি বা আছে কথাটা ব্যবহার হয় না।

দার্শনিক ফরহাদ মজহারের থেকে আরো খানিকটা চুরি করা যাক। তিনি এখানে লালনের আরশি নগরকে টেনে আনেন। এটা দিয়ে ‘দাজাইন’ বুঝতে খানিকটা সুবিধা হয়। এখানে ‘দাজাইন’ আরশিনগরের বাসিন্দা [Being সেখানে] ,আরশিনগরে পড়শী বসত করে কিন্তু একদিনও তারে দেখি নাই। সে হলো অধর। আমি বা মানুষের মধ্যে আয়নার ওপাশের এই অধরকে ধরবার তাগিদ আছে। সে তাগিদে কর্তারূপের বিকাশ ঘটায়। কর্মতৎপর আমি-র জানান দিয়ে তার মধ্যেই অধর নিজেকে পরিচ্ছন্ন করে তোলে। এখনকার ‘আছেময়তা’ স্থির নিদিষ্ট কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু আছেময় একমাত্র মানুষের মধ্য দিয়ে ধরা দিতে পারে, জগৎ হয়ে ওঠে, এটাই মানুষের ইতিহাস।
এখানে প্রাসঙ্গিক যে, হাইডেগারের শিক্ষক এডমন্ড হুসার্ল নিজেকে দেকার্তের ধারার শেষ দার্শনিক মনে করতেন। তিনি দেকার্তের পর্যালোচনা দাড় করান। দেকার্ত সুনিশ্চিত জ্ঞানের অভিমুখে যাত্রা করেন। সেই যাত্রা আমি’র নিসংশয় অভিষেকে ঠেকে। কিন্তু দেকার্ত দ্রব্যের [substance] আলোচনায় গিয়ে দেহ ও মনকে দুটিকে নিরংকুশ স্বাধীন বলে স্বীকার করেন। কিন্তু দ্রব্য আলাদা হবে কেন? তাই তাদের এক করার জন্য চাতুরীর আশ্রয় নেন। এটা হুসার্লের সমালোচনার বড়ো অংশ। ওপরে লালনের আরশিনগরের উদাহরণ টানা হয়েছে। সেটা স্মরণ রেখে একটা মজার বিষয় উল্লেখ করা যায়। লালনকে পুঁজি করে নির্মিত ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রটি মাস কয়েক আগে নানান তর্ক তুলেছিল। সেইখানে চলচ্চিত্রের নায়িকা লালনকে দৈহিকভাবে উত্তেজিত করার চেষ্টা করে। লালন দৈহিকভাবে উত্তেজিত হয়, কিন্তু তার মন এইসবের উর্ধ্বে। লালনের সংলাপ, ‘দেহের নিয়মে দেহ জাগে, মন যদি না জাগে’।

এই ‘দেহের নিয়মে দেহ জাগে, মন যদি না জাগে’, এই দেহ ও মনের মধ্যে লালন সাইজি নাই। আছে দেকার্তের দেহ ও মন আলাদা করা কার্তেসিয় তরিকার ভুত। অথচ বাংলার ফকির বা সাধনপন্থিদের কাছেও এই বিভেদ নাই। তারা বলে যা নাই ভান্ডে, তা নাই ব্রহ্মাণ্ডে। লালন শাহের কাছে দেহ থেকে আলাদা কিছু নাই। মনুষ্য দেহই চিন্তা করে। ফকির লালন শাহের যুগলের সম্পর্কের মধ্যেই ধরা ও অধরার ভেদ বোঝা সম্ভব। কিন্তু তাদের বিচ্ছিন্নভাবে নয়। অন্যদিকে হাইডেগারের বিষয় ও বিষয়ীর বিভেদ না করে বলেন, মানুষ মানেই দুনিয়াস্থ মানুষ, জগতে হাজির মানুষ – ওই মানুষ (dasein) ‘দাজাইন’ মানুষের।

‘দেহের নিয়মে দেহ জাগে, মন যদি না জাগে’,  দেহ – মনের এই ভাগের মধ্যে লালন সাইজি নাই।

মানুষ নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে। মানুষ Being -কে নিয়ে চিন্তা করে। আবার Being কার কাছে ধরা পড়ে- তা নিয়েও চিন্তা করে। এইসব কিছু আবার তার কাছেই ফেরত আসে। হাইডেগারের মতে, মানুষ নিজের চিন্তাকে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক, মানবতাবাদী মানুষকে না চিনে Being¬-কে চিনতে পারে এমন মানুষকে চিনেছেন। সেই মানুষের বৈশিষ্ট্য সে ‘আছে হয়ে’ থাকা নিয়ে প্রশ্ন করে। আর অন্য সকলে এই মানুষের মধ্য দিয়েই অস্তিত্বমান হয়ে ওঠে এবং ভাষা পায়। তাই মানুষ সম্পর্কে তার ধারণার সাথে ভাষা ও চিন্তার সম্পর্ক সরাসরি।

ফরহাদ মজহার Being বলতে যে পরম ব্যবহার করেন, তার কাছে এর আলাদা একটা ব্যাখ্যা আছে। পরম মানে পর¬-ম। পর-ম মানে আমি নই। যে আমার আগে আছে। ‘এই আছে’ আমার ‘পর’। হাইডেগারের কাছে ভাষা হলো সেই পর-মের ঘরবাড়ি। হাইডেগার ভাষার জন্য কবি ও দার্শনিকদের আলাদা মূল্য দেন। তার কাছে কবি ও দার্শনিকরা, যারা চিন্তা করে আর যারা কথা বানায়, তারা এই পর-¬মের এর পাহারাদার। এইভাবে দেখলে, মানুষ সম্পর্কের কারণে তার কাজ পর-ম চিন্তাকে যা দিতে চাইছে তা ভাষায় গ্রহন করা, সম্পন্ন করা, প্রকাশিত করা।

হাইডেগার যদি চান আমরা কবি বা ভাবুক হয়ে থাকি, তাহলে Being বা আছেময়তা প্রকাশিত হয় সম্ভাবনা, তা হয় কবি ও ভাবুকদের কাছে। এখন এই কথা ধরে বুঝে উঠা দরকার কবি আর ভাবুক কি করে? তারা চিন্তা করে। তারা পাহারাদারি করে। কার চিন্তা? কার পাহারাদারী? এই পাহারাদারীতে Being চিন্তাকে যা দেয় তারা ভাষাতে গ্রহন করে। তারা এই আছেময়তাকে অনুধাবন করে। কবি ও ভাবুক নিজেদের বিশেষ সময়ে বিশেষ কিছুতে ওয়াকিবহাল হয়। তাদের মাঝে কিছু হওয়ার বিষয়টার মধ্যে এক ধরনের তৎপরতা থাকে। সেই তৎপরতা চিন্তার পথের বাধাগুলোকে সরিয়ে করে নতুন ইচ্ছা ও প্রত্যয়ে নতুন পথ আবিষ্কার করে। এই আবিষ্কারটুকু আমরা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করি। এই আবিষ্কারটুকু আমি’র ‘আছেময়তা’র আগে হয়ে থাকার মতো নয়। বরং আমি যে জগতের মধ্যে ‘আছে’ এবং সেই ‘আছে’টুকুকে অনুধাবন করে সেটা ঘটে। তাহলে তারা Being-কে বুঝতে মানুষ নিজেদেরই বোঝে। সেই যে, আমি আমাকে দেখছি আছি, কিন্তু ‘আছেময়তা’ কথাটার মানে ‘কি আছে’-কে যখন বুঝার চেষ্টা করি, শুধু আমাকেই দেখি। এই বোঝাবুঝিটুকুতে নিজেদের অনাস্বাদিত অবস্থাকে আস্বাদনের সম্ভাবনা আছে।

> লেখাটি রাজনৈতিক.কম-এ পূর্ব প্রকাশিত।

Comments

comments

Comments are closed.